দিল্লি থেকে হঠাৎ অনুরোধ এল দেশ পত্রিকার পক্ষ থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যেতে হবে ঢাকায়। সাগরদা আমার ওপর আজ্ঞা দিলেন।
আমি বড়লোকদের সংসর্গে থাকতে ভয় পাই। রাজনৈতিক নেতাদের খবরের কাগজের ছবিতেই দেখা পছন্দ করি। অথবা বাধ্য হয়ে টেলিভিশনে। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলবলের সঙ্গে এক বিমানে যেতে হবে শুনে প্রথমে মন ঠিক সায় দেয় না, কিন্তু নেমন্তন্নটা যেহেতু বাংলাদেশে এবং উপলক্ষটা সাত দেশের শীর্ষ সম্মেলন, তাই যাওয়ার ইচ্ছাটাও প্রবল হয়ে ওঠে।
ঢাকা যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির অনেক প্রোগ্রাম। দিল্লি থেকে উড়ে আসবেন পানাগড়ে, সেখান থেকে শান্তিনিকেতন। সন্ধেবেলা দু-তিনটি অনুষ্ঠান, পরদিন সকালে কনভোকেশানে পৌরোহিত্য, তারপর হেলিকপ্টারে পানাগড়ে ফিরে এসে বিমানযোগে গুয়াহাটি, সেখানে পৌঁছে আবার হেলিকপটারে শিলং-এ গিয়ে মিটিং, তারপর গুয়াহাটি থেকে সরাসরি ঢাকায়।
বাচ্চা বয়সে আমাদের স্কুলের রচনায় দেওয়া হত, ‘তোমাকে যদি দেশের প্রধানমন্ত্রী করা হয়, তবে তুমি কীভাবে দেশটাকে চালাইবে?’ তখন কী লিখেছিলুম মনে নেই। কিন্তু এখন মনস্থির করে ফেলেছি, আমাকে হঠাৎ কখনও এ-দেশের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ঝুলোঝুলি করা হলেও আমি রাজি হব না একটি মাত্র কারণে। সারা দেশে চরকিবাজির মতন ঘুরে, একই দিনে দু-তিনটি সভায় দু-তিন রকম বিষয়ে এবং গলার আওয়াজ বদলে বক্তৃতা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
দিল্লি থেকে জানানো হল যে আমি ইচ্ছে করলে প্রধানমন্ত্রীর পার্টির সঙ্গে দিল্লি গিয়েও যোগ দিতে পারি, অথবা শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনই বাড়ির কাছে, রওনা দিলুম সেদিকে। ট্রেনে দেখা হল পরিবর্তন পত্রিকার সম্পাদক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, তিনিও যাচ্ছেন একই উদ্দেশ্যে। কলকাতা থেকে শুধু আমরা দু’জনেই নিমন্ত্রিত, শুনলাম আরও দশ-বারোজন আসবেন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের পত্র-পত্রিকা থেকে।
শান্তিনিকেতন পৌঁছে পোঁটলা-পুঁটলি জমা রাখলুম বন্ধুবর অশেষ চট্টোপাধ্যায়ের বাসা বাড়িতে। বিনা নোটিসে আমার এরকম অকস্মাৎ আগমনের উপলক্ষ শুনে সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, তা হলে তো তোমার সিকিউরিটি পাস-এর ব্যবস্থা করে ফেলতে হয় এক্ষুনি। নইলে তো তোমাকে আসল ব্যাপারের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেবে না।
তখুনি বেরুতে হল ওইসব জোগাড় করতে। শান্তিনিকেতন পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ। মেলাপ্রাঙ্গণে সারি-সারি সশস্ত্র সেপাইদের তাঁবু। এ দৃশ্য চোখকে পীড়া দেয়। যুদ্ধের দৃশ্যে যোদ্ধাদের মানায়, কিন্তু যে-জায়গাটির নাম শান্তিনিকেতন, যেখানে সারা বিশ্বের মনন শিল্প একসঙ্গে মেলাবার স্বপ্ন দেখেছিলেন এক কবি, সেখানেও সমর বাহিনী।
অশেষ চট্টোপাধ্যায়ের তৎপরতায় জোগাড় করা গেল এক টুকরো চোথা কাগজ, যা দেখালে প্রবেশ করা যাবে নিষিদ্ধ এলাকায়। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি শ্রীযুক্ত মণিশঙ্কর আইয়ারের সঙ্গে যোগাবোগ করতে। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যাবে কোথায়? তিনি তো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছায়ার মতন ঘুরবেন।
সুতরাং বিকেলবেলা প্রধানমন্ত্রী প্রথমে যেখানে মিটিং করবেন গেলুম সেই এলাকায়। এখানে তিনি ইন্দিরা গান্ধির নামে জাতীয় সংহতি কেন্দ্রের উদ্বোধন করবেন। গিয়ে দেখি দড়ি দিয়ে ঘেরা সেই জায়গাটিতে শ্রোতার চেয়ে পুলিশের সংখ্যা বেশি। অনেক দূরে, কর্ডনের ওপাশে ভিড় করে আছে গ্রামের লোকজন। সুসজ্জিত মঞ্চের একপাশে একটি ছোট মঞ্চে, নির্বাক-নিষ্পলক হয়ে বসে আছেন শান্তিনিকেতনের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী। তাঁরা নির্দেশ মতন গান গাইবেন।
যথাসময়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি। চর্মচক্ষে এই দ্বিতীয়বার আমি তাঁকে দেখলুম। আগেরবার দেখেছি কিঞ্চিৎ অধিক এক বছর আগে তাঁর মায়ের চিতার পাশে। তখন তাঁর মুখে ছিল শোক দমনের গাম্ভীর্য। এখন তাঁর মুখে একটা সার্বজনীন মিষ্টি হাসি। পৃথিবীতে যতগুলি কৃত্রিম ব্যাপার আছে তার মধ্যে কৃত্রিম হাসিই সবচেয়ে বেশি কৃত্রিম।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার আগ্রহ আমার ছিল না, আর জাতীয় সংহতি বিষয়ে বক্তৃতা মানেই তো সেই একঘেয়ে কথা। আমি খুঁজছিলাম মণিশঙ্কর আইয়ারকে। প্রধানমন্ত্রীর ডান পাশে বাঁ পাশে যাঁরা ভিড় করে আছেন, তাঁদের মধ্যে কোনজন তিনি?
