০৬৫.সম্ভবপর্ব্ব—ব্রহ্মর্ষিবংশ । দেবাসুর-বংশবর্ণন

পঞ্চষষ্টিতম অধ্যায়
সম্ভবপর্ব্ব—ব্রহ্মর্ষিবংশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, দেবরাজ ইন্দ্র নারায়ণের সহিত এইরূপ মন্ত্রণা করিয়া দেবগণকে অংশক্রমে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইতে আদেশ দিলেন। হে রাজন্! তদনন্তর দেবগণ অসুরবিনাশ দ্বারা প্রজাগণের হিতসাধন করিবার মানসে স্বর্গ হইতে অবতীর্ণ হইয়া স্বেচ্ছাক্রমে কেহ ব্রহ্মর্ষিবংশে, কেহ বা রাজর্ষিবংশে জন্মগ্রহণ করিলেন। তাঁহারা বাল্যকালেই এরূপ বলিষ্ঠ হইয়া উঠিলেন যে, দানব, গন্ধর্ব্ব, পন্নগ, রাক্ষস ও নরমাংসলোলুপ অন্যান্য জন্তুগণকে অবলীলাক্রমে বধ করিতে লাগিলেন।

জনমেজয় কহিলেন, “হে মুনিসত্তম! আমি দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, অপ্সরা, মানব ও যক্ষ-রাক্ষস প্রভৃতি অন্যান্য জীবগণের জন্মবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শুনিতে বাসনা করি. অনুগ্রহ করিয়া সবিস্তর বর্ণন করুন।

দেবাসুর-বংশবর্ণন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! আমি ভগবান্ স্বয়ম্ভূকে [ব্রহ্মা] নমস্কার করিয়া সুরাসুর প্রভৃতির জন্মমরণ-বৃত্তান্ত সবিশেষরূপে বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন। সর্ব্বলোক-পিতামহ ব্রহ্মার মরীচি. অত্রি, অঙ্গিরা, পৌলস্ত্য, পুলহ ও ক্রতু নামে ছয় মানস-পুৎত্র জন্মেন। মরীচির পুৎত্র কশ্যপ; কশ্যপ হইতেই এই সমস্ত প্রজার সৃষ্টি হইয়াছে। হে মনুজশ্রেষ্ঠ! অদিতি, দিতি, দনু, কালা, দনায়ু, সিংহিকা, ক্রোধা, প্রধা, বিশ্বা, বিনতা, কপিলা, মুনি ও কদ্রু এই এয়োদশ দক্ষকন্যা কশ্যপের ভার্য্যা ছিলেন। ইঁহাদের গর্ভে কশ্যপের মহাবলপরাক্রান্ত অসংখ্য সন্তান সমুৎপন্ন হয়। হে রাজন! অদিতির গর্ভে যথাক্রমে ধাতা, মিত্র, অর্য্যমা, শক্র, বরুণ, অংশ, ভগ, বিবস্বান্, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা ও বিষ্ণু নামে দ্বাদশ আদিত্য জন্মেন। আদিত্যগণের সর্ব্বকনিষ্ট বিষ্ণু সর্ব্বাপেক্ষা গুণজ্যেষ্ঠ। দিতির গর্ভে একমাত্র পুৎত্র জন্মে। তাহার নাম হিরণ্যকশিপু। হিরণ্যকশিপুর পঞ্চ পুৎত্র;—প্রহ্লাদ, সংহ্লাদ, অনুহ্লাদ, শিবি ও বাষ্কল; ইঁহারা সকলেই সুবিখ্যাত ছিলেন। প্রহ্লাদের তিন পুৎত্র;—বিরোচন, কুম্ভ ও নিকুম্ভ। বিরোচনের পুৎত্র বলি, ইনি ভুবনবিশ্রুত ছিলেন। বলির পুৎত্র মহাবলপরাক্রান্ত বাণ। ইনি বহুকালাবধি ভূতনাথ ভবানীপতির আরাধনা করিয়া মহাকাল নামে বিখ্যাত হন। প্রথম, রাজা, বিপ্রচিত্তি; মহাযশা:, শম্বর, নমুচি, পুলোমা, বিশ্রুত, অসিলোমা, কেশী, দুর্জ্জয়, দানবন, অয়ঃশিরাঃ, অশ্বশিরাঃ, অশ্বশঙ্কু, বীর্য্যবান্, গগনমূর্দ্ধা, বেগবান্, কেতুমান, স্বর্ভানু, অশ্ব, অশ্বপতি, বৃষপর্ব্বা, জ্জক, অশ্বগ্রীব, সূক্ষ্ণ, তুহুণ্ড, মহাবল, একপাদ, একচক্র, বিরূপাক্ষ, মহোদর, নিচন্দ্র, নিকুম্ভ, কুপট, কপট, শরভ, শলভ, সূর্য্য, চন্দ্রমাঃ, এই চত্বারিংশৎ পুৎত্র দনুর গর্ভে জন্মে। একাক্ষ, অমৃতপ, প্রলম্ব, নরক, বাতাপি, শত্রুতাপন, শঠ, গরিষ্ঠ, চ্যবনায়ু, দীর্ঘজিহ্ব এই দশ দানবের পুৎত্র পৌৎত্রাদি অসংখ্য। চন্দ্রার্কবিদ্বেষী রাহু, সুচন্দ্র, চন্দ্রহন্তা ও চন্দ্রমর্দ্দন, এই কয়েকটি পুৎত্র সিংহিকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। সিংহিকা ক্রুরস্বভাবা ছিলেন, এই নিমিত্ত তাঁহার পুৎত্র-পৌৎত্রগণ ক্রোধপরবশ, ক্রুরকর্ম্মা ও অরিমর্দ্দন বলিয়া লোকে বিখ্যাত। দনায়ুর চারি পুৎত্র;—বিক্ষর, বল, বীর, ও বৃত্র। বিনাশন, ক্রোধ, ক্রোধহন্তা, শত্রু প্রভৃতি শমনসদৃশ প্রহর্ত্তা দানবেরা কালার পুৎত্র। ইঁহারা সকলেই মহাবলপরাক্রান্ত ও অরিমর্দ্দন ছিলেন। ঋষিপুৎত্র শুক্র অসুরগণের উপাধ্যায় ছিলেন।

