ষট্পঞ্চাশত্তম অধ্যায়
নাগকুলরক্ষার্থ বরপ্রার্থনা
জনমেজয় কহিলেন, “ইনি বালক, কিন্তু ইঁহার যেরূপ অভিজ্ঞতা দেখিতেছি, তাহাতে বালক বলিয়া কোনক্রমে প্রতীতি হয় না। যাহা হউক, আমি ইঁহার অভিলষিত বর প্রদান করিতে ইচ্ছা করি, হে দ্বিজগণ! আপনাদিগের কি অনুমতি হয়?’ সদস্যগণ কহিলেন, ‘মহারাজ! ব্রাহ্মণ বালক হইলেও রাজাদিগের পূজনীয়, সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ ইনি সর্ব্বশাস্ত্রে মহামহোপাঁধ্যায়, অতএব তক্ষক ব্যতিরেকে আর যাহা প্রার্থনা করিবেন, তাহাই পাইতে পারেন।” অনন্তর রাজা ব্রাহ্মণকে বর-প্রদান করিতে উদ্যত হইলে হোতা কিঞ্চিৎ অসন্তোষ প্রকাশপূর্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন, “মহারাজ! তক্ষক অদ্যাপিও এই যজ্ঞাঙ্গনে উপস্থিত হইল না।” তখন জনমেজয় কহিলেন, “যাহাতে আমার ক্রিয়া সুসম্পন্ন হয় এবং সেই বিষম শত্রু তক্ষক শীঘ্র সমুপস্থিত হয়, তদ্বিষয়ে আপনারা যথাসাধ্য যত্নবান হউন।” ঋত্বিক্গণ উত্তর কহিলেন, “আমরা শাস্ত্রপ্রভাবে ও অগ্নির মাহাত্ম্যে জানিতে পারিয়াছি, তক্ষক ইন্দ্রের শরণাগত হইয়া তথায় অবস্থিতি করিতেছে।” পৌরাণিক মহাত্মা লোহিতাক্ষ সূতও এই কথা কহিয়াছিলেন। রাজা তৎশ্রবণে সূতকে জিজ্ঞাসা করিলেন। তিনি কহিলেন, “রাজন্! ঋত্বিকেরা যাহা কহিতেছেন, তদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমি পুরাণে অবগত হইয়াছি যে, তক্ষক প্রাণভয়ে ভীত হইয়া দেবরাজের শরণাগত হইয়াছে। সুররাজ এই বলিয়া তাহাকে অভয় প্রদান করিয়াছেন, “তুমি অতি গোপনে আমার ভবনে বাস কর, অগ্নি তোমাকে দগ্ধ করিতে পারিবেন না”। রাজা সূতবাক্য-শ্রবণে অত্যন্ত বিষণ্ণ হইয়া হোতাকে নিবেদন করিলেন, “মহাশয়! আপনি ইন্দ্রের আরাধনা করুন।” হোতা তদনুসারে দেবরাজের আরাধনা আরম্ভ করিলে, অমরেন্দ্র বিমানে আরোহণ করিয়া তৎক্ষণাৎ অমরনগরী হইতে যাত্রা করিলেন। চতুর্দ্দিকে দেবতারা স্তুতিপাঠ করিতে লাগিলেন। মেঘমালা, বিদ্যাধরগণ ও অপ্সরাগণ তাঁহার অনুগমন করিল। তক্ষক প্রাণভয়ে ভীত ও সঙ্কুচিত হইয়া দেবরাজের উত্তরীয়বস্ত্রে লুক্কায়িত হইল। এদিকে রাজা ক্রুদ্ধ হইয়া আজ্ঞা করিলেন, “যদি সেই দুরাত্মা তক্ষক ইন্দ্রের নিকট পলায়ন করিয়া লুক্কায়িত থাকে, তবে ইন্দ্রের সহিত তাহাকে অগ্নিসাৎ কর।” হোতা রাজাজ্ঞা পাইয়া তক্ষককে উল্লেখ করিয়া অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিবামাত্র নাগেন্দ্র কম্পিত-কলেবর হইয়া ইন্দ্র সমভিব্যাহারে আকাশ-পথে উপস্থিত হইলেন। ইন্দ্র সেই যজ্ঞের আড়ম্বর দর্শনে ভীত হইয়া তক্ষককে পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। তখন ভয়বিহ্বল তক্ষক ঋত্বিকগণের মন্ত্রপ্রভাবে অবশেন্দ্রিয় হইয়া ক্রমে ক্রমে প্রজ্বলিত পাবক-শিখার সমীপবর্ত্তী হইল।
ঋত্বিকেরা তক্ষককে সমাগত দেখিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আর চিন্তা নাই, তক্ষক আপনার বশংবদ হইয়াছে। বোধ হয়, ইন্দ্র উহাকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। ঐ দেখুন, সেই পন্নগেন্দ্র আমাদিগের মন্ত্রপ্রভাবে বিকলেন্দ্রিয় ও বিচেতনপ্রায় হইয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে আর্ত্তনাদ করিতে করিতে ঘুর্ণিতকলেবরে স্বর্গ হইতে আকাশপথে আগমন করিতেছে। অতএব আপনার অভীষ্টসিদ্ধির আর বিলম্ব নাই। এক্ষণে দ্বিজবরে বর প্রদান করুন।” রাজা প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, “হে ব্রাহ্মণকুমার! অভিলষিত বর প্রার্থনা কর। প্রার্থিত বিষয় অদেয় হইলেও আমি তাহাতে পরাঙ্মুখ হইব না।”
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, হে ব্রহ্মন্! তক্ষকের অনলে পতিত হইবার অব্যবহিতপূর্ব্বেই আস্তীক কহিলেন, “হে নরেন্দ্র! যদ্যপি আমাকে বর প্রদান করেন, তবে এই বর দিন যে, আপনার এই যজ্ঞ নিবৃত্ত হউক এবং ইহাতে যেন আর সর্পেরা দগ্ধ না হয়।” ইহা শ্রবণ করিয়া রাজা জনমেজয় অনতিহৃষ্টমনে প্রত্যুত্তর করিলেন, “আপনি সুবর্ণ, রজত, গো প্রভৃতি যে-কোন বস্ত্র প্রার্থনা করিলেন, আমি অবিলম্বে প্রদান করিতেছি, কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠানে নিবৃত্ত হইতে পারিব না।” আস্তীক কহিলেন, “মহারাজ! আমি সুবর্ণ, রজত, গো-অশ্বাদির নিমিত্ত আপনার নিকট আসি নাই! মাতুলকুলের হিতার্থে আপনার নিকট অর্থিভাবে [যাচক] আসিয়াছি। অতএব যদি সেই অভিলষিত অর্থসাধনে কৃতকার্য্য হইতে না পারিলাম, তবে রজতসুবর্ণাদি লইয়া কি করিব?” আস্তীকের এইরূপ অতর্কিতচর [অচিন্তিতপূর্ব্ব—অভাবনীয়] বর-প্রার্থনায় রাজা বিষাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন এবং বরান্তর দিবার নিমিত্ত পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাঁহাকে ব্যবসায় [সঙ্কল্প] হইতে বিচলিত করিতে পারিলেন না। তদনন্তর বেদজ্ঞ সদস্যেরা একবাক্যে কহিলেন, “মহারাজ! পূর্ব্বে অঙ্গীকার করিয়াছেন, অতএব বর প্রদান করা আপনার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।”