‘আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি যে তুমি
তোমার বাস্তবতা হারিয়ে ফেলেছ
এখনও কি সময় আছে তোমার জীবন্ত শরীর স্পর্শ করার
এবং যে ওষ্ঠ থেকে আমার অতি প্রিয় স্বর জন্ম নেয় সেখানে
চুম্বন দেওয়ার?…
আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি যে হয়তো
আমার পক্ষে আর জাগাই সম্ভব হবে না
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোই, আমার শরীর সব রকম জীবন ও ভালোবাসার জন্য উন্মুক্ত…
আমি তোমার ভুরু ছুঁতে পারি, ওষ্ঠ ছুঁতে পারি এত কম…
আমি তোমাকে এত বেশি স্বপ্ন দেখেছি, হেঁটেছি, কথা বলেছি।
শুয়েছি তোমার ছায়ার সঙ্গে…’
–রোবেয়ার দেনো
মার্গারিটের কাছ থেকে আমি কত দূরে সরে এসেছি। আমার বয়েস বেড়েছে কিন্তু মার্গারিটের বয়েস একটুও বাড়েনি। শেষবার যখন আমি মার্গারিটকে ওর্লি বিমানবন্দরের বারান্দায় দেখি, তখন তার বয়েস সাতাশ, মাথা ভরতি না-আঁচড়ানো ঈষৎ লালচে রঙের চুল, ঠোঁটে মাখেনি রং, আঁকেনি ভুরু, মুখে কোনওরকম প্রসাধনের চিহ্ন নেই, একটা গোলাপি রঙের স্কার্ট পরা। মার্গারিটের সেই মূর্তিটাই আমার স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে। আমার প্যারিস ছাড়ার ফ্লাইট ছিল ভোরবেলা। সেবারে বিদায় নেওয়ার সময় আমরা হাসাহাসি করব, কোনওরকম বিচ্ছেদের কথা তুলব না, পরস্পরের কাছে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। মালপত্র চেক-ইন করিয়ে আমরা দুজনেই মজার মজার গল্প মনে করে বলছিলাম আর হাসছিলাম খুব, মার্গারিট তার প্রিয় কবি আপোলিনেয়ারের কাব্যগ্রন্থ ‘বিসতেয়ার’ থেকে ছোট ছোট কৌতুক-কবিতা শোনাচ্ছিল। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা কেউই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারিনি। মার্গারিট কান্নায় ভেঙে পড়ে রেলিং টপকে নেমে আসার চেষ্টা করছিল নীচে, দুজন বিমানকর্মী তার হাত ধরে টেনে রাখল। আমি তখন বিমানের সিঁড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকছি, হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে ওই দৃশ্য দেখে স্তব্ধ, পেছনের অন্য যাত্রীরা ঠেলছে আমাকে। তখন আর আমার ফেরার কোনও উপায় নেই।
মার্গারিটের সেই কান্না-ভেজানো মুখ, যেন জঙ্গলের কোনও গাছের না- ছেঁড়া, শিশির মাখানো শুভ্র মুখ।
আমার ঠিক পরেই যাঁরা আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন, শঙ্খ ঘোষ এবং জ্যোর্তিময় দত্ত, এঁদের দুজনের সঙ্গেই মার্গারিটের যথেষ্ট পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু এঁরাও মার্গারিটের শেষ পরিণতি সম্পর্কে কিছু জানেন না। পল এঙ্গেল আমাকে নরম করে বলেছিলেন, কারা যেন ওকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে…। হয়তে জোর করতেও হননি, সরল বিশ্বাসেই মার্গারিট তাদের গাড়িতে উঠেছিল। সব মানুষকেই সে বড় বেশি বিশ্বাস করত, কালো মানুষদের প্রতি তার একাত্মবোধ ছিল। পৃথিবীতে যত রকম অপরাধ আছে, তার মধ্যে নিকৃষ্টতম হচ্ছে কোনও অনিচ্ছুক নারীর প্রতি কোনও পুরুষের নিছক গায়ের জোরে যৌন অত্যাচার! ইস, কত কষ্ট পেয়েছিল মেয়েটা!
কাল রাত্রে আমার একেবারেই ঘুম হয়নি। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ বাদেই হঠাৎ পেট আর বুক জ্বলতে শুরু করে। সাধারণ জ্বলুনি নয়, যেন একটা দাবানল ছুটে বেড়াচ্ছে। শরীরের অভ্যন্তরে। ভাস্করের কাছে নানা রকম অ্যান্টাসিড থাকে। ওকে না জাগিয়ে ওর ব্যাগ খুলে দুটো ট্যাবলেট খেয়ে নিলাম। তাতে একটুও কমল না। ডিনারের সময় কোনও রকম একটা খাবার আমার সহ্য হয়নি? ফুড পয়জনিং? অন্য তিনজনের কিছু হয়নি কেন, তারা তো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। রাত্তিরে কোনও রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে আমরা প্রত্যেকে একই খাবার খাই না, যে-যার পছন্দমতন ডিস নিই, আমি নিয়েছিলাম খরগোশের মাংস, শুধু সেটা বিষাক্ত ছিল?
