বিভক্ত অবস্থায় পূর্ব বার্লিন আমি একবার দেখেছি। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের তুলনায় সমাজতান্ত্রিক পূর্বের জাঁকজমক কম ছিল, কিন্তু একটা নিরলঙ্কার সৌন্দর্য চোখ টেনেছিল। পশ্চিমের এক-একটি শহর এত বেশি ঝকঝকে তকতকে, এত বেশি নিখুঁত যে এক-এক সময় বেশ একঘেয়ে লাগে। যেমন ফ্রাংকফুর্ট শহর, যাতায়াতের সবরকম সুবিধে আছে, পৃথিবীর যে-কোনও খাবার পাওয়া যায়, সমস্ত রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন, তবু মুগ্ধ হওয়ার মতন কিছু নেই। সেই তুলনায় পূর্ব বার্লিনের একটা চরিত্র আছে, এবং প্রাচীন শহরের অংশ হিসেবে দ্রষ্টব্য অনেক। মহাযুদ্ধের পর ভাগাভাগির সময়ে সোভিয়েত অংশেই বেশিরভাগ মিউজিয়াম, পুরোনো গির্জা ইত্যাদি পড়েছে। চমৎকার গাছপালা দিয়ে সাজানো বিশ্ববিখ্যাত উন্টার ডেন লিনডেন রাস্তার দুপাশে বিশাল সব বারোক-রোকোকো ধরনের প্রাসাদ। এবং তৈরি হয়েছে প্রচুর নতুন বাড়ি, বিরাট বিরাট হাউজিং কমপ্লেক্স। দেশের প্রতিটি নাগরিককে জীবিকার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বাসস্থান দিতেও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ভারতীয়, আমরা ভারতের গ্রামের মানুষের অবস্থা জানি, শহরের ফুটপাথের অজস্র সংসার দেখেছি, আমাদের কাছে এই প্রতিশ্রুতি, সমস্ত মানুষের জন্য জীবিকা ও পাকা বাড়িতে মাথা গোঁজার মতন স্থান, এই দুটি জিনিসই তো সার্থকতার চরম। এই জন্যই তো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য আমাদের বিপ্লবের স্বপ্ন।
অবশ্য সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলি দেশের সর্বত্র এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছে কি না সে বিষয়ে অনেক পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যায়। একই ফ্ল্যাটে দু-তিনটি পরিবারকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিংবা জীবিকার ক্ষেত্রে যোগ্যতার মূল্য দেওয়া হয় না ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে কোনও মন্তব্য করার অধিকার আমার নেই। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি কিংবা পারিপার্শ্বিক দেখে যেটুকু বুঝেছি, তার বাইরে যেতে চাই না।
পূর্ব বার্লিনে, সোভিয়েত ইউনিয়নে, যুগোশ্লাভিয়ায় আমি সরকারের বানানো ফ্ল্যাটে গিয়েছি কয়েকটি পরিবারের কাছে। বাড়িগুলো আহামরি কিছু না, আমাদের দেশের সরকারি বাড়ির মতনই সস্তা দায়সারা বলে মনে হয়। লিফটের চেহারা বেশ খারাপ, হয় খুব ছোট, দু-তিনজনের বেশি একসঙ্গে ওঠাই যায় না, অথবা রডগুলো ঘটঘটাং শব্দ করে কাঁপে, রক্ষণাবেক্ষণে অমনোযোগ। ফ্ল্যাটের ঘরগুলো খুপরি খুপরি। তবু আমি অভিযোগের কিছু দেখিনি, আমার ভারতীয় চোখে শহুরে বস্তি কিংবা গ্রামের ফুটোফাটা কুঁড়ে-ঘরগুলির তুলনায় ওই সব ফ্ল্যাট অনেকগুণ ভালো!
