০৭৪.শকুন্তলাগর্ভে ভরতজন্ম

চতুঃসপ্ততিতম অধ্যায়
শকুন্তলাগর্ভে ভরতজন্ম

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! তদন্তর বরবর্ণিনী শকুন্তলা যথাকালে মহাবলপরাক্রান্ত দীপ্তাগ্নি-সমতেজস্বী অলৌকিক-রূপগুণসম্পন্ন এক সুকুমার কুমার প্রসব করিলেন। ঐ কুমারের বয়ঃক্রম তিন বৎসর পরিপূর্ণ হইলে মহাত্মা কণ্ব বেদবিধানানুসারে তাঁহার জাতকর্ম্মাদি সংস্কার সম্পাদন করিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত শকুন্তলাপুৎত্র মুনির আশ্রমে দিন দিন দেবকুমারের ন্যায় বৃদ্ধি পাইতে লাগিলেন। পরে ছয় বৎসর বয়ঃক্রমকালে সিংহ, ব্যাঘ্র, বরাহ, মহিষ, হস্তী প্রভৃতি বন্য স্বাপদগণকে আশ্রম-সমীপস্থ বৃক্ষে বন্ধন করিয়া দমন করিতেন। তদ্দর্শনে কণ্বাশ্রমনিবাসী তাপসগণ তাঁহাকে সর্ব্বদমন বলিয়া ডাকিতেন। তদবধি তাঁহার এক নাম সর্ব্বদমন হইল। মহর্ষি কণ্ব বালকের অসাধরণ বল ও অলৌকিক কর্ম্ম-দর্শনে শকুন্তলাকে কহিলেন, “বৎস! তোমার পুৎত্রের যৌবরাজ্য-প্রাপ্তির সময় উপস্থিত হইয়াছে। অতঃপর তোমার এ স্থানে থাকা কর্ত্তব্য নহে।” পরে মুনিবর স্বীয় শিষ্যগণকে আদেশ করিলেন, “তোমরা পুৎত্রবতী শকুন্তলাকে ভর্ত্তৃভবনে লইয়া যাও; যেহেতু নারীগণের চিরকাল পিতৃগৃহে বাস করা অবিধেয় এবং তাহাতে কীত্তি, চরিত্র ও ধর্ম্ম নষ্ট হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা।” শিষ্যগণ ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া ঋষিবাক্য স্বীকার পূর্ব্বক সপুৎত্রা শকুন্তলাকে সমভিব্যাহারে লইয়া হস্তিনানগরে গমন করিলেন।

শকুন্তলার পতিগৃহে গমন

শকুন্তলা দেবকুমারতুল্য আপন কুমারকে ক্রোড়ে লইয়া ক্রমে ক্রমে দুষ্মন্তের ভবনে উপস্থিত হইলেন। কণ্বশিষ্যগণ রাজসমীপে সমুপস্থিত হইয়া যথাবিধি আশীর্ব্বাদবিধানপূর্ব্বক সপুৎত্র শকুন্তলাকে অর্পণ করিয়া আশ্রমে প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহারা আশ্রমে প্রস্থান করিলে শকুন্তলা কৃতাঞ্জলিপুটে রাজাকে কহিলেন, “মহারাজ! এই পুৎত্র আপনার ঔরসে আমার গর্ভে জন্মিয়াছে, আপনি কণ্বমুনির আশ্রমে আমাকে বিবাহ করেন। পরিণয়কালে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, মদ্‌গর্ভজাত পুৎত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিবেন। এক্ষণে এই পুৎত্রের যৌবরাজ্যে প্রাপ্তির সময় উপস্থিত। অতএব আপনি পূর্ব্বকৃত প্রতিজ্ঞা স্মরণপূর্ব্বক ইহাকে যুবরাজ করুন।”

দুষ্মন্তের শকুন্তলা-প্রত্যাখ্যান

রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার বাক্য শ্রবণানন্তর অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন, “তাপসি! তুমি যাহা কহিলে, তাহা আমার কিছুই স্মরণ হইতেছে না। তোমার সহিত যে কখন সন্দর্শন হইয়াছিল, তাহাও স্মরণ হয় না। কিংবা তোমার সহিত আমার কোন সম্বন্ধ আছে, ইহাও বোধ হইতেছে না; অতএব হে দুষ্টতাপসি! তুমি এই স্থানে থাক বা স্থানান্তরে যাও, যাহা ইচ্ছা হয় কর।” শকুন্তলা পতির মুখে এই অশনিপাত-সদৃশ বিষময় বাক্য শ্রবণ করিয়া ঈষৎ লজ্জিত ও দুঃখে স্তম্ভিতপ্রায় হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সংজ্ঞালাভ হইলে ক্রোধভরে তাঁহার দুই চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল এবং ওষ্ঠাধর কম্পিত হইতে লাগিল। তিনি এক একবার বক্রনয়নে রাজার প্রতি এরূপ কটাক্ষপাত করিতে লাগিলেন, বোধ হয় যেন, নয়নবিনির্গত ক্রোধাগ্নির দ্বারা রাজাকে একেবারেই দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন। পরে ক্রোধসংবরণ করিবার যথেষ্ট চেষ্টা করিলেও তাঁহার সে ভাব অপ্রকাশিত রহিল না। ক্ষণকাল এই অবস্থায় অবস্থান করিয়া রোষকষায়িত-নয়নে রাজার প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! তুমি জানিয়া শুনিয়াও কেন ইতর লোকের ন্যায় অসঙ্কুচিতচিত্তে কহিতেছ, ‘আমি কিছুই জানি না।’ আমি যাহা কহিলাম, তাহা সত্য, কি মিথ্যা, তদ্বিষয়ে তোমার অন্তঃকরণই সাক্ষী। তুমি স্বয়ংই সত্য মিথ্যা ব্যক্ত কর; আত্মাকে অবজ্ঞা করিও না। যে ব্যক্তি মনে একপ্রকার জানিয়া মুখে অন্যপ্রকার বলে, সেই আত্মাপহারী চৌরের কোন্ দুষ্কর্ম্ম না করা হয়? তুমি মনে করিতেছ, একাকী এই কর্ম্ম করিয়াছ, অন্য কেহই জানিতে পারে নাই, কিন্তু তুমি কি জান না যে, মহর্ষি কণ্ব অন্তর্য্যামী? তিনি স্বীয় যোগবলে পাপ-পুণ্য সমুদয় জানিতে পারেন। তুমি তাঁহার কাছে গোপন করিতে পারিবে না। লোকে পাপকর্ম্ম করিয়া মনে করে, আমার দুষ্কর্ম্ম কেহই জানিতে পারে নাই; দেবগণ ও অন্তর্য্যামী পুরুষেরা সকলই জানিতে পারেন। আর সূর্য্য, চন্দ্র, বায়ু, অগ্নি, স্বর্গ, পৃথিবী, জল, মন, যম, দিবা, রাত্রি, প্রাতঃকাল, সায়ংকাল এবং ধর্ম্ম, ইঁহারা মনুষ্যের সমস্ত বৃত্তান্ত জানিতে পারেন। পাপপুণ্যের সাক্ষিস্বরূপ হৃদয়স্থিত আত্মা সন্তুষ্ট থাকিলে বৈবস্বত যম স্বয়ং মনুষ্যের পাপ নাশ করেন। আর যে দুরাত্মার আত্মা সন্তুষ্ট নহে, যম সেই দুরাচারের পাপ বৃদ্ধি করেন। সেই পাপাত্মা আত্মাকে অপমান করিয়া সত্যবিষয় মিথ্যারূপে প্রতিপাদন করে, দেবতারা তাহার মঙ্গলবিধান করেন না। আমি পতিব্রতা। আমি স্বয়ং উপস্থিত হইয়াছি বলিয়া আমাকে অপমান