‘‘বিদায় বিষাদ
স্বাগত বিষাদ
তুমি আঁকা আছে দেওয়ালের কড়িকাঠে
তুমি আঁকা আছে আমার ভালোবাসার চোখে তুমি
নও সম্পূর্ণ দুঃখ
কেননা দরিদ্রতম ওষ্ঠও
তোমাকে
ফিরিয়ে দেয়
এক টুকরো হাসিতে…’
–পল এলুয়ার
মার্গারিট শুধু তার হাতব্যাগটা নিয়ে চলে গেছে, আমার ঘরে ছড়িয়ে আছে তার অনেক জিনিসপত্র। তার বই-খাতা, টাইপ-রাইটার, রেন কোট, এক জোড়া মোজা, আরও কত কি টুকিটাকি। আমাকেও এর মধ্যে সে উপহার দিয়েছে অনেক কিছু। যেমন একটা ড্রেসিং গাউন। দেশে থাকতে আমি বাংলা সিনেমার নায়িকাদের বাবাদেরই শুধু ড্রেসিং গাউন পরতে দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ যে আলখাল্লা পরতেন, সেটাও এক ধরনের ড্রেসিং গাউন বলা যায়। ও জিনিস গায়ে জড়াবার ইচ্ছে আমার কখনও হয়নি। কিন্তু এ দেশে একটা মুশকিল এই যে, যে-কোনও পোশাকে বাইরের লোকের সামনে দরজা খোলা যায় না। আমি রাত্তিরে দিশি প্রথায় পাজামা আর গেঞ্জি পরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুই, শ্লিপিং সুট ফুট কিছু কেনা হয়নি। কিন্তু এক একদিন দেরি করে ঘুমোলে, সকালে কেউ যদি দরজায় নক করে তখনই হয় মুশকিল। আমার শয়নকক্ষ আর বসবার ঘর একই। কেউ এসে ডাকলেই আমি, ওয়ান মিনিট প্লিজ, বলে তড়াক করে লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে, ম্যাজিশিয়ানদের মতন অতি দ্রুত পোশাক পালটাই, পাজামার বদলে ট্রাউজার্স, একট শার্ট গলিয়ে ভেতরে খুঁজে বেল্ট বাঁধতে হয়, তারপর দরজা খুলে হাঁপাতে হাঁপাতে হাসিমুখে বলি গুড মর্নিং! এমনকি, কেউ না ডাকলেও, একতলা থেকে খবরের কাগজ কিংবা চিঠি আনতে হলেও ওরকম ভদ্রস্থ পোশাক পরে নিতে হয়।
প্রথম প্রথম দরজা খুলতে আমার দেরি দেখে মার্গারিট জিগ্যেস করত, তুমি একক্ষণ কী করো বলো তো? আমি সত্যি কথাটা জানিয়ে দিলে ও হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার সঙ্গে তোমার অত ভদ্রতা করতে হবে না, তুমি যে-কোনও সাজে থাকতে পারো। তবে, অন্যদের জন্য, তুমি ড্রেসিং গাউন কিনে নাও না কেন, ওতে সাত খুন মাফ। এমনকি তুমি ভেতরে নগ্ন অবস্থাতেও একটা ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে নিলে, সেটাও ভদ্রতাসম্মত।
আমাকে কেনার সুযোগই না দিয়ে পরের দিনই মার্গারিট একটা নীল রঙের তোয়ালের কাপড়ের ড্রেসিং গাউন নিয়ে এল। সেটা পরেই এখন আমি বসে আছি। অথচ মার্গারিট আর আসবে না।
আমার ঘরে মার্গারিট তার টাইপ রাইটার ও এত বই কাগজপত্র ছড়িয়ে দেখে গেছে। সে কি কখনও ভেবেছিল, হঠাৎ তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে?
