১৮২. চতুর্থ দিনের যুদ্ধ

১৮২তম অধ্যায়

চতুর্থ দিনের যুদ্ধ

“পরদিন প্ৰভাতে অতি নির্ম্মল সূৰ্য্যমণ্ডল সমুদিত হইলে, আমরা পুনরায় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলাম। পরশুরাম গিরিশিখরস্থিত জলধরের ন্যায় রথে আরোহণ করিয়া শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। আমার প্রিয়সুহৃৎ সারথি শরতাড়িত হইয়ারথ হইতে নিপতিত হইলে আমি সাতিশয় বিষণ্ন হইলাম। আমার সারথি মূর্চ্ছিত ও নিপতিত হইয়া মুহূর্ত্তকাল মধ্যেই প্ৰাণপরিত্যাগ করিল। তখন আমি নিতান্ত ভীত হইলাম।

“অনন্তর জামদগ্ন্য অন্তকতুল্য এক শর যোজনা করিয়া বলপূর্ব্বক শরাসন আকর্ষণ করিয়া আমার প্রতি পরিত্যাগ করিলেন। সেই শর আমার বক্ষঃস্থলে প্রবেশ করিলে তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত ধরাতলে নিপতিত হইলাম।

“তিনি আমাকে বিনষ্ট বোধ করিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে বারংবার মেঘের ন্যায় গর্জ্জন করিতে লাগিলেন; তাঁহার অনুচরেরাও সিংহনাদ পরিত্যাগ করিয়া আক্রোশ প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন আমার পার্শ্বস্থিত কৌরবগণ ও সন্দর্শনার্থী অন্যান্য মনুষ্যেরা আমাকে নিপতিত দেখিয়া নিতান্ত কাতর হইলেন।

অষ্টব্রাহ্মণসহ ভীষ্মের গঙ্গাদর্শন

“অনন্তর আমি হুতাশনকল্প আটটি ব্রাহ্মণকে সন্দর্শন করিলাম। তাঁহারা রণক্ষেত্রে আমার চতুর্দ্দিক বেষ্টন ও আহার ভূজপঞ্জব [বাহুবেষ্টনী] দ্বারা গ্রহণ করিয়া অবস্থান করিতেছেন। আমি পরমসুহৃদের ন্যায় সেইসকল বিপ্ৰকর্ত্তৃক অন্তরীক্ষে গৃহীত, পরিরক্ষিত ও শীতলসলিলদ্বারা অভিষিক্ত হইয়া নিশ্বাস পরিত্যাগ করিলাম; তৎকালে আমাকে ভূতল স্পর্শ করিতে হয় নাই। অনন্তর ব্রাহ্মণেরা কহিলেন, “হে ভীষ্ম! তোমার আর কোন শঙ্কা নাই; তুমি মঙ্গল লাভ করিবে।” আমি তাহাদিগের বাক্যে পরিতৃপ্ত ও সহসা উত্থিত হইয়া সরিদ্বরা গঙ্গাকে রথে অবস্থান করিতে সন্দর্শন করিলাম। তিনি আমার নিমিত্ত অশ্ব সংগ্ৰহ করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমি তাঁহার পাদগ্ৰহণ করিয়া বিপ্ররূপী পিতৃগণের রথে আরোহণ করিলাম। ভাগীরথী অশ্ব, রথ ও অলঙ্কারাদির সহিত আমাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। আমি কৃতাঞ্জলিপুটে পুনরায় তাহাকে বিদায় করিলাম।

“দিবাবসান হইলে আমি স্বয়ংবায়ুবেগগামী অশ্বগণকে উত্তেজিত করিয়া জামদগ্ন্যের সহিত যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলাম এবং তাহাকে লক্ষ্য করিয়া মহাজব [অত্যন্ত বেগশালী], মহাবল, হৃদয়চ্ছেদী [হৃদয়বিদারক], এক শর নিক্ষেপ করিলাম। তিনি সেই শরাঘাতে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক জানুদ্বয়, আকুঞ্চিত করিয়া বিমোহিত ও ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন জলদজাল [মেঘমালা] প্রভূততর রুধির বর্ষণ করিতে লাগিল। উল্কাসকল নিপতিত, সৌদামিনী স্ফুরিত [বিদ্যুৎ চমকিত] ও প্রচণ্ড নিৰ্ঘাত [বজ্রধ্বনি] সামুত্থিত হইতে লাগিল। রাহু সহসা প্রখর দিবাকরকে গ্ৰাস করিল। অনবরত ভূমিকম্প ও সমীরণ প্রবলবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল। গৃধ্র, বক ও কঙ্কসমুদয় হৃষ্টান্তঃকরণে ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে প্ৰবৃত্ত হইল। শৃগালগণ দিগদাহ হইতেছে দেখিয়া বারংবার ভয়ঙ্কর চীৎকার করিতে লাগিল। দুন্দুভিসকল আহত না হইয়াও অতি কঠোরস্বরূপে ধ্বনিত হইয়া উঠিল। পরশুরাম মূর্চ্ছিত ও পৃথিবীতে নিপতিত হইলে এই সমস্ত ভয়ঙ্কর উৎপাত লক্ষিত হইতে লাগিল।

“অনন্তর তিনি সহসা উত্থিত হইয়া পুনর্ব্বার যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত ক্রোধাভরে আমার নিকট উপস্থিত হইলেন। তিনি যখন গন্ধরসধাতুময় [গন্ধকযুক্ত] শরাসর ও শরগ্রহণ করিতে উদ্যত হইলেন, তখন কৃপাপরায়ণ তপোধনগণ 
তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন; তিনিও তাঁহাদিগের বাক্যে তৎ
ক্ষণাৎ ক্ষান্ত হইলেন। অনন্তর ভগবান সহস্ৰদীধিতি [সূৰ্য্য] পাংশুপুঞ্জে [ধূলিজালে] সমাচ্ছন্ন হইয়া করনিকর সঙ্কোচিত করিয়া অস্তাচলে গমন করিলেন; সুখসম্পর্শ সুশীতল মারুতসম্পন্ন বিভাবরী সুপস্থিত হইল; আমরাও যুদ্ধ হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলাম। হে রাজন, আমরা সন্ধ্যাকালে যুদ্ধ হইতে বিরত ও প্রাতঃকালে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে লাগিলাম। এইরূপে আমাদের ত্রয়োবিংশতি ঘোরতর যুদ্ধ হইল।”