২৬. ইংরেজি মতে চারটি ঋতু

ইংরেজি মতে চারটি ঋতু হলেও আমাদের ঋতু ছটি। এই অতিরিক্ত দুটি ঋতুর মধ্যে বর্ষাকে প্রবলভাবে টের পাওয়া গেলেও অন্য ঋতুটি অর্থাৎ হেমন্ত যে কখন আসে আর কখন চলে যায়, তা ঠিক বোঝা যায় না। যদিও অনেক কবির কবিতায় এর উল্লেখ থাকে খুব।

যাই হোক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমাদের শীত মাত্র দু-মাস। সারা বছরের মধ্যে এই দুটি মাসই কলকাতা শহরে সবচেয়ে উপভোগ্য লোডশেডিং উপেক্ষা করা যায়, নানা রঙের পোশাকের জন্য রাস্তার মানুষদের বেশ খুশি খুশি মনে হয়, বাজারের তরিতরকারি বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। অনেক উৎসব, মেলা ও প্রদর্শনী হয় এই দু-মাস জুড়ে। বরফের দেশ থেকে হাজার-হাজার পাখি আসে। আর আসে ইউরোপ আমেরিকা থেকে প্রবাসী ভারতীয়রা।

দু-তিন বছর অন্তর অন্তর তারা দেড় মাসের ছুটি নিয়ে আসে নিজের দেশ দেখতে। এরা অনেকেই সান্টা ক্লশের মতন ঝুলি ভরতি করে আনে ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার, আধুনিকতম গান বাজনার ক্যাসেট, ব্লেড, সাবান, পারফিউম আর দু-এক বোতল স্কচ। ভাগ্যবান আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সেগুলি বিলানো হয়। যত সামান্যই হোক, যেকোনও টুকিটাকি বিদেশি জিনিস পেলেই আমরা খুশি। বিদেশি দ্রব্য এখনও আমাদের কাছে অতি পবিত্র।

বাইবেলের প্রডিগাল সনের মতন এদের প্রত্যাবর্তনে মহা ধূমধাম পড়ে যায়, বাড়িতে বাড়িতে। এদের জন্য বাজার থেকে কিনে আনা নব্বই টাকা কেজির চিংড়ি মাছ, কলকাতার শ্রেষ্ঠ দোকানের সন্দেশ। নিজের বাড়িতে এরকম এলাহি বন্দোবস্ত থাকে তো বটেই, তা ছাড়াও প্রত্যেকদিনই থাকে কোনও না কোনও বাড়িতে নেমন্তন্ন, সেসব জায়গাতেও পরিবেশিত হয় আট দশ রকমের আহার্য পদ। এদিকে, অনেকদিন বিদেশ থাকার ফলে এদের খাদ্যাভ্যাস বদলে গেছে, বাঙালি ভূরিভোজনে এরা আর অভ্যস্ত নয়, সামান্য একটি দুটি খাবার এরা খুঁটে মুখে দিয়ে হাত জোড় করে বলে আর পারছি না! ক্ষমা করুন!

বাবা-মায়েরা প্রবাসী কৃতী ছেলে বা মেয়ের গর্বে নিজেরাই বেশি গর্বিত হয়ে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে তাদের দেখাতে নিয়ে যায়। প্রায় ভুলে যাওয়া বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের সামনে এই সব বিদেশি পাখিরা বিনীত মুখ করে বসে থাকে যতদুর সম্ভব কম ইংরিজি শব্দ ব্যবহার করে এবং রূপকথার গল্প শোনায়। অবশ্য দু-চার দিনের মধ্যেই তারা এই ভূমিকায় ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়ে, এবং তারপর তারা তাজমহল কিংবা কাশ্মীর দেখতে চলে যায়।

শীতকালে কোনও না কোনও আড্ডায় এই রকম বিদেশ-ফেরত কারুর না কারুর সঙ্গে দেখা হবেই। আজকাল বিদেশ যাওয়া অনেকটা জলভাতের মতন। খুব বেশি লেখাপড়া জানারও দরকার হয় না, তবলায় দু-একটা চাঁটি লাগাতে জানলে কিংবা একটু আধটু পল্লি গীতি গাইতে শিখলে কিংবা খানিকটা যোগ ব্যায়াম দেখাতে পারলেই দু একবার ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে আসা যায়। আর সাংবাদিক হলে তো অঢেল সুযোগ। প্রবাসী ভারতীয়রাও একথা জানে তাই দেশে ফিরে এইসব আড্ডায় তারা চট করে বিদেশ-এর গল্প শুরু করে না। নেহাৎ যারা বুদ্ধি কম তারা ছাড়া অন্যরা ইংরেজিতে কথাও বলে না, এবং খুব বেশি পোশাকের চাকচিক্যও দেখায় না। তবে প্রায় আলাপের প্রথমেই তারা জানিয়ে দেয়, কে কত বছর বাইরে আছে। কেউ ন’বছর, কেউ বারো বছর, কেউ সতেরো বছর। যে যত সিনিয়র তার তত সম্মান। মনে করুন, ম্যাঞ্চেস্টার থেকে আসা কোনও প্রবাসীর সঙ্গে আলাপ হবার পর আপনি জিগ্যেস করলেন, ম্যাঞ্চেস্টারে আমার এক বন্ধু আছে, অমুক দাশগুপ্ত, তাকে চেনেন? তিনি ভুরু কুচকে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলবেন, ও হ্যাঁ, চিনি সে তো মাত্র দুবছর ধরে আছে! কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের প্রতি থার্ড ইয়ারের ছাত্রদের যে রকম একটা অবজ্ঞার ভাব থাকে, এদের কথাতেও সে রকম একটা ভাব থাকে।

