১১১. কুন্তীর প্রতি দুর্ব্বাসার বর । কুন্তী-গর্ভে কর্ণের জন্ম

একাদশাধিকশততম অধ্যায়
কুন্তীর প্রতি দুর্ব্বাসার বর

বৈশম্পয়ান কহিলেন, যদুবংশাবতংস শূরনামা নৃপতি বসুদেবের জনয়িতা [জনক−পিতা] ছিলেন। প্রথমে তাঁহার পৃথানাম্নী পরমরূপবতী তনয়া জন্মিয়াছিল। শূর অনপত্য পিতৃস্বসৃ-পুৎত্র কুন্তিভোজের নিকটে পূর্ব্বাবধি প্রতিজ্ঞারূঢ় ছিলেন যে, আমার প্রথম সন্ততি তোমাকে প্রদান করিব। এক্ষণে তদনুসারে নির্ম্মম[অপত্যস্নেহ সংযত করিয়া] হইয়া পরমমিত্র কুন্তিভোজকে সেই কন্যা প্রদান করিলেন। কুন্তিভোজ কন্যারত্ন লইয়া ঔরসবৎ [নিজসন্তানতুল্য] পরমযত্নে লালনপালন করিতে লাগিলেন। পৃথা পিতৃগৃহে দিনে দিনে দ্বিতীয় চন্দ্রকলার ন্যায় বৃদ্ধি পাইতে লাগিলেন; কুন্তিভোজের পালিত বলিয়া সকলে তাঁহাকে কুন্তী নামে আহ্বান করিত। কুন্তী কন্যকাবস্থায় ব্রাহ্মণসেবায় ও অতিথিপরিচর্য্যায় নিযুক্তা ছিলেন এবং সর্ব্বপ্রযত্ন-সহকারে পরিচর্য্যা দ্বারা অভ্যাগতদিগকে পরিতুষ্ট করিতেন। একদা ধার্ম্মিকাগ্রগণ্য মহাতেজস্বী, জিতেন্দ্রিয়, মহর্ষি দুর্ব্বাসা কুন্তিভোজের গৃহে আতিথ্যস্বীকার করিলেন। আতিথেয়ী [অতিথিসেবাকূশলা] কুন্তী ভক্তিযোগ-সহকারে ও পরম-সমাদরে তাঁহার সেবাবিধি নির্ব্বাহ করিলে, মহর্ষি পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে এক মহামন্ত্র প্রদান করিলেন এবং কহিয়া দিলেন, ”বৎসে! আমি তোমার সেবায় সন্তুষ্ট হইয়া তোমাকে এই মহামন্ত্র প্রদান করিলাম, তুমি ইহা পাঠ করিয়া যে যে দেবতাকে আহ্বান করিবে, তাঁহাদের প্রভাববলে তোমার গর্ভে এক এক পুৎত্র উৎপন্ন হইবে।”