পশ্চিম বার্লিন ও পূর্ব বার্লিনে গেলে ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের চেহারার বেশ একটা তুলনামূলক রূপ দেখার সুযোগ পাওয়া যেত। পশ্চিম থেকে পূর্বে গেলে মনে হয়নি যে এরা খুব দুঃখ-কষ্টে আছে, মনে হত সব কিছুই তো ঠিকঠাক চলছে, তবু কিছু মানুষ দেওয়াল টপকে ওদিকে যেতে চায় কেন? পশ্চিমের লোকরা অবশ্য বলত, পূর্ব বার্লিন হচ্ছে সমাজতন্ত্রের শো পিস, সীমানার ওপারেই বড় বড় বাড়ি তুলেছে, আর সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে, টুরিস্টদের দেখাবার জন্য। আর পূর্বের কিছু কিছু লোক বলেছে, পশ্চিমের দোকানগুলো কনজিউমার গুডসে ভরতি। ওসব আমাদের না পেলেও চলবে।
এবারে ঠিক করলাম, সদ্য ভূতপূর্ব জার্মানির অন্য একটা শহর দেখতে হবে। ফ্রাংকফুর্ট থেকে বার্লিন পর্যন্ত যে টানা সড়ক, তারই এক পাশে একটি শহর আইসেনাখ। এক দুপুরে বাবুল আর জামি নামে বাংলাদেশি দুই তরুণ বন্ধুর সঙ্গে আমি আর বাদল রওনা দিলাম সেদিকে। বাবুল আর জামি দুজনেই এদেশে আছে এক যুগের বেশি সময়।
এই পথ ধরে বার্লিনের দিকে যেতে গেলে খানিকটা পূর্ব জার্মান ছিটমহল পার হতে হত। অর্থাৎ সেই কাঁটাতারের বেড়া, চেক পোস্ট, ওয়াচ টাওয়ার, গোমড়ামুখো রক্ষী। এখন সেই এলাকাটা জনশূন্য, চেক পোস্ট খাঁ-খাঁ করছে, কাঁটাতারের বেড়াটে অনেকটাই উপড়ে ফেলা হয়েছে। একটা ওয়াচ টাওয়ারের গায়ে আলকাতরা দিয়ে বড় বড় অক্ষরে জার্মান ভাষায় কী যেন লেখা। আমি জিগ্যেস করলাম, ওখানে কী লিখেছে? জামি অনুবাদ করে দিল, দোজখের কুত্তা।
সীমান্ত রক্ষীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল, ওই দুটি শব্দেই তা বোঝা যায়।
রাস্তা দিনে যে-সব গাড়ি যাচ্ছে, তার কোন কোনটা পূর্ব জার্মানির মানুষের, তা জামি অনায়াসে বলে দিতে পারে। সে গাড়িগুলোর চেহারা ছোট ছোট, টু স্ট্রোক ইঞ্জিন, পশ্চিমি মজবুত গাড়িগুলির পাশে সেগুলোকে খেলনা-খেলনা মনে হয়। তবু সেগুলোকে বলা যেতে পারে সস্তা জনতা গাড়ি। সীমান্ত খুলে যাওয়ার পরই পূর্ব জার্মানির অনেক লোক পশ্চিমে এসে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনতে শুরু করেছে।
বাবুল বলল, ফ্রাংকফুর্টের রাস্তায় মানুষদের দেখেও আমি বলে দিতে পারি, কারা কারা পূর্ব জার্মানি থেকে এসেছে।
এটা খুবই অবাক হওয়ার মতনই কথা। আমরা শুধু চেহারা দেখে কে ইংরেজ, কে ফরাসি আর কে জার্মান বুঝতে পারি না। আর জার্মানদের মধ্যেই কে পূর্বে থাকে আর কে পশ্চিমে, তা কী করে বলা সম্ভব?
বাবুল বলল, প্রথম তো জুতো দেখলেই চেনা যায়। ছেঁড়াছোঁড়া, পুরোনো জুতো, তা ছাড়া পোশাকের মধ্যেও এমন একটা কিছু আছে…
মূল রাস্তা ছেড়ে আমরা বাঁক নিলাম আইসেনাখ শহরের দিকে। একটু পরেই আমাদের গাড়িটা লাফাতে লাগল। ভাঙাচোরা রাস্তা, অনেকটা কলকাতা-কলকাতা ভাব। দু’পাশের বাড়িগুলির চেহারা মলিন, অনেক দিন রং করা হয়নি, এখানে সেখানে কিছু আবর্জনা জমে আছে, আমাদের বেশ পরিচিত লাগে।