এর মধ্যে একটা কান্ড হল। পুলিশের কর্ডন ভেদ করে হুড়-হুড় করে ঢুকে এল গ্রামের লোকেরা। পুলিশও বাধা দিল না বিশেষ। বোধহয় হঠাৎ কোনও কর্তাব্যক্তির মাথায় এসেছে যে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দিচ্ছেন অথচ শ্রোতাদের সংখ্যা নগণ্য এটা বোধহয় ভালো দেখায় না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো প্যান্ডেল ভরে গিয়ে বাইরেও উপচে পড়ল মানুষ। এই সব গ্রামবাসীদের মধ্যে স্ত্রীলোক ও কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যাই বেশি। কোনও কোনও মহিলা কাঁখে বাচ্চা নিয়ে এসেছেন। এদের চোখে রাজদর্শনের কৌতূহল। তা ছাড়া আর কী? প্রধানমন্ত্রী, উপাচার্য এবং অন্য সকলেরই বক্তৃতা চলছে ইংরিজিতে, এরা তা একবর্ণ বুঝবে না। আর চেয়ারে-বসা, ভদ্রলোকের পোশাক পরা যাঁরা ইংরিজি বোঝেন তাঁরা এখানে যা বলা হচ্ছে সবই আগে থেকে জানেন।
এই ভিড় ভেদ করে আমি মনিশঙ্কর আইয়ারকে কোথায় খুঁজে পাব? এর মধ্যে কলকাতার পি আই বি-র শ্রীদেবব্রত রায় এসে বললেন যে এর পরবর্তী মিটিং আছে গৌর প্রাঙ্গণে, সেইখানে আমাদের উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে ধরতে হবে। একখানা সরকারি বাসে করে গেলুম সেখানে। এবারে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন পূর্ব ভারত সংস্কৃতি কেন্দ্রের। আগের অনুষ্ঠানের আয়োজক বিশ্বভারতী। এবারেরটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। বিরাট প্যান্ডেল, প্রচুর নিমন্ত্রিত, কড়া সিকিউরিটি ব্যবস্থা। এখানে গ্রামের লোকের হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। আগের অনুষ্ঠানটিতে সিকিউরিটি ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেলেও কোনও বিঘ্ন ঘটেনি। কিন্তু এই অনুষ্ঠানে দর্শক সমাগম সংযত করার জন্য পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছে। এমন শোনা গেল। আমি নিজের চোখে তা দেখিনি, শোনা কথা।
আমি অবশ্য ভেতরে পৌঁছে গেলুম ঠিকঠাক। কিন্তু এবারে শ্রীযুক্ত আইয়ারকে পাওয়া গেল না। আমাদের জন্য যে দিকে বসার ব্যবস্থা হয়েছে, তিনি আছেন তার উল্টো দিকে। সেদিকে আমাদের যাবার উপায় নেই। তখনই ঠিক করে ফেললাম, শ্রীযুক্ত মণিশঙ্কর আইয়ারের সঙ্গে আমার দেখা না করলেও চলবে। তাঁর যদি গরজ থাকে তিনি দেখা করবেন আমার সঙ্গে। ঢাকা যাওয়ার বদলে কলকাতায় ফিরে গেলেও আমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না।
একটু বাদে জানা গেল যে, আমরা ট্যুরিস্ট লজে গেলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে দলটি এসেছে, সেই দলটি সেখানেই অপেক্ষা করবে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও আমি সেই মতো এসে হাজির হলাম টুরিস্ট লজে। পার্থবাবু অভিজ্ঞ ব্যক্তি, ভি ভি আই পি-দের সঙ্গে তিনি অনেক দেশ ঘুরেছেন। কিছুক্ষণ অকারণ অপেক্ষার পর তিনি চুপি-চুপি বললেন, আসুন, রাত্তিরের খাওয়াটা সেরে ফেলা যাক। আমি আগে অনেকবার দেখেছি, শেষের দিকে খাবার পাওয়া যায় না।
প্রধানমন্ত্রী পানাগড় থেকে শান্তিনিকেতন এসেছেন হেলিকপটারে। তাঁর সঙ্গী সাংবাদিকরা আসবেন একটি বাসে। পানাগড় থেকে পৌঁছতে ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগবার কথা নয়, আড়াই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, বাস তবুও বেপাত্তা। কয়েকজন সরকারি অফিসার এখানে কয়েকটি টেলিফোন ঘিরে বসে আছেন, এটা নাকি কন্ট্রোল রুম। আমাদের দেশে ভালো হাসির ছবি হয় না, কিন্তু চার্লি চ্যাপলিন এরকম একটা কন্ট্রোল রুম খুব কাজে লাগাতে পারতেন। এখানে কেউই সঠিক কিছু জানেন না, টেলিফোনগুলির কোনটা খারাপ কোনটা ভালো তা বোঝাবার উপায় নেই। যেটা সরব সেটা মুহূর্ত পরে বোবা হয়ে যাচ্ছে। যেটা বোবা বলে এক কোণে ফেলে রাখা হয়েছিল, সেটা হঠাৎ বেজে উঠছে ঝনঝন করে। প্রত্যেকবার টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে কথা বলছে ভুল লোক, কেউ কারুর কথা বুঝতে পারছে না। এই কন্ট্রোল রুম থেকে গৌর প্রাঙ্গণের দূরত্ব বড়জোর দু’ফার্লং, কিন্তু সেখানকার খবর জোগাড় করবার জন্য এক ভদ্রলোক টেলিফোনে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলেন ঘণ্টাখানেক ধরে।
সাংবাদিক বোঝাই বাসটির তখনও পাত্তা নেই। কেউ বলল পথে ব্রেক ডাউন হয়েছে, কেউ বলল, ভুল করে দুর্গাপুরে চলে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে স্থাপিত এই কন্ট্রোল রুমের কৃতিত্ব দেখে ঘন ঘন চমৎকৃত হতে লাগলুম।
রাত আটটার সময় জানা গেল যে, সেই বাস বহুক্ষণ আগেই শান্তিনিকেতন পৌঁছে গেছে। পথ ভুল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, টুরিস্ট লজে যে সেই বাসের যাত্রীদের খাবার রাখা আছে সে কথা কেউ তাঁদের বলেনি। অপূর্ব ব্যবস্থা!
