১১৯. পাণ্ডুর নির্ব্বেদ। কুন্তী-মাদ্রীসহ পাণ্ডুর বানপ্রস্থ

ঊনবিংশত্যাধিকশততম অধ্যায়
পাণ্ডুর নির্ব্বেদ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পাণ্ডু স্বীয় বান্ধবের ন্যায় সেই মৃগরূপী তপোধনকে পরিত্যাগ করিয়া দুঃখিতচিত্তে ভার্য্যার সহিত নানাপ্রকার বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তাঁহার মনোমধ্যে উদয় হইল যে, যথেচ্ছাচারী দুরাত্মারা সদ্বংশে জন্মগ্রহণ করিলেও আপন কর্ম্মদোষে অশেষ দুর্গতি ভোগ করে। শুনিয়াছি, আমার পিতা পরম ধর্ম্মাত্মর ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনি নিতান্ত কামপরায়ণতাপ্রযুক্ত বাল্যকালেই কালগ্রাসে পতিত হইয়াছেন। বাচংযম [সংযতবাক–যিনি কখন মিথ্যা বলেন না] ভগবান্ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সেই কামাত্মা নরপতির ক্ষেত্রে আমাকেই উৎপাদন করিয়াছেন। হায়! সেই মহাত্মার পুৎত্র হইয়াও দুর্ব্বুদ্ধিক্রমে অতি গর্হিত মৃগয়া-ব্যসনের নিমিত্ত বনে বনে ভ্রমণ করিতেছি। সম্প্রতি ব্যাসপ্রণীত সুবৃত্তির অনুবর্ত্তী হইয়া মোক্ষধর্ম্ম আচরণ করিব, যেহেতু, সংসার-বন্ধন অপেক্ষা ক্লেশকর আর কিছু নাই। আমি অদ্যাবধি কঠোর তপস্যায় মনোনিবেশ করিব। ভার্য্যা ও অন্যান্য বন্ধুবান্ধবগণ পরিত্যাগ করিয়া একাকী আশ্রমে আশ্রমে পরিভ্রমণ করিব। ইষ্টানিষ্ট পরিত্যাগপূর্ব্বক ধূলিধূসরিতকলেবর হইয়া শূন্যগৃহে বা বৃক্ষমূলে শয়ন করিয়া থাকিব। কি শোক, কি হর্ষ, কিছুরই বশংবদ [বাধ্য] হইব না। নিন্দা ও প্রশংসা উভয়কেই সমান জ্ঞান করিব। কাহারও আশীর্ব্বাদ বা নমস্কার-গ্রহণেচ্ছু হইব না। সুখদুঃখের বশীভূত হইব না, কাহাকেও উপহাস বা ভ্রূকুটি প্রদর্শন করিব না। সর্ব্বদা প্রসন্নবদন ও সর্ব্বভূতের হিতকার্য্যে তৎপর থাকিব। কি স্থাবর, কি জঙ্গম, কাহারও হিংসা করিব না। সকল প্রাণিগণকে আপনার সন্তানের ন্যায় দেখিব। জীবনধারণের নিমিত্ত বৃক্ষ-সকলের নিকট ভিক্ষা চাইব। যদি তাহারা ভিক্ষা না দেয়, তবে এককালে পাঁচজন গৃহস্থের বাটীতে, ঊর্দ্ধসংখ্যা দশজনের গৃহে ভিক্ষা করিব। তাহাতে যাহা প্রাপ্ত হইবে, অতি অল্প হইলেও তদ্দারাই জীবনধারণ করিব। অধিক লাভের আশয়ে দশ গৃহের অধিক স্থলে ভিক্ষা করিব না। যে দিবস দশ গৃহে ভিক্ষা করিয়াও কিছুই পাইব না, সেদিন উপবাস করিয়া থাকিব। ক্ষতি ও লাভ সমান জ্ঞান করিব। বাষ্পবারি দ্বারা এক বাহু সিক্ত করিয়া অন্য বাহুতে চন্দন-লোপন করিব। কি মঙ্গল, কি অমঙ্গল কিছুই