করিও না। আমি তোমার সমাদরণীয়া ভার্য্যা। তুমি কি নিমিত্ত এই সভামধ্যে আমাকে সামান্যার ন্যায় উপেক্ষা করিতেছ? তুমি আমার এই সকল সকরুণ বাক্য কি কিছুই শুনিতেছ না? আমি কি অরণ্যে রোদন করিতেছি? হে দুষ্মন্ত! তুমি যদি আমার কথায় অবজ্ঞাপ্রদর্শনপূর্ব্বক উত্তর প্রদান না কর, তাহা হইলে অদ্য তোমার মস্তক শতধা বিদীর্ণ হইবে। পৌরাণিকেরা কহেন, ‘পতি স্বয়ং ভার্য্যার গর্ভে প্রবেশ করিয়া পুৎত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন, এই নিমিত্তই জায়ার জায়াত্ব হইয়াছে।’ পুৎত্র জন্মগ্রহণ করিয়া পূর্ব্বমৃত পিতামহদিগকে উদ্ধার করে এবং পিতাকে পুন্নাম নরক হইতে পরিত্রাণ করে, এই বলিয়া স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা উহাকে পুৎত্র বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। গৃহকর্ম্মদক্ষা পুৎত্রবতী পতিপরায়ণা ভার্য্যাই যথার্থ ভার্য্যা। ভার্য্যা ভর্ত্তার অর্দ্ধাঙ্গস্বরূপ, পরম বন্ধু এবং ত্রিবর্গ [ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম] লাভের মূল কারণ। ভার্য্যাবান্ লোকেরাই ক্রিয়াশালী হয়। ভার্য্যাবান্ লোকেরাই গৃহী বলিয়া পরিগণিত হয়; ভার্য্যাবান্ লোকেরাই সর্ব্বদা সুখী হয়; ভার্য্যাবান্ লোকেরাই সৌভাগ্যসম্পন্ন হয়েন। প্রিয়ংবদা ভার্য্যা অসহায়ের সহায়স্বরূপ, ধর্ম্মকার্য্যে পিতাস্বরূপ, আর্ত্ত ব্যক্তির জননীস্বরূপ এবং পথিকের বিশ্রামস্থানস্বরূপ। ভার্য্যাবান্ ব্যক্তি সকলেরই বিশ্বাসভাজন। মরণানন্তর আর কিছুই অনুগামী হয় না, কেবল পতিব্রতা পত্নীই সহগামিনী হইয়া থাকে। পতিব্রতা ভার্য্যা যদি পূর্ব্বে পরলোকপ্রাপ্ত হয়, তাহা হইলে সে তথায় গিয়া পতির অপেক্ষা করে; আর যদি পূর্ব্বে পতির পরলোক হয়, তবে তাঁহার সহমৃতা হয়। হে মহারাজ! যেহেতু পতি ভার্য্যাকে ইহলোক ও পরলোকে সহায়স্বরূপ প্রাপ্ত হন, এই নিমিত্তই লোকে পাণিগ্রহণ অভিলাষ করেন। পতি স্বয়ং ভার্য্যার গর্ভে প্রবেশ করিয়া পুৎত্রনামধারী হইয়া জন্মগ্রহণ করেন। অতএব পুৎত্রপ্রসবিনী ভার্য্যাকে সাক্ষাৎ মাতা বলিয়া মনে করা কর্ত্তব্য। যেমন আদর্শতলে মুখ-প্রতিবিম্ব, পুৎত্রও তদ্রূপ পিতার প্রতিবিম্বস্বরূপ। এই নিমিত্তই লোকে পুৎত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়া স্বর্গভোগের সুখানুভব করে। মনুষ্য শারীরিক বা মানসিক পীড়ার দ্বারা যতই কেন কাতর হউক না, প্রিয়তমা ভার্য্যাকে অবলোকন করিলে আতপতাপিত সুশীতল জলে অবগাঢ় [স্নাতক] ব্যক্তির ন্যায় সর্ব্বদুঃখ বিস্মৃত হইয়া পরম পরিতোষ লাভ করে। ভার্য্যা কর্ত্তৃক