সেই বাসে আমাদের এখন নিয়ে যাওয়া হবে দুর্গাপুরে। সেখানে রাত্রি যাপন। পরদিন সকালে পানাগড় কাছাকাছি যেতে হবে।
বাসে উঠে দেখলুম অন্য সাংবাদিকরা রীতিমতন ক্ষুব্ধ হয়ে রয়েছেন। তাঁদের ঘোরানো হয়েছে অনর্থক। টুরিস্ট লজে এসে তারা অনায়াসে ঘণ্টা দু-এক বিশ্রাম নিতে পারতেন। তার বদলে অন্ধকার রাস্তায় তাঁদের অকারণ ঘোরানো হয়েছে। শান্তিনিকেতনের কিছুই দেখতে পাননি। তাঁদের তাড়াহুড়ো করে খাওয়ানো হয়েছে ইন্টারন্যাশান্যাল হস্টেলে, যেখানে ছাত্ররা সস্তায় খায়। সকলের মতে সেই খাবার একেবারে অখাদ্য। ডাল মানে হলুদ রঙ করা জল, ভাত হচ্ছে ঠান্ডা শক্ত সাবুদানা। এই নিয়ে ঠাট্টা করতে লাগলেন অনেকে।
বাস চলেছে দুর্গাপুরের দিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক অফিসারের দায়িত্বে। অফিসারটির নাম রায়বাবু। নিরীহ ভালোমানুষ ধরনের, হয়তো অন্য কাজে তাঁর যথেষ্ট দক্ষতা আছে কিন্তু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সাংবাদিকদের বাসে করে নিয়ে রাত্রির বাসস্থান ঠিক করে দেওয়া তাঁর যোগ্য কাজ নয়। সে অযোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া গেল পদে পদে।
আমাদের বাসের পেছনে পেছন একটি পুলিসের এসকর্ট গাড়ি আসবারও কথা। এসেছিলও কিছুটা পথ, তারপর আর তার পাত্তা নেই। আমাদের বাসটি এমনিতেই চলছে আস্তে-আস্তে তারপর মাঝে-মাঝে থেমে যাচ্ছে এসকর্ট গাড়ির প্রতীক্ষায়। সবাই হাসাহাসি করছে। সেই হাসি এক সময় পরিবর্তিত হয়ে গেল রাগে। যখন বাসটা একটা জঙ্গলে ঢোকার মুখে একদম থেমে গেল। বাসচালক একজন সর্দারজি, তিনি বললেন, এই জঙ্গলে পুলিশের পাহারা ছাড়া তিনি যেতে সাহসী নন!
সারা সন্ধের হয়রানি ও খারাপ খাবার খেয়ে সাংবাদিকরা এমনিতেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এবারে তাঁরা চ্যাঁচামেচি করে পশ্চিমবাংলার মুণ্ডপাত করতে লাগলেন। তাঁরা সবাই ঝানু সাংবাদিক, সারা ভারতবর্ষ চষে বেড়ান। তাঁরা বলতে লাগলেন পশ্চিমবাংলার অধঃপতন হবে না কেন? দেখছ তো দুপুর থেকে কারবার? কেউ কথা শোনে না, কেউ মন দিয়ে কাজ করে না। কোনও কো-অর্ডিনেশন নেই, কারুর কোনও দায়িত্বজ্ঞান নেই! কী অবস্থা এই রাজ্যটার! মাঝপথে পুলিশের গাড়ি হাওয়া হয়ে যায়, এ কখনও কেউ শুনেছে? এর থেকে রাজস্থানের ব্যবস্থাপনাও অনেক ভালো!
পার্থবাবু ও আমি দুজনেই চুপ। কী প্রতিবাদ করব? আমরা নিজেরাই তো দেখছি অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা!
রায়বাবু বাস থেকে নেমে পুলিশের গাড়ির খোঁজে খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সবাই চেঁচিয়ে উঠল, রায়বাবু ভাগতা হ্যায়! রায়বাবু ভাগতা হ্যায়!
খানিকবাদে পুলিশের গাড়ির আশা ত্যাগ করতে হল, কোনও গরুর গাড়িরও এত দেরি লাগার কথা নয়। সাংবাদিকরা জিগ্যেস করল, এই জঙ্গলে কীসের ভয়? ডাকাত না নক্সালাইট? বাসে শুধু একদল সাংবাদিক রয়েছে, বর যাত্রী নয়। রাত নটার সময়ে পুলিসের সাহায্য ছাড়া যাওয়া যাবে না? কে কে যেতে রাজি আছ, হাত তোলে।
ড্রাইভারকে এক প্রকার জোর করেই বাধ্য করানো হল বাস চালাতে। এঁরা দিল্লি থেকে প্লেন জার্নি করে এসেছেন, তারপর অনবরত বাসে ঘুরছেন, এখন তাড়াতাড়ি বিশ্রাম স্থানে পৌঁছতে চাওয়া কোনও অন্যায় আবদার নয়। এঁরা কেউ অল্প বয়সী সংবাদিক নন, প্রত্যেকেই ভারতের বিশিষ্ট পত্র-পত্রিকায় উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত।
শান্তিনিকেতন থেকে দুর্গাপুর, এই সামান্য যাত্রাপথটুকুই এক রোমহর্ষক ভ্রমণ কাহিনীর পটভূমিকা হয়ে গেল। জঙ্গলটি নির্বিঘ্নে পার হয়ে এলেও দুর্গাপুর শহরটিই পরিণত হল জঙ্গলে, সেখানেই আমরা পথ হারালুম।
আমাদের ভারপ্রাপ্ত পথপ্রদর্শক ও ব্যবস্থাপক রায়বার দুর্গাপুর শহরটি চেনেন না। আমাদের বাসস্থান কোথায় নির্দিষ্ট হয়েছে সে সম্পর্কেও তাঁর স্পষ্ট ধারণা নেই। ড্রাইভারও কিছু জানেন না। তার ফলে দুর্গাপুর শহরের চওড়া নির্জন রাস্তায় আমাদের বাস অনবরত পাক খেতে লাগল। ক্রমে এক সময় মনে হল, সারা রাতই আমাদের বাসে কাটাতে হবে। কেননা, রাত এগারোটার পর, দুর্গাপুরের সব রাস্তা শুনসান, একটা পথচারীও নেই যে কিছু জিগ্যেস করা যাবে। এই অবস্থায় সকলেই যদি বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে যায়, তাহলে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় কি? কিন্তু লক্ষ করলুম, সকলেই উম্মা প্রকাশ করলেও কোনও সাংবাদিকই একটা খারাপ ভাষা ব্যবহার করেননি। বাসে কয়েকজন বিদেশি ও একজন বিদেশিনী ছিলেন, পূর্ব ইউরোপের কোনও দেশের, এঁরা প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন। এই সব কান্ডকারখানা দেখে এঁরা নিজস্ব ভাষায় হাসাহাসি করতে লাগলেন। কী বলছিলেন, ভাগ্যিস তা বুঝিনি।
