৪৫তম অধ্যায়
শুক্ররূপী ব্ৰহ্মার বিবরণ
সনৎসুজাত কহিলেন, “মহারাজ! জ্যোতিস্মাত্র দীপ্তিশীল মহাযশনামক যে শুক্র [রবি আদি গ্ৰহগণের অন্যতম জ্যোতিষ্ক পদার্থ অর্থে এবং শরীরবিষয়ক মজ্জাদি ধারার অন্যতম ধাতু-অর্থে শুক্র শব্দ ব্যবহৃত হইয়া থাকে। স্থূলাভিমানী ব্যক্তিগণ শুক্রের এইরূপই স্বরূপ নিরীক্ষণ করিয়া থাকেন। যোগীগণ যোগবলে তাঁহার ব্ৰহ্মস্বরূপত্ব প্রত্যক্ষ করেন। তাঁহারা দেখেন—(গ্রহপক্ষে) মূল কারণ শুক্র হইতে উদ্ভূত মায়াকর্ত্তৃক উপাধিপ্রাপ্ত সূৰ্য্য জগৎ প্রসব করেন। (ধাতৃপক্ষে) আনন্দস্বরূপ শুক্রই বীজরূপে জগৎ বিস্তার করেন। দেবাদি অখিল লোক শুক্রের যোগীপ্ৰত্যক্ষীভূত রূপেরই দর্শন ও স্তুতি করিয়া থাকেন; যোগীগণ প্রত্যক্ষ করেন যোগচক্ষু প্রভাবে; আর সেই যোগচক্ষুর জনক ব্ৰহ্মচৰ্য্য। তাই ধৃতরাষ্ট্র-সমীপে ব্ৰহ্মচর্য্যের বিবরণ কহিতে কহিতে সনৎসুজাত ব্ৰহ্মরূপী শুক্রের কথা অবতারণা করিয়াছেন।] আছেন, দেবগণ তাঁহার উপাসনা করেন এবং তাঁহা হইতে সূৰ্য্য বিরাজিত হইতেছেন; যোগীরা সেই সনাতন ভগবান শুক্রকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। ব্ৰহ্মা শুক্র হইতে উদ্ভূত এবং তাঁহা দ্বারাই পরিবর্দ্ধিত হয়েন। সূৰ্য্যাদি জ্যোতিঃপদার্থেরও ভয়প্ৰদ, অন্য দ্বারা অপ্রকাশিত সেই শুক্র গ্রহমণ্ডলীমধ্যে উত্তাপ প্ৰদান করিতেছেন। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। জীব ও ঈশ্বর উভয়েই হৃদয়াকাশে অবস্থান করিতেছেন; তন্মধ্যে একজন নির্ম্মায় [অমায়িক-কাৰ্য্যকারণ গুণহীন] ও সূৰ্য্যের সূৰ্য্য [প্রকাশক]। তিনি ভূলোক ও দ্যুলোক ধারণ করিয়া আছেন। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। ভগবান শুক্ৰ পৃথিবী, আকাশ, দিক-সমুদয়, ভুবন ও সেই দেবদ্বয়কে ধারণ করিতেছেন। তাহা হইতে নদীসকল প্রবাহিত ও মহাসাগরসমুদয় বিহিত হইয়াছে। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। ইন্দ্ৰিয়স্বরূপ অশ্বগণ কর্ম্মধান ও বিনাশী দেহরথে যোজিত হইয়া জীবকে সেই দিব্য অজর, অমর পরমাত্মাপদে প্রতিষ্ঠিত করে। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। তাঁহার রূপের সাদৃশ নাই, কেহ তাঁহাকে নয়নগোচর করিতে সমর্থ হয় না; কিন্তু যাহারা মন, বুদ্ধি ও হৃদয়দ্বারা অবগত হয়েন, তাঁহারাই মুক্তিলাভ করেন। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। জীবগণ চিত্ত, স্মরণ, শোত্ৰ, বাক, বচন, শব্দ, বিপদ, প্রাণ, শ্বসন, সংস্কার, সুকৃতসম্পন্ন চক্ষুরাদির অনুগ্রাহক দেবগণকর্ত্তৃক সুরক্ষিত অবিদ্যানদীর জল পান ও তাঁহাতে পুত্র, পত্নী প্রভৃতি মধুর ফল নিরীক্ষণপূর্ব্বক তৃপ্তিলাভ করিয়া সেই শুক্র নামক অধিষ্ঠানে পুনঃ পুনঃ আবর্ত্তিত হইয়া থাকে; যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন; যে জীব পরলোকে কর্মের অৰ্দ্ধফল উপভোগ করিয়া ইহলোকে অবশিষ্ট ফলভোগ করিবার নিমিত্ত অবতীর্ণ হইয়া থাকে এবং অন্তৰ্য্যামী হইয়া সর্ব্বভূতমধ্যে অবস্থান করে, সেই জীবনই যজ্ঞাদির প্রবর্ত্তক। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। চিদাত্মরূপ পক্ষী স্ত্রীপুত্রস্বরূপ পত্রবিশিষ্ট অবিদ্যা-কৃক্ষ আশ্রয় করিয়া পক্ষহীন নয়; অনন্তর তথায় পক্ষোদ্ভেদ হইলে স্বেচ্ছানুসারে নানাদিকে সঞ্চরণ করিয়া থাকে। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন।
