‘সব সুন্দরেরই থাকে শুধু
একটিই বসন্ত এসো,
আমরা সময়ের পদচিহ্নগুলিতে
পুঁতে দিই গোলাপ।’
–জেরার দ্য নারভাল
অনেক লোক যেমন স্ট্যাম্প জমায়, আমি তেমনি নদী জমাই। নদী আমাকে সব সময় টানে। জন্মেছি নদীমাতৃক দেশে, আমার জন্মস্থানের কাছে ছিল দুর্দান্ত আড়িয়েল খাঁ নদী। ছেলেবেলায় দেখেছি, বিশাল পদ্মানদীর চড়ায় কুমিরদের রোদ পোহাতে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে মেঘনা নদীর ভয়ংকর সুন্দর রূপ একবার দেখলে জীবনে ভোলা যায় না। যেসব নদীর নাম বহুবার পড়েছি, সেগুলি দেখার জন্য মন ছটফট করে। কৃষ্ণা, কাবেরী, ঝিলম, ব্ৰহ্মপুত্ৰ এই সব নদীগুলি প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। রবীন্দ্রনাথ রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠেছিলেন, আমি রূপনারায়ণ নদীর ধারে খোলা আকাশের নীচে অন্ধকার রাত্তিরে ঘুমিয়েছিলাম।
সব নদীই আলাদা, আবার একই নদীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রূপ। হরিদ্বারের গঙ্গা, কাশীর গঙ্গা, কাকদ্বীপের গঙ্গা। সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে ভলগা নদী দর্শনের পর মনে হয়েছিল, যাক, এতদিনে ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’ দেখা হল! চিন ভ্রমণে গিয়ে ইয়াংসিকিয়াং নদী দেখার খুবই সাধ ছিল, শাংহাই শহর থেকে কিছুটা দূরে, কিন্তু সে পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল না। ইচ্ছেমতন ঘোরাঘুরির সুবিধে ছিল না, তাই সেই ক্ষোভ আজও রয়ে গেছে।
একবার যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে গিয়েছিলাম এক রাত্রির জন্য। বিমান কোম্পানি হোটেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, পরদিন সকালেই আবার অন্যত্র যাত্রার জন্য বিমান ধরতে হবে। সন্ধের পর হোটেলে পৌঁছেছি সাড়ে আটটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া শেষ, তারপর আর কিছু করবার নেই। অত তাড়াতাড়ি বিছানায় গড়াতে আমার ইচ্ছে করে না। বেলগ্রেডে কারুকে চিনি না, একটা ঠিকানা বা টেলিফোন নাম্বারও নেই। হোটেলটা শহর থেকে বেশ দূরে, ট্যাক্সি নিয়ে শহরে গেলেও রাত্তিরবেলায় আর তো কিছু দেখা হবে না, কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁই খোলা থাকবে। তখন মনে হল, অন্য কিছু দ্রষ্টব্য না থাক, নদী তো আছে। এই শহরের পাশ দিয়ে গেছে ড্যানিয়ুব!
