না-বোঝার আনন্দ? সেটাই সম্ভব!
ইংল্যান্ডে ঠিক আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও কবিসম্মেলনে যোগ দিইনি বটে, তবে বিভিন্ন সময়ে, নানান অঞ্চলে প্রকাশ্যে কবিতা পাঠ করতে হয়েছে।
প্রথমবারের কথাই আগে বলি।
আমার বাল্যবন্ধু এবং আবাল্যবন্ধু ভাস্কর দত্ত বহু বছর ধরে লন্ডনবাসী। আমি ইউরোপের কোথাও গেলেই ভাস্কর চলে আসত আমার কাছে। প্রথমদিকে, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে। পরের দিকে ভাস্কর চাকরি ছেড়ে নিজেই একটা কারখানার মালিক হয়েছিল, সুতরাং ছুটি নিতে হত নিজের কাছ থেকেই।
সেইরকমই একবার বার্লিন ফেস্টিভালে যোগ দিতে গেছি, ভাস্কর লন্ডন থেকে উড়ে এসে হাজির। তারপর গোটা সপ্তাহ রয়ে গেল আমাদের সঙ্গে। সব সেমিনারে, কবিতা পাঠে ভাস্কর উপস্থিত থাকত। কিন্তু অংশগ্রহণ করার প্রশ্ন ছিল না।
অন্য লোকেরা কৌতূহলী হয়ে আমাকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করত, ইনি কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন?
ভাস্কর কখনও তা শুনতে পেয়ে বলত, আমি সুনীলের বন্ধু। এসেছি আড্ডা মারতে!
অন্য দেশের লেখকরা এ-উত্তর শুনে হতচকিত হয়ে যেত। বন্ধুর সঙ্গে শুধু আড্ডা মারার জন্য পয়সা খরচ করে কেউ এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে আসে, এটা ওয়েস্টার্ন কালচারে একেবারে অভিনব, অবিশ্বাস্যই বলা যেতে পারে। নিজের কাজ ফেলে রেখে আড়া, তার মানেই এরা বোঝে না।
লন্ডন শহরে আমি অনেকবার গেছি, কিন্তু লন্ডনের বদলে প্যারিসই তখন আমাদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল। প্যারিস শহরের আলাদা আকর্ষণ তো আছেই। তা ছাড়া আমাদের বন্ধু অসীম রায় একখানা আস্ত বাড়িতে একা থাকে। সে বিয়েটিয়ে করেনি। ব্যাচেলারের বাড়িতে আড্ডা-হুল্লোড়ই বেশি জমে। এমনিতে অলস প্রকৃতির ভাস্কর, প্যারিসে এসে অপূর্ব মাংস রান্না করার ভেলকি দেখায়।
সেরকমই একবার প্যারিসে গুলতানি করছি, লন্ডন থেকে পূর্ব-পরিচিত এক যুবক একদিন টেলিফোনে অনুরোধ জানাল, লন্ডনে দুর্গাপুজোর সময় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাকে কবিতা পাঠ করতে হবে।
লন্ডন তো ভাস্করের জমিদারি, সুতরাং এ-ব্যাপারে ভাস্করের মতামত নিতে যেতেই ভাস্কর মুখ বিকৃত করে বলল, বাদ দে! বাদ দে!
অর্থাৎ এখানকার আড্ডার মৌজ ছেড়ে অন্য কোথাও কবিতা পড়ার জন্য যাওয়ার কোনও মানে হয় না!
