১৫৪. কৌরবপক্ষে ভীষ্মের সেনাপতিপদ গ্ৰহণ

১৫৪তম অধ্যায়

কৌরবপক্ষে ভীষ্মের সেনাপতিপদ গ্ৰহণ

হে ভূপাল! অনন্তর ধৃতরাষ্ট্রীতনয় দুৰ্য্যোধন অন্যান্য মহীপালগণসমভিব্যাহারে কৃতাঞ্জলিপুটে মহাবীর ভীষ্মকে কহিলেন, “হে পুরুষপ্রবীর! আমাদিগের সৈন্যগণ সংগ্রামার্থ প্রস্তুত হইয়া উপযুক্ত সেনাপতিবিরহে পিপীলিকাপুটের [পিঁপড়ার সারির] ন্যায় ছিন্নভিন্ন হইতেছে। দুই ব্যক্তির বুদ্ধি কদাচ সমভাবসম্পন্ন হয় না, এই নিমিত্ত সেনাপতিগণ পরস্পর স্বীয় বলবীৰ্য্যের স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাকেন।শুনিয়াছি, পূর্ব্বে ব্রাহ্মণগণ কুশময় ধ্বজদণ্ড উন্নত করিয়া বৈশ্য ও শূদ্ৰসমভিব্যাহারে হৈহয়বংশীয় ক্ষত্ৰিয়গণসন্নিধানে গমন করিয়াছিলেন। তখন একদিকে ব্ৰাহ্মণপ্রভৃতি বর্ণত্রয় ও অন্যদিকে একমাত্র ক্ষত্ৰিয়জাতি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন।

“অনন্তর ব্রাহ্মণপ্রভৃতি বর্ণত্রয় ক্ষত্রিয়গণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া বারংবার পরাজিত হইতে লাগিলেন। তখন ব্ৰাহ্মণের তাঁহাদিগকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা কহিলেন, “হে দ্বিজাতিগণ! আমরা সমরে প্রবৃত্ত হইয়া এক বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই মতানুসারে কাৰ্য্য করিয়া থাকি, কিন্তু আপনারা স্ব স্ব বুদ্ধিবৃত্তির বশবর্ত্তী হইয়া যুদ্ধ করিতেছেন।” তখন ব্রাহ্মণগণ নীতিকুশল এক ব্রাহ্মণকে সেনাপতিপদে নিযুক্ত করিয়া যুদ্ধে ক্ষত্রিয়দিগের পরাজয় করিলেন!

“এইরূপ যাহারা হিতাভিলাষী নিষ্পাপ সুনিপুণ ব্যক্তিকে সেনাপতি করেন, তাঁহারা যুদ্ধে শত্রুজয় করিতে সমর্থ হয়েন, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে পিতামহ! আপনি অসুরগুরু শুক্রের তুল্য, আমার প্রিয়ানুষ্ঠানপরতন্ত্র [প্রিয়াচরণে একান্ত নিযুক্ত], অন্যের অসংহাৰ্য্য [অবধ্য] ও ধর্ম্মপরায়ণ, অতএব এক্ষণে আমাদিগের সেনাপতি হউন। সুমেরু পর্ব্বতসকলের, গরুড় পক্ষিগণের, আদিত্য তেজঃপদার্থের, চন্দ্ৰ পাদপসমূগের, কুবের যক্ষগণের, ইন্দ্র দেবগণের, কার্ত্তিকেয় ভূতগণের এবং হুতাশন যেমন বসুগণের রক্ষক, তাদৃশ আপনিও আমাদিগের রক্ষক হউন; আমরা আপনার বলবীৰ্য্যে সুরক্ষিত হইয়া দেবগণের দুৰ্দ্ধৰ্ষ হইব, সন্দেহ নাই। যেমন কার্ত্তিকেয় দেবগণের অগ্রবতী হইয়াছিলেন, তদুপ এক্ষণে আপনি আমাদিগের অগ্রবর্ত্তী হউন। যেমন গোসকল বৃষভের অনুসরণ করে, তদুপ। আমরা আপনার অনুগমন করিব।”