ম্যাপ দেখে নিয়ে আমি হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তা চেনার দরকার নেই। নদী তো হারিয়ে যাবে না। সোজাসুজি প্রায় চল্লিশ মিনিট হেঁটে পাওয়া গেল ড্যানিয়ুব নদী, আবার সৌভাগ্যবশত কাছেই একটা সেতু। রাত প্রায় দশটা। কাছাকাছি কোনও মানুষজন নেই, দু-চারটে গাড়ি শুধু ছুটে যাচ্ছে তীব্র বেগে।
আমি সেতুর মাঝামাঝি দাঁড়ালাম। ইতিহাস-বিশ্রুত এই নদী কিন্তু তেমন চওড়া কিছু নয়। কত যুদ্ধ, কত মারামারি কাটাকাটি হয়েছে এই নদীর তীরে, বিশেষ করে বেলগ্রেডের এই অঞ্চলটায়, কিন্তু তখন সে সব কথা আমার মনে পড়েনি। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম এক অপূর্ব সঙ্গীত। আমার গায়ে ওভারকোট, দু-হাতে দস্তানা, কিন্তু কান দুটোতে ঝাঁপটা মারছিল শীতের বাতাস, খুব শীতেও আমি টুপি মাথায় দিতে পারি না। সেখানে চুপ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শুনতে লাগলাম ব্ল ড্যানিয়ুব সঙ্গীতের মুছনা। এক সময় পকেট থেকে কিছু খুচরো পয়সা যার করে নদীর জলে ছুঁড়ে দিলাম। নদীকে কিছু উৎসর্গ করাই মুসাফিরদের নিয়ম।
রাত্রির অন্ধকারে ড্যানিয়ুব জলের রং বোঝা যায়নি।
বছর তিনেক আগে চেকোশ্লোভাকিয়াতে বাতিশ্লাভা নামে একটা শহরে গিয়েছিলাম। কেমন যেন নির্জীব জায়গাটা, মানুষজনের মুখে বিরক্ত বিরক্ত ভাব। তখনও চেকোশ্লোভাকিয়ায় সরকার-বিরোধী প্রবল আন্দোলন শুরু হয়নি। কিন্তু লোকে প্রচণ্ড অসন্তোষ নিয়ে গুমরে-গুমরে উঠছে তা বোঝা যাচ্ছিল। গান-বাজনার জন্য এক সময় এই শহরের খুব খ্যাতি ছিল, বালক মোৎসার্ট এখানেই সম্রাটের সামনে পিয়ানো বাজিয়ে তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। সম্রাট জিগ্যেস করেছিলেন, তুমি কী উপহার চাও? বালক মোৎসার্ট তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছিল, আমি রানিকে বিয়ে করতে চাই। সেই শহরে গান বাজনার কোনও অনুষ্ঠান শোনা হল না। একদিন রেস্তোরাঁয় একজন সঙ্গীতশিল্পী নিজে থেকেই আমাদের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে লাগল।
যাই হোক, সেখানে একদিন গাড়িতে যেতে যেতে শহরের বাইরে একটা নদী পেরুতে হল। আমি বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, আগে খেয়াল করিনি, ব্রিজের শেষ প্রান্তে এসে জিগ্যেস করলাম, এটা কী নদী?
আমাদের গাইড মেয়েটি জানাল, এটা ড্যানিয়ুব।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, গাড়ি থামাও। আমি এখানে নামবো!
সরকারি আমন্ত্রণে সফর, যখন-তখন, যেখানে-সেখানে গাড়ি থামানো যায় না। সব কিছু একেবারে মিনিট-মাপা সময়ে বাঁধা। তবু ড্যানিয়ুব নদীর ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছি, ভালো করে দেখব না?
