১৪৮. জতুগৃহে অগ্নিসংযোগ, পাণ্ডবগণের পলায়ণ

১৪৮. জতুগৃহে অগ্নিসংযোগ, পাণ্ডবগণের পলায়ণ

অষ্টচত্বারিংশদধিকশততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,—পাণ্ডবগণের বারণাবত নগরে সম্বৎসর পূর্ণ হইলে দুর্মতি পুরোচন তাহাদিগকে একান্ত বিশ্বস্ত জ্ঞান করিয়া মনে মনে পরম সন্তুষ্ট হইল। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির তাহাকে পরিতুষ্ট দেখিয়া স্বীয় ভ্রাতৃচতুষ্টয়কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, হে ভ্রাতৃগণ! পাপাত্মা পুরোচন আমাদিগকে বিশ্বস্ত জ্ঞান করিয়াছে; আমরা কপট ব্যবহার দ্বারা দুরাত্মাকে বঞ্চিত করিয়াছি; সম্প্রতি আমাদের পলায়নের সময় উপস্থিত হইয়াছে; অদ্য আয়ুধাগারে অগ্নি প্রদানপূর্বক পুরোচনকে ভস্মসাৎ, করিয়া ছয় জনকে এখানে রাখিয়া অলক্ষিতরূপে পলায়ন করিব।

বৈশম্পায়ন কহিলেন,—যে দিন যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণের সহিত এই পরামর্শ করেন, সেই দিবস রাত্রিকালে ভোজরাজনন্দিনী দানপ্রসঙ্গে ব্রাহ্মণদিগকে ভোজন করান, স্ত্রীলোকেরাও তথায় উপস্থিত হয়। তাহারা ইতস্ততঃ বিচরণপূর্বক অভিমত পনি ভোজন সমাধান করিয়া কুন্তীর নিকটে বিদায় লইয়া স্ব স্ব নিকেতনে প্রতিগমন করিল। ক্ষুধাতুরা এক নিষাদী কালপ্রেরিত হইয়া জয়লাভ প্রত্যাশায় পঞ্চপুত্র সমভিব্যাহারে তথায় উপস্থিত হইয়াছিল। কুন্তীভোজদুহিতা দয়ার্দচিতে উত্তমরূপে তাহাদিগকে পান-ভোজন করাইলেন। নিষাদী পুত্রগণ সমভিব্যাহারে প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করিয়া হতজ্ঞান ও মৃতকল্প হইয়া সেই স্থানেই অবস্থান করিল। এদিকে ক্রমে রজনী অধিক হইল; নগরস্থ সমস্ত লোক নিদ্রায় অভিভূত’; তৎকালে ভগবান সমীরণ নিরপরাধ পাণ্ডবগণের প্রতি সদয় হইয়াই যেন তাহাদের সাহায্য করিবার মানসে প্রবলবেগে বহিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন উত্তম সুযোগ বুঝিতে পারিয়া অগ্রে পুরোচনের গৃহে, পরে জতুগৃহের দ্বারে, তৎপরে সেই বাটীর চতুর্দিকে অগ্নি প্রদান করিয়া যখন বুঝিতে পারিলেন যে, অগ্নি সৰ্বতঃ প্রদীপ্ত হইয়াছে, তখন ভ্রাতৃগণ ও মাতার সহিত খনকনির্মিত গর্তমধ্যে প্রবেশ করিলেন। জুমে অগ্নির উত্তাপ ও শব্দ প্রবল হইয়া উঠিল। হুতাশনের উগ্রতাপ ও কঠোর শব্দপ্রভাবে পৌরগণ জাগরিত হইল। তাহারা পাণ্ডবগণের আবাস দগ্ধ হইতেছে দেখিয়া সাতিশয় দুঃখিত হইয়া পরস্পর কহিতে লাগিল, দেখ! দুরাত্মা পুরেচন পাণ্ডবদ্বেষী কুরুকুলকলঙ্ক পাপাত্মা দুর্যোধনের আদেশানুসারে নিরপরাধ বিশ্বস্ত সমাতৃক পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করিবার মানসে এই গৃহ নির্মাণ করিয়াছিল; এক্ষণে ইহাতে অগ্নি প্রদান করিয়া স্বীয় মনস্কামনা সিদ্ধ করিল। ধর্মের কি অনির্বচনীয় মহিমা! দুরাত্মা আপনিও এই প্রদীপ্ত হুতাশনে দগ্ধ হইয়াছে, পাপাত্মা ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, উহার কি দুৰ্ব্বদ্ধি! ঐ দুরাত্মা পরমাত্মীয় স্বীয় ভ্রাতুস্পুত্র। গণকে শত্রুর ন্যায় অনায়াসে দগ্ধ করাইল। বারণবিতনগরস্থ লোকগণ দহমান জতুগৃহের চতুর্দিক পরিবেষ্টন করিয়া এইরূপে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিল।

এদিকে মাতৃসমবেত পাণ্ডবেরা গর্ত দিয়া অতিকষ্টে বহির্গত হইয়া দ্রুতবেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। একে রজনীজাগরণ, তাহাতে আবার গৃহদাহভয়; ভীম ব্যতীত সকলেই দ্রুতগমনে অশক্ত হইয়া পদে পদে স্খলিত হইতে লাগিলেন। তখন মহাপরাক্রান্ত বৃকোদর মাতাকে স্কন্ধদেশে, নকুল ও সহদেবকে ক্রোড়ে করিয়া লইলেন এবং যুধিষ্ঠির ও অর্জুনকে হস্তদ্বয়ে মরিয়া বায়ুবেগে গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহার বক্ষের আঘাতে বনরাজি ও তরুণ ভগ্ন ও পদারাতে ধরাতল বিদীর্ণ হইতে লাগিল।