খাবারের ব্যাপারে আমার কোনও বাছ-বিচার নেই, নতুন নতুন খাদ্যও পরীক্ষা করে দেখতে বেশ ভালো লাগে। ব্যাঙ, বাদুড় ও জেব্রার মাংস চেখে দেখেছি, চিনে গিয়ে নানা রকম অচেনা রান্নার মধ্যে সাপের মাংসও খেয়ে থাকতে পারি। সব কিছুই তো দিব্যি হজম হয়ে যায়। তা হলে আজ কী হল? আগুনের জ্বালাটা ক্রমশ বাড়ছে, একেবারে অসহ্য হয়ে উঠছে, মনে হচ্ছে যেন বুকটা ফেটে যাবে! বিছানায় শুয়ে থাকতে পারছি না, ছটফট করছি ঘরের মধ্যে। আরও দুবার অ্যান্টাসিড খেয়েও কোনও সুফল পাওয়া গেল না। এটা কি তবে আকস্মিক আলসার? কোনও কোনও লোকের হঠাৎ অ্যাপেনডিক্স ফেটে মৃত্যু মৃত্যু হয়। ফুড পয়েজনিং-এও তো মারা যায় কেউ কেউ। আমার সারা শরীর একবার কেঁপে উঠল।
রিলকে বলেছেন, পঁয়ত্রিশ বছর বয়েসের পর যে মানুষের মাঝে মাঝে মৃত্যু চিন্তা আসে না, তার কোনও বোধশক্তিই নেই। মৃত্যুভয় এক ধরনের বিলাসিতাও বটে, যা চূড়ান্ত কল্পনার লোকে নিয়ে যায়। আসল মৃত্যু যখন আসে, তখন এ সব বিলাসিতার সুযোগ পাওয় যায় কি না কে জানে!
আমার মৃত্যুভয় কখনওই পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয় না। তারপর হাসি পায়। অত কষ্টের মধ্যেও আমার মনে হল ফ্রান্সের এক ক্ষুদ্র শহরে, হোটেল ঘরের মধ্যে আচমকা মৃত্যুর মতন নাটকীয় ঘটনা মোটেই আমার পছন্দ নয়। বন্ধুরা তা হলে মহাবিপদে পড়ে যাবে। একসঙ্গে বেড়াতে এসে এটা হবে আমার বিশ্বাসঘাতকতা! মরে না গিয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও তো ওদের খুবই বিব্রত করা হবে! ওসব চলবে না।
যাই হোক, শেষ রাত্তিরের দিকে আমার পর পর দুবার বমি হল। একেবারে বেসিন ভেসে যাওরার উপক্রম। ঋষি অগন্ধের মতন আমি যেন এক সমুদ্র বমন করলাম। তাতেই নিভে গেল আগুন। বেরিয়ে গেল খাদ্যের বিষ। এরপর প্রচুর ঠান্ডা জল খেয়ে নাড়িভুড়ি পর্যন্ত ধুয়ে ফেললাম, চমৎকার শান্তি হল, কিন্তু আর ঘুম এল না। ভোরের আলো ফোঁটার পর আমি গায়ে একটা শাল জড়িয়ে চলে এলাম হোটেলের সামনের চত্বরটায়। একটু নীচেই হাইওয়ে, তার ওপাশে লোয়ার নদী। চতুর্দিকের নির্মল নীরবতার মধ্যে নদীটি একমাত্র জেগে আছে।
মৃত্যুর অনুভূতির সময় পর পর দ্রুত প্রিয়জনের কথা মনে আসে, মা, ভাই-বোন, স্ত্রী পুত্র, কলকাতা, অসমাপ্ত লেখা, বন্ধু-বান্ধব, রবিবার দুপুরের আড়া। সব কিছুতেই মায়া জড়ানো। এখন শরীরটা অনেকটা হালকা ও সুস্থ লাগছে, এখন আবার মনে হচ্ছে, যথেষ্ট দিন তো বাঁচা হয়েছে, যিশুখ্রিস্ট, শেলি, কিটস, মোপাসাঁ, মাইকেল মধুসূদন, স্বামী বিবেকানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত আমার চেয়ে কম বয়েসে মার গেছেন, আমি মরে গেলেও ক্ষতি কিছু ছিল না। বেশ এই লোয়ার নদীর তীরে আমাকে কবর দেওয়া হত, একদিন সেই কবরের মাটির ওপর গজিয়ে উঠত নাম-না-জানা গাছ। আবার বিলাসিতা!
আমরা অনেকেই বেঁচে আছি, শুধু মার্গারিট নেই। অথচ তার হারিয়ে যাওয়া একেবারেই উচিত ছিল না!
এবারের ভ্রমণে এসে বন্ধুদের কাছে আর মার্গারিটের কথা উল্লেখ করি না। ওরা বাড়াবাড়ি মনে করতে পারে। শুধু একবার, গাড়িতে আসার সময় এবারেও পোয়াতিয়ে’র। পাশ দিয়ে এসেছিলাম, সেখানে একটা রাস্তায় দাঁ গ্রামের দিকে তীর আঁকা ছিল। মার্গারিটের জন্মস্থান। আমি মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিলাম, অসীম, একবার লুদা ঘুরে গেলে হয় না! অসীম ধমক দিয়ে বলেছিল, আবার? একবার তো গিয়েছিল? সেখানে কী দেখতে পাবে? শুধু শধু ঝামেলা করার কী দরকার?