কিন্তু যুবকটি নাছোড়বান্দা। সে প্রতিদিন ফোনে জ্বালাতন করতে লাগল। একদিন ভাস্কর নিজেই ফোন ধরার পর ছেলেটি এমন কাকুতি-মিনতি করতে লাগল যে, ভাস্কর আর তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারল না। আমার হয়ে ভাস্করই কথা দিয়ে দিল।
তখন ঠিক হল, অসীমকেও নিয়ে আমরা সদলবলেই লন্ডনে যাব। সেখানে ওই অনুষ্ঠানের দিনটা কাটিয়েই আমরা চলে যাবে স্কটল্যান্ডের দিকে বেড়াতে। স্কটল্যান্ডের প্রকৃতি বড়ই মনোহর। প্যারিস থেকে লন্ডনে উড়ে যেতে মাত্র এক ঘণ্টা সময় লাগে।
লন্ডনের বেলসাইজ পার্কেই হয় সবচেয়ে বড় দুর্গাপুজো। দূর-দূর থেকে বহু বাঙালির সমাগম হয় এখানে। এই উপলক্ষে মেয়েদের শাড়ি ও পোশাকের বাহার দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
দুর্গাপুজোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই এখানকার পাড়ার জলসার মতন। নাচ, গান, আবত্তি, বক্ততা সবই আছে। তার মধ্যে আমার কবিতা পাঠ একেবারেই অবান্তর। অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েই বুঝতে পারলাম, ভুল করেছি।
কিন্তু এসে যখন পড়েছি, তখন একবার তো মঞ্চে উপস্থিত হতেই হবে। পাদপ্রদীপের আলোয় এসেই মনে হল, এখানে আমার কবিতা শোনার জন্য কারুরই আগ্রহ নেই। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। অনেকের সঙ্গেই অনেকের অনেকদিন পর দেখা, সুতরাং কে নতুন বাড়ি কিনেছে, কে গাড়ি বদল করেছে, কার বিয়ে হল, নতুন শাড়ি ও গয়না কেনা হল কোথা থেকে, এইসব আলোচনাই বেশি জরুরি। তার মধ্যে রয়েছে বাচ্চাদের চেল্লামেল্লি।
বাঙালিদের এই এক অদ্ভুত স্বভাব। যখন তারা সাহেবদের কোনও অনুষ্ঠানে যায়, তখন কেউ গোলমাল করা তো দূরে থাক, একটি কথাও বলে না। ঠিক সময় উপস্থিত হয়, বাচ্চাদের বাড়িতে রেখে আসে। কিন্তু নিজেদের অনুষ্ঠানে সময়ের মা-বাপ নেই, অনুষ্ঠান চলাকালীন অনবরত কথা চালাচালি হয়, আর বাচ্চারা তো আছেই।
ঘোষণা করা হয়েছিল যে, আমি একগুচ্ছ কাব্য পাঠ করব। কিন্তু আমি ঠিক করলাম, একটি মাত্র কবিতা কোনওক্রমে শেষ করেই পালাতে হবে। তা ছাড়া, আমার মনে-মনে একটা সংকল্প আছে, যে-কোনও জায়গায়, একটি কবিতা পড়ার পর দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে যদি অনুরোধ না আসে, তাহলে আমি দ্বিতীয় কবিতা পড়ি না।
এখানে কবিতাটি পড়া শুরু করার পরই টের পেলাম, কেউই শুনছে না। সুতরাং তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য লাইন বাদ দিতে লাগলাম মাঝে মাঝে। দেড় মিনিটের মধ্যেই মঞ্চ থেকে আমার বিদায়।
এরকম একটি বাজে ঘটনা উল্লেখ করার কারণ, আমার জীবনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় ঘটনা, এর থেকে আমি বিশেষ এক শিক্ষা পেয়েছি।
বাইরে এসে দাঁড়াবার পর অসীম ব্যঙ্গ করে বলল, সুনীল, এই জায়গায় এসে তোমার মানসম্মান খোয়ানোর কোনও দরকার ছিল? আজ সকালেই আমরা স্কটল্যান্ডের দিকে চলে যেতে পারতাম।
ভাস্করও রেগে গিয়ে বলল, ভেবেছিলুম, সুনীলকে প্যারিস থেকে এখানে ডেকে আনানোর ভাড়া চাইব না। এখন শালাদের কাছ থেকে ভাড়ার টাকা তো আদায় করবই, অনেক টাকা ফি চাইব!
অসীম বলল, তুমি চাইলেই দিচ্ছে আর কি!
এইসময় একটি অচেনা যুবক কাছে এসে লাজুক গলায় আমাকে বলল, একটা কথা বলব? যদি কিছু মনে না করেন
আমি বললাম, বলো–
সে বলল, আপনি ‘সত্যবদ্ধ অভিমান’ কবিতাটি থেকে মোট সাতটা লাইন বাদ দিলেন কেন? তাতে কি কবিতাটির ক্ষতি হয়নি?
আমি স্তম্ভিত! আমার ফাঁকিবাজি এই যুবকটি যে শুধু ধরতে পেরেছে তাই-ই নয়, ঠিক ক’টা লাইন বাদ দিয়েছি তাও সে বুঝেছে! আমি ওকে ঠকিয়েছি!