চিন্তা করিব না। কোন মাঙ্গলিক ক্রিয়ার আনুষ্ঠান করিব না। ধর্ম্মার্থলিপ্সা পরিত্যাগ করিব। সকল পাপ হইতে বিমুক্ত হইব। সমুদয় বন্ধন অতিক্রম করিব। কাহারও বশীভূত হইব না। স্বীয় অভিলাষ পূর্ণ করিবার নিমিত্ত নিস্তেজ লোকের মত কাহারও সেবা করিব না; কারণ, উপাসনা দ্বারা বশীভূত লোকের নিকট হইতে অতি সম্মানপূর্ব্বক স্বাভিলাষিত দ্রব্য লাভ করিলেও শ্ববৃত্তি [পরাধিনবৃত্তি–কুক্কুভবৃত্তি] অবলম্বন করা হয়। ফলতঃ এক্ষণে আমার এই স্থিরনিশ্চয় যে, অতি অকিঞ্চিৎকর অচিরস্থায়ী বিষয়ভোগসুখে এককালে জলাঞ্জলি প্রদানপূর্ব্বক মুক্তিপথ অবলম্বন ও মাসিক ভূমানন্দ অনুভব করিয়া চরমে নির্ব্বাণ লাভ করিবে।
পাণ্ডু সাতিশয় দুঃখিত-চিত্তে এই প্রকার বিলাপ করিয়া কুন্তী ও মাদ্রীর দিকে চাহিয়া কহিলেন, ”তোমরা হস্তিনানগরে গমনপূর্ব্বক কৌশল্যা, বিদুর, সবান্ধব রাজা ধৃতরাষ্ট্র, আর্য্যা সত্যবী, ভীষ্ম, রাজপুরোহিতগণ, সোমপায়ী শংসিতব্রত [কঠোর সংযমী] মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ ও অস্মদাশ্রিত পৌরবদিগকে অনুনয় করিয়া এই কথা কহিবে যে, পাণ্ডু রাজ্যাশ্রম পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছেন, আর গৃহে আসিবেন না।” স্বামীর বনবাসে একান্ত অভিলাষ জানিয়া কুন্তী ও মাদ্রী তৎকালোচিত বিনয়বচনে কহিলেন, ”মহারাজ! সন্ন্যাসশ্রম ব্যতীত অন্যান্য আশ্রম আছে, যাহাতে সস্ত্রীক হইয়াও ধর্ম্মাচরণ করিতে পারা যায়; আপনি তাহার মধ্যে কোন আশ্রম আশ্রয় করিয়া আমাদিগের সহিত তপস্যা করুন; পরিশেষে কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বর্গে গমন করায় তথায় আধিপত্য করিতে পারিবেন। আমরাও আপনার সহিত ইন্দ্রিয়গ্রাম-সংযমনপূর্ব্বক ভোগাভিলাষে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়া ভর্ত্তৃলোকপ্রাপ্তির আশয়ে কঠোর তপস্যা করিব। আর যদি আপনি তাহা না করিয়া নিতান্তই আমাদিগের পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে অদ্যই আমরা প্রাণপরিত্যাগ করিব সন্দেহ নাই।”

কুন্তী-মাদ্রীসহ পাণ্ডুর বানপ্রস্থ

পাণ্ডু কহিলেন, ”যদি তোমাদের আমার সঙ্গে বাস করিয়া তপস্যা করিতে নিতান্তই বাসনা হইয়া থাকে, তবে অদ্যাবধি গ্রাম্যসুখ পরিত্যাগ, বল্কলধারণ, ফলমূল ভক্ষণ, উভয় সন্ধায় হোম ও স্নান, চীর [জীর্ণবস্ত্র], চর্ম্ম [অজিন–মৃগচর্ম্ম বা ব্যাঘ্রচর্ম্ম] ও জটাধারণ, শীতবাতাতপক্লেশ সহ্য, ক্ষুৎপিপাসায় অনবধান, ইন্দ্রিয়সংযমন