মার্গারিটদের হস্টেলের বারান্দায় বারোয়ারি ফোন। দু’বার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া গেল না। এর মধ্যে পল এঙ্গেল ফোন করে আমাকে মার্শাল টাউন নামে একটি অদূরবর্তী শহরে নিয়ে যাওরার আমন্ত্রণ জানালেন। পল এঙ্গেল এমন জোর দিয়ে দিয়ে কথা বলেন যে তাঁর কোনও প্রস্তাবেই না বলার উপায় নেই। ফ্রেঞ্চ ডিপার্টমেন্টে গিয়ে মার্গারিটের জন্য একটা ছোট্ট চিঠি লিখে রেখে এলাম। তার কাছে এখন আমার ঘরের দ্বিতীয় চাবি আছে, সে যে-কোনও সময় আসতে পারে।
পল এঙ্গেলের গাড়িটা থান্ডারবার্ড। রেড ইন্ডিয়ান নাম। একটা বোতাম টিপলে জানলা কাঁচ আপনি ওঠে নামে। এসব জিনিস সিনেমায় ছাড়া আগে দেখিনি। গাড়ি চলতে চলতে সামান্য ঝাঁকুনি লাগলে যে গাড়ির চালককে ‘সরি’ বলতে হয়, সেটাও নতুন জানা হল। পল এঙ্গেল কাকে সরি বলছেন, রাস্তাকে, না আমাকে?
যেতে-যেতে পল তাঁর এই মার্শাল টাউন অভিযানের উদ্দেশ্যটা আমাকে জানালেন। সে এক বিচিত্র ব্যাপার। পল এঙ্গেল যখন তিন-চার বছরের শিশু, তখন তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। মা সম্পর্কে তাঁর কোনও স্মৃতি নেই। মায়ের যে দুখানা ফটোগ্রাফ ছিল, তাও নানা গোলমালে কোথায় হারিয়ে গেছে। কিন্তু ইদানীং হঠাৎ তাঁর জননী সম্পর্কে একটা অনুভূতি হচ্ছে, যে-জননীর কোনও মুখ নেই, যাঁর কণ্ঠস্বর, স্বভাব ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও পুত্রের কোনও ধারণা নেই। পল এঙ্গেলের মায়ের এক সহপাঠিনী এতদিন ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়াগো-তে, সদ্য এসেছেন মার্শাল টাউনে। তিনিই একমাত্র জীবিত, যিনি পলের মাকে চিনতেন। পল যাচ্ছেন সেই সুজান কেন্ট নামে মহিলার কাছে, তাঁর মায়ের গল্প শোনবার জন্য।
পলের বয়েস তখন ষাটের কাছাকাছি সুতরাং তাঁর মায়ের বান্ধবীর বয়েস আশি-পঁচাশি হওয়াও স্বাভাবিক। সেই রকম বৃদ্ধা সন্দর্শনে যাওয়া আমার পক্ষে খুব একটা উৎফুল্ল হওরার মতন কিছু নয়। পল কখনও একলা গাড়ি চালাতে ভালোবাসেন না, সঙ্গে সব সময় কারুকে না কারুকে চাই। এই জন্যই তিনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, এই ভেবে প্রথমে আমি খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়ছিলাম। পরে বুঝেছি, পল আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশেষ এক উদ্দেশ্যে। সুজান কেন্ট নামের বৃদ্ধা এবং তাঁর বাড়ি, দুটিই অতি দর্শনীয় ব্যাপার। সুজান ও পলের সাক্ষাৎকারও আমার পক্ষে সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা।
সুজান কেন্ট তাঁর প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন। দুই স্বামীরই সম্পত্তি পেয়েছেন। সম্প্রতি তাঁর প্রথম স্বামীর একমাত্র ভাই নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়ায় তাঁরও বিশাল বাড়ি ও টাকাপয়সা সুজান কেন্টের নামে বর্তেছে। মার্শাল টাউনের বাড়িটাই সেই বাড়ি। আমেরিকানদের এত কম ছেলেমেয়ে হয় যে, অনেক সময় কোনও ধনী ব্যক্তি মারা গেলে তার উত্তরাধিকারী খুঁজতে উকিলরা নাজেহাল হয়ে যায়।