নৌ-বিদ্রোহের মতন বাস-বিদ্রোহের উপক্রম হল। কেউ-কেউ বলল, শান্তিনিকেতনেই ফিরে যাওয়া হোক। কোনও একটি মোড়ে এসে কয়েকজন উদ্যোগী সাংবাদিক জোর করে বাস থামালেন। তারপর একটি রিকশাওয়ালাকে ডেকে সার্কিট হাউস, গেস্ট হাউসের খবর নিলেন। এবং তাঁদেরই চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত গেস্ট হাউস খুঁজে পাওয়া গেল।
রাত তখন বারোটা। একজন সাংবাদিক রায়বাবুকে বললেন, এ রকম অবস্থা আমি জীবনে কখনও দেখিনি।
রায়বাবু অম্লানবদনে উত্তর দিলেন, সত্যি, এরকম অভিজ্ঞতা আমারও প্রথম।
পানাগড় বিমানবন্দরটিও যথারীতি সেনা-পুলিশে ঘেরা। আমাদের পুঁটুলি ও শারীরিক তল্লাসির পর তুলে দেওয়া হল হাওয়াই জাহাজে। এই বিমানবাহিনীর বিশেষ একটা হাওয়াই জাহাজ, অন্দরমহলটি তিনটি ভাগে ভাগ করা। পেছনের কামরায় আমরা, মাঝখানে অফিসারকুল ও সামনের দিকে প্রধানমন্ত্রীর আসন। প্রধানমন্ত্রী আসার একঘণ্টা আগে আমরা উঠে বসে রইলাম। এটাই নাকি নিয়ম। আমি সঙ্গে বই নিয়ে যাইনি। বিমানে আগের দিনের বাসি খবরের কাগজ রয়েছে। আমি এর আগে কখনও এত মনোযোগ দিয়ে কাগজের বিজ্ঞাপন পড়িনি। এমনকি পাত্র-পাত্রী সংবাদও বাদ রাখলুম না।
বিমানটি আকাশে ওড়ার পর প্রথম সাক্ষাৎ পেলাম শ্রীযুক্ত মণিশঙ্কর আইয়ারের। আগের সন্ধ্যাবেলা তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। কয়েকজন সাংবাদিক আগের রাত্রির নাজেহাল অবস্থার বর্ণনা করে অভিযোগ জানালে তিনি হালকা গলায় বললেন, আরে ছি ছি, যাক গে, যা হবার হয়ে গেছে।
আমার একটা ক্ষীণ ধারণা ছিল, রাজীব গান্ধিও বোধহয় কোনও এক সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতে আসবেন। কিন্তু তিনি সর্বক্ষণ অদৃশ্য হরেই রইলেন। যাঁদের সর্বক্ষণ বুকে বুলেট প্রুফ জামা পরে থাকতে হয়, তাঁরা গল্প গুজব বা আড়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য। আহা রে!
শান্তিনিকেতনে মনোরম শীত ছিল কিন্তু গুয়াহাটিতে বেশ গরম। অবশ্য এখানে ব্যবস্থাপনা ভালো। প্রধানমন্ত্রী আবার একটি হেলিকপ্টারে চলে গেলেন শিলং-এর এক সভায় বক্তৃতা দিতে, আমাদের নিয়ে যাওয়া হল বিমানবন্দরের কাছেই একটি নির্মীয়মাণ হোটেলে। প্রত্যেকের বিশ্রামের জন্য আলাদা ঘর। দুপুরবেলা ভদ্রগোছের খাদ্য পরিবেশন। বলাই বাহুল্য, অন্য প্রদেশের সাংবাদিকরা পশ্চিমবাংলার তুলনায় আসামের প্রশংসা করবেনই। গতকাল রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি এবং আজ ঢাকায় কখন পৌঁছব এবং কত রাত্রে কী হবে তার স্থিরতা নেই বলে আমি চট করে খানিকটা দিবানিদ্রা দিনে নিলুম।
এর আগেও আমি বেশ কয়েকবার গুয়াহাটিতে এসেছি। কিন্তু এবারের আসা যেন আসা নয়। বিমানযাত্রী বটে কিন্তু বিনা টিকিটের। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল, আবার সেখান থেকে এয়ারপোর্ট। রাজীব গান্ধি এর মধ্যে ক’টা বক্তৃতা দিনে এলেন কে জানে!
ঢাকার দিকে রওনা হবার পরেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একবারও চাক্ষুষ দেখা হল না। তার বদলে আমাদের কাছে বিলি করা হল প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার ছাপানো কপি, যেটা তিনি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে পড়বেন।
সাতটি দেশের এই শীর্ষ সম্মেলন সম্পর্কে আমি অনেকদিন থেকেই কৌতূহলী। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করলে দু’পক্ষেরই ক্ষতি হয়। এটা সব নীতিশিক্ষাতেই আছে। সব ধর্মেই আছে। তবু মানুষ বোঝে না, রাষ্ট্রনায়করা ইচ্ছে করে বুঝতে চায় না। আমেরিকার রাশিয়ার অস্ত্র কিনে তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলির লড়ালড়ি দেখে সাহেব জাতগুলো হাসে। যাই হোক, প্রথম এই ভারতীয় উপমহাদেশের সাতটি দেশের শীর্ষ সম্মেলন হলেই যে সব সমস্যা মিটে যাবে তা কেউ আশা করে না, তবু একটা চক্ষুলজ্জার ভাব তো হবে! একটি গিট অন্তত খুলতে পারে।
রাজীব গান্ধির বক্তৃতায় অবশ্য পরিষ্কার কোনও প্রস্তাব নেই, আছে পারস্পরিক মেলামেশা ও সম্প্রীতির সম্পর্কে মিষ্টি মিষ্টি কথা। উদ্বোধনী ভাষণে বোধহয় এরকমই কথা বলার নিয়ম। বক্তৃতার শেষ অংশে রবীন্দ্রনাথের কবিতার খানিকটা ভুল অনুবাদ আছে। প্রধানমন্ত্রীর কবিতা পড়ার সময় কোথায়, বক্তৃতা লেখারই বা সময় কোথায়! বোঝাই যাচ্ছে, রাজীবের কোনও পরামর্শদাতা ঠিক মতন হোমওয়ার্ক করেননি। সেই পরামর্শদাতা ভেবেছেন বাংলাদেশের মানুষ আবেগপ্রবণ, সেখানে একটা কিছু কবিতা টবিতা ভাষণের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়াই ভালো। রবীন্দ্রনাথের রচনাবলি ভালো করে খুঁজলে সকলকে খুশি করার মতন অনেক কবিতা পাওয়া যেত। কিন্তু ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ কবিতাংশকে অনুবাদে পালটে দেওয়ার অধিকার প্রধানমন্ত্রীরও নেই।
হঠাৎ কেউ একজন বলল, দ্যাখো, দ্যাখো, বাইরে দ্যাখো!