এই প্রসঙ্গে গিরিশচন্দ্র ঘোষের একটি বিখ্যাত উক্তির কথা মনে পড়ে। মফসসলে অভিনয় করতে গেলে যখন বোঝা যায়, দর্শকরা অনেকেই অশিক্ষিত, উচ্চাঙ্গের ভাব কিছুই বুঝবে না, তখন অনেক দলই দায়সারা অভিনয়ে করে চলে যায়। গিরিশবাবু তাঁর দলের লোকদের বলেছিলেন, সবসময় মনে রাখবে, দর্শকরা যেমনই হোক, তাদের মধ্যে অন্তত একজন আছে, যে প্রকৃত বোদ্ধা, শুধু তার কথা ভেবে, তার সম্মানে মনপ্রাণ দিয়ে অভিনয় করবে!
আর একবার কবিতা পাঠ করেছিলাম বাংলাদেশিদের এক সম্মেলনে।
লন্ডনে কিংবা ইংল্যান্ডের নানান জায়গায় বাংলাদেশিরা নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে, কিন্তু পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের তেমন কোনও উদ্যোগ নেই। এরা দুর্গাপুজো করে, রবীন্দ্রচর্চার কেন্দ্রও আছে, কিন্তু আধুনিক বাংলা সাহিত্য নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই।
বাংলাদেশিদের এক সংগঠন শুধু যে বাংলাদেশ থেকেই লেখক-শিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায়, তাই-ই নয়, পশ্চিমবঙ্গ থেকেও কারুকে-কারুকে অতিথি করে আনে। সেবারে আমন্ত্রিত, শামসুর রাহমান আর আমি।
লন্ডনে গেলে আমি ভাস্করের বাড়িতে থাকব, এটাই অবধারিত। এয়ারপোর্ট থেকে ভাস্কর আমাকে নিয়ে এসেছে, একটু পরেই দুটি বাংলাদেশি যুবক এসে হাজির।
তারা দৃঢ়ভাবে দাবি করল, এবারে আমি তাদের আমন্ত্রণে এসেছি, সুতরাং তাদের আতিথ্যেই আমাকে থাকতে হবে, সম্মেলনের তিন দিন অন্তত। ভাস্কর কিছুতেই রাজি নয়, ওরাও ছাড়বে না। শেষপর্যন্ত আমি ভাস্করকে বললাম, তিনটে দিন ওদের সঙ্গে থেকে আসি, তারপর তো এখানে ফিরে আসবই।
ভাস্কর বেশ রেগে গিয়েছিল, পরে অবশ্য ওই বাংলাদেশি যুবকদের সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়ে যায়। ওরাও ভাস্করের ভক্ত হয়ে পড়ে।
আমাকে নিয়ে ওরা তুলল এক ডাক্তারের বিশাল বাড়িতে। অত্যন্ত ধনী ডাক্তারটি আবার একজন কবিও, তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও আছে। খুব সহৃদয় মানুষ, অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার, শুধু তাঁর একটাই দোষ, যখন-তখন নিজের লম্বা-লম্বা কবিতা শোনাতে শুরু করেন।
ব্যস্ত ডাক্তারটি খুব ধর্মপ্রাণও বটে, নিয়ম করে সারাদিনে পাঁচ ওক্ত নামাজ পড়েন। একজন চুপি চুপি আমাকে জানাল, এ-বাড়িতে আমার আদর-আপ্যায়নের কোনও ত্রুটি হবে না, বরং বাড়াবাড়িই হবে, কিন্তু বাড়ির মধ্যে মদ্যপান নিষিদ্ধ। ধূপমানও চলবে না।
আমাকে একটা আলাদা ঘর দেওয়া হল। সেখানে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে মদ্যপান করা যেত, তবু আমি ঠিক করলাম, এই তিনদিন সুরাবর্জিত হয়েই থাকব। দেখা যাক, পারি কি না!
তবে, সুরার চেয়েও তামাকের নেশা বেশি প্রবল। তাই বাথরুমে ঢুকে মাঝে মাঝে সিগারেটে কয়েক টান না দিয়ে পারিনি।
এই প্রসঙ্গে একটা মজার ব্যাপার উল্লেখ করা যায়। কয়েক বছর পর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই একই বাংলাদেশিদের সংগঠনের আমন্ত্রণে লন্ডনে গিয়েছিল। শীর্ষেন্দুকেও এই একই ডাক্তারের বাড়িতে থাকতে হয়।
আমি ঘোর নাস্তিক আর শীর্ষেন্দু নিষ্ঠাবান ধার্মিক। ওর একটু ছোঁয়াছুঁয়িরও ব্যাপার আছে। আমি গোরুখোর, কোনওরকম মাংসেই আপত্তি নেই, আর শীর্ষেন্দু মাছ-মাংস স্পর্শই করে না। সেই বয়স্ক ডাক্তারবাবুটিও নিষ্ঠাবান মুসলমান, কিন্তু অন্য ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা আছে, যেমনটি ছিল এককালের পূর্ববঙ্গে। শুনেছি, শীর্ষেন্দুর সম্মানে, ওর রান্নাবান্নার জন্য তিনি বাড়িতে এক পৈতেওয়ালা বামুন আমদানি করেছিলেন!
