আজ সকাল থেকেই সারগেই-এর চোখমুখে একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ করছি। আজ যাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা করতে যাওয়ার কথা, তাঁর কাছে যাওয়ার আগ্রহ সারগেই-এরই যেন খুব বেশি। ওলেস হনচার ইউক্রাইন তথা সোভিয়েত রাশিয়ার একজন প্রথম সারির লেখক, তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেয়েছেন।
সারগেই বলল, এই ওলেস হনচারের লেখা পড়ে কলেজ জীবনে আমরা মুগ্ধ হয়েছি, কত রাত জেগে পড়েছি তাঁর বই, মনে-মনে তাঁকে পুজো করেছি, দূর থেকে তাঁকে দু একবার দেখলেও কাছে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য কোনওদিন হবে এমন কল্পনাও করিনি। আজ সেই বিখ্যাত লেখকের সামনাসামনি গিয়ে বসব, একথা ভাবতেই আমার এমন হচ্ছে…। সুনীলজি, আপনি আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন!
আমি হাসিমুখে বললুম, হ্যাঁ।
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় আমি ছিলুম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দারুণ ভক্ত। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে তাঁর সমস্ত বই পড়ে শেষ করেছিলুম। খুব ইচ্ছে করত, তাঁকে একবার চোখে দেখব। কলেজ জীবনে এসে কফি হাউসে আড্ডা মারতে গিয়ে জানতে পারলুম, কাছেই ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিস, সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মাঝে-মাঝে আসেন। পর পর কয়েকদিন ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিস বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলুম, কিন্তু দেখা মিলল না। ভরসা করে একদিন ঢুকেই পড়লুম ‘পরিচয়’ অফিসে। সেদিন সেখানে সত্যিই মানিববাবু উপস্থিত ছিলেন। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ভাবছিলুম, এই কালোমতন গম্ভীর চেহারার মানুষটির হাতে দিয়েই এইরকম সব জটিল লেখা বেরিয়েছে? আমার বন্ধু দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় মানিকবাবুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, কিন্তু আমি একটি কথাও বলতে পারিনি তাঁকে। মানিকবাবু বোধহয় ভেবেছিলেন, আমি বোবা!
ওলেস হনচার কিয়েভের শান্তি কমিটির সভাপতি, তাঁর সঙ্গে দেখা হবে সেই অফিসেই।
ওলেস হনচার-এর জন্ম ইউক্রাইন-এর একটি গ্রামে, ১৯১৮ সালে। শৈশবে মাতৃহীন, তিনি দিদিমার কাছে মানুষ। ছাত্রজীবনে লেখালেখি শুরু। কিছুদিন সাংবাদিকতা করার পর অধ্যাপনা শুরু করলেন। কয়েকটি গল্প, একটি উপন্যাস প্রকাশিত হল। কিন্তু সেগুলি এমন কিছু না। তারপর একটি বিরাট ঘটনা ঘটল। সেই ঘটনার নাম যুদ্ধ। হনচার-এর নিজের ভাষায়, ‘‘দা ওয়ার ওভারটুক মি ইন দা লাইব্রেরি।’ অতিশয় পড়য়া মানুষটিকে যেতে হল যুদ্ধে। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তিনি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলেন, তাঁর প্রত্যেকটি লেখাই মর্মস্পর্শী। তাঁর ‘‘দা স্টান্ডার্ড বেয়ারার্স’ নামে ট্রিলজি অত্যন্ত বিখ্যাত হয়েছে। তারপর দীর্ঘকাল ধরে তিনি সমান জনপ্রিয় হয়ে আছেন। সোভিয়েত দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার–লেনিন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
এ পি এন-এর একজন প্রতিনিধি এসে আমাদের নিয়ে গেলেন নির্দিষ্ট সময়ে। শান্তি কমিটির সভাকক্ষটি বেশ প্রশস্ত, ধপধপে সাদা দেওয়াল, একটি গোল টেবিল ও অনেকগুলি চেয়ার। ওলেস হনচার আগেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন, হাসিমুখে অত্যন্ত সৌজন্যের সঙ্গে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। প্রথম দর্শনেই তাঁকে আমার ভালো লেগে গেল। এক একজন মানুষের মুখের মধ্যে ভারী সুন্দর প্রসন্নতা থাকে, তাঁদের সামনে দাঁড়ালে কোনও আড়ষ্টতা বোধহয় না।
আমি একজন ভারতীয় এই কথাই তাঁকে জানানো হয়েছিল, আমি যে একজন বাঙালি তা তিনি জানতেন না। সারগেই-এর মুখে আমার পরিচয় জেনে তিনি বললেন, কী আশ্চর্য! তোমাকে উপহার দেওয়ার জন্য আমি যে বইটি নিয়ে এসেছি, তার দ্বিতীয় পৃষ্ঠাতেই বেঙ্গল-এর কথা আছে।
আমি জিগ্যেস করলুম, ইউক্রাইনের মানুষ কি বাংলার কথা কিছু জানে?