অসীম ঠিকই বলেছে। শুধু শুধু লুদা গ্রামে গিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কোনও মানে হয় না। তা ছাড়া মার্গারিট সম্পর্কে আমার যা অনুভূতি, অন্যদের তো তা হতে পারে না। এখানে ঘুরতে-ঘুরতে মার্গারিটের কথা আমার বারবার মনে পড়বেই। টুকরো টুকরো ইতিহাস, ছবি, কবিতা, ভাস্কর্য, এই সবের সঙ্গেই মার্গারিটের অনুষঙ্গ জড়ানো। মার্গারিটের সঙ্গে কবে, কোথায় এই সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, তার কিছুই আমি ভুলিনি। আজ আমরা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির শেষ জীবনের বাড়িটি দেখতে যাব। লিয়োনার্দোর আঁকা বিশ্ববিখ্যাত মোনালিসা ছবিটি আমি প্রথমবার দেখি মার্গারিটের সঙ্গে। প্রথম প্রথম মার্গারিট আমাকে ওই ছবিটা দেখতে দিত না। নরম ধমক দিয়ে বলত, না, ওটা তোমায় দেখতে হবে না, সব টুরিস্টরা ওটা দেখার জন্য ছোটে, এমন কিছু দেখার মতন নয় ছবিটা! তার চেয়ে আরও কত ভালো ভালো ছবি আছে, দেখা হয় না…।
আমরা প্রায়ই যেতাম লুভর মিউজিয়ামে। দুটো তিনটে ঘর বেছে নিয়ে সেখানকার সব ছবি দেখতাম মন দিয়ে। মার্গারিট পুরো শিল্পের ইতিহাস আমাকে টুকরো টুকরো ভাবে বুঝিয়ে দিত। ইটালিয়ান শিল্পীদের অনেক ছবি দেখার পর মার্গারিট বলেছিল, এবার আমরা মোনালিসাকে একবার দেখতে পারি। প্যারিস ছাড়ার শেষ দিনটায় লুভর মিউজিয়ামে দুজনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ খেয়াল হল মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, তা হলে কি মোনালিসা দেখা হবে না? দুজনে মিলে ছুটতে ছুটতে, অন্যদের হতচকিত করে, একটার পর একটা কক্ষ পার হয়ে আমরা মোনালিসার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, ও এই! মার্গারিট হাসিতে ভেঙে পড়েছিল। এত বিখ্যাত ছবিটি প্রথম দর্শনে হতাশ হতেই হয়!
সকলের ঘুম ভাঙবার পর বাদলের তৈরি চা খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমবোয়াজ-এর দুর্গ-প্রাসাদটি এমন কিছু দেখবার মতন নয়। এককালে খুবই বিশাল ছিল, এর সঙ্গে অনেক রোমহর্ষক ইতিহাসও জড়িত, কিন্তু এখন বলতে গেলে একটি ভগ্নস্তূপ। দু’দিকের প্রাচীর ও প্রাসাদের সামান্য কিছু অংশ কোনওক্রমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
একেই তো এই অবস্থা তার ওপরে আবার গাইডের উৎপাত। প্রত্যেক শাতো-তেই ঢুকতে পয়সা লাগে, এখানে ভেতরে এসে জানা গেল যে রাজা-রানিদের ঘরগুলো দেখবার জন্য গাইড নিতে হবে, না হলে যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ আবারপয়সা খরচ। একজন গাইড আমাদের পাশে এসে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। রাজা-রানিদের ঘর আমরা অন্য জায়গায় যথেষ্ট দেখেছি, আর না দেখলেও চলবে। সর্বসম্মতিক্রমে গাইডটিকে বিদায় করে দেওয়া হল। আমার নিজেরাই দুর্গের মধ্যে ঘুরতে লাগলাম। এত উঁচু থেকে লোয়ার নদীর একটা চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। শুধু সেইটা দেখাই তো যথেষ্ট।
প্রাচীরের পাশ দিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে চোখে পড়ল একটা প্রাচীন ভাঙা গির্জা। সেখানে রয়েছে লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির একটি আবক্ষ মূর্তি। তার নীচেই ওই মহান শিল্পীর মরদেহ সমাহিত।
আমবোয়াজের ভেতরের বাগানটি এখনও খুবই সুদৃশ্য। হাজার রকম ফুলের সমারোহ। এখানকার বাগানের খ্যতি কয়েক শতাব্দী ধরে। রাজা অষ্টম শার্ল এই বাগান বানিয়েছিলেন। তিনি ইতালিতে গিয়ে সেখানকার বাগান দেখে এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বলেছিলেন, আহা, যদি একটি আদম ও ইভ থাকত, তা হলেই এ যে স্বর্গোদ্যান হয়ে যেত। ইতালিয়ানদের অনুকরণেই তিনি এখানে বাগান শুরু করেন। এই শাতো-টির জাঁকজমক শুরু হয় তাঁর আমলেই। অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে তাঁর এখানেই মৃত্যু হয়েছিল। একদিন রানির সঙ্গে তিনি এখানকার চত্বরে টেনিস খেলা দেখতে আসছিলেন। একটা নীচু দরজা পার হওরার সময় মাথায় গুঁতো খান খুব জোরে। কিছু হয়নি, কিছু হয়নি বলে তিনি এগিয়ে গেলেন, খেলা দেখতে দেখতে হাসি-গল্প করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। তাঁকে ধরাধরি করে শুইয়ে দেওয়া হল খেলার মাঠের পাশেই একটা ছোট্ট ঘরে, খড়ের বিছানায়। লোকজন ব্যস্ত হয়ে ছুটতে লাগল বটে, কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি যে রাজা কতটা অসুস্থ। ফ্রান্সের রাজা অষ্টম শার্ল বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন সেখানেই।