অন্য কয়েকজন বলল, গাড়িতে বসেই তো দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু আমি তাতেও রাজি হলাম না। গাড়ি থেকে নেমে, ব্রিজের তলা দিয়ে নেমে গেলাম জলের ধারে। এক আঁজলা জল তুলে ছোঁয়ালাম মাথায়।
এবার দিনের আলোয় দেখলাম, ড্যানিয়ুবের জলের রং নীল নয়। ঘোলাটে ধরনের। কাছাকাছি অনেক কারখানার নোংরা গাদ এসে পড়ছে এই নদীর জলে।
আজকাল নদীগুলো সব দেশেই দূষিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ড্যানিয়ুব নদীকে কি বিশেষভাবে রক্ষা করা উচিত ছিল না। এ যে পবিত্র নদী। স্বপ্নের নদী। ইয়োহান স্ট্রাউস এই নদীর নামে অমর সঙ্গীত রচনা করেছেন। নিশ্চয়ই স্ট্রাউসের আমলে এই নদীর জলের রং পরিষ্কার, ঝকঝকে নীল ছিল।
পৃথিবীর আর একটি পবিত্র নদী, আমার একটুর জন্য দেখা হয়নি।
আরব দেশের আম্মান শহরে একবার এক হোটেলে রাত্রিবাস করতে হয়ছিল। বিমান বদলাবার কারণে। বাদল বসু ছিলেন সে যাত্রায়। ঘরে বসে ম্যাপ দেখে বুঝতে পারলাম, পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরেই জর্ডন নদী। এই নদীর বুকে দাঁড়িয়ে সেন্ট জন দা ব্যাপটিস্ট যিশুর মাথায় জলের ছিটে দিয়ে তাকে দীক্ষিত করেছিলেন। সেই থেকে বিশ্বের সমস্ত খ্রিস্টানদের কাছে এই নদীর জল পবিত্র। প্রত্যেক গির্জায় এই জল রাখা থাকে। হিন্দুরা জন্ম থেকেই হিন্দু, কিন্তু খ্রিস্টান পরিবারের ছেলেমেয়েদের ব্যাপটিজম না হলে তারা খ্রিস্টান হয় না, নবজাত শিশুদের তাই গির্জায় নিয়ে গিয়ে মাথায় জর্ডন নদীর জলের ছিটে দিয়ে আনতে হয়।
কিন্তু অত কাছে গিয়েও জর্ডন নদী দেখা সম্ভব হল না, কারণ আমাদের ট্রানজিট ভিসা, এক রাতের বেশি থাকার উপায় নেই, হোটেলের বাইরেই যেতে দেয় না। জানি না, জর্ডন নদীর জলেও কলকারখানার নোংরা এসে মেশে কি না।
আম্মান বিমান বন্দরে দেখলাম, নানা আকৃতির শিশিতে জর্ডন নদীর জল বিক্রি হচ্ছে। এক সময় আমাদের দেশেও গঙ্গা জলের এরকম চাহিদা ছিল। সমস্ত পুজো আচ্চায় গঙ্গা জলের প্রয়োজন হত। ভারতের গঙ্গাবর্জিত অঞ্চলগুলিতে বিক্রি হত গঙ্গা জল। কলকাতার আদি যুগে বৈষ্ণবচরণ শেঠ নামে এক ব্যবসায়ী শুধু গঙ্গা জল বিক্রি করেই দারুণ বড়লোক হয়েছিলেন। সিল করা কলশিতে তিনি ভারতের সর্বত্র খাঁটি গঙ্গা জল পাঠাতেন। আমাদের ছেলেবেলাতেও দেখেছি, পূর্ব বাংলা থেকে কেউ কলকাতায় এলে তাকে বলে দেওয়া হত, এক বোতল গঙ্গা জল এনো। এখন গঙ্গা জলের আর মহিমা নেই।
নদী বিখ্যাত হয় তার দু’তীরের সৌন্দর্যের জন্য। দু’পাশে পাহাড় থাকলে সে নদীর শোভা আরও খোলে। এমন নদী তো কম দেখিনি, কোনওটাই অন্যগুলির চেয়ে কম সুন্দর নয়। আমাদের উত্তরবঙ্গেও এমন অনেক চমৎকার নদী আছে। তিস্তা তো বটেই, তা ছাড়া ডায়না নামের নদীটিও আমার খুব পছন্দ।
সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ রায়মঙ্গল নদীর বুকে একবার আমি ডিঙি নৌকোয় সারারাত কাটিয়েছিলাম। পরে শুনেছিলাম, নৌকোডুবির চেয়েও ভয়ংকর ঝুঁকি ছিল ডাকাতের হাতে পড়ার। ওসব জায়গায় কেউ সন্ধের পর নৌকোয় যায় না, সীমান্ত পেরিয়ে ডাকাতরা এসে শুধু নৌকোটা লুঠ করার জন্যই মানুষ মেরে জলে ফেলে দেয়। আমি বৃষ্টি ভিজতে-ভিজতে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম। ওসব কথা আমার মনে পড়েনি, ডাকাতদেরও মনে পড়েনি আমার কথা। এখনও সুন্দরবন যাওয়ার পথে রায়মঙ্গল নদীটিকে দেখে সেই রাতটার কথা ভেবে মজা লাগে।
সাসকাচুয়ান নামটি আমার বড় প্রিয়। নামটার মধ্যে একটা ঝংকার আছে, যেমন উত্তর কাছাড়ের জাটিংগা নদীর নাম শুনলেই রোমাঞ্চ হয়। এই সাসকাচুয়ান নদীটি আমি দেখেছি এ কথা যেমন ঠিক, আবার দেখিনি, এমনও বলা যেতে পারে; কানাডার এই নদীটির তীরে আমি যখন দাঁড়াই, তখন প্রবল শীতকাল, পুরো নদীটি ধপধপে সাদা। সমস্ত জল জমে কঠিন বরফ হয়ে গেছে, তার ওপর দিয়ে হাঁটা যায়, বাচ্চা ছেলমেয়েরা দৌড়োদৌড়ি করছে। জলের স্রোত থাকলে তবেই তো সেটা নদী, বদ্ধ জলাশয়কে তো আর নদী বলা যাবে না। তা হলে আমি কী দেখলাম?
আয়ওয়াতে থাকার সময় আয়ওয়া নদীর ধার দিয়ে প্রতিদিন হেঁটে যেতে হত। খুবই ছোট নদী, কিন্তু বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল হয় না, ভরাভরাই থাকে সারা বছর, শীতের কয়েকটা মাস জমে শক্ত হয়ে যায়। অন্য সময় আয়ওয়া নদীর জলের রং কালো, কিন্তু বরফের রং কালো হয় না। এই একটাই নদী যাকে আমি কালো এবং সাদা, স্রোতস্বিনী এবং স্তব্ধ অবস্থায় দেখেছি। ওই ছোট নদীকেও কতরকমভাবে সাজাবার চেষ্টা। ওই একটা শহরেই নদীর ওপর অন্তত গোটা পাঁচেক সেতু, দু-ধারে নানারকম ফুলের কেয়ারি। মার্গারিট থাকত নদীর এপারে, আমি অন্য পাড়ে, নদী পেরিয়ে প্রতিদিন দেখা হত দুজনের। কখনও কখনও সেতু দিয়ে নদী পার না হয়ে আমি অ্যালেক নামে একটি ছেলের নৌকো ধার নিতাম। অ্যালেক ছবি আঁকত। ভাসমান নৌকোয় বসে ছবি আঁকা ছিল তার খেয়াল। আমি কোনওদিন রোয়িং শিখিনি, পূর্ব বাংলায় কৈশোরে বৈঠা দিয়ে ছোট ডিঙি নৌকো চালিয়েছি কয়েকবার। সেই স্মৃতির ওপর ভরসা করে একলা নৌকো চালাতাম, উলটে গেলেও বিপত্তির কিছু ছিল না। ওইটুকু নদী সাঁতরে পার হতে আর কতক্ষণ লাগে! মার্গারিট সাঁতার জানত না বলে নৌকোয় চাপতে ভয় পেত। তবু দু একদিন তাকে জোর করে চাপিয়েছি। সেই টলটলে নৌকোয় বসে ভয়মাখা হাসিমুখে মার্গারিট ম দিউ, দিউ, ও লালা এই সব শব্দ করত। মার্গারিটের চোখে আমেরিকার চেয়ে ফরাসি দেশের সব কিছুই ভালো। সে বলত, দূর, এটা আবার একটা নদী নাকি? নদী দেখবে আমাদের দেশে গিয়ে, লোয়ার, শের, মাইয়েন…