এই সব বিদেশ থেকে স্বদেশ ভ্রমণ করতে আসা মানুষদের সঙ্গে আলাপ করতে আমার ভালোই লাগে। এদের চেহারায় পোশাক ও কথাবার্তায় বেশ একটা টাটকা বাতাসের স্পর্শ পাওয়া যায়। এমনকি এরা যখন কলকাতার নোংরা রাস্তা, অতিরিক্ত ভিড়, ট্রেন প্লেনের অনিয়মিত চাল-চলনের নিন্দে করেন, তাতেও রেগে যাই না। এরকমই তো স্বাভাবিক। মানুষ যেখানে দশ বারো বছর ধরে থাকে সেখানকার জীবন যাপনেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। গ্রামের ছেলে অনেকদিন শহরে কাটানোর পর আবার গ্রামে ফিরে গেলে কমোড ছাড়া বাথরুমে স্বস্তি বোধ করে না। এদের কথাবার্তায় প্রচ্ছন্ন অহংকার ফুটে বেরুলেও আশ্চর্য হই না। মানুষের যখন কোনও দুর্বলতা থাকে কিংবা গোপন দুঃখ থাকে, তখনই তারা বেশি অহংকারের ভাব দেখায়।

তবে, একটা ব্যাপারে আমি এদের খুবই অপছন্দ করি। বিদেশি দস্যুর মতন এরা আমাদের দেশের সুন্দরী মেয়েদের লুঠ করে নিয়ে যায়।

এক সময় ভারতীয় ছেলেরা বিলেত আমেরিকায় পড়াশুনা বা চাকরি করতে গেলে প্রায় অবধারিতভাবেই বিদেশি বউ নিয়ে ফিরত। ষাটের দশক পর্যন্ত আমরা অনেক মেম বউ দেখেছি কিন্তু এখন মেম বিয়ে করার রেওয়াজ আর নেই বললেই চলে। শতকরা পাঁচজনের বেশি ভারতীয় এখন আর বিদেশিনী বিয়ে করে না। সাধারণত বিদেশে কয়েক বৎসর থেকে খানিকটা সেটল করে তারপর এরা দেশে এসে বিয়ে করে যায়। এখানকার খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রী কলমেও এরকম বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যায়। ‘বিদেশি উচ্চ চাকরিরত (মাসিক আয় আড়াই হাজার ডলার বা আটশো পাউন্ড) পাত্রের জন্য শিক্ষিতা, রূপবতী, গান-বাজনা রান্না জানা সদবংশীয় পাত্রী চাই! বিদেশে বসবাসের উপযুক্ত মানসিকতা থাকা চাই!’ ইংল্যান্ড-আমেরিকায় ভারতীয়দের দ্বারা প্রকাশিত পত্রপত্রিকাতেও আজকাল এরকম বিজ্ঞাপন থাকছে। কলকাতায় অনেক স্কুল-কলেজে বাছা-বাছা সুন্দরী মেয়েদের বিশেষভাবে শিক্ষা দেওয়া হয় প্রবাসীদের উপযুক্ত স্ত্রী হিসেবে তৈরি হয়ে ওঠার জন্য। তারা অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে ইংরেজি ছাড়াও ফরাসি বা জার্মান ভাষার কোর্স নেয়। বিদেশ থেকে প্রতি বৎসর ঝাঁক-ঝাঁক ছেলে এসে এদের নিয়ে চলে যায়।

এইসব মেয়েদের সঙ্গে হয়তো কোনওদিনই আমার আলাপ পরিচয় হত না। একটিও কথা বলার সুযোগ পেতাম না। কিন্তু পথে-ঘাটে দেখতে তো পেতাম। কলকাতা থেকে এইসব সুন্দরীরা চিরকালের জন্য চলে যায় বলে আমার দুঃখ বোধ হয়। এদেশ থেকে যত ইচ্ছে ব্রেন-ড্রেইন হোক তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, কিন্তু এরকম সুন্দরী নারীদের রফতানি মেনে নিতে পারি না।

যেসব মেয়ের বাবারা মেয়েদের এই রকম বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত কিংবা ছেলেমেয়েদের খুব বেশি লেখাপড়া শেখান তাঁদের অনেকেরই শেষ বয়েসের ট্রাজেডি আমি দেখেছি। অনেক মধ্যবিত্ত বাবা নিজেদের কষ্টার্জিত টাকায় ছেলে মেয়েদের ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার করে তোলেন। তারপর সেইসব ছেলেমেয়েরা আরও উচ্চশিক্ষার জন্য বা চাকরি পেয়ে বিদেশে চলে যায়। আর ফেরে না। এক জাঁতাকলে আটকে পড়ে। বাবা মায়ের কাছে তারা নিয়মিত চিঠি লেখে ও মানি অর্ডার পাঠায়, যত বছর যায়, ততই চিঠির ফ্রিকোয়েন্সি এবং টাকার পরিমাণ কমতে থাকে। একসময়ে বৃদ্ধ বাবা-মা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, তাঁদের অসুখ হলে পাশে দাঁড়াবার জন্য কারুকে পাওয়া যায় না। যখন তখন অসুখের খবর জানিয়েও তাঁরা অতদূরের সন্তানদের বিব্রত করতে চান না। একমাত্র তাঁদের মৃত্যুর পরই যদি টেলিগ্রাম ঠিক সময় পৌঁছোয় কিংবা টেলিফোন কানেকশান পাওয়া যায়, তা হলে তাঁদের ছেলে মেয়েরা বিমানে উড়ে আসে। বাবা কিংবা মায়ের মৃতদেহের সঙ্গেও শেষ দেখা হয় না।