আমাকে অবশ্য তিনদিনই সুরাবর্জিত হয়ে কাটাতে হয়নি। দুদিন দিব্যি কাটিয়ে দিলাম, এমন আত্মশ্লাঘাও বোধ করছিলাম যে মদ্যপান না করে আমি যেন এক বিরাট সংযমের পরিচয় দিচ্ছি। তৃতীয় দিয়ে সন্ধেবেলা আমার অনুজ বন্ধু ফারুক হায়দার ফোন করল।
ফারুক খুব বড় চাকরি করে, দিলদরিয়া, সে একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী, বাংলা ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা বলে বিশুদ্ধ উচ্চারণে। টেলিফোনে আমার কুশল সংবাদ নিতে-নিতে ফারুক জিগ্যেস করল, ওখানে ড্রিংক করছেন কী করে? ডাক্তারসাহেবের তো নানারকম শুচিবাই আছে।
আমি হাসতে-হাসতে বললাম, ড্রিংক করছি না। তাতে ভালোই আছি।
ফারুক আঁতকে উঠে বলল, একফোঁটাও খাননি? এ ভারী অন্যায়। অতিথি হচ্ছে নারায়ণ, তার সবরকম সেবা করা উচিত। ডাক্তারসাহেব তার বাড়ির নিয়ম আপনার ওপর খাটাবে কেন? আমি এখুনি মদ নিয়ে আসছি।
আমি বললাম, আরে না, না। আমার লাগবে না। সত্যিই কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কালকে তো চলেই যাব।
ফারুক শুনল না। আধঘণ্টার মধ্যে চলে এল, সঙ্গে দুটি স্কচের বোতল।
তা-ও আমার ঘরের নিভৃতিতে নয়, প্রশস্ত বসবার জায়গায় এসে ফারুক ঘোষণা করল, কই গেলাস দিন। ডাক্তারসাহেব, আপনি সুনীলদাকে মদ্যপান করতে নিষেধ করেছেন কেন?
ডাক্তারসাহেব আকাশ থেকে পড়ে বললেন, আমি বারণ করেছি? কখখনো না। আমি জানব কী করে যে উনি ড্রিংক করেন? তাহলে আমি নিজেই বোতল আনিয়ে দিতাম।
ফারুক দুটি গেলাসে সুরা ঢেলে বলল, আর-একটা গেলাস, আপনিও আজ থেকে শুরু করবেন নাকি?
ডাক্তারসাহেব হাতজোড় করে বললেন, ওইটি পারব না। তোমরা খাও যত ইচ্ছা, আমি এর ঘ্রাণ থেকেও একটু দূরে থাকতে চাই।
ফারুক ও-বাড়ির নিয়ম ভঙ্গ করেই খুশি। আমরা শুধু একবার গেলাস খালি করেই বেরিয়ে পড়লাম।
এদের সম্মেলনটি হয়েছিল ইস্ট লন্ডনের একটি বড় সভাকক্ষে এবং তা উপচে পড়েছিল শ্রোতার সংখ্যায়। কয়েকটা গান ও ছোটখাটো বক্তৃতাও হয়েছিল বটে, কিন্তু কবিতা পাঠই প্রধান। ডাক্তারসাহেব প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তিনি একাই কবিতা পড়লেন আধঘণ্টা।
শামসুর রাহমান প্রথম দিন আসতে পারেননি। তাঁর ফ্লাইট পৌঁছোয় পরের দিন। উদবোধনের দিন আমাকে কবিতা পাঠ করতে হয়েছিল, গুনে-গুনে মোট এগারোটি। প্রথম দুটি আমার নির্বাচিত, তারপর শ্রোতাদের কাছ থেকে অনুরোধ আসতে লাগল। একসঙ্গে তিন-চারজনও চিৎকার করে বলতে লাগল কোনও একটি কবিতার নাম। এরকম শ্রোতা পেলে কার না পড়তে ভালো লাগে!