আমরা পৌঁছলাম বিকেলের দিকে। শোনা গেল, ডিনারের পর, ঠিক আটটা বেজে পনেরো মিনিটে সুজান কেন্ট আমাদের দর্শন দেবেন। আমাদের দেওয়া হল দুটি গেস্ট রুম। বাড়ি তো নয় প্রাসাদ, প্রধান গেট থেকে মূল বাড়িতে পৌঁছবার যে ড্রাইভওয়ে, সেটা প্রায় সিকি মাইল, দু’ পাশে অজস্র ফুলের বাগান ও কয়েকটি মর্মরমূর্তি। অতিথি কক্ষটি রাজা-মহারাজাদের থাকার যোগ্য। বাথরুমে আট-দশ রকমের পারফিউমের শিশি, সবই নতুন। জলের কলগুলি এমনই চোখ ধাঁধানো ঝকঝকে হলুদ যে মনে হয় খাঁটি সোনার তৈরি। অবশ্য সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ হতে পারিনি। আমি আসল সোনা আর নকল সোনার পার্থক্য বুঝবই বা কী করে বাথরুমটি অনেক বেডরুমের চেয়ে বড়, তার এক পাশে আছে বইয়ের যানক, তাতে নানা ধরনের বই, কবিতা-প্রবন্ধ, ডিটেকটিভ উপন্যাস।
এ দেশে দাস-দাসীর প্রথা উঠে গেছে, কিন্তু ধনীদের বাড়িতে হেলপিং হ্যান্ড থাকে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ভালো পয়সার বিনিময়ে বাসন মাজা, ঘর থোওয়া, রান্নার কাজ করে দিয়ে যায়। সে রকম তিন-চারজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম, তা ছাড়া একজন বাটলারও আছে মনে হল। ডিনার টেবিলে শুধু পল আর আমি, সেসব খাবার-দাবারের আর বর্ণনা দিয়ে কাজ নেই, তবে দু’ফুট লম্বা সেই চিংড়ি মাছটির কথা জীবনে ভুলব না। ও রকম লবস্টার কখনও চর্মচক্ষে দেখিনি। সেই ব্যাঘ্র-চিংড়িটিকে আস্ত অবস্থায় ওয়াইনে সেদ্ধ করা হয়েছে, সেই ভাবেই একটা রুপোর ট্রে-তে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছেনি বাটালির মতন জিনিস দিয়ে মাঝখানটা কেটে আমি ভেতরের খানিকটা চিংড়ি-মাংস খেলাম, বাকি সবটা পড়ে রইল। এত বড় একটা চিংড়িতে দশ-বারোজনের খাওয়া হয়ে যেত। কী অপচয়, কী সাংঘাতিক অপচয়। এ দেশের এ রকম অপচয় দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। খুব দুর্লভ দামি কোনও খাবার খেতে বসে আমার দেশের স্বজন-বন্ধুদের কথা মনে পড়ে, আমি ভালো করে খেতে পারি না। তখনই দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে। এখানে আসবার আগে কফি হাউসের মাটন ওমলেট কখনও পুরো এক খেতে পাইনি, দু-তিনজনে ভাগ করে নিতে হয়েছে, তবু সে-ও অনেক ভালো।
খাবার টেবিলে পল এঙ্গেল বললেন, আমার মা সাধারণ চাষি পরিবারের মেয়ে ছিলেন, পড়াশুনো করার সময় রেস্তোরাঁয় বাসন ধোওরার কাজ করতেন। এই সুজান কেন্টও তাঁর সঙ্গে এক ঘরে থাকতেন, একই কাজ করতেন, ভাগ্যচক্রের খেলায় তিনি আজ এত ধনী হয়েছেন।
এক সময় এক দেবদূতের মতন রূপবান যুবক (সেও আসলে কাজের লোক আমাদের জানাল যে সুজান কেন্ট আমাদের সাক্ষাৎকারের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। যেন কোনও মহারানির দরবারে ডাক পড়ল আমাদের।
এটাও বিশেষ অত্যুক্তি নয়। ফিলমে ইওরোপীয় রাজা-মহারাজাদের শয়নকক্ষ এর চেয়ে বেশি তো সাজানো হয় না। প্রায় ঘরের অর্ধেক জোড়া বিশাল একটি পালঙ্ক, বিছানার রং, দেওয়ালের রং, পর্দার রং, সবই গোলাপি, অর্থাৎ এটা পিংক রুম। ধনীদের বাড়িতে এরকম ব্ল রুম, হোয়াইট রুমও আলাদা আলাদা থাকে। সেই বিছানার প্রান্তে কয়েকটি বালিশে ঠেস দিয়ে বসে আছেন সুজান কেন্ট, বুক পর্যন্ত একটা সোনালি লেপ দিয়ে ঢাকা। প্রথম দর্শনে তাঁকে সম্পূর্ণ অলীক মনে হয়। মাথার চুল পাউডার পাফের মতন সাদা, ঠোঁটে লাল রং, কুঞ্চিত গালে রুজ মাখা, বয়েসের তুলনায় চোখ দুটি উজ্জ্বল, গাঢ় নীল। আমরা খাটের পাশে দাঁড়াতেই তিনি দু-হাত বাড়িয়ে অত্যন্ত সরু গলায় ব্যাকুলভাবে বললেন, পলি, পলি, কাম ক্লোজার, কাম ক্লোজার!