অনেক বছর পর সেই আয়ওয়া নদীর প্রান্ত দিয়ে স্বাতীর সঙ্গে হেঁটেছি। অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু নদীটার বিশেষ রূপান্তর হয়নি। সব নদীর মধ্যেই যেন একটা চিরন্তন ব্যাপার আছে। স্বাতীও সাঁতার জানে না, তবে সেবারে পরিচিত কারুর নৌকোও পাইনি। ফুলের সমারোহের মধ্য দিয়ে আমরা হেঁটে বেড়াতাম অনেক রাত পর্যন্ত। যখন যেখানেই যাওয়ার দরকার হোক, অন্য রাস্তা দিয়ে না গিয়ে আমরা নদীকে দেখে যেতাম একবার।
শীতে জমে যাওয়া নদীর ওপর দিয়ে ভরসা করে কখনও হাঁটিনি অবশ্য। হঠাৎ বরফ ভেঙে ভেতরে ডুবে গিয়ে কেউ আর উঠতে পারেনি এরকম অ্যাকসিডেন্টের কথা শোনা যায় মাঝে মাঝে। তবু অকুতোভয় দু-চারটি ছেলেমেয়ে নদীর মাঝখানে গিয়ে লাফালাফি করে, নাচে, বরফ খুঁড়ে জল যার করে।
বিশাল চওড়া নদী মিসিসিপি দেখে প্রথমবার বেশ হতাশ হয়েছিলাম। একটুও নদী নদী ভাব নেই। তীরের মাটি নেই, কাদা নেই, দু’দিকের পাড় বাঁধানো, দুপুরবেলাতেও কেউ সেখানে অসলভাবে ছিপ ফেলে মাছ ধরছে না, কেউ স্নান করছে না। স্টিমার আর স্পিড বোটের ছড়াছড়ি, পাল তোলা নৌকো দেখা যায় না একটাও। নদীর সঙ্গে কূলের মানুষের একটা একাত্মতা থাকে, তবেই তো নদীর রূপ খোলে। স্টিমারে চেপে মিসিসিপির বুকে বেশ খানিকক্ষণ ঘুরেছি বটে, কিন্তু মনে তেমন দাগ কাটেনি। এর চেয়ে পদ্মার রূপ অনেক সুন্দর। চিনের ক্যান্টন শহরের পাশে পার্ল নদী দেখে পদ্মার কথা মনে পড়েছে কয়েকবার। সেই পার্ল নদীর বুকেও অজস্র পাল তোলা নৌকো। শহর ছাড়িয়ে গাড়ির রাস্তায় গেছি অনেক দূর, হঠাৎ হঠাৎ পার্ল নদী কাছে এসে পড়েছে।
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীটি দেখার সৌভাগ্য আমার আজও ঘটেনি। ছবিতে দেখেছি, সিনেমায় দেখেছি, কিন্তু সশরীরে, স্পর্শের দূরত্বের মধ্যে না দেখলে কি আর সাধ মেটে! দু’পাশে ভয়াল অরণ্য, তার মধ্য দিয়ে ছুটে যাওয়া গর্জমান নদী, আমি মাঝে মাঝে তাকে কল্পনায় দেখতে পাই।
জার্মানির রাইন নদীর জলও দূষিত, কিন্তু দু’দিকের ঢেউ খেলানো পাহাড়, অরণ্য ও টিলার ওপর ছোট ছোট পুরোনো দুর্গ, দৃশ্য হিসেবে বড় সুন্দর।
মিশরের যে নদীটির নাম নাইল, আমরা ছেলেবেলায় ভূগোলে সেটার নাম পড়েছি নীল নদ। কোনটা নদী আর কোনটা যে নদ, তা যে কে ঠিক করে দেয়, কে জানে! এমন সব চমৎকার চমৎকার নামই বা কারা রেখেছিল। আমাদের দেশের একটা ছোট্ট নদীর নাম চূর্ণী নদী, ছলো ছলো করে গ্রাম চুর্ণী নদী তীরে’ এই লাইনটা আমি আপনমনে অকারণে করবার আওড়াই শুধু এই নামটার জন্য। কপোতাক্ষ নামটাও তো মাইকেল মধুসূদন রাখেননি! সাগরদাঁড়ি গ্রামে গিয়ে কপোতাক্ষ নদে নৌকোয় চেপে ঘুরতে-ঘুরতে আমার মনে হয়েছিল, মাইকেলের আগেও এখানে একজন বেশ বড় কবি ছিল, যিনি পায়রার চোখের সঙ্গে তুলনা দিয়ে এই নদীর নাম রেখেছিলেন। আগে এই নদ বা নদীটির কেমন রূপ ছিল তা জানি না, আমি যখন দেখেছি, তখন সেটা বেশ ছোট এবং জলের রং ঘোলাটে। তা হলে তো নামদাতার কল্পনাশক্তির আরও প্রশংসা করতে হয়!
