রাস্তায় তো কোনও মিছিল-শোভাযাত্রা ছিল না, তবু বহু কণ্ঠের একসঙ্গে চিৎকার শুনতে পেলাম হঠাৎ। সময় সেপ্টেম্বরের মেদুর সন্ধ্যা, প্যারিসের শেন নদীর পাড়ে। শুধু রং ও রূপ, বাতাসে সুগন্ধ ইভনিং ইন প্যারিস যাকে বলে। এমন সময় কীসের গোলমাল? আগুন দেখলে পোকা ছুটে যায়, গোলমাল শুনলে মানুষ। অনেক লোক সত্যিই সেদিকে ছুটে গেল, সট সট করে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি। আমার সঙ্গে একজোড়া ফরাসি যুবকযুবতী, এলেন আর হোব্রেয়ার, ওরা বলল, ম দিও, আর একটা মরল বোধ হয়? এ মাসে এ নিয়ে ক’টা হল? তিনটে না চারটে?
অল্পক্ষণের মধ্যে শুনতে পেলাম, একজন নয়, দুজন, এফেল টাওয়ার থেকে লাফিয়ে পড়েছে। এমন সুন্দর সন্ধ্যায় মানুষ মরতে চায় কেন? এখন তো মনে হয় পৃথিবীতে কোথাও কোনও দুঃখ নেই, অভিযোগ নেই, বুকের বিষ নেই। সাময়িক বা নকল, যাই হোক না, প্যারিসে সন্ধেবেলা সবাই সুখী। তবু একজোড়া রুমানিয়ান দম্পতি হঠাৎ আত্মহত্যা করতে গেল কেন? স্রোবেয়ার বলল, দূর, ছাই, এই কুচ্ছিৎ স্তম্ভটাকে ভেঙে ফেলে না কেন? এটা আমাদের দু-চক্ষের বিষ।
এলেন বলল, ভাঙলেই বা কী লাভ। টাওয়ার সোসাইটির সভাপতি কে বলেছে শোনোনি? টাওয়ারটা ভেঙ্গে ফেললে মানুষ তখন শেন নদীর জলে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করবে। মানুষ আত্মহত্যা করা কখনও থামবে না।
হ্রোবেয়ার গলার স্বর গাঢ় করে বলল, কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? এলেন তুমি মরতে চাও কখনও?
এলেন নিবিড় হয়ে, এসে উত্তর দিল, কী জানি! চরম সুখের মুহূর্তেও মানুষ বোধ হয় মরতে চায়!
অতঃপর তরুণ-তরুণীদ্বয় বলিষ্ঠ আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ওষ্ঠ সংলগ্ন করলেন। আমি যে পাশে দাঁড়িয়ে আছি, তাতে গ্রাহ্যই নেই। ফরাসিজাত একে বলে। আমার ইচ্ছে ছিল মৃত রুমানিয়ান দম্পতিকে একবার দেখে আসি; তাদের মুখে প্রকৃত সুখ চিহ্নিত কি না! কিন্তু ভিড় ঠেলে এগুতে পারলুম না। সুতরাং ওদের সঙ্গে কারতি ল্যাত্রায় বইপাড়ায় চলে গেলুম। আমিও দেশ ছাড়ার পর কাগজে পড়েছিলুম যে, আত্মহত্যা নিবারণের জন্য প্যারিসের খবরের কাগজগুলো খুব হইচই তোলায় এফেল টাওয়ারের যে তিনটে বারান্দা আছে, সেগুলোতে সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু তারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আত্মহত্যা অবশ্য তাতে থামেনি। গত সপ্তাহেও ভিয়েতনামের একটি ছাত্র তারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে আত্মহত্যা করায়, এ পর্যন্ত ওই স্তম্ভ প্রান্তের অপমৃত্যুর সংখ্যা হল ৩৪৯টি। প্রতি মাসে একটা না একটা মৃত্যু লেগেই আছে।