জানালা দিনে দেখা গেল, আমাদের বিমানের দু-পাশে দুটি দুটি চারটি বাংলাদেশি সামরিক বিমান সমান গতিতে উড়ে আসছে। কোনও রাষ্ট্রপ্রধান এলে তাঁকে এই রকম সম্মান দেখিয়ে, পথ দেখিয়ে আনাই নাকি প্রটোকল। পাশাপাশি কয়েকটি বিমান উড়ে যেতে আমি এর আগে শুধু সিনেমাতেই দেখেছি
হঠাৎ মনে একটা প্রশ্ন জাগল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তো একবারও দেখা হল না এ পর্যন্ত, তবু তাঁর সঙ্গে একই বিমানে যাওয়ার জন্য আমাদের নেমন্তন্ন করা হল কেন? সহযাত্রীদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী নিদেশ সফরে গেলে এইরকম একটা দল সঙ্গে নিয়ে যাওয়া নাকি প্রথা। আগেকার দিনে রাজা মহারাজাদের সঙ্গে যেমন পারিষদ দল থাকত, সেইরকম? কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকদের ভূমিকা তো পারিষদদের মতন নয়। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী কার্যক্রম সমালোচনা করা বা টেনে গালাগাল দেবার কোনও বাধা নেই।
ঢাকা বিমানবন্দরের আকাশে যখন আমাদের বিমানটি চক্কর দিচ্ছে, সেই সময় আমাদের জানানো হল যে প্রধানমন্ত্রী নামবার সঙ্গে-সঙ্গেই আমরা যেন হুড়োহুড়ি করে নেমে না পড়ি। প্রধানমন্ত্রী একা নামবেন, আমাদের এদিক থেকে শুধু ভিসুয়াল মিডিয়ার লোজন, অর্থাৎ টি ভি ও ফিলমস ডিভিসনের কর্মীরা মুক্তি পাবেন আগে।
রাজতন্ত্রের প্রভাব অতি দুর্মর। এখানে তার রেশ অতি প্রকট। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সাত রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে দু’জন তো সত্যিকারের রাজা, সামরিক শাসকদেরও রাজা বাদশার সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় অনায়াসে, কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নেতাদেরও চালচলন অনেকটা রাজকীয়। ট্র্যাজেডি এই যে সাধারণ মানুষ যাঁকে ভোট দিনে ক্ষমতায় তুলে দেয় সেই মানুষটিকে বর্ম পরে, দেহরক্ষী পরিবৃত অবস্থায় থাকতে হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘোরাফেরার সুযোগ তাঁর থাকে না।
কিছুদিন আগে আমি সুইডেনে বেড়াতে গিয়েছিলুম। সেখানকার বন্ধুরা আমাকে স্টকহম শহরে ঘোরাতে-ঘোরাতে এক জায়গায় একটা সরু মতন রাস্তায় একটি বাড়ি দেখিয়ে বললেন, এই বাড়িটায় সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী থাকেন। সেখানে একজনও সেপাই সান্ত্রী নেই। শোনা গেল, প্রায়ই দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেটের মিটিং সেরে ফেরার পথে সুপার মার্কেট থেকে বাজার করে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন।
যত বেশি গরিব দেশ, তত বেশি আড়ম্বর, তত বেশি পুলিশ মিলিটারির দাপট! এসিয়াড খেলার সময় দিল্লিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়ে অন্য দেশের প্রতিনিধিদের দেখাবার চেষ্টা হয়েছে, ভারত গরিব নয়! আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীরা এক একটা মিটিং করতে যান, তার জন্য কত লক্ষ টাকা যে বাজে খরচ হয় তার ইয়ত্তা নেই। বস্তির মানুষদের দু-বেলা উনুন ধরে না, তার কাছেই তৈরি হয় পাঁচ তায়া হোটেল।
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধিকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য প্রেসিডেন্ট এরশাদ এলাহি ব্যবস্থা করেছেন। আমরা বিমানের এক দরজায় দেখতে লাগলুম। অন্য দরজায় দাঁড়িয়ে সিঁড়ির কাছে পাতা হল লাল কার্পেট। নানা দিকে দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ সেনাবাহিনী। একদিকে দেখা গেল একটি জীবন্ত রামধনু। নানা বয়েসি বালিকারা বিভিন্ন রঙের পোশাক পরে রামধনুর আকার তৈরি করেছে। দেখে প্রথমেই মনে হল, কতক্ষণ ধরে এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওই বালিকারা?
সেনাবাহিনীর মধ্যে এই অংশের পোশাক চক্রাবক্রা, তাদেরই বোধহয় কমান্ডো বলে। তাদের একজন ভোলা তলোয়ার হাতে রয়েছেন রাষ্ট্রপতি এরশাদের পাশে। এই তলোয়ারধারী কমাণ্ডোর হাঁটার ভঙ্গিটা অদ্ভুত, হাত-পা দুটোরই নড়াচড়া বেশি-বেশি! অনেকটা ক্যারিকেচারের মতন। বিমানবন্দরে সব রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা হয়তো এই রকমই হয়। কিন্তু আমি তো এর আগে দেখিনি, তাই আমার কাছে কেমন-কেমন লাগছে। রাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্কে হৃদ্যতার প্রশ্ন নেই। বাহ্যাড়ম্বরই প্রধান। বিমানবন্দরটি চমৎকার সাজানো হয়েছে। অতিথি রাষ্ট্রপ্রধানদের বিমান থেকে নেমেই মোটরগাড়িতে ওঠার উপায় নেই। তার আগে বেশ কিছুক্ষণ ব্যায়াম করতে হয়। প্রথমে মঞ্চে উঠে স্যালুট গ্রহণ, তারপর মাপা-মাপা পায়ে হেঁটে সেনাবাহিনীর সামনে দিনে ঘুরতে হয় অনেকখানি।
রাজীব গান্ধিকে তো করতে হল একবার। প্রেসিডেন্ট এরশাদকে অবিকল এই একই ব্যাপার করতে হবে ছ’বার। রাষ্ট্রপতি হবার ধকল কম নয়।
বাংলাদেশের ব্যান্ডে প্রথমে বাজানো হল ওঁদের জাতীয় সঙ্গীত, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। পরে বাজানো হল ডি এল রায়ের সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি…’। আমি ভারতীয়, আমি বিদেশি হিসেবে পাশপোর্ট নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে শুনতে পাচ্ছি আমার মাতৃভাষার প্রিয় গান। যা আমি নিজের দেশের সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে কোনও দিন শোনার আশা রাখি না।
দুই নায়ক রঙ্গভূমি থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার পর আমরা বিমানবাহিনী থেকে অবতরণের অনুমতি পেলাম। টারম্যাকে তখনও লাল কার্পেট ছড়ানো রয়েছে চতুর্দিকে। আমিও পা ফেলতে লাগলুম খুব সাবধানে। যাতে কোনওক্রমে ওই লাল কার্পেটে আমার পা না পড়ে। আমি গরিবের ছেলে আমার তো ঘোড়ারোগ দরকার নেই। অপরের জন্য পাতা কার্পেটে আমি পা দিতে যাব কেন?