ওলেস হনচার বললেন, তেমন কিছু জানে না, তবে একটা রোমান্টিক ধারণা আছে। বাংলা হল সেই সুদূর দেশ যেখানে আমাদের হাঁসেরা শীত কাটাতে যায়। সেই বাংলা হল কবিদের দেশ, চিরবসন্তের দেশ।
বলতে-বলতে তিনি ভুরু নাচিয়ে হাসলেন, আমিও হাসলুম। অর্থাৎ প্রকৃত সত্য তিনি জানেন, আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই।
এরপর নানা বিষয়ে আড্ডা হতে লাগল। সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর কোনও গোঁড়ামি নেই, তাঁর মন সংস্কারমুক্ত। কথায়-কথায় তিনি বললেন, কোনও লেখকেরই উচিত নয় নিজেকে বা অন্য লেখকদের ধারণার পুনরাবৃত্তি করা, তাতে শিল্পের তৃপ্তি পাওয়া যায় না। সময়ের ধারাবাহিকতা ও ঐতিহাসিক পটভূমিকায় সবসময় মানুষকে দেখা উচিত। শিল্পী তাঁর বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে চান, অথচ শিল্পের স্বভাবই হল অনবরত পরিবর্তন। সাহিত্যে এই দুই বিপরীত শক্তি মিলেমিশে থাকে।
অনেক মার্কসবাদী তাত্বিক সাহিত্য সম্পর্কে যেসব রসকষহীন ফতোয়া জারি করেন তার চেয়ে এই ধরনের একজন সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকের সঙ্গে কথা বললে প্রগতি-সাহিত্য সম্পর্কে অনেক বেশি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
আমি জিগ্যেস করলুম, আপনি যে উপন্যাসগুলি লেখেন, তার বিষয়বস্তু কি আগেই ভেবেচিন্তে ঠিক করেন, না হঠাৎ মাথায় আসে?
তিনি বললেন, মনের প্রক্রিয়া বড় জটিল। কী করে যে কোন বিষয়টা মনে ধাক্কা দেবে, তা বলা যায় না। যুদ্ধের সময় আমি নোট রাখতুম, মৃত বা জীবিত কমরেডদের কথা অন্যদের জানানো আমার কর্তব্য বলে মনে করতুম। তারপর আরও অনেক বিষয় নিয়ে লিখেছি।
কথায়-কথায় ওলেস হনচার জানালেন যে তিনি আমেরিকা ভ্রমণ করে এসেছেন, সেখানকার চওড়া-চওড়া বহুদূর পর্যন্ত একটানা সোজা রাস্তাগুলি দেখে এক-এক সময় তাঁর কল্পনাশক্তি বিস্তৃত হয়েছে।
আমি আবার জিগ্যেস করলুম, আপনি একজন সৃষ্টিশীল লেখক, এবং আপনি এখানকার শান্তি কমিটির সভাপতি। লেখা ছাড়া অন্যান্য কাজে মন দিতে বা সময় দিতে আপনার অসুবিধে হয় না?
তিনি একটু হেসে বললেন, এখানকার কাজ খুব বেশি নয়। সব শিল্পীদের কিছুটা সামাজিক ভূমিকা নিতে হয়। না, আমার সময়ের অভাব হয় না। বিশ্বশান্তি সম্পর্কে তোমার কী অভিমত?
আমি বললুম, আমরা তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক, আমাদের মতামতের কী মূল্য আছে? আমরা তো কামানের খাদ্য!
তিনি বললেন, সব মানুষেরই মতামতের মূল্য আছে। প্রতিবাদ জানানো একটা নৈতিক অধিকার। যুদ্ধ যে কত ভয়াবহ, কী সাংঘাতিক অপচয়, তা আমরা মর্মে-মর্মে বুঝেছি। তাই আমরা সত্যিই চাই না, পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হোক।
আমি বললুম, সে কথা আমি বিশ্বাস করি। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য আপনাদের দেশ বেশি উদ্যোগী, আপনাদের প্রয়াস আন্তরিক।
এরপর কফি ও কেক-পেস্ট্রি এসে গেল।
ওলেস হনচার ইংরেজি জানেন না। কিংবা জানলেও বলেন না। কথাবার্তা হচ্ছিল সারগেই-এর অনুবাদের মাধ্যমে। আমাদের আলোচনা যখন শেষ তখন সারগেই জানাল যে সে ওয়েলস হনচারের কত ভক্ত, তাঁর কত বই পড়েছে। ছাত্র বয়েস থেকে তাঁকে কাছাকাছি দেখবার জন্য কত উদগ্রীব।
বিখ্যাত লেখকটি তখন তাঁর ওই তরুণ ভক্তটির সঙ্গে ওঁদের নিজস্ব ভাষায় নানারকম কৌতুক করতে লাগলেন, যা আমি কিছুই বুঝলুম না।
ওলেস হনচার আমাকে তাঁর যে বইটি উপহার দিলেন, সেটির নাম ‘দা সোর অফ লাভ।’ ইংরেজি অনুবাদটি বেরিয়েছে মস্কো থেকে। উপন্যাসটি পড়ে আমি বুঝতে পারলুম, ওলেস হনচারের বর্ণনাভঙ্গি বেশ কাব্যময় এবং একটা রোমান্টিক সুর আছে।
সেই বইতে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রসঙ্গটি আমি এখানে তুলে দিচ্ছি।
কৃষ্ণসাগরের তীরে একটি ছোট শহর। সেখানে একটি নার্সদের ট্রেনিং কলেজ। সেখানকার একজন শিক্ষিকা রেড ক্রসের কাজ নিয়ে দূর বিদেশে গিয়েছিলেন। তরুণী নার্সরা তাদের ওই প্রিয় শিক্ষিকার কাছে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাইছে। তারা বলছে, ‘আমাদের বলুন সেই সোনার বাংলার কথা, যেখানে আমাদের হাঁসেরা শীত কাটাতে যায়!