সাতিশয় ভর্ৎসিত হইলেও তাহার অপ্রিয় কার্য্য করা কদাপি বিধেয় নহে; কারণ, রতি, প্রীতি ও ধর্ম্ম এই তিন সুখসাধনই ভার্য্যার আয়ত্ত। স্ত্রীলোক আত্মার পবিত্র জন্মক্ষেত্র এবং স্ত্রীলোক ব্যতীত পুৎত্রৎপাদন হয় না। পুৎত্র পিতৃপদে প্রণাম করিয়া ধূলিধূসরিতকলেবর হয় এবং পিতাকে আলিঙ্গন করে; এই অসার সংসারে ইহা অপেক্ষা সুখ আর কি আছে? অতএব হে মহারাজ! স্বয়ং আগত এই প্রাণসম পুৎত্রকে কেন অবমানিত করিতেছ? দেখ, ক্ষুদ্র জীব পিপীলিকারাও স্বীয় অণ্ডসমুদয় সাতিশয় যত্নসহকারে রক্ষা করে, তুমি ধর্ম্মজ্ঞ হইয়াও কি নিমিত্ত আপন পুৎত্রকে পালন করিতে পরাঙ্মুখ হইতেছ? শিশুপুৎত্রের আলিঙ্গনে লোক যাদৃশ সুখানুভব করে, বসন, স্ত্রীগাত্র বা সুশীতল জল স্পর্শ করিয়া কি তাদৃশ সুখাস্বাদন করিতে পারে? যেমন দ্বিপদের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, চতুষ্পদের মধ্যে গো শ্রেষ্ঠ, গুরুজনের মধ্যে পিতা শ্রেষ্ঠ। সেইরূপ স্পর্শবান্ পদার্থের মধ্যে পুৎত্র সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। অতএব এই প্রিয়দর্শন পুৎত্র তোমাকে আলিঙ্গন করিয়া তোমার স্পর্শসুখ উৎপাদন করুক। হে অরিকুল কালান্তক! তিন বৎসর বয়ঃক্রম পরিপূর্ণ হইলে মহর্ষি কণ্ব ইহার ক্ষৎত্রিয়োচিত সমুদয় সংস্কার সম্পাদন করিয়াছেন, অতএব এই পুৎত্র সর্ব্বাংশে তোমার মনস্তাপ নাশ করিবে। হে পুরুবংশাবতংস! যখন এই পুৎত্র ভূমিষ্ঠ হয়, সেই সময়ে আমার প্রতি দৈববাণী হইয়াছিল, ‘এই কুমার যথাকালে শতসংখ্যক অশ্বমেধ-যজ্ঞ করিবে।’ আরও দেখ, পিতা বহুদিনের পর স্থানান্তর হইতে আগমন করিয়া পুৎত্রকে ক্রোড়ে গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার মস্তক আঘ্রাণ ও বদন চুম্বন করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করেন। কুমারের জাত কর্ম্মকালে ব্রাহ্মণেরা এই সকল মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া থাকেন, বোধ হয়, তুমিও কোন্ তাহা না জান।–’হে পুৎত্র! তুমি আমার প্রতঙ্গ হইতে সম্ভূত হইয়াছ; তুমি আমার হৃদয় হইতে জন্মিয়াছ এবং তুমি আমার পুৎত্রনামধারী আত্মা; অতএব তুমি শত বৎসর জীবিত থাক; আমার জীবন তোমার অধীন; আমার অক্ষয় বংশ তোমার অধীন; অতএব তুমি সুখী হইয়া শত বৎসর জীবিত থাক।’ হে রাজন! এই পুৎত্র তোমার শরীর হইতে সমুৎপন্ন; অতএব নির্ম্লল সলিলে আত্মপ্রতিবিম্ব-দর্শনের ন্যায় পুৎত্রমুখ নিরীক্ষণ কর। যেমন গার্হপত্য অগ্নি হইতে আহবনীয় অগ্নি প্রণীত হয়, সেইরূপ তোমা হইতে এই পুৎত্র সমুৎপন্ন হওয়াতে একমাত্র তুমিই দ্বিধাকৃত হইয়াছ। হে রাজন! একদা তুমি মৃগয়ায় গমন করিয়া এক মৃগের অনুসরণক্রমে তাত কণ্বের আশ্রমে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলে। আমি সে সময়ে কুমারী ছিলাম। হে মহারাজ! উর্ব্বশী, পূর্ব্বচিত্তি, সহজন্যা, মেনকা, বিশ্বাচী ও ঘৃতাচী এই ছয়জন অপ্সরা সর্ব্বপ্রধান। তন্মধ্যে ব্রহ্মলোকনিবাসিনী মেনকা স্বর্গ হইতে মর্ত্ত্যলোকে আগমন করিয়া বিশ্বামিত্রের ঔরসে আমাকে উৎপাদন করিয়াছিলেন। অভদ্রা মেনকা হিমালয়ের প্রস্থদেশে আমাকে প্রসব করিয়া শত্রুকন্যার ন্যায় তথায় পরিত্যাগপূর্ব্বক চলিয়া যান। হায়! না জানি, আমি জন্মান্তরে কি মহাপাতক করিয়াছিলাম; যেহেতু, বাল্যকালে বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল, এক্ষণে আবার তুমি পতি হইয়াও পরিত্যাগ করিলে! যাহা হউক, তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিলেও আমার তত ক্ষতি বোধ হইবে না; কারণ, আমি এক্ষণেই পিতার আশ্রমে গমন করিব; কিন্তু তোমার স্বীয় ঔরসজাত এই সুকুমার নবকুমারকে পরিত্যাগ করা নিতান্ত অবিধেয়।”

দুষ্মন্ত কহিলেন, “শকুন্তলে! আমি তোমার গর্ভে যে পুৎত্র উৎপাদন করিয়াছি, ইহা আমার কোন প্রকারেই স্মরণ হইতেছে না, স্ত্রীলোকেরা প্রায়ই মিথ্যা কহিয়া থাকে; বোধ হয়, তুমিও মিথ্যাকথা কহিতেছ; কে তোমার কথায় বিশ্বাস করিবে? কুলটা মেনকা তোমার জননী; তাহার মত নির্দ্দয় লোক জগতে নাই। সে তোমাকে প্রসব করিয়া নির্ষ্মাল্যের [পূজান্তে পরিত্যাক্ত পুষ্প] ন্যায় হিমালয়ের প্রস্থে পরিত্যাগ করিয়াছিল। আর তোমার জন্মদাতা বিশ্বামিত্রও অতি নীচাশয়; কারণ তিনি ক্ষৎত্রিয়কুলোদ্ভব হইয়া পরম পবিত্র সর্ব্বজনমাননীয় ব্রাহ্মণত্ব পাইয়াছেন; তত্রাচ কামপরবশ হইয়াছিলেন। ভাল, তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, যদি মেনকা অপ্সরার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র মহর্ষিদিগের অগ্রগণ্য, তবে তুমি তাঁহাদিগের কন্যা হইয়া কি নিমিত্ত পুংশ্চলীর [কূলটা—পরপুরুষগামিনী] ন্যায় মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিতেছ? এই সভাসদ্‌গণের সমক্ষে, বিশেষতঃ আমার সমক্ষে এই সকল অশ্রদ্ধেয় কথা কহিতে তোমার কি লজ্জা হইতেছে না? অতএব রে দুষ্টতাপসি! তুমি এ স্থান হইতে প্রস্থান কর। মহর্ষিশ্রেষ্ঠ বিশ্বামিত্র ও অপ্সরাপ্রধানা মেনকাই বা কোথায়, আর তাপসীবেশধারিণী তুমিই বা কোথায়? তোমার এই পুৎত্রকে বাল্যকালেই মহাবলপরাক্রান্ত ও মহাকায় দেখিয়া কোনরূপেই তোমাকে বিশ্বাস হইতেছে না। তুমি আপনিই কহিতেছ, সুনিকৃষ্টা স্বৈরিণী [স্বচ্ছাচারিণী] মেনকা তোমার জননী। সে কামরাগে অন্ধ হইয়া তোমাকে উৎপাদন করিয়াছে। আর তুমিও পুংশ্চলীর ন্যায় কথাবার্ত্তা কহিতেছ। তুমি যে-সকল কথা কহিলে, আমি তাহার বিন্দুবিসর্গও জানি না এবং তোমাকেও চিনি না; অতএব তুমি যথায় ইচ্ছা চলিয়া যাও।”