ষাট বছর বয়স্ক পল এঙ্গেল ওঁর বুকের কাছে মাথাটা নিয়ে গেলেন, আর সেই পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা পলের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে শিশুর মতন তাঁকে আদর করতে লাগলেন।
এরপর সুজান কেন্ট আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ ছেলেটি কে?
পল বললেন, এ আমার এক ভারতীয় বন্ধু।
বৃদ্ধা ভুরু তুলে জিগ্যেস করলেন, ইনজান?
এই রে, ইনি আমাকে রেড ইন্ডিয়ান মনে করেছেন। রেড শব্দটা এখন উঠেই গেছে, শুধু ইন্ডিয়ান শুনলে সবাই এখানে এদের অধিবাসীদের কথাই ভাবে। পল আমার বিস্তৃত পরিচয় দেওরার পর সেই মহিলা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ক্যালকাটা? নাইনটিন ফর্টিওয়ানে আমি গিয়েছিলাম সেখানে, বেশ ভালো শহর, ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরেছি, একটা বেশ সুন্দর নদী আছে।
একজন পরিচারক ছোট ছোট গ্লাসে লিকিওর দিয়ে গেল আমাদের। বৃদ্ধাও সেই সুগন্ধ সুরায় চুমুক দিতে লাগলেন।
এদেশের সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে। পল তাঁর মায়ের বান্ধবীকে মাসি না বলে বললেন, সুজান, তুমি আমার মায়ের কথা বলো, কেমন দেখতে ছিল মাকে। সে কি বদমেজাজি ছিল, না কোমল?
সুজান কেন্ট বললেন, তোর মা রুথ, আজও যেন স্পষ্ট দেখতে পাই তাকে। ওঃ, কী রূপ ছিল তার, আমার চেয়ে অনেক সুন্দরী, আমি তাকে হিংসে করতাম। অনেকটা লম্বা, সরল উন্নত চেহারা, কী মসৃণ চামড়া, সে কোনও জায়গা দিয়ে হেঁটে গেলে সবাই তার দিকে ফিরে ফিরে তাকাত। বাচ্চাদের প্রতি তার বিশেষ স্নেহ ছিল, রাস্তাঘাটে কোনও শিশু দেখলেই আদর করত। একবার কী হয়েছিল জানিস…
পল এঙ্গেলের মা মারা গেছেন ছাব্বিশ বছর বয়েসে। তারপর তাঁর আর বয়েস বাড়েনি। সেই ছাব্বিশ বছরের তরুণীর বর্ণনা করছেন এই পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা।
এক সময় পল বললেন, সুনীল, তুমি আর এখানে বসে থেকে কী করবে? এসব আমাদের ব্যক্তিগত কথা তোমার শুনতে ভালো লাগবে না। তুমি বরং এই বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দ্যাখো, এখানে অনেক ছবি আছে।
সুজান কেন্টও আমাকে সেই অনুমতি দিলেন।
একটি যুবক আমাকে নিয়ে গেল বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তের দোতলার একটি হলঘরে। এ যে প্রাইভেট মিউজিয়াম। ঠিক কোনও মিউজিয়ামের ঘরের মতনই সমস্ত দেওয়াল ছবিতে সাজানো, ঘরের মাঝখানে সাজিয়ে রাখা আছে কিছু ভাস্কর্য। সেই ভাস্কর্যগুলির মধ্যে একটি হেনরি মুরের। ছবিগুলির অনেক শিল্পীই আমার অচেনা, তবু তার মধ্যে আমি কামিল পিসারো, জাঁ রেনোয়াঁ এবং পাবলো পিকাসোর তিনটি ছবি আবিষ্কার করে ফেললাম। এই সব শিল্পীদের মূল ছবি। আমার সর্ব অঙ্গে শিহরণ হল। গোটা ভারতবর্ষে কোথাও পিকাসোর একটাও মৌলিক পেইটিং আছে বলে শুনিনি, অথচ মার্শাল টাউনের মতন এত ছোট্ট একটা শহরে রয়েছে। আমরা ছবির বইতে ছোট ছোট রিপ্রোডাকশান ছাড়া আর তো কোনও পিকাসো দেখিনি। এটা বেশ বড় মাপের ক্যানভাস, পিকাসোর ব্ল পিরিয়ডের আঁকা।