এই অঞ্চলের অনেকগুলি শাতোর সঙ্গেই রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া’র নাম সংযুক্ত। ফরাসি দেশের ইতিহাসেও যেমন তাঁর বিশিষ্ট স্থান, তেমনি এই রকম বিশাল বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ ও পরিবর্ধনে তাঁর ছিল অদম্য উৎসাহ। তিনি ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রাসাদে থাকতেন। প্রথম ফ্রাঁসোয়া যখন তরুণ যুবক ও যুবরাজ, সেই সময় তিনি আমবোয়াজ-এ এসে প্রাসাদটি আরও সুসজ্জিত করেন। যুদ্ধবিদ্যা, নাচ-গান এবং আমোদ-প্রমোদ সব দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল এবং তাঁর শিল্প-রুচিও খুব উন্নত। এই প্রথম ফ্রাঁসোয়া’ই ইতালি থেকে লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে সসম্মানে এখানে নিয়ে আসেন। রনেশাঁস আমলের সেই পুরোধা শিল্পীকে তিনি একটি অতি উত্তম বাড়ি দিয়েছিলেন, ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন প্রচুর টাকা মাসোহারার। লিওনার্দো এখানে নিজস্ব কাজ বা লেখাপড়া যা খুশি করবেন, শর্ত শুধু একটাই, মাঝে মাঝে রাজা এই শিল্পীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করার সময় চাইবেন।
ফ্লরেন্স তখন পশ্চিমি শিল্পের রাজধানী। সেই নগর ছেড়ে লিওনার্দো এই আমবোয়াজ এর মতন এক অখ্যাত জায়গায় আসতে রাজি হলেন কেন, তা অবশ্য জানা যায় না। হয়তো শেষ জীবনটা নিরিবিলিতে কাটাবারই ইচ্ছে ছিল তাঁর। এখানে তিনি বেঁচে ছিলেন চার বছর। নদী-নালা ও স্থাপত্য বিষয়ে রাজাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। ১৫১৯ সালের ২ মে, ৬৭ বছর বয়েসে লিওনার্দোর মৃত্যু হয়। রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া লিওনার্দোর এমনই ভক্ত ছিলেন যে এই শিল্পীর মৃত্যুর পর তাঁর আর এখানে মন টেকেনি, তিনিও আমবোয়াজ ছেড়ে চলে যান। পরে এখানে এসেছেন কদাচিৎ।
রনেশাঁস বা রেনেশাঁস শব্দটি ফরাসি হলেও সকলেই জানেন যে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রে এই নবজাগরণের সূত্রপাত হয় ইতালিতে। ইতালিয়ান ভাষায় একে বলে রিনাসেনৎসা বা পুনরুত্থান। এখান থেকেই পশ্চিমি সভ্যতায় মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিককালের শুরু। আমাদের প্রাচ্যে এই মধ্যযুগ আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে, আমরা আধুনিককালে উপনীত হয়েছি আরও অনেক পরে।
ইতালির কবি পেত্রার্ক-কে অনেকেই এখন মনে রেখেছেন তাঁর পত্নী লরার উদ্দেশ্যে রচিত সনেটগুলির জন্য, কিন্তু এই পেত্রার্ক-ই বলতে গেলে প্রথম রনেশাঁসের মূল সূত্রটি উচ্চারণ করেছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে পেত্রার্ক বললেন যে, প্রায় এক হাজার বছরব্যাপী যে মধ্যযুগ, তা প্রায় একটা অন্ধকার যুগ, এর আগেকার যে গৌরবময় ক্লাসিকাল যুগ, তার কথা আমরা ভুলে গেছি। ক্লাসিকাল যুগের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সুনীতির পুনরুদ্ধার করতে হবে, এবং শুধু সেগুলির অনুকরণ নয় তাদের উৎকর্ষের বিশ্লেষণ করে এগোতে হবে সামনে, নইলে একালের বর্বরতার অবসান হবে না। তরুণ সমাজকে তিনি ডাকলেন ‘বিস্মরণের ঘুম ভেঙে জাগতে। এই সময় এক নতুন মানবতাবাদেরও জন্ম হল, এতদিন ইউরোপে পাপবোধ এবং ঈশ্বর-নির্ভরতা প্রবল ছিল (আমাদের নিয়তিবাদের মতন), এই সময় থেকে একটা চেতনা জাগ্রত হল যে মানুষ নিজেই নিজের নিয়ন্তা এবং কর্মফলের প্রভু। মৃত্যুর পরে আত্মাকে রক্ষা করার চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ জীবনের চিন্তায় মগ্ন হল। এই চিন্তার প্রতিফলন হল শিল্পে, সাহিত্যে।