শকুন্তলা কহিলেন, “মহারাজ! সর্ষপপ্রমাণ পরদোষ নিরীক্ষণ কর, কিন্তু বিল্ব-পরিমিত আত্মদোষ দেখিতে পাও না। মেনকা দেবগণের মধ্যে গণনীয়া ও আদরণীয়া; অতএব তোমার জন্ম হইতে আমার জন্ম উৎকৃষ্ট তাহাতে সন্দেহ নাই। আরও দেখ, তুমি কেবল পৃথিবীতে ভ্রমণ কর, আমি পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ উভয় স্থলেই গতায়াত করিতে পারি; অতএব আমার ও তোমার প্রভেদ সুমেরু ও সর্ষপের প্রভেদের ন্যায়। আমার এরূপ প্রভাব আছে, আমি ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ প্রভৃতি দেবগণের ভবনেও অনায়াসে যাতায়াত করিতে পারি। হে মহারাজ! আমি এস্থলে এক লৌকিক সত্য দৃষ্টান্ত দেখাইতেছি, শ্রবণ কর; রুষ্ট হইও না। দেখ, কুরূপ ব্যক্তি যে পর্য্যন্ত আদর্শমণ্ডলে আপন মুখ না দেখে ততক্ষণ আপনাকে সর্ব্বাপেক্ষা রূপবান্ বোধ করে; কিন্তু যখন আপনার বিকৃত মুখশ্রী নিরীক্ষণ করে, তখন আপনার ও অন্যের রূপ-প্রভেদ জানিতে পারে। যে ব্যক্তি অত্যন্ত সুশ্রী, সে কখন অন্যকে অবজ্ঞা করে না। যে অধিক বাক্যব্যয় করে লোকে তাহাকে মিথ্যাবাদী ও বাচাল কহে। যেমন শূকর নানাবিধ সুখাদ্য মিষ্টান্ন পরিত্যাগ করিয়া পুরীষ [বিষ্ঠা] মাত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ মূর্খলোকেরা শুভাশুভ বাক্য শ্রবণ করিলে শুভকথা পরিত্যাগপূর্ব্বক অশুভই গ্রহণ করিয়া থাকে; আর হংস যেমন সজল দুগ্ধ হইতে অসার জলীয়াংশ পরিত্যাগপূর্ব্বক দুগ্ধরূপ সারাংশই গ্রহণ করে, সেইরূপ পণ্ডিত ব্যক্তিরা লোকের শুভাশুভ বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহা হইতে শুভই গ্রহণ করেন। সজ্জনেরা পরের অপবাদ শ্রবণ করিয়া অতিশয় বিষণ্ণ হয়েন, কিন্তু দুর্জ্জনেরা পরের নিন্দা করিয়া যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হয়। সাধু ব্যক্তিরা মান্য লোকদিগের সংবর্দ্ধনা করিয়া ষাদৃশ সুখী হন, অসাধুগণ সজ্জনগণের অপমান করিয়া ততোধিক সন্তোষ লাভ করে। অদোষদর্শী সাধু ও দোষৈকদর্শী [কেবল পরচ্ছিদ্রানুসারী] অসাধু উভয়েই সুখে কালাতিপাত করে; কারণ, অসাধু সাধু ব্যক্তির নিন্দা করে, কিন্তু সাধু ব্যক্তি অসাধু কর্ত্তৃক অপমানিত হইয়াও তাহার নিন্দা করেন না। যে ব্যক্তি স্বয়ং দুর্জ্জন, সে সজ্জনকে দুর্জ্জন বলে, ইহা হইতে হাস্যকর আর