সেই ছবিগুলির সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ। বারবার মনে হতে লাগল, মার্গারিট আমার পাশে থাকলে ছবিগুলো কত ভালো করে বুঝিয়ে দিতে পারত, এই সব শিল্পীদের সম্পর্কে কত গল্প শোনাত।
হলঘরটির দ্বারে অটোমেটিক রাইফেলধারী একজন প্রহরী দন্ডায়মান। তা তো হবেই, এই সব ছবির দাম কোটি কোটি টাকা।
মার্শাল টাউনের সেই বাড়িটাতে আমাকে থাকতে হল তিন দিন। পল এঙ্গেল আমাকে একা থাকার এবং ইচ্ছেমতন বই পড়বার সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার সর্বক্ষণ মনে পড়ত মার্গারিটের কথা। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের চেয়েও অনেক বেশি হয়ে গেছে, কিন্তু শারীরিক ছোঁয়াছুঁয়ি চলবে না। এ যে বড় দুঃসহ ব্যাপার।
মার্গারিটের ধর্মীয় গোঁড়ামি থাকলেও সে সিগারেট খায়, সুরাপানেও আপত্তি নেই। সে হুইস্কি-রাম দু’চক্ষে দেখতে পারে না, কিন্তু ফরাসি হয়ে জন্মেছে, ওয়াইন তো খাবেই। সাহিত্য-শিল্পের ব্যাপারে তার কোনও চুতমার্গ নেই। ন্যুড স্টাডি ফরাসি শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কবিতা উপন্যাসে কোনও বর্ণনায় কোনও শব্দকেই সে অশ্লীল মনে করে না। সেই সময় ফরাসি সাহিত্যে জাঁ জেনে-কে নিয়ে খুব হইচই চলছে। জেনে একজন জন্ম-অপরাধী, সারাজীবন চুরি ও গুণ্ডামি করেছেন, মাতাল-ব্যভিচারী ও খুনীদের সঙ্গেই শুধু মিশেছেন। কোনও এক অপরাধে জেনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, তখন পর্যন্ত তাঁর নামও কেউ শোনেনি। জেলখানায় বসে এই দাগি কয়েদিটি একখানা বই লিখতে শুরু করে। শ’ দু-এক পাতা লেখা হল, তারপর জেলাখানার ঝাড়দার একদিন সেই পুরো পাণ্ডুলিপি ঝাট দিয়ে ফেলে দিল। জেনে আবার সেটাই লিখতে বসলেন, দিনের পর দিন আপন মনে লিখে চললেন। পরে কোনও এক সময় সেই সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি জেলের বাইরে চলে আসে। কোনও এক প্রকাশক সেটি প্রকাশ করার পর আচম্বিতে ফরাসি সাহিত্যে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে তোলে। এই বই, ‘আওয়ার লেডি অফ দা ফ্লাওয়ার্স’-এর স্বাদও অনাস্বাদিতপূর্ব, বহু লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবী ফরাসি সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে জেনে-কে মুক্ত করেন কারাগার থেকে।
