১৩৫. দ্রোণের মুখে অর্জুনের পরিচয়, অর্জুনের অস্ত্রকৌশল প্রদর্শন

১৩৫. দ্রোণের মুখে অর্জুনের পরিচয়, অর্জুনের অস্ত্রকৌশল প্রদর্শন

পঞ্চত্রিংশদধিক শততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! দুৰ্য্যোধন ও ভীমসেন উভয়ে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করিলে উভয়পক্ষীয় দর্শকমণ্ডলী দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া দণ্ডায়মান হইল। তৎপরে দর্শকের হা বীর কুরুরাজ! হা ভীম! এই বলিয়া মহান কোলাহল করিতে লাগিল। ধীমান দ্রোণ সেই রঙ্গস্থল তরঙ্গসঙ্কুল সাগরের ন্যায় অবলোকন করিয়া প্রিয়পুত্র অশ্বত্থামাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস! মহাবীৰ্য্য ও সুশিক্ষিত বীরদ্বয়কে গদাযুদ্ধ হইতে নিবারণ কর; দেখিও, যেন ভীম ও দুৰ্য্যোধনের ক্রোধ উদ্রেক না হয়। অশ্বথামা পিতার অনুমতি পাইকমাত্র মহাবেগে ও যুগান্তানিলসংক্ষুব্ধ, অম্ভোনিধির ন্যায় গদাযুদ্ধোদ্যত বীরদ্বয়কে তৎক্ষণাৎ নিরস্ত করিলেন। তৎপরে দ্রোণাচাৰ্য রঙ্গপ্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান হইয়া মহামেঘনির্ঘোষ সদৃশ বাদ্যধ্বনি নিবারণপূর্বক কহিলেন, মদীয় শিষ্য অর্জুন আমার পুত্র হইতেও প্রিয়তর, সর্বশস্ত্রবিশারদ ও উপেন্দ্রতুল্য মহাবীর; হে দর্শকগণ! তোমরা ইহাকে দর্শন কর। তখন অৰ্জন আচার্যের আদেশক্রমে গোধালতার অঙ্গুলিত্রাণ ও কাঞ্চনময় কবচ ধারণপূর্বক ধনুর্বাণ হস্তে করিয়া সূৰ্যসন্নিহিত ইন্দ্রায়ুধালঙ্কত, সন্ধ্যাকালীন মেঘের ন্যায় রঙ্গমধ্যে পরিদৃশ্যমান হইলেন; তদ্দর্শনে রঙ্গস্থ লোকের চিত্ত প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। এই অবসরে চতুর্দিকে শঙ্খধ্বনি ও বাদ্যোদ্যম হইতে লাগিল। অনন্তর ‘ইনি শ্ৰীমান্ কুন্তীনন্দন’ ‘ইনি পাণ্ডবদিগের তৃতীয়’ ‘ইনিই দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র’ ‘ইনিই কৌরবগণের অক্ষক’ ‘ইনি অস্ত্রবোদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’ ‘ইনি পরম ধাৰ্মিক’ ‘ইনি অতিশয় সুশীল’ দর্শকগণকৃত এইরূপ প্রশংসাবাদ রঙ্গমধ্যে সর্বত্রই শ্রুত হইতে লাগিল। পুত্রের প্রশংসা শুনিয়া সবাষ্পস্তন্যদ্বারা পুত্রবৎসলা কুন্তীর উরস্থল সিক্ত হইতে লাগিল।

রঙ্গভূমির সেই সকল শব্দ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের শ্রবণগগাচর হইলে তিনি হৃষ্টমনে বিন্দুরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হে বিহুর! উচ্ছলিত মহাসাগরের ন্যায় এই তুমুল কোলাহল কি নিমিত্ত সহসা রঙ্গভূমি হইতে উত্থিত হইয়া নভোমণ্ডল বিদীর্ণ করিতেছে? বিদুর কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডুনন্দন অর্জুন সাংগ্রামিকবেশে রঙ্গস্থলে অবতীর্ণ হইলে লোকে তাহার ভূয়সী প্রশংসা করিতেছে, এই কারণে এতাদৃশ কোলাহল উত্থিত হইল। তখন ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে বিদুর! আমি কুন্তীগৰ্ভসস্তৃত পাণ্ডবয় দ্বারা ধন্য, অনুগৃহীত ও রক্ষিত হইলাম।