কি আছে? ক্রুদ্ধ কালসর্পরূপী সত্যধর্ম্মচ্যুত পুরুষ হইতে যখন নাস্তিকেরাও বিরক্ত হয়, তখন মাদৃশ আস্তিকেরা কোথায় আছেন? যে ব্যক্তি স্বয়ং স্ব-সদৃশ পুৎত্র উৎপাদন করিয়া তাহার সমাদর না করে, দেবতারা তাহাকে শ্রীভ্রষ্ট করেন এবং সে অভীষ্টলোক প্রাপ্ত হইতে পারে না। পিতৃগণ পুৎত্রকে কুল ও বংশের প্রতিষ্ঠা এবং সর্ব্বধর্ম্মোত্তম বলিয়া নির্দ্দেশ করেন, অতএব পুৎত্রকে পরিত্যাগ করা অত্যন্ত অবিধেয়। ভগবান্ মনু কহিয়াছেন—ঔরস, লব্ধ, ক্রীত, পালিত এবং ক্ষেত্রজ এই পঞ্চবিধ পুৎত্র মনুষ্যের ইহকালে ধর্ম্ম, কীর্ত্তি ও মনঃপ্রীতি বর্দ্ধন করে এবং পরকালে নরক হইতে পরিত্রাণ করে। অতএব হে নরনাথ! তুমি পুৎত্রকে পরিত্যাগ করিও না। হে ধরাপতে! আত্মকৃত সত্যধর্ম্ম প্রতিপালন কর। হে নরেন্দ্র! কপটতা পরিত্যাগ কর। দেখ, শত শত কূপ খনন অপেক্ষা এক পুষ্করিণী প্রস্তুত করা শ্রেষ্ঠ; শত শত পুষ্করিণী খনন করা অপেক্ষা এক যজ্ঞানুষ্ঠান করা শ্রেষ্ঠ, শত শত যজ্ঞানুষ্ঠান অপেক্ষা এক পুৎত্রোৎপাদন করা শ্রেষ্ঠ এবং শত শত পুৎত্র উৎপাদন অপেক্ষা এক সত্য প্রতিপালন করা শ্রেষ্ঠ। একদিকে সহস্র অশ্বমেধ ও অন্যদিকে এক সত্য রাখিয়া তুলনা করিলে সহস্র অশ্বমেধ অপেক্ষাও সত্যের গুরুত্ব অধিক হয়। হে মহারাজ! সমুদয় বেদ অধ্যয়ন ও সর্ব্বতীর্থে অবগাহন করিলে সত্যের সমান হয় কি না সন্দেহ। যেমন সত্যের সমান ধর্ম্ম নাই এবং সত্যের সমান উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই, তদ্রূপ মিথ্যার তুল্য অপকৃষ্ট আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। হে রাজন্! সত্যই পরব্রহ্ম, সত্যপ্রতিজ্ঞা প্রতিপালন করাই পরমোৎকৃষ্ট ধর্ম্ম, অতএব তুমি সত্য পরিত্যাগ করিও না। আর যদি তুমি মিথ্যানুগামী হইয়া আমাকে অশ্রদ্ধা কর, তবে আমি আপনিই এ স্থান হইতে প্রস্থান করিব, তোমার সহিত আর কদাচ আলাপ করিব না; কিন্তু হে দুষ্মন্ত! তোমার অবিদ্যমানে আমার এই পুৎত্র এই সসাগরা বসুন্ধরা অবশ্যই প্রতিপালন করিবে সন্দেহ নাই।”

দুষ্মন্তের প্রতি দৈববাণী

বৈশম্পায়ন কহিলেন, শকুন্তলা রাজাকে এই কথা কহিয়া নিরস্ত হইবামাত্র ঋত্বিক্, পুরোহিত, আচার্য্য ও মন্ত্রিগণ-পরিবেষ্টিত রাজার প্রতি এই আকাশবাণী হইল,—”মাতা চর্ম্মকোষস্বরূপ, পিতাই পুৎত্ররূপে জন্মপরিগ্রহ করেন; পুৎত্র জনয়িতা হইতে কিছুমাত্র বিভিন্ন নহে, অতএব হে দুষ্মন্ত! তুমি আপনার পুৎত্রকে প্রতিপালন কর, শকুন্তলাকে অপমান করিও না। হে নরদেব! ঔরস পুৎত্র পিতাকে যমালয় হইতে উদ্ধার করে। শকুন্তলা সত্যই কহিতেছেন, তুমিই এই পুৎত্রের উৎপাদক। জনয়িত্রী