ছেলেবেলায় স্মৃতি এমনই কাজ করে যে কায়রো শহরে গিয়ে আমি নদী দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে নাইল-এর বদলে নীল নদ বলে ফেলেছিলাম এবং তখনও আমার ধারণা, এই নদের জলের রং নীল। অবশ্যই তা নয় এবং একে নদ বলারও কোনও কারণ নেই। আমাদের দেশের বাইরে আর কোথাও নদীর লিঙ্গভেদ আছে এমন শুনিনি। খ্যাতির জন্যই নাইল-এর তীরে দাঁড়িয়ে আমার রোমাঞ্চ হয়েছিল, নইলে দৃশ্যত এমন কিছু সুন্দর নয়।
সমতলে নদীর জল সাধারণত নীল হয় না, স্বচ্ছও হয় না। নদীর জল ঝকঝক করে পাহাড়ে। পাহাড়ি নদী দেখেছি প্রচুর এবং প্রত্যেকটাই আলাদাভাবে মনোহর। আসামের জাটিংগা নদীটি আমাকে একবার খুব প্রতারিত করেছে। অনেক বছর আগে, ছোট ট্রেনে চেপে দু’পাশের গাঢ় সবুজ অরণ্যানীর মধ্যে দিয়ে যেতে-যেতে এই দুর্দান্ত নদীটিকে দেখে দারুণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। কী সাংঘাতিক তেজি প্রবাহ। মহানাগের ফণার মতন লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে ঢেউ, যেন হঠাৎ রেল লাইনকেও গ্রাস করে নেবে। তখন আমার ধারণা ছিল নদীটির নাম জাটিংগা নয়, ঝাটিংগা। জ আর ঝ-এর সামান্য তফাতেও ধ্বনিমাধুর্য অনেক বদলে যায়। এখন জাটিংগা নামটা অনেকটা পরিচিত, শুধু নদী নয়, এ নামে একটা জায়গাও আছে। বছরের কয়েকটি মাস সেখানে একটা রসহ্যময় ব্যাপার চলে। রাত্তিরবেলা সেখানে আলো জ্বেলে রাখলেই ওপর থেকে ঝপাস ঝপাস করে বড় বড় পাখি এসে পড়ে। সেই পাখি অনেকেই ধরে-ধরে মেরে খায়, তাতেও পাখি আসা কমে না। শুধু ওই জায়গাটিতেই কেন আলো দেখলে অত বড় বড় পাখি আত্মহত্যা করতে আসে, তা এখনও একটা বিস্ময়। পৃথিবীর নানা দেশ থেকেই কৌতূহলীরা আসে ‘জাটিংগা বার্ডস’ নিয়ে গবেষণা করতে।
আমি যখন প্রথম দেখি তখন জাটিংগার এই পক্ষী-খ্যাতি ছিল না। নামটাও আমি জানতাম ঝাটিংগা। খেলনার মতন ছোট ট্রেন অনেকক্ষণ থেমে ছিল হারাং গাঁজাও নামে একটা স্টেশনে। নিবিড় গভীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ঝাটিংগা ও হারাং গাঁজাও এই নাম দুটি আমার মাথার মধ্যে টং টং শব্দ করতে থাকে, ব্রহ্মার হাতের বীণার নাদের মতন। মনে হয় যেন আমি আদিম পৃথিবীতে ফিরে গেছি। এই নদী নিয়ে আমি একটা কবিতা লিখে ফেলেছিলাম এবং পরে অনেকের কাছে ওই নদী বিষয়ে গল্প করেছি।
