১৫৫. পাণ্ডবপক্ষে সেনাপতিনির্ব্বাচন

১৫৫তম অধ্যায়

পাণ্ডবপক্ষে সেনাপতিনির্ব্বাচন

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন!! রাজা যুধিষ্ঠির বৃহস্পতিতুল্য বুদ্ধিমান, পৃথিবীর ন্যায় ক্ষমাবান [অবিচলিত], সমুদ্রের ন্যায় গভীর, হিমাচলের ন্যায় সুধীর, প্রজাপতির ন্যায় উদারগুণসম্পন্ন [সর্ব্বত্ৰ সমদৰ্শী], দিবাকরের ন্যায় তেজস্বী, দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় শত্রুবিদারণসমৰ্থ [শত্ৰুনাশসমর্থ], ভূপালগণের অগ্রগণ্য মহাবীর ভীষ্মকে অতি ভীষণ লোমহর্ষণ তুমুল সংগ্রামে দীর্ঘকালের নিমিত্ত দীক্ষিত শ্রবণ করিয়া কি বলিলেন এবং ভীষ্ম, অর্জ্জুন ও মহামতি কৃষ্ণই বা কি কহিলেন?

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সমস্ত ভ্রাতৃগণ ও সনাতন বাসুদেবকে আহ্বান করিয়া শান্তবাক্যে কহিতে লাগিলেন, “হে ভ্ৰাতৃগণ! তোমরা চতুর্দ্দিকে ভ্ৰমণ করা এবং বর্ম্মধারণ [অঙ্গরক্ষক পরিচ্ছদ—পোষাক] করিয়া সাবধান হইয়া থাক। প্রথমতঃ পিতামহ ভীষ্মের সহিত তোমাদের যুদ্ধ উপস্থিত হইবে; অতএব এক্ষণে সাত অক্ষৌহিণীর সাতজন সেনাপতি অবধারণ কর।” বাসুদেব কহিলেন, “মহারাজ! আপনি সময়োচিত কৰ্মই নির্দ্দেশ করিতেছেন; উহাতে আমারও সম্মতি আছে; অতএব অনতিবিলম্বে সাতটি সেনাপতি নিযুক্ত করুন।”

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির মহাবীর দ্রুপদ, বিরাট, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, ধৃষ্টকেতু, শিখণ্ডী ও মগধদেশাধিপতি সহদেব-এই সাতজনকে বিধিপূর্ব্বক সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিলেন। যিনি দ্রোণবিনাশের নিমিত্ত প্ৰদীপ্ত হুতাশনমধ্য হইতে প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন, সেই মহাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন সর্ব্বসেনাপতিপদে প্রাদুর্ভূত হইলেন। মহাবীর অর্জ্জুন যুধিষ্ঠিরের বাক্যানুসারে এই সমস্ত সেনাপতির আধিপত্য স্বীকার করিলেন এবং ধীমান জনাৰ্দন অর্জ্জুনের সারথি হইলেন।

অনন্তর নীলাম্বরধারী কৈলাসগিরিসদৃশ মধুপানমত্ত আরক্তলোচন বলদেব এই কুলক্ষয়কর ঘোরতর যুদ্ধ সমুপস্থিত দেখিয়া অক্রুর, গাদ, শাম্ব, উদ্ধব, রৌক্সিণেয় [রুক্সিণীতনয়] আহুক ও চারুদেঞ্চপ্রভৃতি বলদৃপ্ত [বিলোন্মত্ত] বৃষ্ণিবংশীয় মহাবীরগণসমভিব্যাহারে দেবগণসুরক্ষিত সুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় মন্দ মন্দ গমনে পাণ্ডবগণের আবাসভবনে প্রবেশ করিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ, পার্থ ও ভীমকর্ম্মা ভীমসেন তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র আসন হইতে উত্থিত হইলেন। পরে অর্জ্জুন ও অন্যান্য ভূপালগণ তাঁহাকে যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা করিলে বাসুদেবপ্রভৃতি সকলেই তাঁহাকে অভিবাদন করিতে লাগিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির করদ্বারা তাঁহার কর গ্রহণ করিলে পর তিনি বৃদ্ধরাজা বিরাট ও দ্রুপদকে নমস্কার করিয়া যুধিষ্ঠিরের সহিত উপবিষ্ট হইলেন।

কৃষ্ণপ্রতি বলরামের উপদেশ-তীর্থযাত্ৰা

এইরূপে সকলেই আসন পরিগ্রহ করিলে রোহিণীনন্দন বলদেব কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! অবিলম্বে অতি ভয়ঙ্কর লোকক্ষয় সমুপস্থিত হইবে; আমি নিশ্চয় বোধ করিতেছি, এই দৈবঘটনা অতিক্রম করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। এক্ষণে আমার অভিলাষ এই যে, তোমরা বান্ধবগণের সহিত আরোগ ও অক্ষত-শরীরে যুদ্ধ হইতে উত্তীর্ণ হও। আমার নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, এই একত্র সমবেত ভূপালগণের বিনাশকাল নিকটবর্ত্তী হইয়াছে; অতএব মাংসশোণিতময় মহৎ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইবে। আমি তোমাকে বারংবার নির্জ্জনে কহিয়াছিলাম, হে মধুসূদন! তুমি আত্মীয়গণের সহিত একরূপ ব্যবহার কর, পাণ্ডবগণের ন্যায় দুৰ্য্যোধনও আমাদিগের প্রিয়পাত্ৰ, তাঁহার সাহায্য ও অর্চনা করা তোমার কর্ত্তব্য, কিন্তু তুমি অর্জ্জুনের প্রতি স্নেহবশতঃ তদ্বিষয়ে একান্ত পরাঙ্মুখ হইয়াছ। যখন তুমি পাণ্ডবগণের প্রতি পক্ষপাতপ্রদর্শন করিতেছ, তখন তাঁহাদিগের জয়লাভ হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি তোমা ব্যতিরেকে অন্য লোককে অবলোকন করিতে অভিলাষী নহি, এই নিমিত্ত তুমি যাহা অনুষ্ঠান কর, তাহারই অনুসরণ করিয়া থাকি। গদাযুদ্ধবিশারদ ভীম ও দুৰ্য্যোধন উভয়েই আমার শিষ্য, তাঁহাদিগের প্রতি আমার সমান স্নেহ, আমি কৌরবগণের বিনাশ উপস্থিত হইলে কদাচ উপেক্ষা করিতে পারিব না, অতএব এক্ষণে সরস্বতীনদীর তীর্থসমুদয় পর্য্যটন করিতে যাত্ৰা করিলাম।” এই বলিয়া বলদেব বাসুদেবকে প্রতিনিবৃত্ত করিয়া পাণ্ডবগণের আদেশানুসারে তীৰ্থপর্য্যটনার্থ নিৰ্গত হইলেন।