২০৯. সুন্দ-উপসুন্দ উপাখ্যান
নবাধিকদ্বিশততম অধ্যায়।
নারদ কহিলেন, হে কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির! তুমি ভ্রাতৃগণ সমভিব্যাহারে সেই সুন্দোপসুন্দের পুরাতন ইতিহাস শ্রবণ কর। পূর্বকালে মহাসুর হিরণ্যকশিপুর বংশে নিকুম্ভ নামে মহাবলপরাক্রান্ত তেজস্বী এক দৈত্য জন্ম গ্রহণ করে। ঐ দৈত্য যাবতীয় দানবগণের অধীশ্বর ছিল। ভীমপরাক্রম রমনাঃ সুন্দও উপসুন্দ তাহারই পুত্র। ঐ মহাবলপরাক্রান্ত একনিশ্চয় ও এককাৰ্যনিরত ভ্রাতৃদ্বয় সর্বদা সমদুঃখসুখ হইয়া কালযাপন করিত। তাহারা কেহ কাহাকে পরিত্যাগ করিয়া ভোজন, শয়ন বা গমন করিত না। সতত পরস্পর পরস্পরের প্রিয়কাৰ্য্য করিত এবং পরস্পরকে প্রিয় বাক্য কহিত। ফলতঃ তাহাদিগের দুই ভ্রাতাকে দেখিলে বোধ হইত যেন, এক মূর্তি দ্বিধা বিভক্ত হইয়াছে; সেই সহোদরদ্বয় ক্রমে ক্রমে বয়ঃপ্রাপ্ত হইল।
কিয়দ্দিন পরে সুন্দ ও উপসুন্দ ত্রৈলোক্যবিজয়সঙ্কল্পে দীক্ষিত হইয়া বিন্ধ্যপৰ্বতে গমনপূর্বক অতি কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিল। সেই জটাবল্কলধারী বীরদ্বয় তপোনুষ্ঠানকালে ক্ষুৎপিপাসা পরিত্যাগপূর্বক কেবল বায়ু ভক্ষণ ও আপনাদের গাত্রমাংস ছেদন করিয়া অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিত এবং অনিমিষলোচন ও উৰ্দ্ধবাহু হইয়া চরণের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে নির্ভর করত দণ্ডায়মান থাকিত। এইরূপে তাহারা বহুকাল কঠোর তপস্যা করিল। বিন্ধ্যাচল তাহাদের অত্যুগ্ৰ তপঃপ্রভাবে তাপিত হইয়া ধূম মোচন করিতে লাগিল।
দেবগণ সেই অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে যৎপরোনাস্তি ভীত হইয়া তাহাদের তপোবিঘ্ন সাধনে যত্নবান হইলেন। তাঁহারা কখন বিবিধ রত্ন, কখন বা সুন্দরী স্ত্রী সমুদায়দ্বারা তাহাদিগকে প্রলোভিত করিবার চেষ্টা করিতেন, কিন্তু তাহারা কিছুতেই বিচলিত হইল না। তখন দেবগণ মায়াজাল বিস্তার করিয়া তাহাদের কপোবিয় করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। একদা তাহারা তপস্যা করিতে করিতে দেখিল, একটা শূলধারী বিকটাকার রাক্ষস তাহাদের মাতা; ভগিনী, পত্নী ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদিগকে প্রাণসংহারার্থ লইয়া যাইতেছে; রাক্ষসভয়ে তাহাদিগের বসন, ভূষণ ও মাল্যাদি পরিভ্রষ্ট হইল। পরে তাহারা সেই দুই ভ্রাতাকে উদ্দেশ করিয়া ‘পরিত্রাণ কর, পরিত্রাণ কর’ বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে আহ্বান করিতে লাগিল। সুন্দ ও উপসুন্দ তাহাতেও কিছুমাত্র বিচলিত হইল না। তদ্দর্শনে সেই সমস্ত স্ত্রীগণ ও রাক্ষস অন্তর্হিত হইল।