অনন্তর সেই কোলাহল নিবৃত্ত ও রঙ্গস্থ লোক সকল সন্তুষ্ট হইলে মহাবীর অর্জুন আচাৰ্য দ্রোণসন্নিধানে আপনার অস্ত্রকৌশল প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। প্রথমতঃ আগ্নেয়াস্ত্র পরিত্যাগপূর্বক অগ্নি সৃষ্টি করিয়া বারুণাস্ত্র প্রয়োগপূর্বক জল সৃষ্টি করিলেন। তৎপরে বায়ব্যাস্ত্র দ্বারা বাত্যা উথাপিত করিয়া পার্ল্ডন্যাস্ত্র দ্বারা নভোমণ্ডলে মেঘ সৃষ্টি করিলেন। ভৌমাস্ত্র দ্বারা ভূগর্ভে প্রবেশ করিয়া পার্বতাস্ত্র দ্বারা পৰ্বত সৃষ্টি করিলেন। অন্তৰ্দ্ধাস্ত্র দ্বারা অন্তর্হিত হইলেন। তৎপরে শিক্ষাকৌশলে কখন দীর্ঘ, কখন হ্রস্ব, কখন রথসম্মুখে, কখন থমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন এবং অবিলম্বেই ভূতলে অবতীর্ণ হইলেন। অনন্তর গুপ্রিয় অর্জন বিবিধ বাণদ্বারা সুকুমার, স্থূল ও সূক্ষ্ণ লক্ষ্যসকল অনায়াসে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তিনি অষণশীল লৌহময় বরাহের মুখে এককালে অসঙ্কীর্ণরূপে পঞ্চ শর এক শরের স্থা নিক্ষেপ করিলেন। তৎপরে কেশমত্ব রক্ষুদ্বারা লম্বিত গোণিকোষে একবিংশতি বাণ বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে অসিচৰ্য্যা, ধনু ও গদাশিক্ষায় আপনার বিবিধ কৌশল প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

এই অদ্ভুত ব্যাপার সমাধানান্তে অধিকাংশ লোক সমাজ হইতে নির্গত ও বাদ্যকোলাহল নিস্তব্ধায় হইল। এই অবসয়ে বজ্রনির্ঘোষসদৃশ বাহ্বাস্ফোটন দ্বারদেশ হইতে উত্থিত ও শ্রুত হইতে লাগিল, ঐ শব্দ কর্ণগোচর করিয়া রঙ্গস্থ লোকেরা, ইহা কি বিদীর্ণ পর্বতের? না দলিত ভূতলের? বা মেঘাচ্ছন্ন নভোমণ্ডলের ঘৈার রব শ্রুত হইতেছে, এইরূপ অনুমান করিয়া সত্বর সকলেই জ্বরদেশাভিমুখে গমন করিল। দুৰ্য্যোধন গদামাত্ৰসহায় ও ভ্রাতৃশত দ্বারা পরিবৃত হইয়া, পূর্বকালে অসুরসংগ্রামে দেবগণ কর্তৃক পরিবেষ্টিত দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় শোভমান হইলেন। সেই সময়ে পঞ্চতারাগ্রথিত হস্তাসংযুক্ত চন্দ্রের ন্যায় পঞ্চপাণ্ডবপরিবৃত দ্রোণাচাৰ্য দীপ্তি পাইতে ছিলেন। তিনি অশ্বথামা ও ভ্রাতৃশত সমভিব্যাহারে উত্থিত দুৰ্য্যোধনকে নিবারণ করিলেন।