বছর দু-এক আগে হাইলাকান্দি গিয়েছিলাম এক সাহিত্যসভায়। স্বাতী ছিল সঙ্গে। ফেরার সময় স্বাতী বলল, এই দিকেই তো তোমার সেই ঝাটিংগা নদী, একবার দেখা যায় না! সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়ে গেল। ধস পড়ে লাইন নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ছোট রেল বন্ধ হয়ে আছে, কিন্তু গাড়িতে যাওয়া যেতে পারে হাফলং পর্যন্ত, রাস্তা খুব খারাপ, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না।
শিলচর ছাড়িয়ে লামডিং-এর পথে এগোতে-এগোতে আমি ক্রমশই বিচলিত বোধ করলাম। কোথায় সেই দুর্ভেদ্য অরণ্য। এ তো দেখছি ছাড়া ছাড়া গাছ, অধিকাংশই পাতা ঝরা। আগেরবার দূর দূর টিলার ওপর জমাট জঙ্গল দেখে মনে হয়েছিল, ওখানে বুঝি কখনও মানুষের পা পড়েনি, এমনকি জরিপকার্যও হয়নি। এখন সে সব জঙ্গল প্রায় সাফ হয়ে গেছে। মানুষ কি পৃথিবী থেকে সমস্ত গাছ ঝাড়েবংশে নির্বংশ করবে ঠিক করেছে?
নদীটাই বা গেল কোথায়? মাঝে মাঝে আমি স্বা তাঁকে বলছি, এবার নদীটি দেখতে পাবে! স্বাতী আমার দিকে এমন কৌতুকের চোখে তাকাচ্ছে যেন এত কাল আমি সবাইকে গুল মেরেছি, কবিতাটাও বানিয়ে লিখেছি। সত্যিই সেই দুর্ধর্ষ, তেজি নদীটি একেবারে উধাও! এক সময় হারাং গাঁজাও স্টেশনটি পাওয়া গেল, আগের বার এটা ছিল খুবই নিরিবিলি, ছোট্ট ছিমছাম স্টেশন। এখন বেশ লোকজন, দোকানপাট হয়েছে। যেন ম্যাজিকে অন্য রকম। কাছে সেই নদীর খাতটা রয়েছে বটে, জল নেই এক বিন্দু। অমন চমৎকার নদীটিকে কে খুন করল? আমার কষ্ট হতে লাগল রীতিমতন। পৃথিবীতে বহু জায়গাতেই নদীগুলোকে বাঁধ বেঁধে নির্জীব করে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের গঙ্গা নদীও তো মুমূর্ষ, বাংলাদেশ এর থেকে যথেষ্ট জল পাচ্ছে না। কলকাতার কাছে মাঝগঙ্গায় লোকে হেঁটে বেড়ায়।
অবশ্য জাটিংগা নদী আমি প্রথবার দেখেছিলাম বর্ষাকালে, দ্বিতীয় বার শীতকালে। বর্ষায় অরণ্যের রূপ খোলে, নদীগুলিও স্বাস্থ্যবতী হয়। তা বলে কি বর্ষার পাহাড়ি নদী শীতকালে একেবারে মরে যায়? আর একবার বর্ষায় গিয়ে জাটিংগাকে দেখে আসতে হবে। শুনেছি আমাদের ছেলেবেলার রুদ্ররূপী আড়িয়েল খাঁ নদীরও এখন খুব করুণ অবস্থা।
