৩৫৭. ধর্ম্মজিজ্ঞাসু দ্বিজের নাগসমীপে যাত্রা

৩৫৭তম অধ্যায়

ধর্ম্মজিজ্ঞাসু দ্বিজের নাগসমীপে যাত্রা

ভীষ্ম বলিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! অতিথি এই কথা কহিলে, ব্রাহ্মণ তাঁহার বাক্যশ্রবণে নিতান্ত প্রীত হইয়া কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্‌! ভারপীড়িত ব্যক্তির ভারাবতরণ, পথশ্রান্তের শয়ন, দণ্ডায়মান ব্যক্তির আসন, তৃষ্ণার্ত্তের পানীয়, ক্ষুধার্ত্তের অন্ন, অতিথির প্রকৃত সময়ে অভীষ্টভোজন [১], পুত্ৰার্থী বৃদ্ধের পুত্র ও মনঃকল্পিত প্রীতিকর বস্তুর দর্শনলাভ যেমন নিতান্ত সন্তোষজনক হইয়া থাকে, সেইরূপ আপনার বাক্য যারপরনাই প্রীতিকর হইয়াছে। এক্ষণে আপনি যেরূপ কহিলেন, আমি অবশ্যই তাহার অনুষ্ঠান করিব। ঐ দেখুন, দিবাকর করজাল সঙ্কুচিত করিয়া অস্তাচলে গমন করিতেছেন; রাত্রি প্রায় উপস্থিত হইল; অতএব আপনি এই রজনী আমার আলয়ে অতিবাহিত করুন; প্রভাতে গমন করিবেন।

“ব্রাহ্মণ এই কথা কহিলে, সেই আগন্তুক তৎপ্রদত্ত আতিথ্যসৎকার গ্রহণপূৰ্ব্বক তাঁহার সহিত সন্ন্যাসধৰ্ম্মের কথোপকথন করিতে করিতে দিবসের ন্যায় পরমসুখে রাত্রি অতিবাহিত করিলেন এবং প্রভাত হইবামাত্র গাত্রোত্থানপূর্ব্বক ব্রাহ্মণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া তাঁহার আলয় হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তখন ব্রাহ্মণও স্বজনগণের অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক অতিথির উপদেশানুসারে সেই নাগরাজের আলয়ে গমন করিবার নিমিত্ত স্বীয় আবাস হইতে বহির্গত হইয়া নৈমিষাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।”

৩৫৮তম অধ্যায়

নাগদর্শনার্থ দ্বিজের গোমতীতীরে বাস

ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর সেই ব্রাহ্মণ ক্রমে ক্রমে বিচিত্র বন, তীর্থ ও সরোবরসমুদয় অতিক্রমপূৰ্ব্বক এক মহর্ষির আশ্রমে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সেই নাগের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন। ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করাতে মহর্ষি তাঁহার প্রতি সদয় হইয়া তাঁহার নিকট উহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলেন। তখন ব্রাহ্মণ পরমপরিতুষ্টচিত্তে সেই নাগের আলয়ে সমুপস্থিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে তাঁহাকে সম্বোধন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় নাগরাজ স্বীয় আবাসে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁহার ধৰ্ম্মবৎসলা পতিব্রতা পত্নী ব্রাহ্মণের বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে স্বাগতজিজ্ঞাসা ও তাঁহার যথাবিধি পূজা করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! আমাকে আপনার কোন্ কার্য্য সাধন করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন।’

‘তখন সেই ব্রাহ্মণ নাগপত্নীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দেবি! তুমি যথোচিত সৎকার ও মধুরবাক্যপ্রয়োগদ্বারা আমার শ্রান্তি দূর করিয়াছ। এক্ষণে তোমার নিকট আমার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। মহাত্মা নাগরাজকে দর্শন করিবার নিমিত্তই আমি নিতান্ত উৎসুক হইয়াছি। তাঁহার দর্শনলাভ করিলেই আমার অভিলাষ পূর্ণ হয়। তাঁহার দর্শনলাভের নিমিত্তই আজ তোমাদিগের গৃহে উপস্থিত হইয়াছি।

“তখন নাগপত্নী কহিলেন, ‘ভগবন্! আমার পতিকে এক বৎসরের মধ্যে এক মাস সূৰ্য্যের রথ বহন করিতে হয়। এক্ষণে তিনি সেই নিয়মানুসারে আদিত্যের রথ বহন করিতে গমন করিয়াছেন। আপনি পঞ্চদশ দিন এই স্থানে অবস্থান করুন, নিশ্চয়ই তাঁহার সাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারিবেন। এই আমি আপনার নিকট আমার ভর্ত্তার বিদেশগমনের কারণ কীৰ্ত্তন করিলাম, এক্ষণে আপনি আমাকে যাহা আজ্ঞা করিবেন, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।’

“তখন ব্রাহ্মণ নাগপত্নীকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘পতিব্রতে! আমি নাগরাজের দর্শনলাভের নিমিত্ত কৃতনিশ্চয় হইয়া এই স্থানে আগমন করিতেছি, সুতরাং অবশ্যই আমাকে তাঁহার আগমনপ্রতীক্ষা করিতে হইবে। আমি তাঁহার আগমনপ্রতীক্ষায় এই গোমতীতীরে নিরাহারে অবস্থান করিব। তিনি গৃহে প্রত্যাগমন করিলে তুমি তাঁহার নিকট আমার আগমনের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতে বিস্মৃত হইও না।’ ব্রাহ্মণ নাগপত্নীকে বারংবার এইরূপ কহিয়া গোমতীতীরে গমনপূর্ব্বক অনাহারে কালহরণ করিতে লাগিলেন।”