৬৯. কর্ণের কুৎসিত উক্তি

কর্ণের কুৎসিত উক্তি

কৰ্ণ কহিলেন, “হে ভদ্রে! এই সভামধ্যে ভীষ্ম, বিদুর ও দ্রোণাচাৰ্য্য এই তিনজন সবল আছেন, ইহারা স্বীয় প্রভুকে দুষ্ট বলিয়া থাকেন; স্বস্ব ধন বৃদ্ধি করিতে বাঞ্ছা করেন, কিন্তু তজ্জন্য ব্যাকুল হন না। আর দাস, পুত্র ও অস্বতন্ত্র নারী এই তিনজন অধম। দাসের পত্নী ও তাহার সমুদয় ধন প্রভুর অধীন। এক্ষণে আমার অনুমতিক্রমে তুমি রাজভবনে প্রবেশপূর্ব্বক রাজপরিবারের অনুগত হও। রাজপুত্র! এখন ধৃতরাষ্ট্রনন্দনগণই তোমার প্রভু, পাণ্ডুনন্দনেরা নহেন। এক্ষণে যে ব্যক্তি তোমাকে দ্যূতে পরাজিত হইয়া দাসীত্ব-শৃঙ্খলে বদ্ধ না করে, তুমি এমন একজনকে পতিত্বে বরণ কর। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব দূতে পরাজিত হইয়াছেন, তুমিও দাসী হইয়াছ, আর ঐ পরাজিত পঞ্চভ্রাতা এক্ষণে তোমার পতি নহেন। যুধিষ্ঠির আপনার জন্মের আবশ্যকতা, পরাক্রম ও পৌরুষের প্রতি দৃষ্টিপাতও করেন না, তিনি এই সভামধ্যে দ্রুপদাত্মজাকে দ্যূতমুখে সমৰ্পণ করিয়াছেন।

ক্ৰোধনস্বভাব ভীমসেন কর্ণের বাক্য শ্রবণে পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর ক্ৰোধান্বিত হইয়া রোষকষায়িতলোচনে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া নিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন্‌। আমি সূতপুত্রের বাক্যে ক্রুদ্ধ হই নাই; যথার্থ আমরা দাসভাবাপন্ন হইয়াছি। কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখুন, যদি আপনি পাঞ্চালীকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া না করিতেন, তাহা হইলে কি শক্ৰগণ এরূপ পরুষোক্তি করিতে পারিত?”

ভীমের দুৰ্য্যোধন উরুভঙ্গ প্ৰতিজ্ঞা

ভীমসেনের এই বাক্য শ্রবণানন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন তুষ্ণীম্ভূত অচেতনপ্রায় রাজা যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে নৃপতে! ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব তোমার বশীভূত, এক্ষণে বল, দ্রৌপদী পরাজিত হইয়াছে কি না।” ঐশ্বৰ্য্যমদে মত্ত দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ধর্ম্মরাজকে এইরূপ কহিয়া হাসিতে হাসিতে দ্রৌপদীর প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক বসন উত্তোলনপূর্ব্বক সর্ব্বলক্ষণসম্পন্ন, বজ্রতুল্য দৃঢ়, কদলীদণ্ড ও করিশুণ্ডের ন্যায় স্বীয় উরু-মধ্য তাহাকে দেখাইলেন। কর্ণ হাস্য করিতে লাগিলেন। মহাক্ৰোধন ভীমসেন তদর্শনে সাতিশয় ক্রোধান্বিত হইয়া লোহিতবর্ণ লোচনদ্বয় উৎফালনপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে সভামণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া রাজগণসমক্ষে কহিতে লাগিলেন, “হে ভূপতিগণ! আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, যদি আমি মহাযুদ্ধে গদাঘাতে এই উরু ভগ্ন না করি, তাহা হইলে অন্তে আমার পিতৃলোকের সমান গতি হইবে না।” অমর্ষী ভীমসেন এই কথা কহিতে কহিতে আরও ক্ৰোধান্বিত হইয়া উঠিলেন। দহমান বৃক্ষকোটরের ন্যায় তাহার রোমকূপ হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বহির্গত হইতে লাগিল।

তখন বিদুর কহিলেন, “হে পার্থিবগণ! এই দেখ, ভীমসেন ভয়ানক প্ৰতিজ্ঞা করিলেন। নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, দৈবই ভারতবংশে এই মহতী অনীতি উৎপাদন করিয়াছেন। হে ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ! তোমরা অন্যায় দ্যূতক্রীড়া করিয়াছ; যেহেতু, সভামধ্যে ঐ লইয়া বিবাদ করিতেছ। তোমাদের যোগক্ষেম [রাজ্যের কল্যাণ] সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হইল, তোমরা সকলেই কুমন্ত্রণা পরতন্ত্র হইয়াছ। হে কৌরবগণ! সভামধ্যে অধৰ্মানুষ্ঠান হইলে সমুদয় সভা দূষিত হয়, এক্ষণে আমার ধর্ম্যবাক্য শ্রবণ কর। দেখ যদ্যপি যুধিষ্ঠির আত্মপরাজয়ের পূর্ব্বে দ্রৌপদীকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া করিতেন, তাহা হইলে উনি তাহার যথার্থ ঈশ্বর হইতেন, কিন্তু অনীশ্বরের নিকট বিজিত ধন আমার মতে স্বপ্নানির্জিত ধনের ন্যায়, অতএব হে কৌরবগণ! তোমরা গান্ধাররাজের বাক্য শ্রবণে বিমূঢ় হইয়া ধর্ম্মচ্যুত হইও না।”

