১৮৫. সপ্তমদিনের যুদ্ধ-ভীষ্মের প্রস্বাপাস্ত্রপ্রয়োগ

১৮৫তম অধ্যায়

সপ্তমদিনের যুদ্ধ-ভীষ্মের প্রস্বাপাস্ত্রপ্রয়োগ

ভীষ্ম কহিলেন, “হে রাজন! অনন্তর ‘হে ভীষ্ম! তুমি প্রস্বাপাস্ত্র পরিত্যাগ করিও না’, এই বলিয়া নভোমণ্ডলে এক মহা কোলাহল সমুত্থিত হইল। কিন্তু আমি জামদগ্ন্যকে লক্ষ্য করিয়া সেই অস্ত্ৰ যোজনা করিতে লাগিলাম। ইত্যবসরে দেবর্ষি নারদ তথায় সমুপস্থিত হইয়া আমাকে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! দেবগণ আকাশে অবস্থান করিয়া তোমাকে প্রস্বাপাস্ত্র পরিত্যাগ করিতে নিষেধ করিতেছেন, অতএব এক্ষণে তুমি তাহা প্রয়োগ করিও না। জামদগ্ন্য তপঃপরায়ণ ব্রাহ্মণ, বিশেষতঃ তোমার গুরু; তুমি কদাচ তাহার অবমাননা করিও না।” করিতে সন্দর্শন করিলাম। তাঁহারা সহাস্যবদনে আমাকে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! দেবর্ষি নারদ যাহা কহিলেন, তুমি তাহা অনুষ্ঠান কর। ইঁহার বাক্য লোকের পরম হিতকর বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়া থাকে। তখন আমি প্রস্বাপাস্ত্র প্রতিসংহার [প্রত্যাহার—প্ৰত্যাহত] করিয়া বিধানানুসারে ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ উদ্দীপিত করিলাম। পরে জামদগ্ন্য প্রস্বাপাস্ত্র প্রতিসংহৃত [প্রত্যাহত—ফিরাইয়া লওয়া] দেখিয়া সহসা রোষাবিষ্টচিত্তে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! আমি তোমার নিকট পরাজিত হইলাম।”

পরাজিত পরশুরামের যুদ্ধত্যাগ

“অনন্তর তিনি তথায় তাহার পিতা ও মহামান্য পিতামহকে সন্দর্শন করিলেন। তাহারা জামদগ্ন্যকে বেষ্টন করিয়া সান্ত্ববাদ প্রয়োগপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে বৎস! তুমি ক্ষত্ৰিয়ের, বিশেষতঃ ভীষ্মের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইতে কদাচ সাহস প্রকাশ করিও না। পূর্ব্বে আমরা কহিয়াছিলাম, কোন কারণবশতঃ অস্ত্ৰ পরিগ্রহ করা নিতান্ত ভয়ঙ্কর। কিন্তু তুমি সেই অকাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিয়াছ; যুদ্ধবিগ্রহ করা ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্ম আর অধ্যয়ন ও ব্রতসাধনই ব্রাহ্মণের পরম ধর্ম্ম। তুমি ভীষ্মের সহিত যে ঘোরতর সংগ্রাম করিলে, ইহাই পৰ্য্যাপ্ত [যথেষ্ট-প্রয়োজনীতিরিক্ত] হইয়াছে, অতঃপর আর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইও না। তোমার কামুকধারণ এই পৰ্য্যন্তই পৰ্য্যবসিত [ত্যাগে পরিণত] হইল; এক্ষণে তুমি ইহা পরিত্যাগ করিয়া তপানুষ্ঠান কর।’ ” দেবগণ শান্তনুনন্দন ভীষ্মকে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন—“হে ভীষ্ম! তুমি যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হও। জামদগ্ন্য তোমার গুরু, অতএব তুমি তাঁহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইও না। তাঁহাকে রণস্থলে পরাজয় করা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে না, বরং তুমি তাঁহার সম্মান পরিবর্দ্ধিত করা। আমরা তোমার অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ; এই নিমিত্তই তোমাকে নিবারণ করিতেছি।’ পরশুরামকে কহিলেন, “হে জামদগ্ন্য! তুমি ভাগ্যবলে জীবিত রহিয়াছ। ভীষ্ম বসুগণের অন্যতম; তুমি কিরূপে তাহাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে; অতএব এক্ষণে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হও। ভগবান স্বয়ম্ভ [ব্ৰহ্মা] মহাবলপরাক্রান্ত ইন্দ্ৰনন্দন অর্জ্জুনকে যথাকলে ভীষ্মের অন্তকরূপে উৎপাদনা করিয়াছেন।”

