০৭৫.সাধারণ সৃষ্টিবর্ণন । যযাতিচরিত

পঞ্চসপ্ততিতম অধ্যায়
সাধারণ সৃষ্টিবর্ণন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে পুণ্যাত্মন্! মহারাজ দুষ্মন্ত ও পতিপরায়ণা শকুন্তলার উপাখ্যান কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে দক্ষ প্রজাপতি, বৈবস্বত মনু, ভরত, কুরু, পুরু, আজমীঢ়, যদু, কৌরব ও ভারত ইঁহাদিগের বংশ কীর্ত্তন করি শ্রবণ করুন। ইঁহারা সকলেই মহর্ষির ন্যায় তেজস্বী এবং ইঁহাদিগের বংশকীর্ত্তন অতি পবিত্র, আয়ুস্কর ও যশস্কর। প্রচেতার প্রথমতঃ দশ পুৎত্র জন্মে। তাঁহারা সকলেই রাক্ষস হইয়াছিলেন। ভগবান্ প্রচেতাঃ মুখনির্গত অগ্নি দ্বারা সেই মহাতেজস্বী রাক্ষসরূপী পুৎত্রগণকে দগ্ধ করেন। পরে প্রচেতার দক্ষ নামে অপর এক পুৎত্র জন্মেন। দক্ষ হইতে এই সমস্ত প্রজা-সৃষ্টি হইয়াছে। হে পুরুষসিংহ। এই কারণবশতঃ লোকে তাঁহাকে পিতামহ বলিয়া নির্দ্দেশ করে। দক্ষ বীরিণীর গর্ভে আত্মসদৃশ সহস্রসংখ্যক পুৎত্র উৎপাদন করেন। মহর্ষি নারদ সেই সহস্রসংখ্যক দক্ষ-সন্তানগণকে অত্যুৎকৃষ্ট সাঙ্খ্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করাইয়া মোক্ষোপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন। হে জনমেজয়! অনন্তর প্রজাসিসৃক্ষু [জনসৃষ্টিকামী] প্রজাপতি দক্ষ পঞ্চাশৎ কন্যা উৎপাদন করিলেন। তিনি তাঁহাদিগের সকলকেই পুৎত্রিকা করিয়া অন্মধ্যে দশটি ধর্ম্মকে, ত্রয়োদশটি কশ্যপকে ও সাতাইশটি চন্দ্রকে সম্প্রদান করেন। কশ্যপের ত্রয়োদশ পত্নীর মধ্যে দাক্ষায়ণী প্রধান ছিলেন। তাঁহার গর্ভে দ্বাদশ আদিত্য উৎপন্ন হয়েন। তৎপরে কশ্যপ হইতে ইন্দ্রাদি দেবতা ও বিবস্বান্ জন্মগ্রহণ করিলেন। বিবস্বানের দুই পুৎত্র;— বৈবস্বত মনু ও যম। ধীমান্ মনু হইতে ব্রাহ্মণ, ক্ষৎত্রিয় প্রভৃতি মানবজাতি উৎপন্ন হয়, এই নিমিত্ত তাঁহার মানব বলিয়া প্রখ্যাত হইয়াছেন। তন্মধ্যে ব্রাহ্মণেরা সাঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করিলেন। বেণ, ধৃষ্ট, নরিষ্যন্ত, নাভাগ, ইক্ষ্বাকু, কারুষ, শর্যাতি, ইলা, পৃষধ্রু এবং নাভাগারিষ্ট, মনুর এই দশ সন্তান ক্ষৎত্রিয়ধর্ম্মপরায়ণ হইলেন। মনুর আরও পঞ্চাশটি পুৎত্র জন্মে; কিন্তু আমরা শুনিয়াছি তাঁহারা পরস্পর বৈরভাব অবলম্বন করিয়া বিনষ্ট হয়েন। ইলা হইতে পুরূরবাঃ উৎপন্ন হইয়াছিলেন। ইলা তাঁহার পিতা ও মাতা উভয়ই ছিলেন। পুরূরবাঃ মনুষ্য-কলেবর ধারণ করিয়াও সর্ব্বদা দেবগণে বেষ্টিত থাকিতেন এবং সমুদ্রপরিবেষ্টিত ত্রয়োদশ দ্বীপের অধীশ্বর হইয়াছিলেন। তিনি বীর্য্যমদে