আইসেনাখ শহরটি কিন্তু ইতিহাস বিখ্যাত। প্রাচীন এই শহরটিতে দ্রষ্টব্য স্থান আছে অনেক, রোমান আমলের ওয়ার্টবুর্গ দুর্গ, তার পেছনেই থুরিঙ্গিয়া অরণ্য। প্রখ্যাত খ্রিস্টিয় সংস্কারক মার্টিন লুথারের নাম এই শহরটির সঙ্গে জড়িত, এখানে তিনি কিছুদিন নির্বাসিত ছিলেন, সেই সময়ই তিনি বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অনুবাদ করেন গ্রিক থেকে জার্মান ভাষায়, আধুনিক জার্মান গদ্যের বিকাশ হয় সেই অনুবাদ থেকে।
এখানেই জন্মেছিলেন সঙ্গীত কমপোজার বাখ। রিচার্ড ভাগনারও তাঁর একটি বিখ্যাত অপেরা রচনা করেছিলেন এখানে। আর একটি তথ্যও উল্লেখযোগ্য, ১৮৯৮ সালে এই শহরে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম মোটর গাড়ি। তবে, এখন এখানে যে ছোট ছোট গাড়ি তৈরি হয়, তা পৃথিবীর অনেক দেশের গাড়ির সঙ্গেই পাল্লা দিতে পারে না।
বিকেল গড়িয়ে গেছে বলে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি আমাদের ঘুরে দেখা হল না। আমরা এসে
পৌঁছলাম একটা প্রশস্ত চত্বরে, যেখানে একটি অস্থায়ী বাজার বসেছে।
বাজার ঘুরে দেখলে সমাজের স্বাস্থ্য খানিকটা আন্দাজ করা যায়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে পশ্চিমি কনজিউমার গুডসের বিরুদ্ধে একটা প্রচার সব সময় চলেছে, কিন্তু তাদের দেশে যে তরি-তরকারি, মাংস ও ফলমূলের যথেষ্ট অনটন, তা স্বীকার করা হয়নি। আমি অনেকগুলি সমাজতান্ত্রিক দেশের বড়-বড় শহরের বাজার ঘুরে দেখেছি।
সেইসব বাজারের তুলনায় আমাদের দেশের যে-কোনও বাজারে অনেক বেশি জিনিস পাওয়া যায়। বুলগেরিয়ার সোফিয়া শহরের বাজারে দেখেছি, মাংসের দোকানের মতন ফুলকপির দোকানের সামনেও লাইন, সেই লাইনে যত লোক দাঁড়িয়ে আছে, দোকানে তত ফুলকপি নেই। কিয়েভ শহরে দেখেছি, একজন লোক শশা হাতে নিয়ে রাস্তা দিনে যাচ্ছে, একটি বৃদ্ধা তাকে জিগ্যেস করলেন, শশা কোথায় পাওয়া যাচ্ছে, তারপর সেই দিকে ছুটে গেলেন। শশা জিনিসটাও যে এমন লোভনীয় বা দুর্লভ হতে পারে, তা সেদিনই প্রথম জানলাম। শুধু চিনের কোনও কোনও বাজারে তরিতরকারি ফলমূল যথেষ্ট দেখেছি।
আইসেনাখের বাজারটিতেও বিশেষ কিছুই নেই। আগে একটা সরকারি বাজার ছিল, এখন কিছু কিছু লোক তাদের গাড়ির পেছনের ডালা খুলে কিংবা ছোট তাঁবু খাঁটিয়ে জিনিসপত্র সাজিয়ে ব্যক্তিগত দোকান খুলে বসেছে। কেউ কেউ কাছাকাছি পশ্চিমি শহর থেকে চকচকে খেলনা, জুতো, হাল ফ্যাশানের পোশাক আর নানারকম ফলমূল কিনে এনে বিক্রি করছে এখানে। এখানে যাদের হাতে একটু পয়সা আছে, সবাই পশ্চিমে বাজার করতে যায়। পশ্চিম বার্লিনে পঙ্কজের স্ত্রী মাধুরী আমাকে বলেছিল, গত কয়েক মাস তার বাচ্চা মেয়ের জন্য দুধের জোগাড় করা খুব মুশকিল হয়ে পড়েছিল। বার্লিনের দেওয়াল ভাঙার পর দলে-দলে পূর্বের মানুষ, বিশেষ করে পোল্যান্ডের লোকেরা এসে প্রচুর জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেত নিজেদের দেশে ব্যাবসা করার জন্য। পোলান্ডে দুধের খুব অনটন, তাই তারা সব দুধ কিনে নিয়ে যেত। পোলান্ডে সেই জন্যই তখন ডলারের ব্ল্যাক মার্কেট তুঙ্গে।
এখানকার বাজারে অনেক জায়গায় কলা বিক্রি হচ্ছে। এত কলা কেন? আমাদের সঙ্গীরা বলল, আহা, ওরা যে অনেকদিন কলা খায়নি!
