অনেকের ধারণা সাহেব-মেমরা খুব সৎ ও সত্যবাদী। বড়-বড় ডাকাত হয় বটে, কিন্তু জোচ্চুরি করে না। লোককে ঠকায় না। জিনিসপত্র কেনার সময় দরদাম করে না। অন্তত আমার এই রকমই ধারণা ছিল। এবং এখনও আছে। কিন্তু এই ধারণাটা আমার দৃঢ় হয়েছে সাহেব-মেমদের মধ্যে কিছু কিছু সত্যিকারের বদমাস-জোচ্চোর দেখার পর। ওই সব বদমাস-জোচ্চোরদের দেখার পর যে ক’জন সত্যিকারের মহৎ নারীপুরুষকে দেখেছি তাদের চরিত্রবলের প্রশংসা না করে পারা যায় না।
যাই হোক, আপাতত নিউইয়র্কের একটি রাস্তার কথা বলা যাক। কুখ্যাত ফরটি সেকেন্ড স্ট্রিট, আমেরিকার প্রায় সকলেই এই রাস্তার কথা জানে, কিন্তু বিদেশিদের পক্ষে একটি মৃত্যু-ফাঁদ।
সব বড় শহরেই কিছু-কিছু জোচ্চোর দোকানদার দেখেছি। কিন্তু নিউইয়র্কের ৪২ নং রাস্তার দোকানগুলির মতো এমন ভয়াবহ দোকানের সারি আর কোথাও বোধ হয় নেই।
আমাদের দেশে জিনিসপত্রের দরাদরি হয় শুনে–অনেক সাহেব-মেমকে হাসাহাসি করতে শুনেছি। সুতরাং আমার ধারণা ছিল, আমেরিকায় কোনও জিনিসের দরাদরি হয় না। সত্যিই হয় না। কিন্তু ওই এক ৪২ নং রাস্তায় ছাড়া। কিন্তু নতুন লোকের পক্ষে তো জানা সম্ভব নয়, ও রাস্তার প্রত্যেকটি দোকানের কাছেই যে চুম্বক আটকানো আছে, একবার না ঢুকে উপায় নেই।
প্রত্যেকটি দোকানের বাইরে বিরাট বিরাট অক্ষরে লেখা আছে সেল! সেল! কোথাও লেখা ৫০ পারসেনট শস্তা, কোথাও লেখা দোকানের সব জিনিস আজই বিক্রি হবে ইত্যাদি। শো-কেসে এক একটা চমৎকার দ্রব্যের গায়ে অবিশ্বাস্য রকমের শস্তা দাম লেখা আছে। পরে শুনলাম–সারা বছরই ওরকম ‘সেল লাগানো থাকে সব দোকানে।
আমি ঢুকেছিলাম নিতান্ত হঠকারীর মতোই। কোনও কিছু কেনার দরকার ছিল না। তবু হঠাৎ মনে হল, একটা সিগারেট ধরাবার লাইটার কিনতে হবে। কী অন্যায় ইচ্ছে! সারা আমেরিকায় দেশলাই পাওয়া যায় বিনামূল্যে–কত সুন্দর-সুন্দর রকমারি দেশলাই, যে কোনও দোকানে বা ব্যাংকে ঢুকে যে ক’টা ইচ্ছে তুলে নেওয়া যায়। কিন্তু এই বিনা পয়সায় বলেই হয়তো প্রায়ই পকেটে থাকে না। মাঝরাত্রে উঠে জানালা দিয়ে বরফ পড়া দেখবোকিন্তু সব আনন্দটাই মাটি, সিগারেট ধরাবার দেশলাই নেই।
ঢোকামাত্র দোকানদার আমাকে লুফে নিল।
আসুন আসুন। লাইটার চাই? এই যে। দশ-পনেরোটা লাইটার ফেলে দিল টেবিলে। আমি বাছাবাছি করছি–আর চোখ বোলাচ্ছি সারা দোকানে। ছোট দোকানঘর হাজার রকম জিনিসে ঠাসা। যে ছেলেটি আমায় অ্যাটেন্ড করছিল, তার বয়েস ২০-২১, অত্যন্ত সুন্দর, সরল দেখতে ছেলেটিকে। জিগ্যেস করল, আপনি বুঝি সাউথ আমেরিকা থেকে আসছেন?
