২২৮. খাণ্ডবযুদ্ধে দেবগণের পরাজয়, দৈববাণী অনুসরণে ইন্দ্রের যুদ্ধবিরতি, অর্জুন কর্তৃক ময়দানবের মুক্তি
অষ্টাবিংশত্যধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, খাণ্ডবারণ্যনিবাসী দানব, রাক্ষস, নাগ, তরক্ষু, ভল্লুক, মদস্রাবী হস্তী, শার্দুল ও সিংহ প্রভৃতি জন্তুগণ এবং অন্যান্য প্রাণিসমুদায় শৈলপতনে ভীত হইয়া উদ্বিগ্নচিত্তে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। কৃষ্ণ ও অর্জুন উদ্যতাস্ত্র হইয়া সেই বন রক্ষা করিতে লাগিলেন। পলায়মান জন্তুগণের চীৎকারররে এবং ঔৎপাতিক শব্দ সদৃশ শৈলনিপাত শব্দে খাববন-সমাকীর্ণ হইয়া উঠিল। অরণ্য দৃগ্ধ হইতেছে এবং কৃষ্ণ অস্ত্র ধারণ করিয়া রহিয়াছেন, দেখিয়া জন্তুগণ ভয়ানক স্বরে চীৎকার করিতে লাগিল। জগণের ভয়ঙ্কর নিনাদ ও অমিয় ভীষণ শব্দে গগনমণ্ডল প্রতি ধ্বনিত হইতে লাগিল। তখন মহাবাহু বাসুদেব ঐ সমস্ত জন্তুগণকে বিনাশ কবিধার মানসে তেজঃপ্রদীপ্ত তীক্ষ্ণ চক্র নিক্ষেপ করিলেন। ক্ষুদ্রজাতীয় প্রাণী, দানব ও নিশাচরণ চক্রাঘাতে জর্জরিতকলেবর হইয়া প্রাণ পরিত্যাগপূর্বক প্রদীপ্ত পাবকমধ্যে পতিত হইতে লাগিল। কৃষ্ণচক্রে বিদা্রিতাঙ্গ দৈত্যগণ বসারুধিরচর্চিত হইয়া সন্ধ্যাকালীন মেঘের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। ভগবান্ চক্রপাণি সহস্র সহস্র পিশাচ, পক্ষী, নাগ ও পশুগণকে বিনাশ করিয়া কালান্তক যমের ন্যায় তথায় ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। অমিত্রঘাতী কৃষ্ণ যতবার চক্র নিক্ষেপ করেন, চক্ৰ ততবারই বহুসংখ্যক প্রাণী বিনাশ করিয়া তাহার হয়ে ফিরিয়া আইসে। এইরূপে বহুসংখ্যক পিশাচ, স্বপ্ন ও রাক্ষসগণ বিনাশ করাতে সর্বভূতাত্মা বাসুদেবের রূপ অতীব ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল। ঐ সময় সমস্ত দেবগণ কৃষ্ণ ও অর্জুনের সহিত সংগ্রাম করিলেন, কিন্তু কেহই তাহাদিগকে পরাজয় করিতে পারি লেন না। সুরগণ কৃষ্ণার্জুন হস্ত হইতে আগুরারণ্য রক্ষা করিতে না পারিয়া পরিশেষে প্রতিন্বিত হইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তদ্দর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়া কৃষ্ণ ও অর্জুনকে প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
সুরগণ প্রতিনিবৃত হইলে ইন্দ্রকে লক্ষ্য করিয়া এই দৈববাণী হইল, দেবরাজ! তোমার সখা ভুজগেশ্বর তক্ষক বিনষ্ট হন নাই। খাণ্ডবারণ্যজাহকালে তিনি কুরুক্ষেত্রে গমন করিয়াছিলেন। আমার বাক্য শ্রবণ কর; এই রাক্ষুদেব ও অর্জুনকে তুমি কখনই পরাজয় করিতে পারিবে না। ইহারা পূৰ্বে নর ও নারায়ণ নামে সুরপুরে বিখ্যাত ছিলেন। তুমিও উহাদের বীৰ্য্য ও পরাক্রমের বিষয় সমুদায় অবগত আছ। এই দুরাধ, সৰ্বলোকবি, পুরাল মহুর্ষিদ্বল্প মূদ্ধে পরাজিত হইবার নহেন। ইহার সমুদায় দেব, অসুর, যক্ষ, রাক্ষস, গন্ধর্ব, কর, কিঙ্কর ও পন্নগ্নগণের পুজনীয়। অতএব হে ” ঝাব। তুমি স্কুলগণসমভিব্যাহারে স্বস্থানে স্থানপূর্বক এই খাণ্ডবদাহ নিরীক্ষণ কর।
