১২৮. দুর্য্যোধনের দুর্বুদ্ধি দূরীকররেণ গান্ধারীর বাক্য

১২৮তম অধ্যায়

দুর্য্যোধনের দুর্বুদ্ধি দূরীকররেণ গান্ধারীর বাক্য

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! নরনাথ ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া সত্বর সর্ব্বধৰ্মজ্ঞ বিদুরকে কহিলেন, “বৎস! দূরদর্শিনী গান্ধারীর সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে এখানে আনয়ন করা; আমি তাঁহার সমভিব্যাহারে দুরাত্মা দুৰ্য্যোধনকে অনুশাসন করিব। যদি গান্ধারী, সামবচনে [সান্ত্বনাবাক্যে] লোভাভিভূত দুর্বুদ্ধি দুঃসহায় [দুষ্টজনের সাহায্যপ্রাপ্ত] দুৰ্য্যোধনকে শান্ত ও সৎপথাবলম্বী করিতে পারেন, তাহা হইলে আমরা অনায়াসে পরমসুহৃৎ বাসুদেবের বিচনানুসারে কাৰ্য্য করিতে পারিব। হায়! আমাদের এই দুৰ্য্যোধনকৃত ঘোর ব্যাসন কি প্রশমিত হইবে?”

ধীমান বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের আদেশানুসারে তৎক্ষণাৎ গান্ধারীকে তথায় আনয়ন করিলেন। তখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধাররাজতনয়াকে কহিলেন, “গান্ধারি! তোমার পুত্র দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন, ঐশ্বৰ্য্যলোভে সুহৃজ্জনের শাসন অতিক্রম করিয়াছে; অতএব সে ঐশ্বৰ্য্য ও জীবন উভয়েই বঞ্চিত হইবে, সন্দেহ নাই। ঐ দুরাত্মা অদ্য সুহৃদ্বাক্য উল্লঙ্ঘনপূর্ব্বক পাপাত্মাগণসমভিব্যাহারে অশিষ্টের ন্যায় সভা হইতে বহির্গত হইয়া গিয়াছে।”

যশস্বিনী গান্ধারী স্বামীর বাক্য শ্রবণানন্তর কুরুকুলের শ্রেয়োলাভের আশায় কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! সত্বর সেই রাজ্যকামুক দুৰ্মতি পুত্রকে জ্ঞাত কর যে, ধর্ম্মার্থবিলোপী [ধর্ম্ম ও অর্থের বিলোপকারী-ধ্বংসকারক] অশিষ্ট অবিনীত ব্যক্তি কখনই রাজ্যলাভ করিতে সমর্থ হয় না। হে রাজন! এই যে ব্যসন সমুত্থিত হইয়াছে, ইহাতে তুমি নিন্দনীয় হইবে; তুমি দুৰ্য্যোধনের পাপপরায়ণতা অবগত হইয়াও তাহার মতের অনুসরণ করিয়া থাক। এক্ষণে ঐ দুরাত্মা কাম, ক্রোধ ও লোভের নিতান্ত বশীভুত হইয়াছে; সুতরাং তুমি আজি বলদ্বারাও উহাকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে পরিবে না। মুখ, দুরাত্মা, দুঃসহায়, লুব্ধের হস্তে রাজ্যভার সমর্পণ করিলে যে ফললাভ হয়, তুমি তাহা ভোগ করিতেছ। তুমি আত্মীয়জনের সহিত ভেদ কিরূপে উপেক্ষা করিতেছ? তোমাকে স্বজনের সহিত ভেদ করিতে দেখিয়া শত্ৰুগণ হাস্য করিবে। সাম ও দানদ্বারা বিপদ হইতে উত্তীর্ণ হইতে পারিলে কোন ব্যক্তি দণ্ডবিধানে প্রবৃত্ত হয়?”

অনন্তর মহাত্মা বিদুর ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর বিচনানুসারে অমর্য্যসম্পন্ন দুৰ্য্যোধনকে পুনরায় সভায় আনয়ন করিলেন। দুৰ্য্যোধন মাতার বাক্যশ্রবণাভিলাষে ক্রোধারক্ত নয়নে কুপিত আশীবিষের ন্যায় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক সভামধ্যে প্রবেশ করিলেন।

গান্ধাররাজতনয়া কুপথগামী দুৰ্য্যোধনকে সমুপস্থিত দেখিয়া ভৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “বৎস দুৰ্য্যোধন! আমি তোমাকে যে হিতকর ও ভবিষ্যতে সুখজনক বাক্য কহিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর ও তোমার পিতা যাহা কহিয়াছেন, তুমি তদনুসারে কাৰ্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। তুমি শান্তিমাৰ্গ অবলম্বন করিলে ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, আমি ও দ্রোণপ্রভৃতি সুহৃদগণ সকলেই সৎকৃত হইব। দেখ, রাজ্য স্বেচ্ছাক্রমে লাভ, রক্ষা বা ভোগ করিবার নহে, অজিতেন্দ্ৰিয় ব্যক্তি কদাচ বহুকাল রাজ্যভোগ করিতে সমর্থ হয় না; জিতেন্দ্ৰিয়, মেধাবী মহাত্মাই স্বচ্ছন্দে রাজ্যপালন করেন। কাম ও ক্ৰোধ মনুষ্যকে অর্থ হইতে পরিচ্যুত করে; ঐ রিপুদ্ধয়কে পরাজয় করিতে পারিলেই অনায়াসে পৃথিবী জয় করা যায়। দুরাত্মা প্ৰভুত্ব, রাজ্য ও অভিলষিত স্থান কখনই রক্ষা করিতে পারে না। ধর্ম্মার্থভিলাষী ব্যক্তি মহত্ত্বকামনায় যত্নপূর্ব্বক ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিবে; যেমন ইন্ধন [কাষ্ঠ] দ্বারা হুতাশন [অগ্নি] প্রবৃদ্ধ হয়, তদ্রূপ ইন্দ্ৰিয়গণ সংযত হইলে বুদ্ধি পরিবৰ্দ্ধিত হইয়া উঠে। যেমন অবাধ্য অশান্ত অশ্বগণ অনভিজ্ঞ সারথিকে বিনিষ্ট করে, তদ্রূপ ইন্দ্ৰিয়গণকে বশীভুত না করিলে উহারা মনুষ্যকে বিনষ্ট করিয়া থাকে। যে ব্যক্তি আপনাকে বশীভূত না করিয়া অমাত্যগণকে পরাজয় করিতে বাসনা করে এবং অমাত্যদিগকে পরাজয় না করিয়া শত্রুগণকে পরাভব করিতে অভিলাষ করে, সে স্বয়ং পরাজিত হয়। যে ব্যক্তি প্ৰথমে দ্বেষভাব অবলম্বনপূর্ব্বক আত্মাকে পরাজয় করিরেত পরে, পরে অমাত্য ও শক্রগণকে পরাজয় করা তাহার পক্ষে কোনক্রমেই দুঃসাধ্য নহে। যিনি ইন্দ্ৰিয়গণকে স্ববশে আনয়ন করিয়া অমাত্যগণকে পরাজয় ও দুষ্টগণের প্রতি দণ্ডধারণপূর্ব্বক বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া কাৰ্য্য করেন, লক্ষ্মী নিরন্তর তাঁহাকে আশ্রয় করিয়া থাকেন।

“হে বৎস! ক্ষুদ্র ছিদ্রসঙ্কৃল জলজড়িত মৎস্যদ্বয়ের ন্যায় শরীরাভ্যন্তরস্থ কামক্ৰোধ প্রজ্ঞা বিলুপ্ত করে; কোন বীতরাগ ব্যক্তি স্বর্গগমনোন্মুখ হইলে দেবগণ ভয়নিবন্ধন তাঁহারা অন্তঃকররেণ কামক্ৰোধ বৰ্দ্ধিত করিয়া স্বৰ্গপথ রোধ করেন। যে ব্যক্তি কাম, ক্ৰোধ, লোভ, দম্ভ ও দর্প সম্যকরূপে পরাজয় করিতে পারে, পৃথিবী বিজয় করা তাহার পক্ষে অতি সামান্য কর্ম্ম। যে ভূপতি ধর্ম্ম, অর্থ ও অরাতিপরাজয় বাসনা করেন, সতত ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহে যত্নবান হওয়া তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি কামক্রোধাভিভূত হইয়া কপটাচরণ করে, কি আত্মীয়, কি অনাত্মীয় কেহই তাহার সহায় হয় না। হে পুত্র! তুমি মহাপ্রাজ্ঞ মহাবলপরাক্রান্ত অরতিনিপাতন পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইলে পরমসুখে পৃথিবী ভোগ করিবে। শান্তনুতনয় ভীষ্ম ও মহারথ দ্রোণ কহিয়াছেন যে, পাণ্ডবগণ অজেয়; উহা যথার্থ।