বহু শত বর্ষ ধরে রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ইতালি ছেড়ে চলে গিয়েছিল কনস্টান্টিনোপল। বড় বড় পণ্ডিত ও দার্শনিকেরা বাসা বেঁধেছিলেন সেখানে। মধ্যযুগের সায়াহ্নে সেই কনস্টান্টিনোপলের গৌরবও প্রায় অস্তমিত, তরুণ তুর্কিরা সেখানে বারবার হানা দিচ্ছে, রোমান সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন করে সেখানে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা আসন্ন। তাই দেখে বড় গ্রিক পণ্ডিত-দার্শনিকরা চলে এলেন রোমে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে ইতালি আবার উন্নত হয়ে উঠল। খ্রিস্টান জগতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি পোপের আধিপত্য খর্ব হল অনেকটা, ভ্যাটিকানের ওই সর্বোচ্চ পদের জন্য দুই পোপ সাধারণ স্বার্থসম্পন্ন মানুষের মতন এমন লড়ালড়ি শুরু করে দিল যে, ঈশ্বরের এই প্রতিনিধি সম্পর্কে অনেকের ভক্তিশ্রদ্ধা চলে গেল। বিজ্ঞানেও এল নতুন আলো। এতদিন ধরে পণ্ডিতেরা বিজ্ঞানের তত্ব নিয়েই শুধু আলোচনা করতেন এবং বই লিখতেন, এখন শুরু হল হাতে-কলমে পরীক্ষা, জন্ম হল আধুনিক বিজ্ঞানের। কোপারনিকাস এবং গ্যালিলিও সত্যি সত্যি দেখতে পেলেন মহাকাশ। এই প্রথম শ্বেতাঙ্গ জাতি জানল যে, সূর্য আকাশ জুড়ে চলাফেরা করছে না, পৃথিবীটাই তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
মানবতাবাদের আন্দোলন ছড়িয়ে গেল অন্যান্য দেশেও। দুর্ধর্ষ স্প্যানিয়ার্ড ও পোর্তুগিজ নাবিকেরা অকূল জাহাজ ভাসিয়ে ঘুরে গেল আফ্রিকা, ছুঁয়ে গেল ভারত। পৃথিবীর নতুন নতুন অংশ যেমন আবিষ্কৃত হল, তেমনি আবিষ্কৃত হতে লাগল মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা। হল্যান্ডে ইরাসমুস হলেন মুক্তচিন্তার প্রবক্তা। জার্মানিতে শিল্পী ডুরের-এর সৃষ্টিতে ফুটে উঠল এই নবজাগরণের চেতনা। ফ্রান্সে তখনও বড় শিল্পী বিশেষ কেউ ছিল না, কিন্তু মনতেইন ও রাবেলে’র রচনায় দেবতাদের ছাড়িয়ে মানুষই প্রধান হয়ে উঠল। ইংরেজরা তখনও ছবি আঁকতে শেখেইনি বলতে গেলে, গান-বাজনায় তাদের অবদান শূন্য, কিন্তু অচিরকালের মধ্যেই তারা বিশ্বকে দিল এক বিস্ময়কর উপহার, উইলিয়াম শেকসপিয়র!
ইতালিতে তখন এক অভূতপূর্ব শিল্পী-সমাবেশ ঘটেছে। ফ্লরেন্স শহরেই এক সময় ধনাঢ্য মেদিচি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় একসঙ্গে ছবি আঁকা ও ভাস্কর্যে নিমগ্ন থেকেছেন মিকেলাঞ্জেলো, বত্তিচেল্লি এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মতন বিরাট প্রতিভাবান শিল্পীরা। আর একজন শিল্পী, যিনি শিল্পের ইতিহাসের একটি স্তম্ভস্বরূপ, সেই রাফায়েল তখনও অতি তরুণ।
রনেশাঁস আমলের এই সব শিল্পীদের বৈশিষ্ট্য হল, এঁরা শুধু ছবি আঁকেননি কিংবা মূর্তি বানাননি। এঁরা সমসাময়িক কালের প্রকাণ্ড ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞানেও এঁদের ছিল সমান যোগ্যতায় বিচরণ। মিকেলাঞ্জেলো ভ্যাটিকানের সিসতিন চ্যাপেলে যে চিত্রমালা রচনা করে গেছেন, সেটাই তাঁর অমরত্বের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু এক সময় আঁকা ও মূর্তিগড়া ছেড়ে তিনি যুদ্ধনীতি নির্ধারণে মন দিয়েছিলেন এবং বিশেষজ্ঞ হিসেবে গণ্য হয়েছিলেন। সত্তর বছর বয়েসে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাঁর কিছু কিছু সনেট আজও বিখ্যাত। শিল্পী রাফায়েল ছিলেন এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্বিক, দলবল নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে তিনি প্রাচীনকালের প্রচুর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করেছেন।