যুদ্ধে ভীষ্মের নিয়মবন্ধন

ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহাবাহো! তুমি যাহা কহিলে, আমি তদ্বিষয়ে সম্মত হইলাম, কিন্তু তোমাদের ন্যায় পাণ্ডবেরাও আমার প্রিয়পাত্ৰ, সুতরাং তাহাদিগকে সৎপরামর্শ প্ৰদান করাও আমার কর্ত্তব্য হইতেছে। কিন্তু আমি এক্ষণে পূর্ব্বপ্রতিজ্ঞানুসারে তোমাদের পক্ষ হইয়াই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব। মহাবীর অর্জ্জুনব্যতিরেকে ভূমন্ডলে আমার প্রতিদ্বন্দী আর কেহই দৃষ্টিগোচর হইতেছে না। তিনি বহুদিন দিব্যাস্ত্ৰসকল অবগত হইয়াছেন; তথাচ প্রকাশ্যে আমার সহিত সংগ্ৰাম করিতে কদাচ সমর্থ হইবেন না। আমি অস্ত্রবলে ক্ষণকালমধ্যেই সুর, অসুর ও রাক্ষসগণ-পরিবৃত বিশ্বকে নির্ম্মানুষ্য [মনুষ্যশূন্য] করিতে পারি; কিন্তু পাণ্ডবগণকে উৎসাদিত [উৎসন্ন—নির্ম্মূল] করিতে কখনই সমর্থ নাহি। আমি কহিতেছি, যদি পাণ্ডবগণ আমাকে বিনষ্ট না করে, তাহা হইলে আমি তোমার নিয়োগানুসারে প্রতিদিন তাঁহাদিগের এক এক অযুত সৈন্য সংহার করিয়া ক্ৰমে ক্রমে তাঁহাদিগকে নিধন করিব। আর আমি তোমার সেনাপতিপদ গ্ৰহণ করিব; তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু একটি নিয়ম নিৰ্দ্ধারিত করিতেছি, শ্রবণ কর; সূতপুত্ৰ কৰ্ণ সতত আমার সহিত রণের স্পৰ্দ্ধা করিয়া থাকেন; এক্ষণে আমাদের উভয়ের মধ্যে কে অগ্রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবে?” কর্ণ কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর ভীষ্ম জীবিত থাকিতে আমি কদাচ অগ্রে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না। তিনি বিনষ্ট হইলে পশ্চাৎ অর্জ্জুনের সহিত সংগ্ৰাম করিব।”

ভীষ্মের সৈনাপত্য-কৌরবপক্ষে বিঘ্নসূচনা

অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন বিধিপূর্ব্বক ভীষ্মদেবকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিলে তিনি তখন সমধিক শোভাসম্পন্ন হইলেন। বাদকেরা রাজার নির্দ্দেশানুসারে অব্যগ্রমনে শতসহস্র ভেরী ও 
শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিল। বীরপুরুষেরা সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু মেঘশূন্য নভোমণ্ডল হইতে অনবরত কর্দম ও রুধিরময় বৃষ্টি নিপতিত, বজ্রাঘাত ও ভূকম্প হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে যোদ্ধৃগণের মন নিতান্ত বিহ্বল হইয়া উঠিল। আকাশবাণী ও নিরন্তর উল্কাপাত হইতে লাগিল। অনিষ্টসূচক শিবাগণ তারস্বরে চিৎকার করিতে প্ৰবৃত্ত হইল। ভী
ষ্মদেব সেনাপতির কাৰ্য্য পরিগ্রহ করিলে এইরূপ নানাপ্রকার উৎপাত উপস্থিত হইতে লাগিল ।

রাজা দুৰ্য্যোধন ব্রাহ্মণগণকে ধেনু ও নিষ্ক [স্বর্ণালঙ্কার] প্রদানপূর্ব্বক সৈন্য ও ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে ভীষ্মকে পুরষ্কৃত [অগ্ৰে সংস্থাপন] করিয়া কুরুক্ষেত্রে যাত্রা করিলেন। তৎকালে আশীর্ব্বাদকেরা তাঁহাকে জয়াশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন। তিনি কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া কর্ণের সহিত পরিভ্রমণপূর্ব্বক প্রভূত তৃণ ও ইন্ধন [কাষ্ঠ] সম্পন্ন উর্ব্বর ও সমতল প্রদেশ পরিমাণ করিয়া শিবির সংস্থাপন করিলে উহা হস্তিনাপুরীর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।