দুৰ্য্যোধন বিদুরের বাক্যাবসানে দ্রৌপদীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে যাজ্ঞসেনি! ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেবের মতেই আমার মত, যদি তাঁহারা যুধিষ্ঠিরকে অধিশ্বর কহেন, তাহা হইলে তোমার দাসীত্ব মোচন হইবে।” তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “মহারাজ ধর্ম্মরাজ পূর্ব্বে আমাদের সকলের ঈশ্বর ছিলেন, এক্ষণে তিনি আমার প্রভু হইয়া কাহার নিকট পরাজিত হইয়াছেন, তাহা কুরুগণ জানেন!”

র্তাহাদের এইরূপ উত্তর-প্রত্যুত্তর চলিতেছে, এমত সময়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অগ্নিহোত্ৰ-গৃহে গোমায়ু ও গর্দভগণ চীৎকার করিতে লাগিল এবং পক্ষিগণ চতুর্দিকে ভয়ানক শব্দ করিয়া উঠিল। তত্ত্ববিৎ বিদুর ও সুবলনন্দিনী গান্ধারী সেই শব্দ শ্রবণ করিলেন। বিদ্বান ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্য উহা শ্রবণ করিয়া স্বস্তি স্বস্তি কহিতে লাগিলেন। তত্ত্ববেত্তা বিদুর ও গান্ধারী ঘোরতর উৎপাত-দর্শনে সাতিশয় ভীত ও কাতর হইয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন।

ধৃতরাষ্ট্রের নিকট পঞ্চালীর বরপ্রাপ্তি

তখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র দুৰ্য্যোধনকে ভৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “আরে দুর্বিনীত দুৰ্য্যোধন! তুই একেবারে উৎসন্ন হইলি; যেহেতু, কুরুকুলকামিনী, বিশেষতঃ পাণ্ডবগণের ধর্ম্মপত্নী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে সম্ভাষণ করিতেছিস!” পরমপ্রাজ্ঞ বান্ধবগণহিতৈষী রাজা ধৃতরাষ্ট্র দুৰ্য্যোধনকে এইরূপ তিরস্কার করিয়া সাত্ত্বনাবাক্যে দ্রৌপদীকে কহিলেন, “হে দ্রুপদতনয়ে! তুমি আমার নিকট স্বীয় অভিলষিত বর প্রার্থনা কর, তুমি আমার সমুদয় বধূগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।”

দ্রৌপদী কহিলেন, “হে ভরতকুল-প্রদীপ! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে এই বর প্রদান করুন যে, সর্ব্বধর্ম্মযুক্ত শ্ৰীমান যুধিষ্ঠির দাসত্ব হইতে মুক্ত হউন। আপনার পুত্ৰগণ যেন ঐ মনস্বীকে পুনরায় দাস না বলে, আর আমার পুত্র প্রতিবিন্ধ্য যেন দাসপুত্ৰ না হয়। কেন না, প্রতিবিন্ধ্য রাজপুত্র, বিশেষতঃ ভূপতিগণ কর্তৃক লালিত, উহার দাসপুত্রত হওয়া নিতান্ত অবিধেয়।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে কল্যাণি! আমি তোমার অভিলোষানুরূপ এই বর প্রদান করিলাম; এক্ষণে তোমাকে আর এক বর প্রদান করিতে ইচ্ছা করি; তুমি একমাত্র বরের উপযুক্ত নহ।”

দ্রৌপদী কহিলেন, “হে মহারাজ! সরথ সশরাসন ভীম, ধনঞ্জয়, নকুল ও সহদেবের দাসত্বমোচন হউক।”

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে নন্দিনী! আমি তোমার প্রার্থনানুরূপ বর প্রদান করিলাম; এক্ষণে তৃতীয় বর প্রার্থনা কর। এই দুই বরদান-দ্বারা তোমার যথার্থ সৎকার করা হয় নাই। তুমি ধর্ম্মচারিণী, আমার সমুদয় পুত্রবধূগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।”

দ্রৌপদী কহিলেন, “হে ভগবান! লোভ ধর্ম্মনাশের হেতু, অতএব আমি আর বর প্রার্থনা করি না। আমি তৃতীয় বর লইবার উপযুক্ত নহি; যেহেতু, বৈশ্যের এক বর, ক্ষত্ৰিয়পত্নীর দুই বর, রাজার তিন বর ও ব্রাহ্মণের শতবর লওয়া কর্তব্য। এক্ষণে আমার পতিগণ দাসত্বরূপ দারুণ পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইয়া পুনরায় উদ্ধৃত হইলেন, উহারা পুণ্যকর্ম্ম দ্বারা শ্রেয়োলাভ করিতে পরিবেন।”