জাঁ পল সার্ত গোটা একটি বই লিখেছেন এই জেনে সম্পর্কে। সেই বইয়ের নাম ‘সন্ত জেনে।’ দাগি আসামিকে সন্ত বলেছেন তিনি বিশেষ কারণে। সার্ত প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই একজন মানুষ, যার জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না, যার খ্যাতির মোহ ছিল না। বই লিখে অর্থোপার্জনেরও কোনও প্রশ্ন ছিল না, সাহিত্যকীতি স্থাপনের কথা যে জানতই না, তবু সে লেখে কেন? তবে কি এটাই দৈব প্রেরণা! এই প্রেরণা যে পায়, সেই তো সন্ত! একবার পুরো পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়ে যাওরার পরেও সে লিখেছিল।
জেনের এই উপন্যাসের ভাষা পাগলের মতন অসংলগ্ন, তবু সেটাই এক নতুন ভাষা। তিনি যখন-তখন খিস্তি খেউর ও চোর-ডাকাত-বেশ্যা-সমকামীদের ব্যবহৃত শব্দ মিশিয়ে দিয়েছেন, তবু তা এক মৌলিক সৌরভ এনে দিয়েছে। পরে অবশ্য জাঁ জেনে নাট্যকার হিসাবেও খ্যাতিমান হন।
মার্গারিট সেই ‘আওরার লেডি অফ দা ফ্লাওয়ার্স’-এর মূল ফরাসি থেকে আমাকে অংশবিশেষ পড়ে পড়ে শোনাত। কোনও শব্দেই তো তার আপত্তি হয়নি। তবু কেন সামান্য একটা চুম্বনের আবেদনে তার এত অনীহা?
মার্শাল টাউনের সেই বাড়িতে বসে বসেই আমি ঠিক করে ফেললাম, থাক, ওসব আমার কিছু চাই না। সংযম দেখাবার মধ্যেও একটা অহংকার আছে। আমেরিকান ছেলেরা যা পারেনি, তা আমি নিশ্চয়ই পারব। মার্গারিটের সাহচর্যই আমার পক্ষে যথেষ্ট।
ফিরে এলাম রবিবার সকালে। দশটার সময় মার্গারিট গির্জায় যায়। সেই গির্জার রাস্তায় ধরলাম তাকে। মাথায় একটা সিল্কের স্কার্ফ বাঁধা মার্গারিট অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল, আমাকে দেখে চমকে গেল।
আমি সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম, তুমি আমার ওখানে আর আসবে না?
মার্গারিট ফ্যাকাশেভাবে বলল, কী জানি!
আমি ওর হাত ধরে বললাম, এই দ্যাখো, আমি তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, আমি আর কক্ষনো ওরকম দাবি করব না। তোমার বন্ধুত্ব ছাড়া কিছুই চাইব না।
মার্গারিট বলল, প্রতিজ্ঞা করলেও তোমার মনের মধ্যে একটা ক্ষোভ রয়ে যাবে। তুমি ইচ্ছেটাকে দমন করবে। সেটা তো ভালো নয়। আমি কেন তোমার কষ্টের কারণ হলো, বলো! তাতে আমারও কষ্ট হবে।
আমি ওর হাত ছেড়ে দিয়ে বললাম, তা হলে তুমি আমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে?
ও বলল, আমি যে খুব চাই। তুমি যখন ছিলে না, আমি দুবার গেছি তোমার ঘরে। শোনো সুনীল, আমি আজ গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার সময় অনুমতি চাইব। যদি কোনও সাড়া পাই
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, কীসের জন্য প্রার্থনা করবে বললে?
মার্গারিট লাজুকভাবে বলল, তুমি যা চেয়েছিলে।
সেই মুহূর্তে হাসি সামলানো আমার পক্ষে সত্যি খুব কষ্টকর হয়েছিল।
মার্গারিট চুমু খেতে পারবে কি না সে সম্পর্কেও ভগবানের কাছে অনুমতি চাইতে হবে? আমার দৃঢ় ধারণা ওর ভগবান ওকে সেই অনুমতি দেবেন না। এই সব ভগবান টগবানেরা অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ হয়।
ওলড টেস্টামেন্টের ঈশ্বর তো নিজের মুখেই সে কথা স্বীকার করেছিলেন!