স্বকীয় অঙ্গকে দ্বিখণ্ড করিয়া অর্দ্ধভাগ পুৎত্ররূপে প্রসব করেন; অতএব হে দুষ্মন্ত! এই শকুন্তলাগর্ভসম্ভৃত পুৎত্রকে প্রতিপালন কর। জীবৎপুৎত্রকে পরিত্যাগ করা শ্রেয়স্কর নহে, অতএব হে রাজন্! শকুন্তলাগর্ভজাত এই স্বীয় পুৎত্রকে লালনপালন কর। যেহেতু, আমাদিগের উপরোধে তোমার এই পুৎত্রকে ভরণ করা আবশ্যক হইল, এই নিমিত্ত ইনি ভরত নামে বিখ্যাত হইবেন।”

রাজা দুষ্মন্ত দৈববাণী শ্রবণে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া পুরোহিত ও অমাত্যবর্গকে কহিলেন, “আপনারা দেবদূতের বাক্য শুনিলেন? আমিও এই কুমারকে আমারই আত্মজ বলিয়া জানি; কিন্তু যদি সহসা ইহাকে গ্রহণ করি, তাহা হইলে লোকে আমাকে দোষী করিবে এবং পুৎত্রটিও কলঙ্কী হইবে; এই ভয়ে শকুন্তলার সহিত বিতণ্ডা করিতেছিলাম।” তাঁহাদিগকে এই কথা বলিয়া রাজা হৃষ্টচিত্তে পুৎত্রকে গ্রহণ করিলেন।

অনন্তর রাজা পিতৃকর্ত্তব্য সমুদয় কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া পুৎত্রের মস্তকাঘ্রাণপূর্ব্বক আলিঙ্গন করিলেন। তৎকালে ব্রাহ্মণগণ তাঁহাকে ধন্যবাদ করিতে লাগিলেন এবং বন্দিগণ স্তুতিপাঠ করিতে লাগিল। অনন্তর রাজা ধর্ম্মপত্নী শকুন্তলাকে যথোচিত সমাদর পূর্ব্বক সান্ত্বনাবাক্যে কহিতে লাগিলেন, “প্রিয়ে‍! নির্জ্জন কাননে তোমার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলাম, কেহই জানিত না; দোষৈকদর্শী লোক পাছে তোমাকে কুলটা, আমাকে কামপরবশ এবং রাজ্যে অভিষিক্ত পুৎত্রকে জারজ মনে করে, এই ভয়ে আমি এতক্ষণ এতদ্রূপ বিচার করিতেছিলাম; তুমি ক্রুদ্ধা হইয়া আমার প্রতি যে-সকল কটুবাক্য প্রয়োগ করিয়াছ, হে প্রিয়তমে! আমি তাহা ক্ষমা করিয়াছি।”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভারত! রাজা দুষ্মন্ত মহিষীকে এইরূপ কহিয়া বস্ত্রান্নপানাদি দ্বারা পরিতুষ্ট করিলেন এবং শকুন্তলার পুৎত্রের নাম ভারত রাখিলেন। পরে রাজাধিরাজ দুষ্মন্ত পুৎত্রকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। ভরত যুবরাজ হইয়া কতিপয় দিবসের মধ্যে সমস্ত মহীপালগণকে পরাজয় করিয়া ধর্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা পরম যশস্বী হইলেন; অনন্তর রাজচক্রবর্ত্তী হইয়া অনল্প অশ্বমেধ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান দ্বারা সুরগণের নিকট ইন্দ্রের ন্যায় আদরণীয় হইয়া উঠিলেন। হে মহারাজ! সেই ভরত হইতে ভারতী কীর্ত্তি ও তোমাদিগের ভারতনামক সুবিখ্যাত কুল সমুৎপন্ন হইয়াছে।

আদিপর্ব্বান্তর্গত সম্ভবপর্ব্বাধ্যায়ে শকুন্তলোপাখ্যান সম্পূর্ণ।