১০২তম অধ্যায়
জয়দ্রথরক্ষক দুর্য্যোধনসহ যুদ্ধে কৃষ্ণের ইঙ্গিত
কৃষ্ণ কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! ঐ দেখ, দুৰ্য্যোধন আমাদিগকে অতিক্রম করিয়াছে। দুৰ্য্যোধন অতি অদ্ভুত পরাক্রমশালী; আমার মতে ইহার তুল্য রথী আর কেহই নাই। ঐ মহাধনুর্দ্ধর অতিশয় অস্ত্র কুশল ও যুদ্ধ দুৰ্ম্মদ। উহার অস্ত্র সকল অত্যন্ত দৃঢ়। সকল মহারথেরাই উহার বহুমান করে। ঐ কৃতী রাজপুত্র চিরকাল সুখে লালিত হইয়াছে। ঐ দুরাত্মা নিরন্তর তোমাদিগের দ্বেষ করিয়া থাকে। অতএব হে অনঘ! এক্ষণে উহার সহিত যুদ্ধ করা তোমার নিতান্ত আবশ্যক। এই সংগ্রামে জয় ও পরাজয় তোমারই আয়ত্ত। হে অর্জ্জুন! তুমি অবিলম্বে দুর্য্যোধনের উপর সেই চিরসঞ্চিত ক্রোধবিষ নিক্ষেপ কর। যে দুরাত্মা পাণ্ডবদিগের অনর্থপাতের নিদান, সেই আজি তোমার সহিত যুদ্ধে সমাগত হইয়াছে। অতএব এক্ষণে তুমি কৃতকাৰ্য্য হইতে চেষ্টা কর। রাজা দুৰ্য্যোধন রাজ্যার্থী হইয়া কেন তোমার সহিত যুদ্ধে উপস্থিত হইল? যাহা হউক, ঐ পাপাত্মা ভাগ্যক্রমেই এক্ষণে তোমার বাণগোচর হইয়াছে; অতএব যাহাতে অচিরাৎ জীবন পরিত্যাগ করে, শীঘ্র তাহার উপায় কর। ঐশ্বৰ্য্য মদমত্ত দুৰ্য্যোধন দুঃখের লেশ মাত্রও ভোগ করে নাই। ঐ দুরাত্মা তোমার সংগ্রামিক পরাক্রম কিছুমাত্র অবগত নহে। হে পার্থ! এক দুর্য্যোধনের কথা দূরে থাকুক, সমুদায় সুর অসুর ও মানবগণ একত্র হইলেও তোমাকে পরাজয় করিতে সমর্থ হন না। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ভাগ্যক্রমে আজি তোমার রথ সমীপে উপস্থিত হইয়াছে। অতএব পুরন্দর যেমন বৃত্রাসুরকে বিনাশ করিয়াছিলেন, সেইরূপ তুমিও ইহারে বিনাশ কর। ঐ পাপাত্মা নিরন্তর তোমার
অনিষ্ট চেষ্টা, শঠতাপূর্ব্বক দ্যূতক্রীড়ায় ধর্ম্মরাজকে বঞ্চনা এবং সতত তোমাদিগের প্রতি ভূরি ভূরি নৃশংস ব্যবহার করিয়াছে। অতএব তুমি কোন বিচার না করিয়া ঐ পাপপরায়ণ নৃশংসকে সংহার কর। হে অর্জ্জুন! শঠতা সহকারে রাজ্যপহরণ, বনবাস ও দ্রৌপদীর সেই সকল ক্লেশ স্মরণ করিয়া সংগ্রামে পরাক্রম প্রকাশ তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। আজি দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন সৌভাগ্যক্রমে তোমার কার্য্য ব্যাঘাত করিবার চেষ্টায় তোমার সহিত যুদ্ধ করিতে বাসনা করিয়া তোমার বাণপথের পথবর্তী হইয়া বিচরণ করিতেছে। আজি দৈবক্রমে তোমাদিগের মনোরথ সকল সফল হইল। অতএব হে পার্থ! পূৰ্ব্ব কালে দেবাসুর যুদ্ধে যেমন দেবরাজ ইন্দ্র জম্ভাসুরকে বিনাশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আজি তুমি কুরুকুল কলঙ্কভূত ধৃতরাষ্ট্র তনয়কে নিপাত করিয়া দুরাত্মাদিগের মূল ছেদন ও শত্রুতার শেষ কর। ঐ দুরাত্মার নিধনে উহার সৈন্য সকল অনাথ হইলে তুমি অনায়াসে তাহাদিগকে বিনাশ করিতে পারিবে।”
অর্জ্জুনের দুর্য্যোধনাভিমুখে গমন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাত্মা কেশব এই কথা বলিলে অর্জ্জুন তাঁহার বাক্য স্বীকার করিয়া কহিলেন, হে বাসুদেব! তুমি যাহা কহিলে ইহা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। অতএব অন্যান্য কাৰ্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক যেস্থানে দুৰ্য্যোধন অবস্থিতি করিতেছে, অবিলম্বে সেই স্থানে গমন কর। হে মাধব! যে দুরাত্মা এত দীর্ঘকাল অকণ্টকে আমাদিগের রাজ্য ভোগ করিয়াছে, আজি কি রণস্থলে পরাক্রম প্রকাশ পূর্ব্বক তাহার মস্তক ছেদন করিয়া সেই দুঃখভোগে অযোগ্য দ্রৌপদীকে কেশাকর্ষণ দুঃখ হইতে পরিত্রাণ করিতে সমর্থ হইব?”