তদনন্তর সর্বভূত-হিতকারী ভগবান ব্রহ্মা স্বয়ং সেই মহাসুরদ্বয়ের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাহাদিগকে বর প্রদান করিতে উদ্যত হইলেন। দৃঢ়বিক্রম সুন্দ ও উপসুন্দ ভগবান্ কমলযোনিকে সমাগত দেখিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান হইয়া কহিতে লাগিল, হে পিতামহ! আপনি যদি আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে এই বর দিন, যেন আমরা সৰ্বমায়াভিজ্ঞ, সৰ্ব্বাকোবিদ ও মহাবল পরাক্রান্ত হই; ইচ্ছানুরূপ রূপ ধারণ করিতে পারি এবং উভয়ে অমর হই। ব্রহ্মা কহিলেন, আমি অমরত্ব ভিন্ন তোমা অন্য সমুদায় প্রার্থনায় সম্মত হইলাম; অমরত্ববিধান করিলে তোমরা দেবতাদিগের সমান হইবে; তোমরা সকলের উপর একাধিপত্য করিবে বলিয়া এই কঠোর তপস্যা আরম্ভ করিয়াছ; অতএব তোমাদিগকে অমরত্ব প্রদান করা বিধেয় নহে। তোমরা ত্রৈলোক্য বিজয়ের মানসে তপশ্চরণে সমুদ্যত হইয়াছ, এই নিমিত্ত তোমাদিগকে অমরত্ব প্রদান করিলাম না। তখন সুন্দ ও উপন্দ কহিল, হে পিতামহ! যদি আপনি নিতান্তই আমাদিগকে অমর না করেন, তবে এই বর প্রদান করুন যেন, ত্রৈলোক যাবতীয় স্থাবর বা জঙ্গম পদার্থ হইতে আমাদের কোন ভয় না থাকে; কেবল আমরা পরস্পর পরস্পরকে সংহার করিতে পারি। ব্রহ্মা কহিলেন, হে দানবেন্দ্রদ্বয়! আমি তোমাদের প্রার্থনায় সম্মত হইলাম; আমি বর দিতেছি, তোমরা যেরূপ প্রার্থনা করিলে, তোমাদের তদনুরূপ মৃত্যুই হইবে। ভগবান্ কমলযোনি দৈত্যয়কে এইরূপ অভিমত বর প্রদানদ্বারা কঠোর তপস্যা হইতে নিছক্ত: করিয়া ব্ৰহ্মলোকে গমন করিলেন। সুন্দ ও উপসুন্দ ইহারাও সৰ্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার বরে সর্বলোকের অবধ্য হইয়া স্বীয় ভবনে প্রস্থান করিল।
স্বাভিলষিত বরলাভানন্তর প্রত্যাগত ভ্রাতৃদ্বয়কে অবলোকন করি। তাহাদের সুহৃদ পরম পরিতুষ্ট হইল। তৎপরে সুন্দ ও উপসুন্দ স্বীয় জটাভার পরিত্যাগপূর্বক মস্তকে কিরীট, অঙ্গে মহার্হ অভিরণ এবং দিব্য বসন পরিধান করিল। তৎকালে তাহার যেন অকাল-কৌমুদীর সাৰ্বকালিক প্রাদুর্ভাব প্রবর্তিত করিল। তাহাদিগের বান্ধবগণ আনন্দসলিলে ভাসমান হইল। স্থানে স্থানে নৃত্যগীত, স্থানে স্থানে বাদ্যদ্যম ও স্থানে স্থানে ‘দীয়তাং ভুজ্যতাং’ ইত্যাদি বাক্য প্রয়োগ হইতে লাগিল। কামরূপী দৈত্যগণ এইরূপে আনন্দসাগরে নিমগ্ন হইয়াঅবিচ্ছিন্ন বিহারদ্বারা শত শত বৎসর এক মুহূর্তের ন্যায় অতিবাহিত করিতে লাগিল।