পুনর্ব্বার পাশকক্রীড়াপ্রবৃত্তি
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর দুৰ্য্যোধন ধীমান ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন “হে পার্থ। এই সভামধ্যে বহুবিধ লোকের সমাগম হইয়াছে, এক্ষণে পিতা আদেশ করিতেছেন, আইস, অক্ষনিক্ষেপপূর্ব্বক দ্যূতারম্ভ করি!” তখন যুধিষ্ঠির প্রত্যুত্তর করিলেন, “লোকে দৈব-বলে শুভাশুভ ফলভোগ করিয়া থাকে, অতএব যদি পুনর্ব্বার ক্রীড়াই করিতে হয়, ভাল, ভাগ্যে যাহা আছে, কখনই তাহার অন্যথা হইবে না। আমি বৃদ্ধ রাজার নির্দেশানুসারে দ্যূতে আহূত হইয়াছি; সুতরাং অক্ষদ্যূত ক্ষয়কর জানিয়াও এক্ষণে তদ্বিষয়ে পরাঙ্মুখ হইতে পারি না।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! জীবের হেমময় কলেবর হওয়া নিতান্ত অসম্ভব। ইহা জানিয়াও রঘুকুলতিলক রাজা রামচন্দ্র স্বর্ণমৃগলুব্ধ হইয়াছিলেন, সুতরাং লোকের বিপৎকাল আসন্ন হইলে প্রায়ই বুদ্ধির ব্যতিক্রম ঘটিয়া থাকে।
অনন্তর যুধিষ্ঠির এই কথা বলিয়া ভ্রাতৃগণের সহিত মৌনভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন এবং জানিয়াও পুনর্ব্বার দ্যূতে আসক্ত হইলেন। তাঁহারা পুনরায় দ্যূতসভায় প্রবেশ করিলে তাহাদিগের সুহৃদাবর্গ মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, “ইহারা বহুবিধ সুখসম্ভোগে কালাতিপাত করিতেছিলেন, কিন্তু দুদৈব সর্ব্বলোক-সংহারার্থ ইহাদিগকে পীড়ন করিয়া দ্যূতে প্রবৃত্ত করিলেন।”
বনবাস-অজ্ঞাত বনবাসপণে পাণ্ডবপরাজয়
শকুনি যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! বৃদ্ধ রাজা আপনাদিগকে যে অর্থ প্ৰত্যপণ করিয়াছেন, তাহা ভালই হইয়াছে, কিন্তু এক্ষণে এক মহাধন পণ অবধারিত হইয়াছে, শ্রবণ করুন। আমরা আপনাদিগের নিকট দ্যূতে পরাজিত হইলে রুরুচর্ম্ম [কৃষ্ণসার মৃগচর্ম্ম] পরিধানপূর্ব্বক মহারণ্যে প্রবেশ করিয়া এক বৎসর অজ্ঞাতবাস ও দ্বাদশ বৎসর জনসমাকীর্ণ প্রদেশে প্রবেশ করিব। আর আমরা জয়ী হইলে আপনাদিগকেও অজিন পরিধানপূর্ব্বক কৃষ্ণার সহিত এইরূপ ত্ৰয়োদশ বৎসর বনবাস করিতে হইবে। হে মহারাজ! এই প্রকার ত্ৰয়োদশ বৎসর অতীত হইলে উভয়পক্ষের একতর পক্ষ পুনরায় স্বরাজ্য প্রাপ্ত হইতে পারিবেন। অতএব আসুন, এক্ষণে এইরূপ পণ রাখিয়া অক্ষনিক্ষেপপূর্ব্বক পুনর্ব্বার দ্যূতারম্ভ করি।”
অনন্তর সভাস্থ সমস্ত সভ্য নিত্যান্ত উদ্বিগ্ন হইয়া শশব্যস্ত চিত্তে হস্তোত্তোলনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বান্ধবগণ! তোমাদিগকে ধিক, তোমরা রাজা যুধিষ্ঠিরকে এতাদৃশ ভয়ঙ্কর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করাইতেছ; কিন্তু পরিণামে কি হইবে, বোধ হয়, ইনি বুঝিয়াও কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না।”
বৈশম্পয়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপ বহুতর লোকপ্রবাদ শ্ৰবণ করিয়াও লজ্জা ও ধর্ম্মভয়ে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কুরুবংশীয়দিগের বিনাশকাল আসন্ন হইয়াছে, ইহা নিশ্চয় করিয়া পুনর্ব্বার দ্যূতে প্ৰবৃত্ত হইলেন।
তখন যুধিষ্ঠির শকুনিকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে শকুনে! মত্তুল্য ধর্ম্মপরায়ণ কোন রাজা দ্যূতে আহত হইয়া প্রতিনিবৃত্ত হইতে পারে? আইস, এক্ষণে দ্যূতারম্ভ করি।” শকুনি কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ। হিরণ্য, গো, অশ্ব, ধেনু, অসীম মেষ, অজ, গজ, সমস্ত দাস-দাসী ও কোষ, আমরা বনবাসার্থে এই সকল একত্র পণ রাখিব। পরাজিত হইলে আমাদিগকে বা আপনাদিগকেই হউক, অরণ্যবাস আশ্রয় করিতে হইবে। আসুন, এক্ষণে দ্বাদশ বৎসর জনসমাকীর্ণ স্থানে অবস্থান ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস পণ রাখিয়া ক্রীড়ারম্ভ করি।” তখন যুধিষ্ঠির তাহার বাক্যে অঙ্গীকার করিলেন। শকুনি অক্ষনিক্ষেপ করিবামাত্র তাহার জয়লাভ হইল।