গাড়িটা পিচ রাস্তা ছেড়ে নামতেই এক রাশ ধুলো উড়ছে। ধুলোর মেঘে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঢেকে গেল লোকগুলো। চার-পাঁচজন মানুষ, মুখোমুখি দুটি কাঠের বেঞ্চিতে বসা। সামনেই একটা ছোট্ট চায়ের দোকান।
আমার লজ্জায় ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করলে। আমি গাড়ি চড়ার আরাম উপভোগ করি বটে। কিন্তু গাড়ি-শ্রেণির মানুষ নই। এ রকম রাস্তার ধারের চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে আমি বহুবার বসে থেকেছি, হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে কোনও গাড়ি এসে থামলে আমি নিশ্চয়ই চটে লাল হয়ে যেতাম। গালাগালি দিতাম গাড়ির মালিককে।
এ গাড়ির মাসিক অবশ্য আমি নই, আমার বন্ধু অলোক এটা ভাড়া করেছে, তাকেই উপ-মাসিক বলা যায়। অলোক গর্জন করে বলল, ইডিয়েট! এনক্রোঞ্চমেন্টের একটা সীমা আছে। একেবারে রাস্তার ওপরে বেঞ্চ পেতেছে। এরপর এরা মাঝ রাস্তায় দোকান খুলে বসবে।
লোকগুলো কিন্তু রাগারাগি করল না, বরং দু-তিনজন সম্ভমে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিল।
এই খাতিরটা অবশ্য আমাকে কিংবা অলোককে নয়, ধূলোর আড়াল সরে গেলে ওরা রোজমেরিকে দেখতে পেয়েছে। সাদা চামড়ার প্রতি সমীহ এখনও আমাদের মজ্জায় মজ্জায়। মেমসাহেব বলে কথা। সকলেই রোজমেরিকে দেখছে।
অনেকদিন বাদে আমেরিকা থেকে স্ত্রীকে নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছে অলোক। একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে কাছাকাছি মফস্বলে। চা-তেষ্টার জন্য এখানে থামা।
রোজমেরি নাকে রুমাল চাপা দিয়ে রয়েছে। একটা পচা কাঁঠালের গন্ধ আমিও পাচ্ছি। এমনই গরম যে একটা কাক কা-কা ডাকের বদলে খ্যারর-খ্যারর করে ডেকে উঠল।
রোজমেরি অবশ্য কোনও অভিযোগ করে না। গরম কিংবা দুর্গন্ধ সে হাসিমুখে মেনে নেয়, ধুলোতে তার সত্যিই কষ্ট হয়; দম আটকে আসে। কিন্তু আমাদের মতন গরম দেশে ধুলো এড়াবার তো উপায় নেই।
দোকানটির জীর্ণ অবস্থা দেখে অলোক খানিকটা ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, এখানে কী চা খাওয়া যাবে? খুব নোংরা জায়গাটা।
রোজমেরি একটা বেঞ্চে বসে পড়ে বলল, ইটস ওকে। তুমি ওদের চিনি কম দিতে বলল না। যত ইচ্ছে দিক। আমি টিপিক্যাল রোড সাইড স্টলের চা পান করতে চাই।
একটা বড় কড়াইতে কালো কুচকুচে রঙের তেলে আলুর চপ ভাজা হচ্ছে। ওই একই তেলে দিনের পর দিন অনেক কিছু ভাজা হয়। যাদের স্বাস্থ্য বাতিক আছে তারা ওই সব খেতে ভয় পায়, কিন্তু গরম আলুর চপ দেখলে আমার জিভে জল আসে। বাড়ির তেলে ভাজায় কখনো এমন চমৎকার স্বাদ হয় না।
অলোক চায়ের অর্ডার দিয়ে দিয়েছে; আমি দোকানের একটা বাচ্চা ছেলেকে বললাম, এই আলুর চপ দে তো!
ছেলেটা ধপধপে সাদা দাঁতে হেসে জিগ্যেস করল, কয়টা দেবো স্যার?
অলোক আমার দিকে কটমট করে তাকাল। আমেরিকার বাসিন্দা হবার ফলে তার চোখে এইসব দোকানের ভাজাভুজি একেবারে বিষ!
আমি ছেলেটাকে বললাম, মেম সাহেব খাবে না, এই সাহেবও না। আমার জন্য আন, আর গাড়ির ড্রাইভার খাবে কি না জিগ্যেস করে দ্যাখ।
অন্য লোকগুলো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোজমেরির দিকে।
রোজমেরি আগেই বলে দিল, তোমাদের দেশে এই একটাই প্রধান অসুবিধে। অচেনা লোকেরা সোজাসুজি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অথচ কোনও কথা বলে না।
ওদের দেশে কারোর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই হাই বলা নিয়ম। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ একজন মেম সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সাহসই পায় না। আমি রোজমেরিকে বলেছিলুম তুমি বিশেষ দ্রষ্টব্য, তাই তোমাকে দেখে সবাই।
বাচ্চা ছেলেটা একটা শাল পাতায় দুটো আলুর চপ এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, মেম সাহেব আলুর চপ খায় না?