-না।
-তবে?
–ভারতবর্ষ।
–ও, ইন্ডিয়া? নমস্তে, নমস্তে।
আমি অবাক। ছেলেটি হেসে বলল, আমাদের দোকানে অনেক ভারতীয় আসে। ভারতীয়রা খুব দরাদরি করতে ভালোবাসে, নিন আপনাকে দরাদরি করতে হবে না। এইটা দশ ডলার দাম, আপনাকে আট ডলারে দিলাম।
আট ডলার? না, না। অসম্ভব। আমাকে একটা শস্তা দামের দাও, ওই কালো রঙেরটা কত?
কালোটা? ওটা আপনাকে মানাবে না। ওসব লাইটার গ্যাংসটাররা ব্যবহার করে। এই যে দেখুন, এইভাবে ঝুঁকে-টুপিতে মুখ ঢেকে গ্যাংসটাররা টস করে আওয়াজ করে এ সব লাইটার জ্বালে। এসব কি আপনাকে মানায়? আপনি নিন ওই রূপোলিটা, কী চমৎকার। আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে আপনি খুব শিক্ষিত লোক, প্রফেসার নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, প্রফেসার, আমি বলছি, আপনি এইটাই নিন।
তোষামোদের গুণ এই যে বুঝতে পারলেও ভালো লাগে। লোকটা আমাকে প্রফেসার বলায় আমি আর প্রতিবাদ করতে পারলুম না। মনে পড়ল, একবার রাণাঘাট স্টেশনে একটি কুলি শ্রেণির লোক–আমাকে একটা ইংরেজিতে লেখা ঠিকানা পড়তে দিয়েছিল। আমি হাতের লেখাটা পড়ার চেষ্টা করছি। হঠাৎ লোকটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, থাক-থাক। আমি অন্য লোককে দিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছি।
সুতরাং অকস্মাৎ এখানে প্রফেসারের সম্মান পাওয়াতে আমি আর ভাবলুম না। লাইটারটা নিয়েই নিলাম। তখন ছেলেটি বলল, প্রফেসার আপনার কলম চাই না? আপনার কত লেখার কাজ-ওটা কি একটা বিশ্রী কলম আপনার পকেটে?
-নাঃ যে কোনও কলমেই কাজ চলে যায়।
-তা কি হয়? একবার দেখুন, লিখে দেখুন না। আচ্ছা এ কলমটা আপনাকে আমি উপহার দিলাম।
শুধু-শুধু উপহার নেব কেন? আমাকে কলমটার দাম দিতে হল। এবার আর আমার পয়সা নেই। সুতরাং এযার আমি নির্ভয়ে কয়েকটা জিনিসের দরদাম করতে লাগলাম। এই ক্যামেরাটা কত? তিনশো ডলার? নাঃ-আমি একটা একশো ডলারের মধ্যে খুঁজছি। ওই বাইনোকুলারটা তিরিশ ডলার?