অসুরগুরু শুক্রের বংশ

শুক্রের চারি পুৎত্র;— ত্বষ্টাধর, অত্রি এবং অপর দুইজন। ইঁহারা চারি জনেই সূর্য্যসম তেজস্বী ও ব্রহ্মলোকপরায়ণ ছিলেন। ইঁহারাই অসুরগণের যাজনক্রিয়া সমাধা করিতেন। হে রাজন! পুরাণে যেরূপ শ্রুত আছে, তদনুসারে দেবাসুরগণের বংশ কীর্ত্তন করিলাম। কিন্তু যে যে দেবতা বা দানবের নামোল্লেখ করিলাম, তাঁহাদের পুৎত্র-পৌৎত্রাদি অসংখ্য। অশেষরূপে তাঁহাদিগের নাম নির্দ্দেশ করা অতিশয় দুঃসাধ্য।

তির্য্যক্‌প্রাণী প্রভৃতির জন্মক্রম

তার্ক্ষ্য, রিষ্টনেমি, গরুড়, অরুণ, আরুণি ও বারুণি, ইঁহারা বিনতার পুৎত্র। শেষ, অনন্ত, বাসুকি, তক্ষক, কূর্ম্ম ও কুলিক, ইঁহারা কদ্রুর পুৎত্র। ভীমসেন, সুপর্ণ, বরুণ, গোপতি, ধৃতরাষ্ট্র, সূর্য্যবর্চ্চাঃ, সত্যবাক্, অর্ক, পর্ণ, প্রযুত, ভীম, চিত্ররথ, শালিশিরাঃ, পর্জ্জন্য, কলি, নারদ এই ষোড়শ পুৎত্র মুনির গর্ভে জন্মেন। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ দেবতা, কেহ কেহ গন্ধর্ব্ব। প্রধার গর্ভে অনবদ্যা, মনু, বংশা, অসুরা, মার্গণপ্রিয়া, অনূপা, সুভগা ও ভাসী এই কয়েকটি কন্যা এবং সিদ্ধ, পূর্ণ, বহী, পূর্ণায়ু, ব্রহ্মচারী, রতিগুণ, সুপর্ণ, বিশ্বাবসু, ভানু ও প্রচন্দ্র এই দশপুৎত্র জন্মগ্রহণ করেন। পুরাণে কথিত আছে, মহাভাগা প্রধাদেবী দেবর্ষির ঔরসে পরম-পবিত্র সুবিখ্যাত অপ্সরোবংশে সমুৎপন্ন হয়েন। অলম্বুষা, মিশ্রকেশী, বিদ্যুৎপর্ণা, তিলোত্তমা, অরুণা, রক্ষিতা, রম্ভা, মনোরমা, কেশিনী, সুবাহু, সুরতা, সুরজা ও সুপ্রিয়া এই কয়েকটি কন্যা এবং অতিবাহু, হাহা, হূহূ, তুম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্ব্বগণ ও ব্রাহ্মণ, অমৃত, গো গন্ধর্ব্ব প্রভৃতি নানাবিধ অপত্য কপিলা হইতে সমুৎপন্ন হয়। হে রাজন্‍! আমি তোমার নিকট গন্ধর্ব্ব অপ্সরা, ভুজঙ্গ, সুপর্ণ, রুদ্র, মরুৎ এবং গোব্রাহ্মণ প্রভৃতি সমস্ত জীবগণের জন্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিলাম। যে ব্যক্তি অসূয়াশূন্য হৃদয়ে এই শ্রবণানন্দদায়ক সর্ব্বপ্রাণীগণের জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণ করে ও অন্যকে শুনায়, তাহার আয়ুঃ, পুণ্য ও যশঃ বৃদ্ধি হয়। আর যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণগণ-সন্নিধানে নিয়মপূর্ব্বক ইহা পাঠ করে, তাহার ইহকালে ধন ও যশঃ এবং পরকালে সদ্‌গতি লাভ হয়।