আমি বললুম, তুই জিগ্যেস করে দ্যাখ না।
ছেলেটা লজ্জায় গা মোচড়াতে লাগল। হিজল গায়ের রং, একটা ছেঁড়া হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, মুখখানা বেশ মিষ্টি, টলটলে দুটি চোখ। খুব ভাবতে ইচ্ছে করে যে ছোট বেলায় আমার মুখখানাও ওই রকমই ছিল।
আমি আবার বললুম, লজ্জা কী, জিগ্যেস কর না। এই মেম একটু একটু বাংলা বোঝে।
রোজমেরি আমার দিকে ফিরে ভঙ্গি করে বলল, তুমি একলা-একলা কী খাচ্ছ? আমাদের দিচ্ছ না কেন?
আমি বললাম, তোমাকে দিলে তোমার বর বকবে। এটা অত্যন্ত সুস্বাদু বিষ।
এইবার ছেলেটা লজ্জা ভেঙে হঠাৎ বলে উঠল, মেম সাব, নট ইট আলুর চপ?
আমি চমকে উঠে, ছেলেটার গালে একটা টোকা মেরে জিগ্যেস করলাম, বাঃ! তুই দেখছি ইংরিজিও জানিস! ইস্কুলে পড়েছিস বুঝি?
ছেলেটা বলল, কেলাস থিরি, সাহেব!
রোজমেরি ওর কথা বুঝতে পারেনি। জিগ্যেস করল, কী বলছে, এই সুইট ছেলেটি কী বলছে?
আমি বললুম, ও তোমাকে ইংরিজিতে জিগ্যেস করল, নট ইট? তুমি আলুর চপ খাও না?
রোজমেরি বলল, অফ কোর্স আই শ্যাল টেইস্ট ইট!
আমার হাত থেকে একটা আধ খাওয়া আলুর চপ নিয়ে রোজমেরি এক কামড় দিয়ে বলল, উমম ডিলিশাস! চমৎকার! এতক্ষণ দাওনি কেন?
তৃতীয় কামড় দিয়ে অবশ্য রোজমেরি ঝালের চোটে মাথা চাপড়াতে লাগল আর উসস উসস করে লাফাতে লাগল প্রায়।
অলোক সব দোষ চাপাল আমার ঘাড়ে। বাচ্চা ছেলেটা রোজমেরির কাণ্ড দেখে হেসে উঠল খিলখিল করে। অন্য লোকরাও হাসি চাপতে পারছে না।
আমি অম্লানবদনে খেয়ে যেতে লাগলুম। ঝাল তো হবেই। সস্তার দোকানের যেকোনও জিনিসই বেশি ঝাল হয়। পচা জিনিস-টিনিস দিলে তার মধ্যে অনেক লঙ্কা ঠেসে দেয়, যাতে অন্য কোনও স্বাদ আর পাওয়া না যায়।
বউয়ের অবস্থা দেখে অলোক খুব রাগারাগি শুরু করলেও রোজমেরি অবশ্য লজ্জা পেয়ে গেছে। একটু ঠান্ডা হওয়ার পর সে বলল, মেক্সিকানরাও খুব ঝাল খায়। এবার ফিরে গিয়ে আমিও কাঁচা লংকা খাওয়া প্র্যাকটিস করব। অলোক যে একেবারেই ঝাল পছন্দ করে না।
আমি বললুম, অলোক যে সাহেবদের থেকেও বেশি সাহেব!
ছোট ছেলেটা মুখের ওপর হেসে উঠলেও রোজমেরি তার ওপর রাগ করেনি। সে মুখ ঝুঁকিয়ে জিগ্যেস করল, তোমার নাম কী?
ছেলেটা বলল, আমার নাম সেফু।
আমি বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করলুম, কী বললি।
সে এবার স্পষ্ট করে বলল, আমার নাম সৈফুদ্দিন, সাব।
সবাই সেফু বলে।
-তোর বাড়ি কোথায়?
-আমার বাড়ি…আমার বাড়ি নাই, সাব!
–বাড়ি নেই মানে? তুই থাকিস কোথায়? দোকানের মালিক এবার গলা বাড়িয়ে জানাল, ও ছেলেটা এই দোকান ঘরেই শুয়ে থাকে!
আমি সেফুকে আবার জিগ্যেস করলাম, তোর বাবা-মা কোথায় থাকে?
ছেলেটা উত্তর না দিয়ে দু-দিকে মাথা নাড়ল। অন্য বেঞ্চির লোকগুলো কিছু একটা বলার সুযোগ পেয়ে প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠল, ওর বাপ-মা নেই। মা মরে গেছে। বাপটা ওকে ফেলে কলকাতায় চলে গেছে।
রোজমেরি এত বাংলা বুঝতে পারে না। তাকে সব বুঝিয়ে দিতে হল। রোজমেরির কৌতূহল প্রবৃত্তি বেশি, সে ছেলেটি সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে চায়।
অলোকের এ সব বিষয়ে আগ্রহ নেই। সে অস্থির হয়ে বলল চা খাওয়া তো হয়ে গেছে, এবার চলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি ছেলেটাকে জিগ্যেস করলাম তুই ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছিলি, ইস্কুল ছেড়ে দিলি কেন?