থাক।
ঘুরে-ঘুরে দেখছি, ছেলেটি আমাকে সব কিছু দেখাচ্ছে। দোকানে আর লোক নেই। অন্য কর্মচারীরাও আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকেরই কী বিনয়। কী ভদ্রতা। প্রতি কথায় স্যার আর প্রফেসার যোগ করা। সঙ্গে-সঙ্গে ভারতবর্ষের রাজা-মহারাজাদের ধন দৌলত সম্পর্কে মন্তব্য। আমার এমন একটা ভাব হল যেন এরা আমার আজ্ঞাবাহী ভৃত্য, আমি যা-যা হুকুম করবো, তাই পালন করবে। হঠাৎ আয়নায় দেখি, আমার মুখ। না মুখ নয়-মুখের ভঙ্গি থিয়েটারের রাজা-মহারাজার মতোই হয়ে উঠেছে। বুঝলাম এযার বিদায় নিতে হবে। বেরুতে যাচ্ছি। ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, টেপ রেকর্ডারটা আপনার পছন্দ হয়েছিল, শুধু দামের জন্যই নিলেন না? অন্য জায়গায় ঠকবেন। একশো ডলারে কেউ ভালো টেপ রেকর্ডার দিতেই পারে না। আপনার যখন পছন্দ হয়েছে। আপনি ওটাই নিয়ে যান। একশো ডলারেই নিয়ে যান।
পাশ থেকে আর একজন কর্মচারী বলে উঠলো। তুমি পাগল হয়েছে জিমা। একশো ডলারে কী করে দেবে।
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, দিয়ে দাও, প্রফেসার যখন পছন্দ করেছেন।
-অসম্ভব! একশো ডলারে–
না হয় লোকসানই করবো, তবু একজন মান্যগণ্য লোক ফিরে যাবেন—
তখন ওরা দু’জনে ঝগড়া শুরু করে দিল।
আমি হা-হা করে উঠে বললাম না, না, আমি এখন কিনব না। পরে কিনবো, থাক না।
সেই ছেলেটি রাগত মুখে বলল, না আপনি নিয়ে যান। এ দোকানে আমার চতুর্থাংশ শেয়ার। আমারও একটা কথার দাম আছে। আপনি নিয়ে যান।
-না ভাই, কী করে নেবো, আমার যে সঙ্গে টাকাই নেই।
-না থাক। আপনি চেক লিখে দিন।
–কিন্তু আমার এখন কেনার ইচ্ছে নেই।
ছেলেটি কাঁদো-কাঁদো মুখ করে বলল, আপনার জন্য আমি ঝগড়া করলাম, আর এখন আমি–
আমি বিষম অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়লাম। শেষ পর্যন্ত সবই নিতে হল–টেপরেকর্ডার, ক্যামেরা বাইনোকুলার সবই–এবং এসব ভরে নেবার জন্য একটা সুটকেশ পর্যন্ত। হাতে টাকা গুণে দিতে মায়া লাগে–কিন্তু চেক লেখার মধ্যে কোনও মায়া নেই, বিশেষত যে নতুন চেক বই পেয়েছে। আমার কাছে চেকে কুড়ি লেখা আর দুশো লেখা একই।
যে বন্ধুর বাড়িতে থাকি, তাকে সব জিনিসগুলো দেখালাম ফিরে এসে। অ্যালেন গিনসবার্গ বলল, কী সর্বনাশ, ৪২ নম্বর রাস্তা থেকে কেনোনি তো?
-হ্যাঁ, কেন?
-ডুবিয়েছে। তোমার সেল ট্যাক্স বাঁচাবার নাম করে ওরা ক্যাশমেমো দেয়নি নিশ্চই?
-না।
তোমাকে শস্তায় দেবার জন্য একজন কর্মচারী আর একজন কর্মচারীর সঙ্গে ঝগড়া করেছিল?
-হ্যাঁ, কিন্তু–
-বুঝেছি। গরীবের ছেলে বিদেশে এসে ডুবলে! সুটকেশ-ভর্তি কতকগুলো মাংস এনেছে। ওগুলো সব ঝুটো, সেকেন্ড হ্যান্ড, রং করা। বাজে। ছি ছি তুমি যে এরকম বোকামি করবে…আমার উচিত ছিল আগেই তোমাকে সাবধান করা
আমি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলুম। তারপর আবার গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ালুম। বললুম, যাক ভালোই হল এক হিসেবে। মায়া কেটে গেল। এসব জিনিস কেনার আমার কোনই ইচ্ছে ছিল না। শুধু একটু লোভ হয়েছিল হঠাৎ। এখন লোভ কেটে গেছে। কয়েকটা কাগজের টাকা মাত্র দন্ড গেল, কিন্তু এগুলো আমি দেশে নিয়ে যাব না। কিছুই নিয়ে যাব না।