রনেশাঁস-চরিত্রের প্রতিভূ বলা যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি নিঃসন্দেহে মোনালিসা। এর প্রিন্ট দেখেনি, শিক্ষিত সমাজে এমন মানুষ বিরল। তাঁর ‘দা লাস্ট সাপার’ প্রায় একই রকম স্মরণীয়। কিন্তু এই ছবি দুটির খ্যাতি তাঁর অন্যান্য কীর্তিকে অনেকটা ঢেকে দিয়েছে। তাঁর কালে তিনি ছিলেন প্রধান স্থাপত্যবিদ ও নদী বিশেষজ্ঞ; কবিতা লিখেছেন এবং সঙ্গীত রচনা করেছেন; মনুষ্য শরীর সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল সেকালের অনেক চিকিৎসকের চেয়েও বেশি। এবং শিল্পী হিসেবে তিনি বেশি বড় ছিলেন, না বিজ্ঞানী হিসেবে, সে সম্পর্কে তর্ক তোলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, বৈজ্ঞানিক, বর্তমানকালের শেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা যেতে পারে। অনেকের মতে, তিনি তাঁর যোগ্য সময়ের চারশো বছর আগে জন্মে গেছেন! অত কাল আগে, যখন মানুষ আকাশে ওড়ার কথা চিন্তাই করেনি, তিনি তখন হেলিকপ্টারের নিখুঁত ডিজাইন করে ফেলেছিলেন।
আমবোয়াজ প্রাসাদ-দুর্গ ছেড়ে আমরা এগোলাম লিওনার্দের বাড়ির দিকে। পুরোনো শহরের পাথর বাঁধানো সরু-পথ, সবটা গাড়ি যায় না। উঁচুনীচু রাস্তা ধরে এগোচ্ছি। কোনও এক সময় লিওনার্দোর বাড়ি থেকে একটা ভূগর্ভ সুড়ঙ্গ ছিল রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত, প্রবীণ শিল্পী সেই পথে যেতেন তরুণ রাজার সঙ্গে দেখা করতে, রাজাও গোপনে আসতেন শিল্পীর কাছে।
এক সময় বাড়িটার মস্ত বড় কাঠের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। বাড়িটির নাম ‘ল্য ক্লো লুসে’। এই ধরনের বাড়িকে বলে ম্যানর হাউজ, এর সংলগ্ন রয়েছে একটা চ্যাপেল। এক সময় রাজা-রানিরাও এই বাড়িতে থেকেছেন। প্রাচীন বাড়িটি প্রায় অবিকৃত রয়েছে, এটাই এর বৈশিষ্ট্য, এর মধ্যে পা দিলেই চারশো বছর আগেকার হাওয়া যেন এখনও গায়ে লাগে।
একটাই মুশকিল, প্রচুর লোকজনের ভিড়। নিরিবিলিতে এই সব জায়গা ঘুরে দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু উপায় তো নেই। অবশ্য এখানে কেউ চ্যাঁচামেচি করে না। সারিবদ্ধভাবে সবাই নিঃশব্দে এগোয়।
রোম থেকে এখানে আসবার সময় খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে লিওনার্দো যেসব মালপত্র এনেছিলেন, তার মধ্যে ছিল তাঁর প্রিয় তিনটি ছবির ক্যানভাস। তার একটি হচ্ছে মোনালিসা। এখানে এসে বাড়িটি নিজের মতন করে সাজিয়েছিলেন। খেতে ভালো বাসতেন। তাই রান্নাঘরটি বেশ বিরাট। তাঁর বিছানাটি রাজা-রাজড়াদের যোগ্য। রাজা প্রথম ফ্রাঁসোয়া এই শিল্পীকে যে খুবই খাতির করতেন, তার প্রমাণ আছে অনেক। যে ঘরে লিওনার্দো শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, সেটি রাখা আছে হুবহু অবস্থায়। শিল্পী যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন রাজা তাঁর শিয়রের পাশে এসে বলেছিলেন।
বিভিন্ন ঘরের দেওয়ালে যেসব ছবি, তার অধিকাংশই কপি, আসলগুলি অন্যত্র চালান হয়ে গেছে। একটি ছবি দেখে আমার চোখ আটকে গেল। এক নারী, তার মুখখানা অবিকল মোনালিসার মতন, কিন্তু সমগ্র মুখমণ্ডলে বিষাদের ছায়া! আসল মোনালিসার ছবির হাসিটিই সুপ্রসিদ্ধ। ওই মহিলার মুখে হাসিটি ফুটিয়ে রাখার জন্য লিওনার্দো চেয়েছিলেন যাতে ওর মেজাজ সব সময় প্রসন্ন থাকে। মহিলাকে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকার সময় পেছন থেকে নানা রকম সঙ্গীতের ঝঙ্কার আসার ব্যবস্থা ছিল। পরবর্তীকালে লিওনার্দো এক দুঃখী মোনালিসার ছবি আঁকার কথাও ভেবেছিলেন? এ ছবিটির কথা আমি আগে কোথাও পড়িনি।
নীচের তলায় একটি ঘরে সাজিয়ে রাখা রয়েছে লিওনার্দো আবিষ্কৃত এবং পরিকল্পিত নানারকমের যন্ত্রপাতি। লিওনার্দো কিছু মডেল বানিয়েছিলেন, কিছু কিছু নিখুঁত স্কেচ করে গিয়েছিলেন, সেই সব দেখে IBM কোম্পানি সবগুলির নতুন করে মডেল বানিয়ে দিয়েছে। সে সব দেখলে সত্যি তাজ্জব হতে হয়। পেট্রোলিয়াম কিংবা বিদ্যুৎ আবিষ্কারের কয়েকশো বছর আগে এই সব যন্ত্রের আকার-প্রকারের চিন্তা একজন মানুষের মাথায় এসেছিল কী করে?