এবং বন্যফল, জল ও মন্ত্র দ্বারা দেবগণ ও পিতৃগণের তর্পণ করিয়া দুশ্চর তপোনুষ্ঠান দ্বারা শরীর শুষ্ক করিতে থাক। কি বানপ্রস্থগণ, কি আত্মীয়বান্ধবগণ, কি অন্যান্য গ্রামবাসিগণ, কাহারও সহিত সাক্ষাৎকার বা কাহারও কোন অপ্রিয়াচরণ করিবে না; এইরূপে কঠোর আরণ্যশাস্ত্র- বিধান অবলম্বনপূর্ব্বক যাবজ্জীবন কালযাপন করিবে।”
মহারাজ পাণ্ডু ভার্য্যাদ্বয়কে এই কথা বলিয়া চূড়ামণি, নিষ্ক, অঙ্গদ, কুণ্ডল, মহামূল্য বাসন ও স্ত্রীদিগের আভরণ প্রভৃতি সমুদয় দ্রব্য বিপ্রগণকে প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, “আপনারা হস্তিনাপুরে গমন করিয়া কহিবেন যে, পাণ্ডু বনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিয়াছেন, আর তথা হইতে প্রত্যাগমন করিবেন না।” তাঁহাদিগকে এই প্রকার আদেশ করিয়া নরপতি পাণ্ডু অর্থ, কাম, রতি, সুখ প্রভৃতি সমুদয় পরিত্যাগপূর্ব্বক পত্নীদ্বয় সমভিব্যাহারে লইয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। অনুচর ও পরিচারকগণ তাঁহার বিবিধ করুণবাক্যশ্রবণে সাতিশয় বিষণ্ণ হইয়া উচ্চৈঃস্বরে হাহাকার করিতে লাগিল। পরে তৎপ্রদত্ত সমুদয় ধনগ্রহণপূর্ব্বক অশ্রুপূর্ণ-নয়নে হস্তিনানগরে গমন করিয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে সমুদয় বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিল। ভূপতি ধৃতরাষ্ট্র তাহাদের মুখে পাণ্ডুর বনবাস-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া একান্ত বিষন্নমনাঃ হইয়া আহার, বিহার, শয়ন প্রভৃতি সমুদয় সুখ পরিত্যাগপূর্ব্বক দিনযামিনী কেবল চিন্তাসাগরে নিমগ্ন রহিলেন।
এদিকে মহীপতি পাণ্ডু কেবল বন্য ফল-মূলমাত্র আহার দ্বারা কথঞ্চিৎ জীবন-ধারণ করিয়া পত্নীদ্বয়-সমভিব্যাহারে নাগশত-নামা পর্ব্বতে উপস্থিত হইলেন। তৎপরে নাগশত হইতে চৈত্ররথ, তথা হইতে কালকূট, তথা হইতে হিমালয় ও হিমালয় হইতে গন্ধমাদন পর্ব্বতে গমন করিলেন। পাণ্ডু-নৃপতি মহাভূত, সিদ্ধ ও পরমর্ষিগণ কর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া সমবিষমস্থলে [সুগম-দুর্গম বা বন্ধুর–নতোন্নত-উচ্চনীচ–সমান-অসমান] বাসকরতঃ একস্থান হইতে স্থানান্তরে গমন করিতে লাগিলন। তদনন্তর তিনি গন্ধমাদন হইতে ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরে ও তথা হইতে হংসকূটে গমন করিলেন। পরে হংসকূট অতিক্রম করিয়া শতশৃঙ্গে গমনপূর্ব্বক তথায় অনন্যমনাঃ হইয়া তপস্যা করিতে লাগিলেন।