এগারোটিও পরেও অনুরোধ এসেছিল, তখন আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নেমে পড়েছি মঞ্চ থেকে।
এবারে আমার একেবারে প্রথমবার ইংল্যান্ড ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বলি।
সে অনেককাল আগের কথা। তখন ভাস্করও লন্ডনে যায়নি। ওখানে আমার পরিচিত কেউই প্রায় ছিল না।
সেবার আমি গিয়েছিলাম ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে। তখন কালচারাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে ইংল্যান্ড থেকে কোনও কবি বা লেখক আসতেন ভারতে, আর এদেশ থেকেও কোনও কবি-লেখকদের আমন্ত্রণ জানানো হত ইংল্যান্ডে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, আমেরিকা থেকে ফেরার পথে আমাকে দশ দিনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের আতিথ্য নিতে হবে। উত্তম হটেলে থাকার ব্যবস্থা, খাদ্য-পানীয় এবং ঘোরাঘুরি সবকিছুর দায়িত্ব সরকারের।
সে-যাত্রায় টি এস এলিয়টের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। উনি তখন ফেভার অ্যান্ড ফেভার নামে একটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কবি স্টিফেন স্পেন্ডারও একদিন দেখা করতে এসেছিলেন আমার হোটেলে। যতদূর মনে হয়, এসব কথা আমি অন্য কোথাও লিখেছি, তাই পুনরুক্তি করছি না।
অন্য একটি অভিজ্ঞতার কথা এখনও অলিখিত আছে। সরকারি পয়সায় লন্ডনের কয়েকটি থিয়েটার ও দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখার পরেও আমাকে বাইরে পাঠানো হয়েছিল কয়েক জায়গায়।
তার মধ্যে অবশ্যই একটি স্থান, শেকসপিয়রের জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড অন আভন। আমার সঙ্গে সবসময়ই একজন-না-একজন গাইড থাকে। গাইডের বদলে বলা হয় কমপানিয়ান।
স্ট্রাটফোর্ডে বাস থেকে নামার পরেই আমাকে অভ্যর্থনা জানাল একজন রমণী। সে আগামী তিন দিন আমার সঙ্গে থাকবে। তার নাম মার্থা। আমার বয়েস তখন ঠিক তিরিশ, মার্থাও সেই বয়েসিই হবে, একটু বড়ও হতে পারে। খাঁটি ব্রিটিশ।
আমেরিকার চেয়ে ইংল্যান্ডে আমি সবসময় কেমন যেন অশ্বস্তি বোধ করতাম। আমেরিকানদের স্বভাবটা অনেকটা খোলামেলা হয়, সেই তুলনায় ইংরেজরা অনেক ফর্মাল। এখানে এসে কোনও বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়নি, শুধু ইংরেজদের সঙ্গেই কথাবার্তা বলতে হচ্ছে। আমি পরাধীন ভারতের সন্তান, তাই ইংরেজরা ছিল আমাদের চোখে রাজার জাত। যদিও আমরা ইংরেজি কাব্য-সাহিত্য পড়েই পশ্চিমি সভ্যতার স্বাদ পেয়েছি, তবু শাসক ইংরেজদের সম্পর্কে মনের মধ্যে কিছুটা বিদ্বেষ ও বিতৃষ্ণার ভাব ছিল। আরও কয়েক বছর আগে জন্মালে আমি নির্ঘাত বিনয়-বাদল-দীনেশের সহযোগী হতাম। আমি প্রথমবার যখন ইংল্যান্ডে যাই, তখন স্বাধীনতার পর মাত্র সতেরো বছর কেটেছে, কিন্তু পরাধীন আমলের স্মৃতি কিছুটা রয়ে গেছে।
স্ট্রাটফোর্ডের মার্থাই আমার সেই অস্বস্তির ভাব কাটিয়ে দিল।
তার ব্যবহারের মধ্যে ব্রিটিশরাজের কোনও গন্ধ নেই। খুবই সরল, সাবলীল ব্যবহার। দুজনেই সমবয়েসি, তাই তাড়াতাড়ি ভাব জমে উঠল। আমি তখন অববাহিত, মার্থাও কথায়-কথায় জানাল, সে বিয়ে করেনি। সেইসময়, অর্থাৎ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এসব দেশে পুরুষের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল, তাই অনেক মেয়েকেই অবিবাহিত থাকতে হত। যাই হোক, মার্থা আর আমার মধ্যে একটু প্রেম-প্রেম ভাব এসে পড়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। একমাত্র নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যেই জাতিভেদ এসে উঁকি মারে না।
এখন সুট-টাই পরার বাধ্যবাধকতা অনেক শিথিল হয়ে গেছে, কিন্তু তখনও হিপিরা আসেনি, তাই ইংল্যান্ডে বাড়ি থেকে বেরুতে হলেই পুরোদস্তুর পোশাক পরতে হত। আমি গলায় টাই বেঁধে কখনও স্বচ্ছন্দ বোধ করতাম না, বিশেষত গরমের সময়। এখন তো যতবারই বিদেশে যাই, টাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক একেবারে চুকিয়ে দিয়েছি। তখন গলায় টাই বাঁধতেই হত।
সেপ্টেম্বর মাস, একটু-একটু গরম, মার্থাই একদিন আমাকে বলল, তুমি বারবার টাইয়ের গিঁট নাড়াচাড়া করছ, টাইটা খুলেই রাখো না!
