১৩৪. কুমারগণের কৃত্রিম যুদ্ধ প্রদর্শন, রণক্ষেত্র নির্মাণ, যুদ্ধদর্শনার্থী জনতা, পরস্পর যুদ্ধারম্ভ

১৩৪. কুমারগণের কৃত্রিম যুদ্ধ প্রদর্শন, রণক্ষেত্র নির্মাণ, যুদ্ধদর্শনার্থী জনতা, পরস্পর যুদ্ধারম্ভ

চতুম্বিংশদধিক শততম অধ্যায়।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে ধৃতরাষ্ট্রাত্মজগণ ও পাণ্ডবেরা অস্ত্রশিক্ষা করিলে একদা দ্রোণ, কৃপ, সোমদত্ত, বাহ্লীক, ভীষ্ম, ব্যাস ও বিদুরের সন্নিধানে ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, মহারাজ! কুমারেরা সকলেই ধনুৰ্বেদে কৃতবিদ্য হইয়াছেন। অনুমতি হইলে আপন আপন অস্ত্রশিক্ষার পরিচয় দেয়। ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণবাক্যে পরম পরিতুষ্ট হইয়া কহিলেন, হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ ভারদ্বাজ! আপনি আমাদিগের এক মহৎ কর্ম সাধন করিলেন। মহাশয়। এ সময় অস্ত্রশিক্ষাদর্শনবিধায়িনী রঙ্গভূমি যে স্থানে যে প্রকারে নির্মাণ করা আবশ্যক বোধ করেন, তাহা আজ্ঞা করুন; কদাচ আপনকার অদেশের অন্যথা হইবে না। আজ আমার অন্ধনিবন্ধন নিৰ্ব্বেদের উদয় হইল। আমি অন্ধ, যাহা হউক, কুমারের যে সকল চক্ষুষ্মন্ ব্যক্তিদিগের সমক্ষে আপন আপন অস্ত্রশিক্ষার সবিশেষ পরিচয় প্রদান করিবে, আমি তাহাদের সান্নিধ্যলাভের একান্ত অভিলাষ করি। এই বুলিয়া মহারাজ ধৃত রাষ্ট্র সম্মুখােপবিষ্ট বিদুরকে কহিলেন, হে ধর্মবৎসল! আচাৰ্য দ্রোণ আমাদিগের মহোপকার সাধন করিয়াছেন। এক্ষণে যাহা আদেশ করেন, তুমি সত্বর হইয়া অবিলম্বে তাহা সম্পাদন কর। বিদুর রাজাজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া কৰ্তব্যানুষ্ঠানে প্রস্থান করিলেন; এদিকে প্রাজ্ঞবর দ্রোণাচাৰ্য্য সমতল ভূতলে রঙ্গভূমির সীমা পরিমাণ করিলেন। ঐ স্থান তরুগুল্মবিহীন, সুপরিচ্ছন্ন এবং স্থানে স্থানে প্রস্রবণ ও জলাশয়ে অতীব রমণীয় হইয়াছিল। আচার্য্য দ্রোণ শুভনক্ষত্রযোগসম্পন্ন তিথিবিশেষে বীরসমাজে ডিণ্ডিম প্রচার করত ঐ স্থলে পূজোপহার প্রদান করিলেন। রাজশিল্পীরা সেই রঙ্গভূমির মধ্যে শাস্ত্রানুসারে অস্ত্রশস্ত্র পরিপূর্ণ অতিবিস্তীর্ণ এক এক দর্শনাগার এবং স্ত্রীলোকদিগের অবলোকনার্থ সুরম্য গৃহ সকল নির্মাণ করিল। পুরবাসীরা তথায় অত্যুন্নত মঞ্চ ও মহামূল্য শিবিকা সকল প্রস্তুত ও সুসজ্জিত করিতে লাগিল।