আমাদের জন্য হোটেল নির্দিষ্ট ছিল। এদিককার ব্যবস্থাপনা প্রায় নিখুঁত। সব কিছু চলছে ঘড়ির কাঁটায়। হোটেলের ঘরের আয়নায় একবার মুখটি দেখে নিয়েই ছুটতে হল ভারতীয় হাই কমিশনের চত্বরে। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী রিসেপশান দিচ্ছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে এবং আরও বহু হোমরা-চোমরারা আসবেন। আমরা গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতেই পার্টি প্রায় শেষ। কেউ-কেউ বেরিয়ে আসছেন, আরও হাজার খানেক নারী-পুরুষ রয়ে গেছেন তখনও। দারুণ-দারুণ পোশাকের বাহার, প্রচুর সুন্দরী মহিলা, কাকে ছেড়ে কাকে দেখি।
আমি দলভ্রষ্ট হয়ে একা-একা ঘুরছিলাম। হঠাৎ দেখা হয়ে গেল শামসুর রহমানের সঙ্গে। কবি সাহেব আজ এসেছেন সাহেবি পোশাক পরে। দেখাচ্ছেও সাহেবদের মতন। তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছি। একটু পরে এলেন সৈয়দ সামসুল হক, অবশ্য দু-তিন মাস আগেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল অন্য প্রবাসে। কবি ও সফল নাট্যকার সৈয়দ সামসুল হক এখন চলচ্চিত্রে প্রবেশ করেছেন। সন্ধানী পত্রিকার সম্পাদক গাজি সাহাবুদ্দিন দূর থেকে এসে হাসতে-হাসতে বললেন, আমার স্ত্রী বীথি বলছে, ওই ভদ্রলোককে দেখতে ঠিক সুনীলদার মতন। সত্যিই আপনি সুনীলদা তত? এবারে বীথি কাছে এসে অভিযোগ-অভিমানের সঙ্গে বলল আপনি আসছেন। আমাদের একটা খবরও দেননি? আমি বললুম আমি যে ঢাকায় আসব, সেটা তো আমিই জানতুম না গত সপ্তাহেও।
ওঁদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে আমার গা থেকে সাংবাদিক-সাংবাদিক গন্ধটা মিলিয়ে যেতে লাগল। দাড়ি কামাবার পর মুখে আফটার শেভ লোশানের বদলে তারপিন তেল মেখে ফেললে যা হয়, আমার গা থেকে বোধহয় সেইরকমই গন্ধ বেরচ্ছিল।
একজন বিশেষ সুন্দরী মহিলা হাসি-হাসি মুখ করে এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। গাজি সাহাবুদ্দিন আমাকে বললেন, সুনীলদা, আপনি ওঁকে চেনেন? আমি না বলতেই গাজি বললেন তাহলে উনি বোধহয় আপনাকে চেনেন।
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিনে আমাকে টেনে সেই ভদ্রমহিলার সামনে নিয়ে গিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে কী পরিচয় আছে? এনার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মহিলা বললেন, ও।
তারপর দু-এক মুহূর্তে দ্বিধা করে জিগ্যেস করলেন, আপনি কোথায় আছেন?
আমি বিনীতভাবে বললুম, আমি দেশে আছি।
কথা বলার সময় কোনও শব্দে কোটেশান চিহ্ন দেওয়া যায় না। সুতরাং আমি দেশে আছি শুনে উনি চার পাঁচ রকম অর্থ ভেবে নিতে পারেন। যে একটি মাত্র শব্দে পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়, তিনি সেই শব্দটিই উচ্চারণ করলেন। তিনি বললেন, ও।
তারপর চলে গেলেন বাইরের দিকে।
তখন অন্যদের কাছে তাঁর পরিচয় জানলুম।
ইনিই বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের পূর্বতন রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমানের পত্নী। এখন একটি বিরোধী দল সমষ্টির নেত্রী। এঁর মতন বিখ্যাত রমণীর পক্ষে আমাকে চেনার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি যদি সাংবাদিক হিসেবে চালু হতাম, তাহলে এর পরে দৌড়ে ওঁর পেছন-পেছন গিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা কিংবা সার্ক সম্মেলন সম্পর্কে ওঁর মতামত চাইতাম। কিন্তু ওসব কথা আমার মাথাতেই আসে না।
এক সময় বীথি ও গাজি আমাকে বললেন, হোটেলে ফিরে কী করবেন? চলুন আমাদের বাড়িতে আড্ডা দেবেন। খেয়ে নেবেন ওখানেই।
সৈয়দ সামসুল হকের শরীর তেমন সুস্থ নেই বলে আমি শামসুর রাহমানকে অনুরোধ করলুম তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে। এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী করবে?