হে মহারাজ! কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন পরস্পর এইরূপ বলিতে বলিতে দুৰ্য্যোধনকে আক্রমণ করিবার মানসে পরমানন্দে সংগ্রাম স্থলে শ্বেতাশ্ব সমুদায় সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। তখন আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন তাঁহাদিগের নিকটে উপস্থিত হইয়া সেই দারুণ ভয়াবহ সময়ে কিছুমাত্র শঙ্কিত হইলেন না; প্রত্যুত অগ্রসর হইয়া অর্জ্জুন ও হৃষীকেশকে নিবারণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তদ্দর্শনে সকল ক্ষত্রিয়েরাই তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ মধ্যে সিংহনাদ সমুত্থিত হইল। তখন আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন অর্জ্জুনকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। শত্রুতাপন কুন্তিনন্দন দুৰ্য্যোধন কর্ত্তৃক নিবারিত হইয়া ক্রোধে একান্ত অধীর হইলেন। দুৰ্য্যোধনও তাঁহার উপর যার পর নাই ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। ভীষণরূপধারী ভূপতিগণ চতুর্দ্দিক হইতে সেই পরস্পরের প্রতি ক্রুদ্ধ দুৰ্য্যোধন ও ধনঞ্জয়কে অবলোকন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর দুৰ্য্যোধন বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া হাস্য করত যুদ্ধার্থ তাঁহাদিগকে আহ্বান করিলেন। কেশব ও ধনঞ্জয় দুর্য্যোধনের আহবানে একান্ত হৃষ্টচিত্ত হইয়া সিংহনাদ করিয়া শঙ্খবাদন করিতে লাগিলেন। কৌরবগণ সেই বীরদ্বয়কে আহ্লাদিত দেখিয়া এককালে দুর্য্যোধনের জীবিতাশা পরিত্যাগ করিলেন এবং তাঁহাকে অগ্নিমুখে আহুত স্থির করিয়া নিতান্ত শোকাৰ্ত্ত হইলেন। কৌরবপক্ষীয় যোধগণ ভয়ে কাতর হইয়া ‘রাজা হত হইলেন, রাজা হত হইলেন’, এই বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন স্বপক্ষীয় সৈন্যগণের আর্ত্তনাদ শ্রবণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে বীরগণ! তোমরা ভয় পরিত্যাগ কর, আমি এখনই কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে যমরাজের রাজধানীতে প্রেরণ করিব।” কুরুরাজ সৈনিক পুরুষদিগকে এইরূপে আশ্বাস প্রদান করিয়া ক্রোধভরে অর্জ্জুনকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, হে পার্থ! যদি তুমি পাণ্ডুরাজের ঔরসে জন্ম পরিগ্রহ করিয়া থাক, তাহা হইলে দিব্য পার্থিব প্রভৃতি যে সকল অস্ত্র শিক্ষা করিয়াছ তৎসমুদায় আমাকে প্রদর্শন কর, কেশবের যতদুর ক্ষমতা আছে, উনি তাহা প্রকাশ করুন। হে ধনঞ্জয়! তুমি আমার পরোক্ষে যে যে কাৰ্য্য করিয়াছ, আজি আমার প্রত্যক্ষে সেই সমুদায় প্রকাশ কর”।”