“পূর্ণস্বরূপ পূর্ণকে উদ্ধার করেন, পূর্ণস্বরূপ পূর্ণস্বরূপকে নির্ম্মাণ করেন এবং পূর্ণস্বরূপ পূর্ণস্বরূপকে সংহার করেন, সুতরাং পরিশেষে একমাত্র পূর্ণই অবশিষ্ট থাকেন। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করেন। বায়ু তাঁহা হইতে উদ্ভূত হইয়া তাঁহাতেই বিলীন হইতেছে; অগ্নি, সোম ও প্রাণ তাঁহা হইতেই সঞ্জাত হইতেছে; ফলতঃ সমস্ত বস্তুই সেই পূর্ণ হইতে সমুদ্ভূত হইতেছে। হে মহারাজ! তিনি বাক্যের অগোচর। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সনদর্শন করিয়া থাকেন।
যোগীগণের পরমাত্মদর্শন প্ৰণালী
“অপান [*শরীরস্থ পঞ্চবায়ু-প্ৰাণ, অপান, সমান উদান, ব্যান। অপানবায়ুর অধিষ্ঠান গুহাদেশে, প্ৰাণবায়ুর অধিষ্ঠান হৃদয়ে। যোগীগণ এই পঞ্চবায়ু ক্রমশঃ উৰ্দ্ধদিকে উদগত করিয়া পরমাত্মায় লীন করিয়া থাকেন] প্রাণে [*], প্রাণ মনে, মন বুদ্ধিতে, বুদ্ধি পরমাত্মাতে বিলীন হইয়া থাকে। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করেন। যেমন হংস সময়ানুসারে একচরণ গোপণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ জাগ্ৰত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও তুরীয়াখ্য [চতুর্থ] পদচতুষ্টয়সম্পন্ন পরমাত্মা তুরীয়খ্য পাদ প্রকাশ না করিয়া কেবল পদত্রয়ে বিচরণ করেন। তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে মৃত ও অমৃত উভয়ই বিলুপ্ত হয়। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। অন্তরাত্মা অঙ্গুষ্ঠমাত্র পুরুষ; তিনি লিঙ্গশরীরযোগে নিত্য হইয়া থাকেন; কিন্তু মূঢ়েরা সেই সৰ্বকাৰ্য্যসমর্থ স্তবনীয়, মূলকরণ চৈতন্যস্বরূপ ঈশ্বরকে সন্দর্শন করিতে সমর্থ হয় না; কিন্তু যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। মনুষ্যেরা শমাদিবিহীন হউক বা তদযুক্তই হউক ঈশ্বরকে একরূপ দর্শন করিয়া থাকে; তাঁহার নিকট মৃত ও অমৃত উভয়েই তুল্য; কেবল মুক্ত ব্যক্তিরা মধুস্বরূপ ব্ৰহ্মকে লাভ করেন। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। বিদ্বান ব্যক্তি ব্ৰহ্মবিদ্যাপ্রভাবে সবিশেষ জ্ঞাত হইয়া উভয় লোকেই সঞ্চরণ করিতে সমর্থ হয়েন; তিনি তৎকালে অগ্নিহোত্ৰে আহুতি প্ৰদান না করিলেও তাহার ফল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। হে রাজন! আপনি ‘আমি দাস’ এরূপ বাক্য কদাচ প্রয়োগ করিবেন না; কারণ, ধ্যানপরায়ণ ব্যক্তিরা ব্রহ্মের স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েন। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। বাক্যমনের অগোচর, যোগিকগম্য, নির্ব্বিকার পরমাত্মা জীবকে আপনাতে নীল করেন; যে ব্যক্তি সেই পরমাত্মাকে অবগত হইয়াছেন, তাঁহার মোক্ষলাভ হইয়া থাকে। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। যিনি অনন্ত পক্ষ বিস্তার করিয়া থাকেন, যিনি অনন্ত পক্ষ বিস্তার করিয়া গমন করেন, যাহার বেগ মনোবেগ তুল্য, তিনিই হৃদয়স্থ পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হয়েন; যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন।