“মহাতেজঃ জামদগ্ন্য এইরূপে পিতৃগণকর্ত্তৃক অভিহিত হইয়া কহিলেন, “হে পিতৃগণ! আমি পূর্ব্বে কখন যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হই নাই। এক্ষণেও নিবৃত্ত হইব না, ইহাই আমার একমাত্ৰ ব্ৰত। আপনারা গাঙ্গেয়াকে সংগ্রাম হইতে নিবৃত্ত করুন। আমি কদাচ রণস্থল হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইব না।” তখন ঋচীকপ্রমুখ মহর্ষিগণ দেবর্ষি নারদের সহিত সমাগত হইয়া আমাকে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! তুমি যুদ্ধে ক্ষান্ত হইয়া ব্ৰাহ্মণের সম্মাননা কর।” আমি তখন ক্ষত্রিয়ধর্ম্মানুসারে তাহাদিগকে কহিলাম, “হে মহর্ষিগণ! আমার এইরূপ একটি ব্ৰত আছে যে, আমি সমর পরাস্তুখ [যুদ্ধে পশ্চাৎপদ] বা পৃষ্ঠভাগে শরদ্বারা তাড়িত হইয়া কদাচ নিবৃত্ত [পৃষ্ঠপ্ৰদৰ্শন-প্রবৃত্ত] হইব না। আমার এই দৃঢ়বিশ্বাস আছে যে, আমি লোভ, কার্পণ্য, ভয় ও অমর্ষবশতঃ কদাচ শাশ্বত ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিব না।”

“তখন নারদপ্রমুখ মহর্ষিগণ ও জননী ভাগীরথী সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু আমি গৃহীত্যাগ্র ও স্থিরনিশ্চয় হইয়া যুদ্ধাৰ্থ প্রস্তুত হইয়া রহিলাম। পরে তাহারা পুনরায় জামদগ্ন্যের নিকট গমন করিয়া কহিলেন, “হে রাম! ব্রাহ্মণের হদয়, কখন অবিনীত হয় না; অতএব তুমি প্রশান্ত হইয়া যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হও। ভীষ্ম তোমার অবধ্য এবং তুমিও ভীষ্মের বাধার্হ [বধ্য— বিনাশযোগ্য] নাও!” এই বলিয়া তাহারা রণক্ষেত্রে প্রতিরোধ [অনুরোধপূর্ব্বক যুদ্ধবিরত] করিয়া রামকে অস্ত্ৰ পরিত্যাগ করাইলেন।

“অনন্তর আমি পুনরায় উদিত আটটি গ্রহের ন্যায় দীপ্তিশীল আটটি ব্রাহ্মণের সন্দর্শনলাভ করিলে তাহারা প্রীতিপূর্ব্বক আমাকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! তুমি লোকের হিতানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত জামদগ্ন্যের নিকট গমন কর। তিনি সুহৃদগণের অনুরোধে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইয়াছেন।” তখন আমি লোকের হিতসাধনার্থ তাঁহাদের বাক্য স্বীকার করিয়া দুঃখিত মনে জামদগ্ন্যসন্নিধানে গমন ও তাঁহার পাদবন্দনা করিলাম। রাম হাস্য করিয়া প্রীতমনে কহিলেন, “হে ভীষ্ম! পৃথিবীতে তোমার তুল্য ক্ষত্ৰিয় আর নাই; এক্ষণে তুমি গমন কর। আমি এই যুদ্ধে তোমার প্রতি নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি।’ ”