ফ্রান্সে গিয়ে আমরা সাধারণত শুধু স্যেন নদীটাই দেখি। প্যারিস শহরের মাঝখানের নদীটির চেয়ে তার সেতুগুলির বৈচিত্র্যই আসল দর্শনীয়। শহরের উপকণ্ঠে একবার বিজ্ঞানী ভূপেশ দাসের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে তাঁর বাড়ির কাছেই একটা ছোট্ট নদী আছে। একেবারে একরত্তি নদী, ইচ্ছে করলে জোরে লাফ দিয়ে পার হওয়া যায়, কিন্তু তার রীতিমতন স্রোত আছে, সেই স্রোতেরা কুলুকুলু ধ্বনি আছে। নদীটির নাম ইভেৎ। এত ছোট্ট নদী আমি কখনও দেখিনি, তার এত সুন্দর নাম। সেইজন্য তাকে ভোলা যায় না। ওই অঞ্চলে গেলেই নদীটা একবার দেখতে যাই।
ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত নদী বোধহয় লোয়ার। ইতিহাস ও ভূগোল, দু’দিক থেকেই এর অনেক গুরুত্ব। এই নদীর দু’ধারে প্রচুর দ্রষ্টব্য স্থান।
মাঝখানের দু’বছর আমি আর ফরাসি দেশে যাইনি। এর মধ্যে একবার বুলগেরিয়া চেকোশ্লোভাকিয়া গিয়ে মনে হয়েছিল, টপ করে একবার প্যারিস চুঁয়ে এলে হয়। প্রাগ শহর থেকে অসীম-ভাস্করকে ফোন করেও লোভ সংবরণ করতে হল। আগে থেকে ঠিক করা ছিল, সেবার আমি তুরস্কে যাব। সেখানে কোনও আমন্ত্রণ নেই, চেনাশুনো কারুর বাড়িতে থাকার জায়গাও পাওয়া যাবে না। তা হলেও ইস্তানবুল শহরটা একবার না দেখে মরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। পৃথিবীতে ইস্তানবুলই একমাত্র শহর, বার দুটো অংশ দুটো মহাদেশে। এশিয়া ও ইউরোপ। এককালে এরই নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। তারও আগে এটাই ছিল ইউরোপীয় সভ্যতার সূতিকাগার। এখানে জন্মেছিলেন মহাকবি হোমার। যিশুর মা ভার্জিন মেরির বাড়ি এখানে খুঁজে পাওয়া গেছে। পুরাতাত্বিকদের মতে এরই কাছাকাছি ছিল ট্রয় নগরী।
ইস্তানবুলে নদী নেই। একদিকে কৃষ্ণসাগর, মর্মরসাগর। অন্য দিকে ভূমধ্যসাগর। কৃষ্ণসাগর ও ভূমধ্যসাগরকে জুড়েছে বসফরাস প্রণালী, সেটাই গেছে শহরের মাঝখান দিয়ে। সি অফ মারমারা’র নাম বাংলায় কে মর্মসাগর দিয়েছিল কে জানে, ভালোই দিয়েছিল। সস্তায় হোটেল ভাড়া করে ইস্তানবুলে আমি কয়েকটা দিন কাটালাম সম্পূর্ণ একা, এক একদিন কারুর সঙ্গে একটাও কথা বলিনি। সেও এক নতুন অভিজ্ঞতা।
পরের বছর আবার ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ও লন্ডনে দু-একটি সভায় যোগদানের উপলক্ষ ঘটল। তা হলে তো মাঝখানের ফ্রান্সকে উপেক্ষা করার কোনও মানে হয় না। অসীমকে চিঠি লিখতেই অসীম জানাল ছুটি নিয়ে নিচ্ছি। এবার তা হলে লোয়ার নদীর উপত্যকায় ঘোরাঘুরি করা যাবে, কী বলে?
শুরু হল আমাদের নতুন অভিযান।