“সেই পরমাত্মার রূপ নয়নগোচর হয় না; কিন্তু বিশুদ্ধসত্ত্বসম্পন্না শুদ্ধচিত্ত ব্যক্তিরাই তাঁহাকে দর্শন করিয়া থাকেন। যিনি জগতের মিত্র ও ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহশীল হইয়া এবং পুত্ৰাদি-বিনাশেও শোকাকুল না হইয়া প্রব্রাজিত হয়েন, সেই মহাপুরুষই মুক্তিপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন। যোগীরা সেই মুক্তিদাতা সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। মনুষ্যেরা স্বীয় শিক্ষা ও চরিত্রদ্বারা আপনার পাপকর্ম্মসমুদয় গোপন করে; আর বিমূঢ় ব্যক্তিরা আপাতরমণীয় বিষয়ে বিমোহিত হয় এবং অন্যকেও সেই সমস্ত পাপকর্মে প্রবর্ত্তিত করিয়া থাকে; কিন্তু যোগীরা সর্ব্বদা সৎসংসৰ্গলাভের নিমিত্ত সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। আমি কোন কালে সুখদুঃখজরামরণাদিসম্পন্ন নহি। অতএব আমার জন্মমরণও নাই; সুতরাং মোক্ষলাভের অভিলাষ করি না। কারণ, সত্য, মিথ্যা, সৎ ও অসৎ সকলই একমাত্র ব্রহ্মে পৰ্য্যবসিত হইতেছে। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। মনুষ্যমণ্ডলীমধ্যে সৎকর্ম্ম ও অসৎকর্ম্মদ্বারা উৎকর্ষ বা অপকর্ষ নয়নগোচর হয়, কিন্তু চৈতন্যস্বরূপ পরব্রহ্মে তাহা কিছুই নাই; তিনি সেরূপ নহেন। অমৃতের সমান সর্ব্বদা সমভাবসম্পন্ন; পুণ্যপাপ কদাচ তাঁহাকে স্পর্শ করে না। হে মহারাজ! আপনি পূর্বোক্তরূপে ব্ৰহ্মপ্রাপ্তির অভিলাষ করুন। যোগীরা এই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। নিন্দা ব্ৰহ্মজ্ঞ ব্যক্তির হৃদয় পরিতপ্ত করিতে সমর্থ হয় না, অধ্যয়নে অমনোযোগ ও অগ্নিহোত্রের অনুষ্ঠান তাঁহার অন্তঃকরণ সন্তপ্ত করিতে পারে না। তিনি ব্রহ্মবিদ্যাপ্রভাবে অতি শীঘ্ৰ ধ্যান্যপরায়ণ পুরুষলভ্য প্রজ্ঞা লাভ করেন। যোগীরা সেই সনাতন ভগবানকে সন্দর্শন করিয়া থাকেন। যিনি সর্ব্বভূতমধ্যে আত্মাকে দর্শন করেন, তিনি অন্যকে বিষয়াসক্ত নিরীক্ষণ করিয়া কদাচ শোকাকুল হয়েন না; কিন্তু সেই বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরাই শোকাকুল হইয়া উঠে। যেমন পিপাসার্ত্ত ব্যক্তির জলাশয়ে ইষ্টসিদ্ধি হয়, তদ্রূপ আত্মজ্ঞ ব্যক্তির সমস্ত বেদমধ্যে ইষ্টসিদ্ধি হইয়া থাকে। অঙ্গুষ্ঠমাত্র হৃদ স্থিত আত্মা কাহারও দৃষ্টিগোচর হয়েন না; তিনি জন্মাদিশূন্য, অতীন্দ্রিত ও জগন্নিয়ন্তা। বিদ্বান ব্যক্তি তাঁহাকে জ্ঞাত হইয়া নির্ম্মল হয়েন।
“আমি মাতা, আমি পিতা, আমি পুত্র, আমি অতীত, অনাগত ও বর্ত্তমান সকলেরই আত্মা এবং আমিও বৃদ্ধ পিতামহ। তোমরা আমার আত্মাতে অবস্থান করিতেছ; কিন্তু আমার নও, আমিও তোমাদের নই। আত্মাই আমার অধিষ্ঠান এবং আত্মাই আমার জন্মস্থান। আমিও তপঃপ্রভাবে সর্ব্বত্র অবস্থান করিতেছি; আমি অজর, আমি দিবারাত্ৰ আলস্যশূন্য; পণ্ডিত ব্যক্তিরা আমাকে সন্দর্শন করিয়া, নির্ম্মল হইয়া থাকেন। ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে সূক্ষ্ম অপেক্ষা সূক্ষ্ম, সর্ব্বদর্শী, সকলের অন্তর্যামী, পিতা ও হৃৎপদ্মে অবস্থিত বলিয়া জ্ঞাত হয়েন।”
সনৎসুজাতপার্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত