১০২. নারদ-মাতলির ভোগবতীভ্ৰমণ

১০২তম অধ্যায়

নারদ-মাতলির ভোগবতীভ্ৰমণ

অমরাবতীপুরী যেরূপ মনোহর ও অগ্রগণ্য, বাসুকিপরিপালিত এই ভোগবতীনগরীও সেইরূপ। শ্বেতাচল কলেবর [ধবলগিরিতুল্য শুভ্রদেহ], দিব্যাভরণভূষিত, জ্বালজিহ্ব [অগ্নির শিখারূপ জিহ্বার ন্যায় জিহ্বাবিশিষ্ট], মহাবল শেষনাগ এই স্থানে অবস্থান করিয়া তপঃপ্রভাবে সহস্র মস্তকদ্বারা প্রভাবতী পৃথিবীকে ধারণ করিতেছেন। সুরসা ভুজঙ্গীর সহস্ৰসংখ্যক পুত্র গতিক্লেশ [অশ্রান্ত দেহ-বিশ্রামান্তে সুস্থশরীর] হইয়া এই লোকে বাস করে; তাহারা সকলেই স্বভাবতঃ বলবান ও ভয়ঙ্কর; তাহাদিগের আকার নানাপ্রকার ও ভূষণও নানাবিধ; তাহাদিগের শরীর মণি, স্বস্তিক [কুম্ভের মত মাঙ্গল্যচিহ্ন-২২ প্রকার অধিবাস দ্রব্যের মধ্যে স্বস্তিক একটি উহা পিটুলিদ্বারা নির্মিত ও ত্রিকোণাকার], চক্র ও কমণ্ডলুচিহ্নে চিহ্নিত। সেইসকল পর্ব্বতাকার বিপুলভোগশালী ভুজঙ্গদিগের মধ্যে কতকগুলি সহস্র শিরাঃ, কতকগুলি পঞ্চশতশিরাঃ, কতকগুলি শতশিরাঃ, কতকগুলি দশশিরাঃ, কতকগুলি সপ্তশিরাঃ, এবং কেহ কেহ বা ত্রিশিরাঃ; এক্ষণে সেই একবংশীয় সহস্ৰ সহস্ৰ প্রযুত প্রযুত অর্বুদ অবুৰ্দ আশীবিষ এই স্থানে বাস করিতেছে। জ্যেষ্ঠানুক্রমে তাহাদিগের নাম শ্রবণ কর,-বাসুকি, তক্ষক, কর্কোটক, ধনঞ্জয়, কালয়, নহুষ, কম্বল, অশ্বতর, বাহ্যকুণ্ড, মণি, আপূরণ, খাগ, বামন, এলাপত্র, কুকুর, কুকুন, আৰ্য্যক, নন্দনক, কলস, পোতক, কৈলাসক, পিঞ্জীরক, ঐরাবত, সুমনোমুখ, দধিমুখ, শঙ্খ, নন্দ, উপনন্দ, আপ্ত, কোটরাক, শিখী, নিষ্ঠুরিক, তিক্তিরি, হস্তিভদ্র, কুমুদ, মাল্যপিণ্ডক, পদ্মদ্বয়, পুণ্ডরীক, পুষ্প, মুহরপর্ণক, করবীর, পিঠরক, সংবৃত্ত, উদ্ৰ্ববৃত্ত, পিণ্ডার, বিল্বপত্র, মূষিকাদ, শিরীষক, দিলীপ, শঙ্খশীর্ষ, জ্যোতিষ্ক, অপরাজিত, কৌরব্য, ধৃতরাষ্ট্র, কুহক, কৃষক, বিরজা, ধারণ, সুবাহু, মুখর, জয়, বধিরান্ধ, বিশুণ্ডি, বিরস ও সুরস; ইহা ভিন্ন আরও ভুরি ভুরি ভুজঙ্গ বিদ্যমান আছে। হে মাতলে! অত্ৰত্য কোন ব্যক্তিকে কন্যা সম্পাদনা করিতে অভিরুচি হয়?”

“অনন্তর ধারস্বভাব মাতলি সবিশেষ বিবেচনা করিয়া প্রীতিপ্রকাশপূর্ব্বক ভগবান নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দেবর্ষে। যিনি কৌরব্য ও আর্য্যকের সম্মুখে অবস্থান করিতেছেন, ঐ কান্তিমান সৌম্যমূর্ত্তি কোন কুলের আনন্দোৎপাদন করেন? ইহার জনক-জননী কে? ইনিই বা কোন জাতীয় সৰ্পের অন্তর্গত এবং কোন বংশেরই বা কেতুভূত [বিখ্যাতির হেতুভূত চিহ্নস্বরূপ-পরিচয়স্থল] হইয়াছেন? ইনি একাগ্ৰতা, ধীরতা, রূপ ও বয়সে আমার মনোহরণ করিয়াছেন; অতএব ইনিই গুণকেশীর উপযুক্ত পতি।”

“দেবর্ষি নারদ মাতলিকে সুমুখ [পূর্বোক্ত নাগগণের মধ্যে সুমুখনামে কেহ। নাই। “সুমনোমুখ” আছে। ইহা হইতে সুমুখ অনুবাদ গ্ৰহণ করিতে হইল; ‘সুমনাঃ’ ও ‘সুমুখ’ দুইটি নাম কল্পনা করিতে হয়। দীপ-দেহলী ন্যায়ে ‘সুমনা’র ‘সুর’ সহিত মুখের যোগ বিশেষণস্থলে হয়, কিন্তু নামে হওয়া সঙ্গত নয়। তবে সাধারণতঃ ‘সঞ্জীবন’ নামের মধ্যাংশ বাদ দিয়া সনু গ্রহণের মত মুসুখ হইতে পারে।]-দর্শনে প্রীতমনাঃ দেখিয়া সুমুখের জন্ম, কর্ম্ম ও মাহাত্ম্য কীর্ত্তন করিতে লাগিলেন, “হে মাতলে! এই নাগরাজ ঐরাবতকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, ইঁহার নাম সুমুখ, ইনি আৰ্য্যকের প্রিয় পৌত্র, বামনের দৌহিত্র ও চিকুর নাগের পুত্র। অতি অল্পদিন হইল, বিনতানন্দন ইহার পিতা চিকুর নাগকে বিনষ্ট করিয়াছেন।”

“তখন মাতলি প্রীতিপ্ৰফুল্ল হইয়া নারদকে কহিলেন, “হে দেবর্ষে। এই ভুজগরাজই আমার অভিলষিত জামাতা; আমি ইঁহাকে অবলোকন করিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইয়াছি। আপনি ইঁহাকে আমার প্রিয়তম দুহিতা সম্প্রদান করিবার নিমিত্ত যত্ন করুন।’ ”