মডেলগুলির মধ্যে রয়েছে, আর্মার্ড ট্যাংক, প্লেন, হেলিকপ্টার, প্যারাসুট, ট্রিপল ফায়ার মেশিনগান, হাইড্রলিক টারবাইন, ক্যাটাপল্ট, অনেক রকমের কামান এবং বিভিন্ন ধরনের সেতু। আমাদের মধ্যে অসীমই একমাত্র বিজ্ঞানের ছাত্র, সে উৎসাহের সঙ্গে জিনিসগুলোর ব্যাখ্যা করে শোনাতে লাগল। ভাস্কর এক সময় বলল, ওফ! একটা লোক এক জীবনে এত কিছু করেছে, আর পারা যাচ্ছে না!
আমি বাদলকে বললাম, ম্যানেজার সাহেব, খিদে পেয়ে গেছে। এখন কিছু খাবারের ব্যবস্থা করলে হয় না?
বাদল বলল, খিদে তো আমারও পেয়েছে খুব, মুখ ফুটে বলছিলুম না!
আগের রাত্রে পেট-জ্বালার জন্য ভয়ে আমি সকালে ব্রেকফাস্টে কিছুই খাইনি। এখন খিদে পাওয়ায় মনে হল, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছি। এত কিছু দেখে আমাদের মন ভরে গেছে, এবার পেটের জন্য কিছু চাই।
বাইরে বাগানের উজ্জ্বল আলোয় এসে লিওনার্দোর রচনার তিনটি লাইন মনে পড়ল। ‘আলোর দিকে তাকাও, ভোগ করো এর রূপ। চক্ষু বোজো এবং আবার দ্যাখো। প্রথমেই তুমি যা দেখেছিলে তা আর নেই, এর পর তুমি যা দেখবে, তা এখনও হয়ে ওঠেনি।’
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া রাস্তার ধারে এক মাঠে বসে সেরে নিয়ে আমরা আবার চলিষ্ণু হলাম পরবর্তী অভিযানে। পরের দুটো দিন আমরা আরও বেশি কয়েকটি শাতে দেখলাম, যেমন ব্লোয়া, অঁজে-ল্য-রিদো, শিনো, অঁজে, শোর্মো -সুর লোয়ার, তুর; একটুখানি দেখে বাঁ পাশ দিয়ে ঘুরে গেলাম তালমি, সোমুর, পিথিভিয়ের, ল্য মান, বোজেনসি প্রভৃতি স্বল্পখ্যাত জায়গাগুলি। সবগুলির বর্ণনা দেওয়ার কোনও মানে হয় না। এর মধ্যে ব্লোয়া এবং অঁজে বেশ বিরাট, ইতিহাস ও শিল্প-সম্পদে সমৃদ্ধ, কিন্তু ততদিনে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অঁজে-তে ট্যাপেস্ট্রির দারুণ সংগ্রহ রয়েছে। বড় বড় কার্পেটের ওপর ফুটিয়ে তোলা ধারাবাহিক চিত্র। সেগুলি মূল্যবান ঠিকই কিন্তু ট্যাপেস্ট্রি দেখে আমি বিশেষ সুখ পাই না। একঘেয়ে লাগে।
ছোট ছোট শহরগুলির শুধু শাতো নয়, ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করার জন্য নানারকম মিউজিয়াম ও সংগ্রহশালাও থাকে। ওয়াইন মিউজিয়াম, প্রায় সর্বত্র, তা ছাড়া আর কত রকমের যে সংগ্রহশালা। যেমন মাশরুম মিউজিয়াম, রেল মিউজিয়াম, সমরাস্ত্রের মিউজিয়াম, পোশাক মিউজিয়াম ইত্যাদি। আমরা সময় বাঁচাবার জন্য দুটো একটা দেখি মাত্র।
একটা জায়গায় বেশ মজা হয়েছিল, সেটা বলে প্রসঙ্গটা শেষ করি।
একটা দুপুর আমরা কাটালাম শিনোঁ (Chinon) শহরে। মধ্যযুগীয় ক্ষুদ্র শহর, এক সময় পুরোটাই প্রাচীর ঘেরা ছিল, এখনও সেই প্রাচীর কিছু কিছু রয়ে গেছে। লোয়ার নদীর এক শাখা নদী ভিয়েন, তার তীরেই দুর্গ ও অনেক পুরোনো বাড়ি, অদূরেই গভীর জঙ্গল। ভারী সুন্দর জায়গাটি। এক কালে এই নগর ও দুর্গ ইংরেজ রাজাদের অধীনে ছিল।
শাতোটি দেখতে বেশি সময় লাগল না। কিন্তু এখানকার একটি মিউজিয়াম দেখব বলে আগেই ভেবে রেখেছিলাম। সেটার নাম পুরোনো শিনোঁ এবং রিভার ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়াম। কথিত আছে, ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরির পুত্র রিচার্ড দা লায়নহার্ট এখানে যুদ্ধ করতে-করতে মারা যান এবং ওই বাড়িটিতে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। ছোটবেলা থেকে ইতিহাসে সিংহ-হৃদয় রিচার্ডের কাহিনি পড়ে রোমাঞ্চিত হয়েছি, ইনি ক্রুশেড় লড়তে গিয়েছিলেন, শেরউডের জঙ্গলে দুস্য রবিহহুডের দলবলের মাঝখানে ইনি হঠাৎ এসে উপস্থি হয়েছিলেন। ‘দা লায়ন ইন উইন্টার’ নামে একটা দুর্দান্ত নাটকও আছে। সেই বীরকেশরীর সমাধিটা একবার দেখব না!
