১৪৫. যুধিষ্ঠির সমীপে কৃষ্ণের কৌরবাভিপ্ৰায় প্রকাশ

১৪৫তম অধ্যায়

যুধিষ্ঠির সমীপে কৃষ্ণের কৌরবাভিপ্ৰায় প্রকাশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! এ দিকে অরতিনিসূদন মধুসূদন হস্তিনা হইতে উপপ্লব্যনগরে আগমনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত কহিলেন এবং তাঁহাদিগকে বারবার সম্ভাষণ ও তাঁহাদের সহিত বহুক্ষণ মন্ত্রণা করিয়া বিশ্রামার্থ স্বীয় আবাসভবনে গমন করিলেন। ভগবান প্রখরদীধিতি [উগ্ৰকিরণ-সূৰ্য্য] অস্তাচলে গমন করিলে পাণ্ডবগণ বিরাটপ্রভৃতি নৃপতিগণকে বিদায় করিয়া সায়ংকালীন সন্ধ্যাকৃত্য সমাধান করিলেন; কিন্তু তাবৎকাল তাঁহারা কেবল কৃষ্ণগতমানস [কৃষ্ণসমৰ্পিত চিত্ত] হইয়া তাঁহারই চিন্তা করিতেছিলেন। অনন্তর তাঁহাকে আবাসভবন হইতে আনয়ন করিয়া পুনরায় মন্ত্রণা করিতে আরম্ভ করিলেন।

যুধিষ্ঠির কহিলেন “হে পুণ্ডরীকক্ষ! তুমি হস্তিনাপুরে গমন করিয়া সভামধ্যে দুৰ্য্যোধনকে কি কহিয়াছিলে, তাহা বল।”

কৃষ্ণ কহিলেন, ‘ধৰ্মরাজ! আমি হস্তিনাপুরে গমন করিয়া সভামধ্যে দুৰ্য্যোধনকে যথার্থ হিতবাক্য কহিলাম; কিন্তু ঐ দুরাত্মা তাহা গ্ৰহণ করিল না।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে হৃষীকেশ! দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনকে বিপথগামী দেখিয়া কুরুকুলবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম, আচাৰ্য্য দ্ৰোণ, জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র, আৰ্য্যা গান্ধারী ও আমাদের বিরহে নিতান্ত সন্তপ্ত খুল্লতাত বিদুর এবং তত্রস্থ অন্যান্য সভ্যগণ সেই দুরাত্মাকে কি কহিলেন, তৎসমুদয় যথার্থরূপে কীর্ত্তন কর। তুমি, কুরুকুলশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র ও অন্যান্য ভূপতিগণ—তোমরা আমার নিমিত্ত কুরুসভায় যেসমুদয় বাক্য কহিয়াছিলে, তাহা সেই কামলোভাভিভূত [বিষয়বাসনায় লোভামোহিত] প্ৰজ্ঞাভিমানী [নিজেকে বুদ্ধিমান বলিয়া দম্ভকারী] দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনের হৃদয়মন্দিরে স্থানপ্রাপ্ত হয় নাই। হে কৃষ্ণ! তুমি আমাদের গতি, নাথ ও গুরু; অতএব যাহাতে আমরা কালকবলে [মৃত্যুমুখে] নিপতিত না হই, এক্ষণে এমন উপায় স্থির কর।”

পাণ্ডবসম্বন্ধে ভীষ্মের আশয়প্ৰকাশ

তখন বাসুদেব কহিলেন, “হে রাজন! ভীষ্মপ্রমুখ মহাত্মাগণ কুরুসভামধ্যে দুৰ্য্যোধনকে যাহা যাহা কহিয়াছিলেন, তৎসমুদয় শ্রবণ করুন। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন আমার বাক্য শ্রবণ করিয়া হাস্য কিরলে শান্তুনুনন্দন ভীষ্ম ক্রুদ্ধ হইয়া কহিতে লাগিলেন, ‘হে দুর্য্যোধন! আমি কুলের হিতার্থ তোমাকে যাহা কহিতেছি, তাহা শ্ৰবণ করিয়া তৎসাধনে যত্নবান হও। আমার পিতা শান্তনু লোকমধ্যে অতি বিশ্রুত ছিলেন; আমি তাঁহার একমাত্র পুত্ৰ ছিলাম। একদা তিনি মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, পণ্ডিতগণ কাহেন, এক পুত্র পুত্ৰমধ্যে পরিগণিত নহে; অতএব কিরূপে আমার অন্য পুত্র সমুৎপন্ন হইবে, কিরূপে কুলরক্ষা হইবে ও কিরূপেই বা যশ বিস্তীর্ণ হইবে? আমি পিতার অভিপ্ৰায় বুঝিয়া কালীকে [সত্যবতীকে] আনয়নপূর্ব্বক তাহার সহিত পিতার বিবাহ দিলাম। “পিতা [*পিতার আদেশ পালন ও বংশের রক্ষার জন্য।] ও কুলের [*] নিমিত্ত [*] স্বয়ং রাজা হইব না, ঊর্দ্ধরেতা [শুক্রাধারণকারী] হইব’ বলিয়া দুষ্কর প্রতিজ্ঞা করিলাম। সেই প্রতিজ্ঞানুসারে অদ্যাপি কাৰ্য্য করিলাম। সেই প্রতিজ্ঞানুসারে অদ্যাপি কাৰ্য্য করিতেছি। ইহা তোমার অবিদিত নাই। কিয়দ্দিন পরে কালীর গর্ভে আমার পিতার ঔরসে কুরুকুলতিলক মহাবাহু আমার কনীয়ান [কনিষ্ঠ] ভ্রাতা বিচিত্ৰবীৰ্য্যের জন্ম হইল। পিতার স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি হইলে আমি বিচিত্ৰবীৰ্য্যকে আমার প্রাপ্য রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া তাহার অধীন হইয়া কালব্যাপন করিতে লাগিলাম। কিয়দ্দিনানন্তর আমি বহুসংখ্যক ভূপতিগণকে পরাজয় করিয়া বিচিত্ৰবীৰ্য্যের বিবাহের নিমিত্ত কাশীরাজের কন্যাদিগকে আনয়ন করিলাম; উহা তোমার অবিদিত নাই। পরে পরশুরামের সহিত আমার দ্বন্দ্বযুদ্ধ [দুইজনের পরস্পর সম্মুখ সমর] সমুপস্থিত হইলে নগরবাসিগণ পরশুরামের ভয়ে বিচিত্ৰবীৰ্য্যকে বিপ্রবাসিত [গুপ্তভাবে স্থানান্তরিত] করেন। ঐ সময়ে বিচিত্ৰবীৰ্য্য একান্ত বনিতাসক্ত হইয়া যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়।

“ ‘এইরূপে রাজ্য অরাজক হওয়াতে সুররাজ শতক্ৰতু [ইন্দ্র] বারিবর্ষণে বিরত হইলেন। প্ৰজাগণ ক্ষুধা ও ভয়ে পীড়িত হইয়া আমার নিকট আগমনপূর্ব্বক কহিতে লাগিল, “হে মহাত্মন! সমুদয় প্রজা ক্ষীণ [ক্ষয়প্রাপ্ত] হইয়াছে, অতএব আপনি আমাদের মঙ্গলের নিমিত্ত রাজা হইয়া ঈতি [অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, শস্যনাশক পঙ্গপালনামক পতঙ্গ ও ইন্দুরের আধিক্য, জননাশক পক্ষীর প্রাদুর্ভাব এবং পররাষ্ট্রকর্ত্তৃক স্বরাষ্ট্রের আক্রমণ—এই ছয়টি ইতি ভাব] নিবারণ করুন। হে বীর! প্ৰজাগণ প্ৰায় নিঃশেষিত হইয়াছে; তাহারাও নিদারুণ ব্যাধিনিবহে [বিবিধ ব্যাধিতে] একাত্ত নিপীড়িত হইতেছে; আপনি তাহাদিগকে পরিত্ৰাণ করুন। আমাদের মনোব্যথা দূর করুন ও ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালন করুন। আপনি বর্ত্তমান থাকিতে এই রাজ্য যেন বিনষ্ট না হয়।”