মত্ত হইয়া বিপ্রবর্গের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাঁহাদিগের চিরসঞ্চিত বহুমূল্য রত্নসকল অপহরণ করিতেন। ব্রাহ্মণেরা তাঁহার উপর সমুচিত আক্রোশ প্রকাশ করিয়াও কিছুমাত্র প্রতীকার করিতে পারেন নাই। অনন্তর সনৎকুমার ব্রহ্মলোক হইতে উপস্থিত হইয়া পুরূরবাকে অনুদর্শ-যজ্ঞে দীক্ষিত করিলেন। কিন্তু তিনি তাহা স্বীকার করিলেন না। তৎপরে ক্রোধাবিষ্ট মহর্ষিগণের অভিশাপে সেই লোভপরতন্ত্র বলদৃপ্ত নরাধিপ সদ্যই বিনষ্টপ্রায় হইলেন। তিনি যজ্ঞাদিক্রিয়ানির্ব্বাহার্থ গন্ধর্ব্বলোক হইতে ত্রেতাগ্নি ও উর্ব্বশীকে আনয়ন করেন। ইলাপুৎত্র পুরূরবার ঊর্ব্বশীর গর্ভে আয়ু, ধীমান্, অমাবসু, দৃঢ়ায়ু, বনায়ু এবং শতায়ু এই ছয় পুৎত্র জন্মে। নহুষ, বৃর্দ্ধশর্ম্মা, রাজিঙ্গয় এবং অনেবস্ এই চারিটি আয়ুর ঔরসে ও স্বর্ভানবীর গর্ভে উৎপন্ন হয়েন। হে পৃথিবীপাল্! ধীমান্ সত্যপরাক্রম নহুষ রাজা ধর্ম্মানুসারে এই পৃথিবী পালন করিয়াছিলেন। নহুষ পিতৃলোক, দেবতা, ঋষি, গন্ধর্ব্ব, উরগ, রাক্ষস, ক্ষৎত্রিয় ও বৈশ্য এই সকলকে সমভাবে প্রতিপালন করিতেন। তিনি দস্যুদল এরূপ দমন করিয়াছিলেন যে, তাহারা ঋষিদিগকে কর প্রদান ও পৃষ্ঠে বহন করিত। তিনি স্বকীয় তেজঃপ্রভাবে ও তপোবলে দেবতাদিগকে পরাভব করিয়া ঋষিগণকে ইন্দ্রত্ব ভোগ করাইতেন। তিনি যতি, যযাতি, সংযাতি, আয়াতি, অয়তি ও ধ্রুব নামে ছয়টি পুৎত্র উৎপাদন করেন। তন্মধ্যে যতি যোগবলে মুনি হইয়া চরমকালে পরব্রহ্মে লীন হন। যযাতি স্বীয় বিক্রমপ্রভাবে সম্রাট হইয়া এই সসাগরা পৃথিবী শাসন, বহুবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান ও একান্ত ভক্তির সহিত পিতৃগণকে ও দেবতাগণকে অর্চ্চনা করিয়া সুতনির্ব্বিশেষে প্রজাপালন করিতেন।

যযাতিচরিত

হে মহারাজ! সত্যপরাক্রান্ত যযাতি সম্রাট ছিলেন। তিনি ধর্ম্মতঃ রাজ্যশাসন এবং প্রজাবর্গের প্রতি যথেষ্ট অনুগ্রহ প্রদর্শন করিতেন। মহারাজ যযাতি সর্ব্বদা যাগ-যজ্ঞ এবং ভক্তিপূর্ব্বক পিতৃগণ ও দেবগণের শুশ্রূষা করিতেন। দেবযানী ও শর্ম্মিষ্ঠা নামে যযাতির দুই মহর্ষি ছিলেন। তন্মধ্যে দেবযানীর গর্ভে যদু ও তুর্ব্বসু নামে দুই পুৎত্র জন্মেন। শর্ম্মিষ্ঠার গর্ভে দ্রুৎত্র্য, অনু ও পুরু নামে তিন পুৎত্র জন্মেন। তাঁহারা সকলেই মহাধনুর্দ্ধর ও সর্ব্বগুণসম্পন্ন ছিলেন। মহারাজ যযাতি বহুকাল ধর্ম্মতঃ প্রজাপালন করিয়া অবশেষে শুক্রাচার্য্যের শাপে জরাগ্রস্ত হইলেন। তখন তিনি সেই রূপনাশিনী জরার প্রভাবে ভোগ-সুখে বঞ্চিত হইয়া