অনেক ঘুরে ঘুরেও সেই মিউজিয়ামটির সন্ধান পাওয়া গেল না। অসীম রাস্তার নানা ধরনের লোকজন, কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে ডেকে জিগ্যেস করে, কেউ কিছু বলতে পারে না। কেউ যেন ওই মিউজিয়ামের নামই শোনেনি। অনেকেই বলল, এখানে একটা বিখ্যাত ওয়াইন মিউজিয়াম আছে বটে, কিন্তু ওইরকম ইতিহাসের কিছু মিউজিয়াম আছে বুঝি!
আশ্চর্য দেশ! এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা পর্যন্ত ওয়াইন মিউজিয়ামের খবর রাখে, অথচ একটা ঐতিহাসিক মিউজিয়ামের কথা জানে না?
শিনোঁ অঞ্চলের ওয়াইন অবশ্য বিখ্যাত। প্রতি বছর এখানে মদের উৎসব হয়। প্রখ্যাত লেখক রাবেলে’র শহর এই শিনোঁ। গারগানতুয়া ও পান্তাগ্রুয়েল নামে দুই ভালো মানুষ দৈত্যের কাহিনি লিখেছিলেন তিনি। গারগানতুয়া জন্মের পরেই ড্রিংক, ড্রিংক বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল। এখানে পাহাড়ের গুহায় বড় বড় ওয়াইনের বোতল সাজানো থাকে। সে যাই হোক, ওয়াইন মিউজিয়াম দেখার কোনও আগ্রহ আমাদের নেই।
ইতিহাসের মিউজিয়ামটা কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দেখে আমার বন্ধুদেরও সন্দেহ দেখা দিল। ভাস্কর বলল, কী রে, তুই ঠিক জানিস তো ওরকম কিছু আছে এখানে?
আমার তখন জেদ চেপে গেছে। ওটা দেখতেই হবে। বললাম, আমার কাছে ঠিকানা লেখা আছে, পায়ে হেঁটে খুঁজে দেখব।
গাড়িটা পার্ক করা হল শহরের মাঝখানে। তারপর আমরা হাঁটতে লাগলাম। বেশ সরু সরু রাস্তা, অনেকটা কাশীর গলির মতন। খোলা দরজা দিয়ে অনেক বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত দেখা যায়। ঠেলাগাড়িতে বিক্রি হচ্ছে খাবার।
পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত, প্রায় আটশো বছরের পুরোনো অট্টালিকাটির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের নৈরাশ্যের নিঃশ্বাস ফেলতে হল। দরজা বন্ধ। বাইরে প্রকাণ্ড তালা ঝুলছে। আজ ছুটিছাটার দিন নয়, তবু বন্ধ কেন? একজন দারোয়ান শ্রেণির লোকের কাছ থেকে জানা গেল যে মিউজিয়ামের কিউরেটর হঠাৎ ছুটি নিয়ে গ্রামের গাড়িতে চলে গেছে বলে দরজা খোলা যাচ্ছে না। চাবি তার কাছে।
একজন কিউরেটর ছুটি নিয়েছে বলে সরকারি মিউজিয়ামের দরজা খুলবে না? এরকম ব্যাপার তো শুধু আমাদের দেশেই হয় বলে জানতাম। আমাদের দেশের কোনও কিছুর সঙ্গে সাহেবদের দেশের কোনও কিছুর পুরোপুরি মিল দেখলে আমার হাততালি দিয়ে উঠতে ইচ্ছে হয়। কলকাতা কিংবা ভারতের নিন্দে করে যারা বই লেখে, তাদের ঘাড় ধরে এনে এই ঘটনাটা দেখাতে পারলে আরও মজা হত।
মিউজিয়ামটির বাইরেই একটা ট্যাবলেটে লেখা আছে, রিচার্ড দা লায়নহার্টের এখানে মৃত্যু হয়েছিল ১১৯৯ সালে।