শামসুর রহমান বললেন এই কোট-প্যান্ট পরে কি আড্ডা হয়? আজ বাড়িই যাই। কাল-পরশু দেখা তো হবেই।
গাজির বাড়িতে পানাহার ও আলাপচারি চলল অনেক রাত পর্যন্ত। সেখানে এক সময় এলেন ‘যায় দিন’-এর সম্পাদক শফিক রহমান এবং সর্বজন পরিচিত দুলাভাই। তিনি বীথির দুলাভাই বলে আমাদেরও সকলের দুলাভাই।
রাত সাড়ে এগারোটায় আমি হোটেলে ফিরব, শফিক রহমান আমায় পৌঁছে দেবেন, তাঁর গাড়িতে উঠেও বসেছি। এমন সময় বিরাট শব্দ তুলে একখানা স্টেশন ওয়াগন পেছনে এসে দাঁড়াল। সে গাড়ি থেকে কমান্ডোদের কায়দায় লাফিয়ে নামল কবি রফিক আজাদ আর ফারুক ফরিদ নামে দুটি যুবক। আমার হাত ধরে নামিয়ে তায়া বলল, চলুন, চলুন। বেলাল ও আরও অনেকে আপনার জন্যে এক জায়গায় অপেক্ষা করে আছে, আপনাকে যেতেই হবে।
আমি ঢাকায় পৌঁছে এখনও কারুকে টেলিফোন করার সুযোগ পাইনি; কী করে ওরা জানল। আমি যে এখন এই বাড়িতে আছি সে খবর কী করে পেল, এ সব প্রশ্ন জিগ্যেস করারও সুযোগ পেলাম না। ঢাকা শহর এই রকমই। কোনও উদ্যোগ নিতে হয় না, তার আগেই এখানকার মানুষ এমন আপন করে নেয়।
আমার বরাবরই ধারণা, ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হবার সময় ভারত নামটা বদলে দেওয়া উচিত ছিল। হিন্দুস্থান অবশ্যই নয়, কারণ কংগ্রেসি নেতারা দ্বিজাতিতত্ব মানেননি, অন্য কোনও নতুন নাম, নতুন দেশ। এই নামটাই বা মন্দ ছিল কী? তখনকার কোনও নেতার মাথায় এই নাম আসেনি কেন? ভারত নামটা যদি আমরা ছেড়ে দিতাম তা হলে পাকিস্তানি, বাংলাদেশি, নেপালি, ভুটানি এবং আমরা সকলেই নিজেদের ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতে পারতাম। এমনকি মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কারও এই পরিচয়ে আপত্তি থাকত না বোধহয়, কারণ ভৌগলিকভাবে এই গোটা অঞ্চলটিরই নাম ভারতীয় উপমহাদেশ।
সেই ভারতীয় উপমহাদেশেরই সাতটি দেশের শীর্ষ সম্মেলন বসেছে ঢাকায়। আফগানিস্থান ও বার্মা থাকলে প্রতিনিধিত্ব একেবারে ষোলো আনা হতো, কিন্তু ওই দুটি দেশ কেন যোগ দেয়নি তা আমি জানি না।
এই সম্মেলনের আড়ম্বর চোখকে একটু পীড়া দেয়। বারম্ভে লঘু ক্রিয়ার আশঙ্কা মনে জাগায়। আমরা তো খুব বেশি কিছু আশা করছি না, সাত রাজ্যের পরিচালক হঠাৎ এখনই ভাই ভাই বলে গলা জড়াজড়ি করবেন, এমন কল্পনাও করা যায় না। আমরা চাই পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির অবসান আর একটু একটু সহযোগিতার জন্য হয়তো মেলামেলি। সহজ-সরল পরিবেশে সে রকম সুর হলেই আশ্বস্ত হওয়া যেত।
ঢাকা শহরটি সাজানো হয়েছে খুবই সুন্দরভাবে। এই উপলক্ষে শহরটির প্রসাধন হয়ে গেল। বড় বড় রাস্তাগুলির প্রত্যেকটি বাড়িতে নতুন রঙের প্রলেপ, অফিস বাড়িগুলিতে প্রতিদিন আলোকসজ্জা। খানাখন্দ ভরাট হয়েছে, পথের পাশের পড়ো জমি বা ডোবা ঢেকে দেওয়া হয়েছে রঙিন চট দিয়ে। একটি নতুন ফোয়ারা দেখে এমনই চোখ ধাঁধিয়ে যায় মনে হয় বিলেত-আমেরিকার এক টুকরো দৃশ্য। প্রতিটি দেশের নামে আলাদা আলাদা তোরণ। সাইকেল রিকশা অধ্যুষিত ঢাকা শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণও করা হয়েছে সুষ্ঠুভাবে, প্রধান প্রধান পথ একমুখী।
আমাকে প্রয়োজনীয় কার্ড ও ব্যাজ ইত্যাদি দেওয়া হলেও আমি সার্ক সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার উৎসাহ বোধ করিনি। নিরাপত্তা ব্যবস্থার কড়াকড়ির কথা মনে পড়লেই মনটা কুঁকড়ে যায়। দু-চারটে খুনে কিংবা ধর্মীয় উন্মত্তর জন্য সবাইকেই সন্দেহ করা হয়, পদে-পদে পরীক্ষা দিতে হয়। এ যেন রামের অপরাধের জন্য শ্যামকে শাস্তি দেওয়া। ওই রকম পুলিশ-মিলিটারির কড়া চোখের সামনে দিয়ে যেতে হবে সম্মেলন স্থানে। না গেলে কি আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে? টাটকা খবর পাঠাবার দায়ও আমার নেই।
হোটেলের ঘরে বসে টেলিভিশনেই সব কিছু দেখা যেতে পারে। জ্যান্ত সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু টিভি খোলার পর বেশ একটা চমক খেলাম। এক ঘোষিকা কাঁচুমাচু মুখ করে জানাল যে কী যেন একটা যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে, তাই উদ্বোধন অনুষ্ঠান সরাসরি প্রচার করা যাচ্ছে না। শুনেই আমার ভয় হল। অন্যদিকে সব ব্যবস্থা এমন সুশৃঙ্খল, এই অনুষ্ঠানের জন্য কোটি-কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, সেটাই টি ভি তে দেখানো গেল না! যে কোনও মুহূর্তে যান্ত্রিক গোলমাল হতেই পারে। কিন্তু যাঁদের ওপর আজকের দায়িত্ব দেওয়া আছে তাঁদের কী হবে?