অমররাজ ইন্দ্র এই প্রকার অশরীরিণী বাণী শ্রবণ করিয়া সত্য দিয়ে বিবেচনায় ক্রোধদ্বেষ পরিত্যাগপূর্বক স্বর্গে প্রস্থান করিলেন। অন্যান্য দেবগণ, দেবরাজকে প্রদান করিতে দেখিয়া সৈন্যগণ সমভিব্যাহারে তাহার পচাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। সুরপতি অমরগণ সমভিব্যাহারে স্বস্থানে প্রস্থান করিলে কৃষ্ণ ও অর্জুন সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্বক নিঃশঙ্কচিতে খাণ্ডববন দগ্ধ করিতে লাগিলেন। যেমন বায়ু মেঘমালাকে দূরীভূত কয়ে, তদ্রূপ অন সুরগণকে তথা হইতে নিঃসারিত করিয়া বাণবর্ষণদ্বারা খাণ্ডববন, জন্তুগণকে ব্যস্ত সমস্ত করিলেন। অর্জুনের শরাঘাতে ছিন্নকলেবর হওয়াতে কোন জন্তুই প্রাণ লইয়া পলায়ন করিতে পারিল না। মহাবল পরাক্রান্ত জন্তুগণ, আমোঘাস্ত্র অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করা দূরে থাকুক, তৎকালে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতেও সমর্থ হইল না। শত শত পক্ষিগণ অর্জুনশরাঘাতে প্রাণ পরিত্যাগপূর্বক অগ্নিতে পতিত হইতে লাগিল। হস্তী, মৃগ, তরক্ষু ও অন্যান্য প্রাণিগণ কি তীরভূমি, কি বিষম প্রদেশ, কি পিতৃদেবনিবাস, কোথাও গিয়া প্রাণ রক্ষা করিতে না পারিয়া কাতরস্বরে চীৎকার করিতে লাগিল। তাহাদের আর্তনাদ শ্রবণ করিয়া গঙ্গামধ্যস্থ ও সমুদ্রগর্ভ মীনগণ সাতিশয় ব্রাসযুক্ত হইল। তত্ৰত্য বিদ্যাধরগণ ও অন্যান্য জন্তুগণ কৃষ্ণার্জুনের সহিত যুদ্ধ করিবে কি, তাহাদের সম্মুখীন হইতেই পারিল না। পলায়মান জন্তুগণের মধ্যে বাহার এক বর্ষের অনধিকবয়স্ক, কৃষ্ণ স্বীয় চক্ৰদ্বারা তাহাদিগকেও ছেদন করিতে লাগিলেন। মহাকায় জীবগণ কৃষ্ণার্জুনের অস্ত্রাঘাতে ছিন্নশির ও ভিন্নমস্তক হইয়া প্রদীপ্ত হুতাশনে পতিত হইতে লাগিল। এইরূপে ভগবান হব্যবাহন কৃষ্ণার্জুন প্রভাবে মাংস, রুধির ও বসাদ্বারা তর্পিত হইয়া মহাবেগে গগনস্পর্শপূর্বক ধূমশূন্য হইলেন এবং দীপ্তাক্ষ, দীপ্তজিহ্ব, দীপ্তানন ও দীপ্তকেশ হইয়া প্রাণিগণের বসা পান করত পরম পরিতুষ্ট হইলেন।
হুতাশন প্রচণ্ডবেগে খাণ্ডবারণ্য দগ্ধ করিতেছেন, এমন সময়ে ভগবান মধুসূদন ময়দানবকে তক্ষকের ভবন হইতে পলায়ন করিতে দেখিলেন। মুর্তিমান অগ্নি কৃষ্ণের নিকট গমন করিয়া ময়াসুরকে দগ্ধ করাইতে প্রার্থনা করিলেন। কৃষ্ণ অগ্নি প্রার্থনানুসারে অসুরকে ছেদন করিবার জন্য চক্র উত্তোলন করিলেন। ময় তদ্দর্শনে অতীব ভীত হইয়া রক্ষা করুন, রক্ষা করা, বলিয়া অর্জুনসমীপে গমন করিতে লাগিল। শরণাগতপ্রতিপালক ধনঞ্জয় তাহার সেই করুণস্বর শ্রব দয়াপরবশ হইয়া ‘ভয় নাই’ বলিয়া আশ্বাস প্রদানপূর্বক তাহাকে জীবিতপ্রায় করিলেন; অন এইরূপে অভয় প্রদাম করাতে ভগবান, চক্রপাণি তাহাকে বধ করিবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করিলেন; অগ্নিও তাহাকে দগ্ধ করিলেন না।
হে পৌরববংশাবতংস জনমেজয়! এইরূপে কৃষ্ণার্জুন কর্তৃক রক্ষিত হইয়া ভগবান্ হুতাশন পঞ্চদশ দিবসে সেই বন দগ্ধ করিলেন। এই পঞ্চদশ দিনের মধ্যে তত্তস্থ সমস্ত জীবজন্তুই সেই প্রচণ্ডালে দগ্ধ হইল; কেবল অশ্বসেন, ময় ও চারিটি শাক রক্ষা পাইয়াছিল।