অনন্তর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র নির্দিষ্ট দিন উপস্থিত হইলে মন্ত্রিগণসমভিব্যাহারে কৃপাচার্য ও ভীষ্মকে সম্মুখীন করিয়া মুক্তাজালে অলঙ্কত বৈদুৰ্যমণিশোভিত সুবর্ণময় রমণীয় দর্শনাগারে গমন করিলেন। মহাভাগা গান্ধারী, কুন্তী ও অন্যান্য রাজমহিষীরা সুপরিচ্ছন্ন পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া দাসীগণসমভিব্যাহারে হর্ষোৎফুল্ললোচনে তথায় গমন করিলেন। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় প্রভৃতি চাতুর্বর্ণ লোক রাজকুমারদিগের অস্ত্রশিক্ষাদর্শনার্থী হইয়া রাজধানী হইতে দ্রুতগমনে তথায় আগমন করিতে লাগিলেন। ক্ষণকালমধ্যে রঙ্গভূমিতে প্রবেশার্থী বহুতর দর্শকবর্গের সমাগম হইল; তৎপরে বাদ্যকরের মৃদুমধুর রবে বাদ্য করিয়া দর্শকমণ্ডলীর কৌতূহল উৎপাদন করিতে লাগিল। অভ্যাগত লোকের কোলাহলে সেই সমাজমন্দির উচ্ছলিত মহাসমুদ্রের ন্যায় বারম্বার প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। এই অবসরে শুক্লাম্বরধারী, শুক্লকেশ, শুরুষজ্ঞােপবীতসম্পন্ন, শুক্লশ্মশ্রু, শুক্লচন্দনানুলিপ্তকলেবর মহানুভব দ্রোণাচাৰ্য গলদেশে শুক্লমাল্য ধারণ করিয়া স্বপুত্র অশ্বত্থামার সহিত জলধরোপরোধশূন্য গগনে সভভৗম শশধরের ন্যায় রঙ্গমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং যথানিৰ্দিষ্ট সময়ে বলি প্রদান পূর্বক বিজ্ঞ ও মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণকর্তৃক মাঙ্গলিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করাইলেন। পুণ্যকর্ম সমাধানান্তে অনুচরেরা অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করিয়া রঙ্গমধ্যে প্রবেশ করিল।

অনন্তর মহাবীর্য্য মহারথ রাজপুত্রগণ অঙ্গুলিতে অঙ্গুলিত্র বন্ধনপূর্বক বন্ধুতুণ ও বদ্ধপরিকর হইয়া সর্বজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে অগ্রে করত হস্তে ধনুর্বাণ লইয়া জ্যেষ্ঠকনিষ্ঠক্রমে রঙ্গস্থলে প্রবেশ করিলেন। পরে অত্যাশ্চর্য অস্ত্রশস্ত্র সমুদায় নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। কেহ শরপতনভয়ে মস্তক অবনত করিতে লাগিল; কেহ বা অদ্ভুতবীর্য্য অর্জুনকে দেখিয়া অতিশয় বিস্মিত হইল। রাজকুমারেরা বেগবান্ তুরঙ্গনে আরোহণ করিয়া স্বনামাঙ্কিত কাঁণ দ্বারা লক্ষ্য ভেদ করিলেন। তখন দর্শকমণ্ডলী শবকাৰ্ম্ম কধারী অদ্ভুতরূপ কুমারসেনা সর্শন করিয়া বিস্ময়োৎফুল্ললোচনে শত সহস্র সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। মহাবল কুমারবল তৎকালে কার্ম্মুকদ্বারা অস্থিরলক্ষ্যপাত প্রভৃতি অত্যাশ্চর্য ব্যাপার সকল সমাধানপূর্বক রথে আরোহণ করিয়া রঙ্গমধ্যে বারস্বার মণ্ডলাকারে ভ্রমণ ও প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন; খড়গ, চর্ম গ্রহণপূর্বক কখন গজে, কখন বা অশ্বে অধিরূঢ় হইয়া বাহুযুদ্ধ সমাধানান্তে পরস্পর প্রহার করিতে লাগিলেন। তাঁহারা একমাত্র খড়দ্বারা কৌশলমে অনেকাস্ত্র নিবারণ করিলেন। নিরবচ্ছিন্ন ভ্রাম্যমান খড়ের অংশুমণ্ডল ইতস্ততঃ বিস্তীর্ণ হইয়া এক অপূর্ব শোভা ধারণ করিল। এইরূপ অসিচৰ্য্যায় বীরপুরুষদিগের নির্ভীরু প্রকাশ পাইল। তাঁহাদিগের হস্ত খড়গমুষ্টি হইতে একবারও স্বলিত হইল না; তাঁহারা অলিপ্রয়োগে বিলক্ষণ কুশলী ছিলেন। এই সমস্ত দেখিয়া। রঙ্গ লোকসমুদায় বিস্ময়াবেশ প্রকাশ করিতে লাগিল। অনন্তর মহাবল পরাক্রান্ত দুৰ্য্যোধন ও ভীম উভয়ে বদ্ধপরিকর হইয়া গদাহন্তে একশৃঙ্গ অত্যুন্তুঙ্গ শৈলের ন্যায় রঙ্গস্থলে অবতীর্ণ হইলেন। মদমত্ত কুঞ্জর যেমন করিশীর নিমিত্ত চীৎকার করিতে থাকে এবং নভোমণ্ডলে জলধর যেমন গভীর গর্জন করে, সেই উভয় বীরপুরুষ পৌরুষ প্রকাশার্থ রঙ্গমধ্যে তাদৃশ সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। তৎপরে তাঁহারা গদাহন্তে বামভাগ অবলম্বন করিয়া মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। বিদুর ও কুন্তী, ধৃতরাষ্ট্র ও রাজমহিষী গান্ধারীর সমিধানে রাজকুমারদিগের এই সমস্ত বৃতান্ত নিবেদন করিলেন।