বলেই বুঝতে পারলাম, এটা একটা বোকার মতো প্রশ্ন। যে ছেলের মা নেই, বাবা পরিত্যাগ করে চলে গেছে, নিজস্ব কোনও মাথা গোঁজার কোনও জায়গা নেই, রাত্তিরে শুয়ে থাকে একটা নড়বড়ে চায়ের দোকানে। সে আবার ইস্কুলে যাবে কী? ইস্কুল-টিস্কুল ওদের জন্য নয়!
রোজমেরির নরম মন, হঠাৎ যুক্তিহীন দয়ামায়ায় সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। স্বামীর দিকে তাকিয়ে সে ইংরিজিতে জিগ্যেস করল, এ চমৎকার ছেলেটিকে আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি না।
অলোক ধমক দিয়ে বলল, পাগল নাকি! আমরা দু-সপ্তাহ বাদে ফিরে যাচ্ছি, একে কোথায় রাখবে? এরকম হাজার হাজার ছেলে আছে আমাদের দেশে।
সেফু বলল। সাব, কাটারার মসজিদ দ্যাখতে যাবেন? আমি গাইড হতে পারি।
আমি বললাম, না রে, আমরা আর ওদিক যাব না।
সেফু বলল, চলেন না সাব। বেশি দূর না। ট্যাক্সিতে গ্যালে মাত্র দশ মিনিট। আমি সব দেখিয়ে দেব।
আমরা মুর্শিদাবাদের নবাববাড়ি, ইমাম বাড়া, খোসবাগ দেখে এসেছি। এরপর কাটারার মসজিদ না দেখলেও চলে। আমার আপত্তি নেই, তবে সন্ধের মধ্যে কলকাতায় ফিরতে গেলে আর দেরি করা চলে না।
আমি সেফুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম নারে আমি কাটারার মসজিদ অনেকবার দেখেছি। আর এই সাহেব-মেমদের এখন সময় নেই। পরে আর একদিন আসব! কিন্তু তুই গাইডের কাজ কী জানিস রে?
সে উৎসাহের সঙ্গে বলল, ভালো জানি, সাব শোনবেন। নবাব মুচ্ছিদ কুলি খাঁ যখন ছুবে বাংলার..তখন ইণ্ডিয়ান ভাগ্যাকাশে…একদিন এক পীর ছায়েব এসে বললেন…
উল্টো দিকের বেঞ্চির লোকেরা বলল, মসজিদে অন্য গাইড আছে তো, এই ছেলেটা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে শুনে তাদের কথা মুখস্থ করেছে।
রোজমেরি ইংরিজিতে আমাদের বলল, শ্যাল উই গিভ হিম সাম মানি?
আমার কাছে দু’টি একশো টাকার নোট আছে।
অলোক বলল, এটা তোমার একটা বিলাসিতা। বেশি টাকা দিয়ে তুমি ওকে স্পয়েল করবে। পরে যে সব খদ্দের কম টিপস দেবে, ও তাদের যত্ন করবে না। তা ছাড়া, তুমি ওকে একবার দুশশা দিলে তাতে ওর কী উপকার হবে? খুব সম্ভবত দোকানের মালিক টাকাটা কেড়ে নেবে। দ্যাখো না, লোকটি কী রকমভাবে তাকিয়ে আছে!
এ ব্যাপারে অবশ্য অলোকের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। এই বাচ্চা ছেলেটিকে দুশো টাকা দিলে সেটা ওর কোনও কাজেই লাগবে না। এ দেশে একটা বাচ্চার হাত থেকেও টাকা কেড়ে নেবার মতন মানুষের অভাব নেই।
সুতরাং ওকে দু টাকা বকশিশ দেওয়া ঠিক হল।
আমরা কাটারার মসজিদ দেখতে গেলাম না বলে সেফুর কোনও ক্ষোভ নেই! সে হাসি মুখে আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে এল গাড়ি পর্যন্ত। রোজমেরির দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিটিয়ে সে বলল, সেলাম মেম সাব। আবার আসবেন।
গাড়িটা ছাড়ার পর রোজমেরি আমার দিকে ফিরে বিহ্বলভাবে বললে, একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো! ওই ছেলেটা যখন বলল, ওর কোনও বাড়ি নেই, তখন ও হাসছিল কেন?
আমি ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরালাম।
রোজমেরি আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, চুপ করে আছ কেন? এটা কী করে হয়। ওইটুকু একটা ছেলে, মা-বাবা নেই, থাকার জায়গাও নেই। তবু ও হাসে কী করে? আনন্দে থাকে কী করে?
আমি তবু চুপ করে রইলাম। এ প্রশ্নের কী উত্তর দেব? হাসি একটা অতি রহস্যময় ব্যাপার। ছেলেটা যখন বলেছিল, আমার কোনও বাড়ি নেই, তখন সত্যি ফিক করে হেসে ফেলেছিল। সে হাসির মর্ম আমি বুঝব কী করে?