“ ‘হে দুৰ্য্যোধন! প্ৰজাগণের এইরূপ কাতরোক্তি শ্রবণেও আমার মন ক্ষুভিত হইল না; আমি সদাচার স্মরণ করিয়া প্রতিজ্ঞারক্ষাতেই দৃঢ় হইয়া রহিলাম; তখন সমুদয় পৌরবর্গ, মাতা কালী এবং ভৃত্য, পুরোহিত ও বহুশ্রুত [শাস্ত্রজ্ঞ] ব্ৰাহ্মণগণ শোকে একান্ত অভিভূত হইয়া আমাকে বারংবার কহিতে লাগিলেন, “ভদ্র! তুমি আমাদের হিতার্থে রাজা হও, নচেৎ মহারাজ প্রতীপকর্ত্তৃক রক্ষিত রাজ্য তোমার সময়ে বিনষ্ট হইবে।”

“ তখন আমি নিতান্ত দুঃখিতচিত্তে বদ্ধাঞ্জলি হইয়া তাঁহাদিগকে কহিলাম, “আমি পিতার গৌরবরক্ষা ও কুলরক্ষার নিমিত্ত স্বয়ং ঊৰ্দ্ধারেতা হইব, রাজা হইব না বলিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি। অতএব আমাকে রাজ্যগ্রহণে অনুরোধ করিবেন না।” পরে কৃতাঞ্জলিপুটে মাতাকে বারংবার কহিলাম, “জননি! কৌরববংশে শান্তনুর ঔরসে সমুৎপন্ন ব্যক্তির প্রতিজ্ঞ কখনই মিথ্যা হইবার নহে। বিশেষতঃ, আপনার এই দাস আপনার নিমিত্তই প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছে।”

“ ‘হে দুৰ্য্যোধন! আমি এইরূপে মাতাকে মন্ত্রণাপূর্ব্বক জনগণকে অনুনয় করিয়া মাতার সহিত মন্ত্রণাপূর্ব্বক ভ্ৰাতৃজায়া[ভ্রাতৃপত্নী]দিগের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করিবার নিমিত্ত মহামুনি ব্যাসকে আহ্বান করিয়া প্ৰসন্ন করিলাম। তিনি প্ৰসন্ন হইয়া তিনপুত্র উৎপাদন করিলেন, উঁহার মধ্যে তোমার পিতা জন্মান্ধতাপ্রযুক্ত রাজ্যপ্রাপ্ত হয়েন নাই, মহাত্মা লোকবিশ্রুত পাণ্ডু রাজা হয়েন। এক্ষণে তাঁহার পুত্ৰগণ তাঁহার রাজ্যপ্রাপ্ত হইবার উপযুক্ত; অতএব তুমি কলহ পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডবগণকে রাজ্যার্দ্ধ প্ৰদান কর। আমি জীবিত থাকিতে রাজ্যশাসনে কাহার অধিকার আছে? হে বৎস! আমার বাক্যে অনাস্থা প্ৰদৰ্শন করিও না; আমি তোমাদের শান্তি অভিলাষেই কহিতেছি; তোমাকে ও তাঁহাদিগকে অবিশেষে [তুল্যরূপে] স্নেহ করিয়া থাকি। আমি যাহা কহিলাম, এ বিষয়ে তোমার পিতা ও মাতার বিলক্ষণ মত আছে। হে বৎস! বৃদ্ধবাক্য গ্রহণ করা অবশ্যকর্ত্তব্য; অতএব তুমিও আশঙ্কিতচিত্তে আমার বাক্যানুসারে কাৰ্য্য কর, আত্মা ও সমুদয় পৃথিবী বিনষ্ট করিও না।’ ”