পুৎত্রদিগকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে পুৎত্রগণ! আমি তোমাদিগের যৌবন দ্বারা যুবতীগণের সহিত বিহার করিতে বাসনা করি, তোমরা তদ্বিষয়ে আমাকে সাহায্য কর।” ইহা শুনিয়া দেবযানীর জ্যেষ্ঠ পুৎত্র যদু কহিলেন, “মহারাজ! আমাদিগের যৌবন দ্বারা আপনার কিরূপ সহায়তা সম্পাদন করিব, আজ্ঞা করুন।” যযাতি কহিলেন, “তুমি আমার জরা গ্রহণ কর, আমি তোমার যৌবন লইয়া ইচ্ছানুরূপ বিষয়সম্ভোগ করিব। দীর্ঘসত্রানুষ্ঠানকালে মহর্ষি উশনার শাপে কামার্থবিনাশিনী জরা আমাকে আক্রমণ করিয়াছে, আমি তজ্জন্য সাতিশয় সন্তপ্ত হইতেছি, অতএব হে পুৎত্রগণ! তোমাদিগের মধ্যে একজন আমার জীর্ণ কলেবর লইয়া রাজ্যশাসন কর। যিনি জরা গ্রহণ করিবেন, আমি তাঁহার নবীন তনু আশ্রয় করিয়া বিষয় সম্ভোগ করিব।” তাহা শুনিয়া যদু প্রভৃতি চারিজন তাঁহার জরা গ্রহণ করিতে সম্মত হইলেন না। পরিশেষে সর্ব্বকনিষ্ঠ পুরু কহিলেন, “মহারাজ! আপনি আমার নবযৌবনসম্পন্ন সুকুমার কলেবর আশ্রয় করিয়া অভিলাষানুরূপ বিষয় সম্ভোগ করুন, আমি আপনার জরা গ্রহণ করিয়া রাজ্যশাসন করিব।” পরে রাজর্ষি যযাতি তপোবলে পুৎত্রশরীরে স্বকীয় জরা সঞ্চারিত করিলেন। অনন্তর সেই নৃপতি পুরুষ বয়োলাভ করিয়া যৌবনশালী হইলেন এবং পুরু তদীয় বয়ঃপ্রভাবে জরাগ্রস্থ হইয়া রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। পরমসুখে বিহার করিয়াও পরিতৃপ্ত হইলেন না। পরে চৈত্ররথ নামক কুবেরোদ্যানে [কুবেরের উদ্যানে] বিশ্বাচী-নাম্রী এক অপ্সরার সহিত কিছুকাল বিহার করিয়াও পরিতৃপ্ত হইলেন না। পরিশেষে মনোমধ্যে এই পৌরাণিকী গাথা অনুধ্যান করিলেন;— “কাম্যবস্তুর উপভোগে কামের উপশম হওয়া দূরে থাকুক, প্রত্যুত ঘৃতসংযুক্ত বহ্নির ন্যায় উহা ক্রমশঃ পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকে। যদি একজনে এই রত্নগর্ভা পৃথিবীর সমুদয় হিরণ্য [সোনা], সকল পশু এবং সমস্ত মহিলা উপভোগ করে, তথাপি তাহার তৃপ্তিলাভ হওয়া দুর্ঘট; অতএব শান্তিপথ অবলম্বন করাই শ্রেয়কল্প। লোক যখন কায়মনোবাক্যে কাহারও অনিষ্টচেষ্টা না করে, তখন ব্রহ্মতুল্য হয়।” মহারাজ যযাতি বৈরাগ্যের সারত্ব ও কামের অসারত্ব আলোচনা করিয়া পুৎত্র হইতে আপন জরা গ্রহণ করিলেন ও রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া কহিলেন, “বৎস! তুমিই যথার্থ পুৎত্রকার্য্য সম্পাদন করিয়াছ, তোমার দ্বারাই আমার বংশরক্ষা হইবে, অতএব তোমার বংশ পৌরব-বংশ বলিয়া লোকে বিখ্যাত হইবে।” পরে অনশনব্রত অবলম্বনপূর্ব্বক দেহত্যাগ করিয়া সস্ত্রীক স্বর্গারোহণ করিলেন।