আলেকসুন্দর এফেল নামের সাহেবটি এই ইস্পাত স্তম্ভটি তৈরি করেন ১৮৮৯ সালে। সেবার প্যারিসে বিশাল বিশ্বমেলা হয়েছিল, এফেলের এই টাওয়ার তার স্মারক। তারপর থেকে এ যাবৎ প্যারিস শহরকে একমুহূর্তে বোঝবার জন্য এফেল টাওয়ারের নাম করলেই হয়। অসংখ্য ছবিতে-কার্টুনে প্যারিস বলতেই এফেলের স্তম্ভ। অথচ, ফরাসিরা গোটা প্যারিসের মধ্যে ওই জিনিসটার চেয়ে আর কিছুকে বুঝি বেশি ঘৃণা করে না। সেই ঘৃণার কারণ বোঝা যায়, প্যারিসের মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে অসংখ্য শিল্পকীর্তি, শেন নদীর ওপর সুরম্য সেতুগুলি, এখানে ওখানে ছড়ানো অসংখ্য ভাস্কর্য, নতবদন গির্জার সষমা সাঁজে লিজের মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাজপথ যে শহরের গর্ব, সেই শহরের বুকে নিতান্ত শিল্পহীন একটা ইস্পাতের চূড়া খারাপ লাগতেই পারে। এ সম্পর্কে সেই গল্পটি নিশ্চয়ই অনেকে জানেন যে, একজন তরুণ ফরাসি কবি সর্বক্ষণই প্রায় এফেল টাওয়ারের ওপরের রেস্তোরাঁতে বসে থাকত। তাকে সেখানে দেখে একজন আমেরিকান কবি অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছিল, কী হে, তুমি যে এখানে? তোমরা ফরাসিরা শুনেছি এটার দিকে তাকানো পর্যন্ত সহ্য করতে পারো না? ফরাসি কবিটি মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিল, সেই জন্যই এখানে আসি। গোটা শহরে এই একটি মাত্র জায়গা, যেখানে এলে এই কুচ্ছিৎ জিনিসটাকে পুরো দেখতে পাওয়া যায় না।
কিন্তু তা বলে এফেল টাওয়ার ভেঙে ফেলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কারণ টুরিস্টরা আর শিল্প দেখতে আসে না, তারা আসে বিখ্যাত জিনিস দেখতে। যে-কোনও জায়গাতে গিয়েই কাগজের লিস্ট মিলিয়ে বিখ্যাত জায়গাগুলি দেখে নিতে হয়। এবং প্যারিসে এক নম্বর বিখ্যাত জায়গা হচ্ছে, এফেল টাওয়ার। এ পর্যন্ত এফেল টাওয়ারে যত ভ্রমণার্থী এসেছে, তত আর কিছুতে নয়।
এফেল টাওয়ার আরও নানান ধরনের লোককেও আকর্ষণ করেছে। শৌখিন পর্বতারোহীরা বাইরে থেকে বেয়ে উঠেছে ওপরে। পাইলটরা তলায় গর্ত দিয়ে প্লেন উড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন (কখনোই পারেননি), একজন লোক দু-হাতের ওপর ভর দিয়ে ৩৬৩টা সিঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে। একজন আবার সাইকেল চালিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিল। চূড়া থেকে প্যারাসুটে ঝাঁপিয়েছে অনেক লোক। ১৯১১ সালে একজন দর্জি দু খানা কাপড়ের তৈরি ডানা তৈরি করে, শরীরের সঙ্গে মুড়ে ওড়ার চেষ্টা করেছিল এফেল টাওয়ারের চূড়া থেকে। বলাই বাহুল্য, উড়তে পারেনি, মাটিতে আছড়ে মারা গেছে। এ ছাড়া আত্মহত্যা তো লেগেই আছে।
এফেল টাওয়ার ভেঙে দেবার বদলে রক্ষণ সমিতি আরও দশ ফুট উঁচু করার সিদ্ধান্ত করেছেন। এখন আছে ৯৮৪ ফিট, এরপর হাজার ও আকাশছোঁয়া।