অবশ্য অনুষ্ঠানটি রেকর্ড করে রাখতে ত্রুটি হয়নি। দেখানো শুরু হল ঘণ্টা দেড়েক বাদে থেকেই। এই সম্মেলনের সভাপতি মনোনীত হয়েছেন এরশাদ সাহেব, সেটাই স্বাভাবিক ও সংগত, এর জন্য এরশাদ সাহেবের খাটা খাটনি বেড়ে গেল অনেক। কতবার যে তাঁকে টেবিল ছেড়ে উঠতে হল ও বসতে হল তার ঠিক নেই, অন্যদের বক্তৃতার পর প্রত্যেককে অবিকল একই ভাষায় ধন্যবাদ প্রদান, যাতে কারুর ক্ষেত্রে উনিশ-বিশ না হয়। আমাদের মতন সাধারণ মানুষের কাছে এই সব কাজ বেশ বিরক্তিকর মনে হলেও রাষ্ট্রনেতাদের সহ্য করতেই হয়, অসীম তাঁদের সহ্যশক্তি।
নেতারা প্রত্যেকেই বেশ ভালো-ভালো কথা বললেন। কেউ পুরোনো ক্ষত খুঁচিয়ে তোলেননি। পূর্ব শর্ত অনুযায়ী কেউই দ্বিপাক্ষিক কোনও সমস্যার কথা উত্থাপন করেননি, সুতরাং প্রথম দিনটিকে সার্থকই বলা যায়। আমি কিন্তু সবচেয়ে বেশি চমকে গেছি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের বক্তৃতা শুনে। আমাদের দেশে আমরা তাঁকে একজন কট্টর, জঙ্গী মানুষ বলেই ভাবি। কিন্তু বক্তৃতা শুনে মনে হল অমায়িক ভদ্রলোক। শুরুতে স্রোত্র পাঠের সময় খানিকটা ধর্মগুরু ভাব, তারপর একনাগাড়ে প্রশংসা করতে লাগলেন সকলের, এমনকি ইন্দিরা গান্ধিকে পর্যন্ত। তিনি বোধহয় প্রথম ইন্দিরা গান্ধির নাম উল্লেখ করলেন! শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতিও অবাক করলেন বেশ। শ্রীলঙ্কায় তামিলরা নির্বিচারে নিহত হচ্ছে বলে ওঁকেও ভেবেছিলাম একজন কঠোর নির্দয় মানুষ। কিন্তু এই প্রবীণ মানুষটির কথা শুনলে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অন্যরা পড়েছেন লিখিত ভাষণ, ইনি শেষের দিকে এক্সটেমপোর বলতে লাগলেন, নানা রকম রঙ্গ-রসিকতা মিশিয়ে ঐতিহাসিক তথ্য দিয়ে যেতে লাগলেন অবলীলায়, রবীন্দ্রনাথের কবিতাও মুখস্থ বললেন! রাজনীতিকদের চেনা সত্যিই দুষ্কর, রাজনীতি এক বিচিত্র বস্তু!
এই সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকা শহরটি যে শুধু উৎসবের সাজে সেজেছে তাই-ই নয়, বাইরে থেকেও অনেকে এই উৎসবে যোগ দিতে এসেছে মনে হয়। এই সময় টি ভি ও সিনেমা হলগুলিতে দেখানো হচ্ছে বিভিন্ন ছায়াছবি, সবই পুরোনো, ষাটের দশকের। তবু সেইসব ছবি দেখবার জন্যই হাউস ফুল। নস্টালজিয়াই প্রধান আকর্ষণ তা বোঝা যায়। আমি কোনও কাজে একটি সরকারি অফিসে গিয়েছিলুম, অধিকাংশ টেবলই প্রায় ফাঁকা! একজন অফিসার বললেন বিকেলে টি ভি-তে ইন্ডিয়ান ফিলম দেখাচ্ছে তো, তাই সবাই বাড়ি পালিয়েছে। ছবিটি বাংলা, উত্তম-সুচিত্রার।
একেবারে সাধারণ মানুষ এই সম্মেলনকে কী চোখে দেখছে তা বলা শক্ত। সাধারণ মানুষের মন কি সহজে বোঝা যায়! তবু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে মনে হল, তারা যেন একটু নিরুত্তাপ, তারা রুজি-রোজগারের ধান্দাতেই ব্যস্ত, এরোপ্লেনে উড়ে এসে বড় বড় মানুষেরী কী সব কথা চালাচালি করছে, তাতে তাদের মাথা ব্যথা নেই।
হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার অবস্থান হলেও প্রথম দিন থেকেই আমি আলাদা হয়ে গিয়েছিলুম। সার্থক সাংবাদিকরা ব্যস্ত হয়ে আছেন, কীভাবে প্রেসিডেন্ট এরশাদ বা রাজীব গান্ধি জেনারেল জিয়াউল হকের কাছ থেকে কয়েকটা নিরালা মুহূর্ত ছিনিয়ে নিয়ে একটা এক্সক্লসিভ ইন্টারভিউ নেওয়া যায়। আর আমি সন্ত্রস্ত হয়ে রইলুম, পাছে ওঁদের সঙ্গে আমার দেখা যায়। আমি ওই সব শীর্ষ ব্যক্তির থেকে সহস্র হাত ব্যবধানে থাকতে চাই, কেন-না কাছাকাছি চলে এলেই তো আবার নিরাপত্তা রক্ষীদের কুটি!
শুধু তাই নয়, ঢাকায় নেমেই ঠিক করে ফেলেছি। রাজীব গান্ধির সঙ্গে আর এক বিমানে ফেরা নয়। একবারেই যথেষ্ট, যাবার সময় নিজের পয়সায় টিকিট কাটতে হবে, তা হোক। যে-কোনও অভিজ্ঞতাই একবারের বেশি দু-বার হলে তার তাৎপর্য নষ্ট হয়ে যায়।
তিন দিনের শীর্ষ সম্মেলনে আমার প্রধান কৌতূহল ছিল নেতারা একমত হয়ে কোন কোন বাধা নিষেধ তুলে দেন তা জানার। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্তও জানা গেল না। নেতারা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করছেন, একসঙ্গে লঞ্চে নদী দেখতে যাচ্ছেন, রসিকতা করছেন, সেগুলো ভালো লাগছে ঠিকই, কিন্তু তারপর? শেষদিন প্রেসিডেন্ট এরশাদ স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করলেন বাংলায়, তাই শুনে শ্রীলঙ্কার জয়বর্ধনে রাজীব গান্ধিকে বললেন, আগামী বছর তো দিল্লিতে সম্মেলন হবে, আপনি এর মধ্যে কবিতা লেখা প্র্যাকটিস করুন।
রাজীব গান্ধির কবিতার সঙ্গে বিশেষ কোনও সংস্পর্শের কথা শুনিনি, এই এক বছরে তিনি কবি হয়ে উঠবেন কি না জানি না। যদি দৈবাৎ রাজীব গান্ধি কবিতা রচনা করে ফেলেন, তা হলে, আমার ধারণা, পাকিস্তানের জিয়াউল হকও ছাড়বেন না। তিনিও কবিতা লিখবেন। বেশ তো। চমৎকার ব্যাপার হবে তা হলে।
শীর্ষ সম্মেলন শেষ হল খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহাওয়া। যদিও স্পষ্ট কোনও প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি হয়নি। তবু একটা বড় কাজ হয়েছে। যুদ্ধ বা অস্ত্র বা সীমান্ত সমস্যা ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও তো আলোচনা হল, ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপিত হল। এরপর পরস্পরের দিকে ছোরা তুলতে গেলে একটু চক্ষু লজ্জা হবে না?