একটি ব্রিটিশ মেয়ের কাছ থেকে এরকম কথা শোনা খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল।
এবার আসল ঘটনাটা বলা যাক।
সেসময় স্ট্রার্টফোর্ডে শেকসপিয়ার ফেস্টিভাল চলছে। বিভিন্ন দল এসে অভিনয় করছে নানান নাটকের। আমি একদিন ম্যাকবেথ আর-একদিন ওথেলো দেখে নিলাম। বিশ্ববিখ্যাত শেকসপিরিয়ান অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ারকে দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল।
ওথেলো দেখে বেরিয়ে আসছি, থিয়েটার হলের বাইরে একটা জটলা চোখে পড়ল। একজন চিৎকার করে কিছু বলছে, তাকে গোল করে ঘিরে শুনছে অনেকে।
কৌতূহলী হয়ে উঁকি মারলাম।
আসলে ওখানে চলছে কবিতা পাঠ। পথসভার মতন পথ-কবিতা। এক-একজন দুটো তিনটে কবিতা পড়ে সরে যাচ্ছে, আর-একজন আসছে। সবই ইংরেজিতে, একটি তরুণী মেয়ে পাঠ করল ফরাসি কবিতা। ক্রমে আরও জমে উঠল ভিড়।
একসময় উদ্যোক্তাদের একজন শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, আপনাদের মধ্যে কোনও কবি আছেন? থাকলে, ইচ্ছে করলে এখানে কবিতা পড়তে পারেন।
আমি কিছু বুঝবার আগেই মার্থা চেঁচিয়ে বলল, এখানে একজন কবি আছেন, ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন।
অমনি কয়েকজন আমার দিকে ফিরে বলল, আমরা ইন্ডিয়ান কবিতা শুনতে চাই।
মার্থা আমাকে প্রায় ঠেলেই পাঠাল মাঝখানে।
আমি দারুণ বিব্রত হয়ে বললাম, আমি কী কবিতা পড়ব? আমার কাছে কোনও ইংরেজি কবিতা নেই।
তখন কয়েকজন বলল, ইংরেজি না হোক, তুমি ইন্ডিয়ান কবিতাই শোনাও।
আমি বললাম, ইন্ডিয়ান কবিতা বলে কিছু হয় না। ইন্ডিয়ার অনেক ভাষা। আমি লিখি বাংলা ভাষায়। তা তো তোমরা কেউ বুঝবে না।
তবুও অনেকে বলল, বাংলাই শোনাও! আমার যে নিজের কবিতাও মনে থাকে না। মুখস্থ বলব কী করে? একবার ভাবলাম রবীন্দ্রনাথের কোনও কবিতা বলে দেব। তারপর মনে পড়ল আমার নিজের একটি মাত্র কবিতা মুখস্থ হয়ে গেছে। তা-ও অন্যদের মুখে শুনে শুনে, ‘কেউ কথা রাখেনি। অনেকেই আবৃত্তি করে, আমাকে বাধ্য হয়ে শুনতে হয়।
চেঁচিয়ে বলে দিলাম সেটাই। তারপর কী বিপুল হাততালি। কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়।
একটি শব্দও কেউ বোঝেনি, তবু এত হাততালি কেন? ভদ্রতা কিংবা না-বোঝার আনন্দ? সেটাই সম্ভব!
কী হল, সে তো অন্য গল্প!