কুন্তী-গর্ভে কর্ণের জন্ম

মুনিবর এই বলিয়া প্রস্থান করিলে পর কুন্তী বালস্বভাবসুলভ কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া মহর্ষি-দত্ত মন্ত্র দ্বারা সূর্য্যদেবতাকে আহ্বান করিলেন। মন্ত্রবলে অশেষ-ভুবনদ্বীপ-দীপক [সমস্ত জগৎ উদ্ভাসনকারী] ভগবান তৎক্ষণাৎ আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলেন এবং কহিলেন, ”সুন্দরি! তোমার অভিপ্রায়ানুসারে উপস্থিত হইয়াছি, কি করিতে হইবে, বল?” কুন্তী এই অদ্ভুদ ব্যাপার-দর্শনে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, ”ভগবান! এক ব্রাহ্মণ আমাকে বিদ্যা ও বরপ্রদান করিয়া যান, আমি তৎপরীক্ষা-বাসনায় আপনাকে আহ্বান করিয়া অতি মূঢ়ের কার্য্য করিয়াছি, আমার আপরাধ হইয়াছে, ভগবান! এক্ষণে চরণ ধরিয়া বিনয়পূর্ব্বক প্রার্থনা করিতেছি, কৃপাময়! কৃপা প্রকাশ করিয়া অপরাধ মার্জ্জনা করুন। স্ত্রীলোক সহস্র অপরাধে অপরাধনী হইলেও তাহাকে ক্ষমা করা মহতের কর্ত্তব্য কর্ম্ম।” সূর্য্যদেব কুন্তীর কাতরোক্তি শুনিয়া মধুরবচনে কহিলেন, ”সুন্দরি! মহর্ষি দুর্ব্বাসা তোমাকে যে বর ও বিদ্যা প্রদান করিয়া গিয়াছেন, আমি তৎসমস্ত অবগত আছি, তুমি ভীত হইও না, অসন্দিগ্ধচিত্তে আমার ভোগাভিলাষ পুর্ণ কর। দেখ শুভে! তুমি আমাকে আহ্বান করিয়াছ, আমি তাহাতেই আসিয়াছি, এক্ষণে আমার মনোরথ ব্যর্থ করা কোনক্রমেই উচিত নহে; আর যদি তুমি একান্তই অসম্মত হও, তাহা হইলে অবশ্যই দোষভাগিনী হইবে, সন্দেহ নাই।” সূর্য্যদেব এইরূপ নানা প্রকার বুঝাইলেও কুন্তী কন্যাবস্থা ও লজ্জাভয়ের অনুরোধ স্বীকার পাইলেন না। তখন সূর্য্যদেব পুনর্ব্বার কহিলেন, ”হে বরবর্ণিনি! তোমার কিছুমাত্র শঙ্কা নাই। আমি কহিতেছি, আমার প্রসাদবলে ইহাতে তোমার কোন দোষ হইবে না।” এই বলিয়া কুন্তীকে সম্মত করিয়া তাঁহার সহিত সহবাসে প্রবৃত্ত হইলেন। সূর্য্যদেবের সহযোগে কুন্তী গর্ভবতী হইলেন এবং সর্ব্বশাস্ত্রবেত্তা, কবচকুণ্ডলধারী, পরমরূপবান এক পুৎত্র-সন্তান প্রসব করিলেন। ঐ পুৎত্র ভুবনতলে কর্ণ নামে বিশ্রুত হইয়াছিল। ভগবান্ সূর্য্যদেব তুষ্ট হইয়া পুনর্ব্বার কুন্তীকে কন্যাত্ব প্রদান করিয়া অম্বরতলে [আকাশে] আরোহণ করিলেন। কুন্তী সদ্যজাত নবকুমার দর্শনে বিষণ্ণ মনে ভাবিতে লাগিলেন, ”এখন কি করি? এ বিষয় কি গোপন রাখিব, না প্রকাশ করিব? ” পরিশেষে বন্ধুজন ভয়ে আত্মদোষ গোপন করাই শ্রেয়ঃকল্প স্থির করিয়া সেই মহাবলপরাক্রান্ত সদ্যঃপ্রসুত কুমারকে লইয়া জলে নিক্ষেপ করিলেন। যশস্বী রাধাভর্ত্তাসেই নবকুমারকে জলে ভাসমান দেখিয়া দয়ার্দ্র-চিত্তে গৃহানয়নপূর্ব্বক পুৎত্রত্বে পরিগ্রহ করিলেন এবং ঐ কুমার বসু অর্থাৎ কবচকুণ্ডলরূপ ধনের সহিত জন্মিয়াছে বলিয়া উহার নাম বসুষেণ রাখিলেন। বসুষেণ ক্রমে ক্রমে প্রাপ্তবয়স্ক ও সর্ব্বাস্ত্রবিশারদ হইয়া উঠিলেন। তিনি প্রত্যহ প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত সূর্য্যের আরাধনা করিতেন; সেই সময়ে ব্রাহ্মণেরা তাঁহার নিকট যাহা প্রার্থনা করিতেন, অতি দুষ্প্রাপ্য হইলেও তিনি তৎপ্রদানে পরাঙ্মুখ হইতেন না। একদা দেবরাজ ইন্দ্র অর্জ্জুনের হিত-সাধনার্থে ব্রাহ্মণবেশধারণপুর্ব্বক তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার অঙ্গস্থ কবচ ভিক্ষা চাহিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ শরীর হইতে নৈসর্গিক কবচ মোচন করিয়া বিপ্ররূপধারী ইন্দ্রের হস্তে প্রদান করিলেন। সুরপতি কবচ গ্রহণ করিলেন বটে, কিন্তু এই অলৌকিক ব্যাপার দর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইলেন এবং তাঁহাকে প্রতিদানস্বরূপ এক শক্তিঅস্ত্র প্রদান করিয়া কহিলেন, ”বৎস! আমি তোমাকে অসাধারণকার্য্য-দর্শনে সন্তুষ্ট হইয়াছি, এই একপুরুষ-ঘাতিনী [অমোঘ-লক্ষ ব্যক্তির নিঃসংশয় নিহন্তা] শক্তি দিতেছি, গ্রহণ কর, ইহাতে তোমার বিশেষ উপকার দর্শিবে; কি সুর, কি অসুর, কি নর, কি বানর, কি গন্ধর্ব্ব, কি ভুজঙ্গ, কি রক্ষ, কি যক্ষ, যাহার প্রতি এই অস্ত্র নিক্ষেপ করিবে, তাহার আর নিস্তার নাই, সে অবশ্যই ইহাতে নিপাতিত হইবে।” এই বলিবা কবচ লইয়া অমররাজ অমরাবতী প্রস্থান করিলেন। বসুষেণ স্বীয় শরীর ভেদ করিয়া ইন্দ্রকে কবচ প্রদান করিলেন বলিবা তদবধি ক্ষিতিতলে কর্ণ ও বৈকর্ত্তন নামে বিখ্যাত হইলেন।