“হে দুৰ্য্যোধন! তুমি অক্লিষ্টকর্ম্মা [কাৰ্য্যে অশ্রান্ত-অনায়াসে কর্ম্মসম্পাদনকারী] মধুসূদনের বাক্যরক্ষা কর; তিনি প্রসন্ন হইলে তোমাদের উভয় পক্ষের সুখসমৃদ্ধি হইবে। যে ব্যক্তি হিতাভিলাষী কৃতবিদ্য সুহৃজ্জনের শাসনানুবর্ত্তী না হয়, সে কেবল শত্ৰুগণের আনন্দবৰ্দ্ধন করে। সংগ্রামে ধর্ম্ম, অর্থ, সুখ বা শ্ৰেয়েলাভ হয় না; যুদ্ধ করিলেই যে জয়লাভ হইবে, তাহারও সম্ভাবনা নাই; অতএব যুদ্ধে অভিলাষ করিও না। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম ও বাহ্লীক ভেদভয়ে [কৌরব-পাণ্ডবের বিচ্ছিন্নতা-অনৈক্য] ভীত হইয়া পাণ্ডুপুত্ৰগণকে রাজ্যাংশ প্ৰদান করিতে স্বীকার করিয়াছেন। পাণ্ডবগণকে রাজ্যাংশ প্ৰদান করিলে এই প্রত্যক্ষ ফললাভ হইবে যে, তাহারা সমুদয় পৃথিবী নিষ্কণ্টক করিকে ; তুমি অনায়াসে উহা ভোগ করিতে পরিবে। অতএব হে পুত্র! যদি অমাত্যগণ-সমভিব্যাহারে অৰ্দ্ধরাজ্য ভোগ করিতে তোমার বাসনা হয়, তাহা হইলে পাণ্ডবগণকে যথোচিত অংশ প্ৰদান কর। রাজ্যের অৰ্দ্ধাংশ তোমার পক্ষে যথেষ্ট, অতএব সুহৃদের বাক্য রক্ষা কর; জনসমাজে যশস্বী হইবে। হে বৎস! সেই শ্ৰীমান জিতেন্দ্ৰিয় বুদ্ধিমান পাণ্ডবগণের সহিত বিগ্ৰহ করিলে নিশ্চয়ই সুখভ্রষ্ট হইবে। অতএব এক্ষণে পাণ্ডুতনয়গণকে তাহাদের সমুচিত অংশ প্রদান ও সুহৃদ্বর্গের ক্ৰোধ নিবারণ করিয়া স্বচ্ছন্দে রাজ্যশাসন কর ।

“হে বৎস! তুমি কামক্রোধের বশীভূত হইয়া ত্ৰয়োদশ বৎসর পাণ্ডবগণের যে অপকার করিয়াছ, এক্ষণে তাহার প্রতিবিধান করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। তুমি দৃঢ়ক্ৰোধ [অটুট রোষ।] কর্ণ ও দুঃশাসনের সাহায্যে পাণ্ডবগণের অর্থ গ্রহণ করিতে অভিলাষ করিতেছ, কিন্তু তাহাতে কৃতকাৰ্য্য হওয়া তোমাদের সাধ্য নহে। আর ভীষ্ম, দ্ৰোণ, কৃপ, কর্ণ, ভীমসেন, ধনঞ্জয় ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্রুদ্ধ হইলে নিশ্চয়ই সমুদয় প্রজা বিনষ্ট হইবে। অতএব তুমি আমর্ষপরায়ণ হইয়া কৌরবগণকে কালগ্ৰাসে পতিত করিও না। তোমার দোষে যেন সমুদয় পৃথিবী বিনষ্ট না হয়। তুমি মূঢ়তাপ্রযুক্ত মনে মনে স্থির করিয়াছ যে, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ-প্রভৃতি বীরগণ তোমার নিমিত্ত প্ৰাণপণে যুদ্ধ করিবেন; কিন্তু তাহা কখনই হইবার নহে; কেন না, এই রাজ্যে তোমাদের ও পাণ্ডবগণের সমান অধিকার আছে এবং উক্ত মাহাত্মারা তোমাদের উভয় পক্ষের প্রতিই সমান প্রীতি প্রকাশ করিয়া থাকেন। কিন্তু পাণ্ডবগণ তোমাদের অপেক্ষা সমধিক ধর্ম্মশীল। ঐ মহাত্মাগণ রাজার অন্নে প্রতিপালিত হইতেছেন বলিয়া সমরে স্বীয় জীবন পরিত্যাগ করিবেন তথাপি ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কখনই প্রহার করিতে সমর্থ হইবে না। হে পুত্ৰ! মনুষ্যগণ লোভপরতন্ত্র হইয়া কদাপি অর্থলাভ করিতে পারে না; অতএব তুমি লোভ পরিত্যাগ করিয়া প্রশান্ত হও।”