কলা নিয়ে পশ্চিম বার্লিনে একটা মজার গল্প চালু আছে। এটাকে গল্প হিসেবেই গণ্য করা উচিত।
পাঁচিল তোলার পর পূর্ব ও পশ্চিমের দুটো বাড়ি একেবারে মুখোমুখি। দুটি বাড়িতেই একটি করে বাচ্চা মেয়ে থাকে, তারা জানলা দিনে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে। একদিন পশ্চিমের মেয়েটি একটি ইলেকট্রনিক খেলনা দেখিয়ে বলল, এই, তোদের এটা আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা সুন্দর পুতুল তুলে ধরে বলল, ওটা না থাকলে কী হয়, আমাদের এত সুন্দর পুতুল আছে। পশ্চিমের মেয়েটি এক জোড়া নতুন জুতো দেখিয়ে বলল, তোর আছে? পূর্বের মেয়েটি একটা কারুকার্য করা লেসের স্কার্ফ দেখিয়ে বলল, তোর এটা আছে? এইভাবে দুটি মেয়েই নানারকম জিনিস তুলে তুলে দেখাতে লাগল। এক সময় চমের মেয়েটি একটা পাকা কলা তুলে দেখিয়ে বলল, তোর কলা আছে? পূর্বের মেয়েটি কখনও কলা চোখেই দেখিনি। কলার বদলে অন্য কোনও ফলও দেখাবার মতন তাদের বাড়িতে নেই। সে তখন কাঁদো-কাঁদো হয়ে মাকে জিগ্যেস করল, মা, আমাদের কলা নেই কেন? মা বললেন, আমাদের কলা নেই তাতে কী হয়েছে, আমাদের কমিউজিনম আছে। পূর্বের মেয়েটি সে কথা জানাতেই পশ্চিমি মেয়েটি একটু দমে গেল। কমিউনিজম কী তা সে জানে না, বাড়িতে তার মা-বাবা কেউ নেই তখন, জিগ্যেসও করতে পারছে না। কিন্তু সে পশ্চিমি কনজিউমার সোসাইটির মেয়ে তো, সে জানে, পয়সা থাকলে সব কিছুই কেনা যায়। তাই সে বলল, ঠিক আছে, আমার বাবাকে বলব, আমার জন্যও কমিউনিজম কিনে দেবে? তখন পূর্বের মেয়েটির মা মেয়েকে বলল, তুই ওকে বলে দে, ও যদি কমিউনিজম কেনে, তা হলে কিন্তু আর কলা পাবে না!
বাজারের পাশ দিনে একটা রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। দু’পাশে দোকানপাট, এটাই এ শহরের প্রধান বাণিজ্য এলাকা। যে-কোনও পশ্চিমি শহরের তুলনায় দোকানগুলির দৈন্যদশা অতি প্রকট। আমাদের চোখেই এটা ধরা পড়ে। বাবুল ও জামির মতে, এটাকে জার্মান শহর বলে চেনাই যায় না। কোনও দোকানের অনেকগুলো তাক খালি, এমন দোকান পশ্চিম জার্মানিতে কল্পনাও করা যায় না।
এক সময় সবই ছিল সরকারি দোকান, এখনও অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস হয়নি, পালাবদল সবে শুরু হয়েছে, অনেক সরকারি দোকান রয়ে গেছে, পাশাপাশি কিছু ব্যক্তিগত ব্যাবসাও শুরু হয়েছে। অনেক দোকানপাট ভেঙেচুরে নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে, মনে হয় পশ্চিমি ব্যবসায়ীরা সেখানে শাখা খুলছে। মিস্তিরিরা খাটাখাটুনি করছে পূর্ণ উদ্যমে। সরকারি দোকানগুলি নিষ্প্রভ, তার পাশেই কোনও ব্যক্তিগত মালিকানার দোকানে লোজন বেশি।
চিনে গিয়েও এ জিনিস দেখেছি। মাও সে তুং-এর আমলের চিনে সমস্ত দোকানই ছিল সরকারি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, জামা-কাপড়ের দোকান, সেলুন, খবরের কাগজের স্টল, ট্যাক্সি ইত্যাদি সবই। এখন কিছু-কিছু ব্যক্তিগত ব্যাবসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। তার ফলে, পাশাপাশি একটা বিরাট সরকারি দোকান ও এক দম্পতির পরিচালনায় ছোট দোকানের তফাতটা বোঝা যায়। সরকারি দোকানের কর্মচারীরা যে-যার নিজের জায়গায় অলস ভঙ্গিতে বসে আছে, খদ্দেররা এলে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন তাদের দয়া করছে, উঠে গিয়ে একটা জিনিস আনতে হলে তারা বরাত দিচ্ছে অন্য একজনের ওপর। আর পাশের ছোট্ট দোকানটিতে স্বামী-স্ত্রী রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ডাকছে, কারু একটা জিনিস পছন্দ না হলে তাকে আর পাঁচটা জিনিস দেখাচ্ছে, একটু দাম কমিয়ে দিচ্ছে। সেই দোকানেই ভিড় বেশি।
বেইজিং শহরে একটা মজার কথা শুনেছিলাম। বেশ কয়েকজনের কাছে জেনেছি যে চিনের শিক্ষিত মেয়েরাও এখন বিয়ের পাত্র হিসেবে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে একজন নাপিত কিংবা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বেশি পছন্দ করে। অবাক হওয়ার মতন ঘটনা নয়। এর কারণ এই যে, কিছু কিছু সেলুন ও ট্যাক্সিকে ব্যক্তিগত মালিকানায় দিনে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের ধরাবাঁধা মাইনে, পরামানিক বা ট্যাক্সি চালকরা যত খাটবে তত বেশি রোজগার করবে, তারা এখন রীতিমতন ধনী।
আমাদের সঙ্গে একটি সুন্দরী তরুণী আগাগোড়া ছিল গাইড হিসেবে। তার চুলের খুব বাহার। আমি তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, তুমি কোন দোকানে চুল কাটতে যাও, সরকারি, না প্রাইভেট? মেয়েটি চিন্তা না করেই উত্তর দিয়েছিল, প্রাইভেট। আমি আরও জানতে চেয়েছিলাম, কেন, সেখানে কি সস্তা? মেয়েটি বলেছিল, না, সস্তা নয়, কিন্তু প্রাইভেট সেলুনে ঢুকলেই মালিক আগ্রহের সঙ্গে হেসে কথা বলে, ব্যক্তিগত যত্ন নেয়।
আমি নিজের চোখে দেখেছি, কলকাতার মতনই, মস্কো শহরের কিছু কিছু ট্যাক্সি ড্রাইভারকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেও মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। সেই ড্রাইভার সরকারের কাছ থেকে মাস মাইনে পাবে, কত যাত্রী সে তুলল বা না তুলল, তাতে কিছু আসে যায় না, সুতরাং সে যাত্রীদের অবহেলা দেখাতেই পারে। কলকাতার কারণটা অবশ্য আলাদা, এখানে কেউ আইন মানে না, ট্যাক্সি ড্রাইভাররা একজনের বদলে পাঁচ-ছ’জন যাত্রী তুলে বেশি লাভ করতে চায়। মস্কোতে এক সন্ধ্যায় যখন আমরা চেষ্টা করেও ট্যাক্সি পাচ্ছি না, তখন একটি প্রাইভেট গাড়ির চালক আমাদের পৌঁছে দিতে চাইল। বিনা পয়সার লিফট নয়, দশ রুবলের বিনিময়ে। এবং ওই দশ রুবল পাবে বলে সে ঠিকানা খুঁজে সযত্নে আমাদের নামিয়ে দিল নির্দিষ্ট বাড়ির দরজায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই, সরকারি চাকরির নিরাপত্তা পেলেই মানুষ কাজে ঢিলে দিতে চায় কেন? অথচ সেই একই লোক যদি নিজস্ব ব্যাবসা খোলে, তাহলে দিন রাত খাটাখাটনি করে। একজন চাষি নিজের ক্ষেতের ফসল ফলাবার জন্য উদয়াস্ত শরীরের ঘাম ঝরায়, আর সেই চাষিই যখন দশজনের সমবায়ের অন্তর্গত হয়, তখন যথেষ্ট শ্রম দেয় না। মানুষ কি পরিশ্রম করে শুধু ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের জন্য? সবাই মিলে একটা কিছু উৎপন্ন করে তারপর সবাই মিলে সমান ভাগ করাই তো উচ্চ আদর্শ। এই আদর্শকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারবে, তবু সমবায় গড়লে সকলের শ্রমের আন্তরিকতা কমে যায় কেন?
এই সূত্র ধরে আরও একটা প্রশ্ন আসে। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে যে সকলে মিলে সমান ভাগ করে নেওয়ার আদর্শ, তার জন্য কি মানুষকে তৈরি করা হয়েছে? নাকি তাড়াহুড়ো করে ওপর থেকে ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখায়, যারা সমাজ ব্যবস্থা বদলের জন্য মানুষকে ডাক দেয়, যারা সেই সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকে, তারাও কি ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ ঈর্ষা, প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে? তারা এসব পারেনি বলেই কি আদর্শ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলি তাসের প্রাসাদের মতন ভেঙে পড়ল?