‘সে তো কবিদের দেশ, চিরকালীন প্রেমের দেশ, চিরবসন্তের দেশ, সেখানকার মানুষরা কৃষ্ণ-চক্ষু, তাদের হাসিতে আছে জাদু, সেখানকার মেয়েদের বাহু রাজহংসীর গলার মতন, সেইসব হাতের ভঙ্গিমা দেখে সাপেরাও মোহিত হয়ে যায়…সেখানে নৃত্যরতা নারীরা, অপূর্ব ছন্দ, যেন জিপসি…’।
কিন্তু শিক্ষিকাটি কোনও কথাই বললেন না। তাঁর চোখ বেদনার্ত। ছাত্রীরা যা বলছে, তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর মনে পড়ছে শত শত ক্ষুধার্ত শিশুর হাত, রক্তশূন্য চেহারার মায়েরা, করুণ চোখে তারা ভিক্ষে চাইছে, চাইছে বেঁচে থাকার জন্য সাহায্য..রেড ক্রসের কর্মীরা সারা দিনরাত পরিশ্রম করলেনও ভিড়ের শেষ নেই…তিনি সবসময় এত পরিশ্রান্ত থাকতেন যে বাংলার অন্য সৌন্দর্য দেখার অবকাশই পাননি…
এর পরে আমরা গেলুম একটা পত্রিকা দফতরে।
ইউক্রাইনের জনসংখ্যা পাঁচ কোটি। আমাদের পশ্চিম বাংলার জনসংখ্যার সমান। ইউক্রাইনিয়ানদের সাহিত্য-প্রীতি খুব বেশি। বাঙালিরাও সাহিত্য-প্রীতির জন্য বিখ্যাত। তবে তফাত হচ্ছে এই যে, ইউক্রাইনে শতকরা সবাই প্রায় শিক্ষিত এবং এখানকার অধিবাসীরা খুবই সচ্ছল। আর পশ্চিমবাংলায় শিক্ষিতের হার শতকরা পঁয়ত্রিশজন আর শতকরা পঞ্চাশজন সারা বছর দুবেলা পেটভরে খেতে পায় না।
ইউক্রাইনের সাহিত্য বাঙালিদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। তবে ইউক্রাইনের বিখ্যাত লেখক শেভচেংকোর জীবন নিয়ে একটি নাটক বাংলায় রচনা করেছেন মন্মথ য়ায়, কলকাতায় সেটি অভিনীতও হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি যখন কিয়েভ শহরে গিয়েছিলেন, সেখানে এক জনসভায় তিনি মন্মথ রায়ের ওই নাটকটির কথা উল্লেখ করেছিলেন, দুই দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধনের উদাহরণ হিসেবে।
নাট্যকার মন্মথ রায় এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির ওই সুকীর্তিটির জন্য বাঙালি হিসেবে আমি বেশ খাতির পেতে লাগলুম।
পত্রিকাটির নাম ‘সেসভিট’। অনুবাদের ওপরে এঁরা খুব জোর দেন। পত্রিকাটির সহযোগী সম্পদাক ডঃ ওলেগ মিকিটেংকো জানালেন যে তাঁরা বাংলা সাহিত্য থেকে বেশ কিছু অনুবাদ প্রকাশ করেছেনরবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এরকম অনেকের, আরও অনুবাদ প্রকাশ করতে আগ্রহী, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে বাংলা বই সংগ্রহ করা।
‘সেসভিট’ পত্রিকাটি ইউক্রাইনিয়ান ভাষায় প্রচারসংখ্যা আড়াই লক্ষ। সোভিয়েত ইউনিয়ানে এসে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করলেই বোঝা যায় যে সমৃদ্ধ রুশ ভাষা প্রত্যেকটি সোভিয়েত রাজ্যের মধ্যে যোগাযোগের ভাষা হলেও প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব ভাষার উন্নতির জন্যও প্রচুর জোর দেওয়া হয়। অর্থাৎ রুশ ভাষা দিয়ে অন্য ভাষাগুলিকে গ্রাস করবার কোনও চেষ্টা নেই। আঞ্চলিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিগুলি যদি সমানভাবে গুরুত্ব পায় তা হলে একটা বড় দেশের মধ্যে অসন্তোষ বা বিভেদকামী শক্তি দানা বাঁধে না।
কিয়েভে আমাদের সফরসূচী প্রায় শেষ। মাত্র বারো দিন আগে আমি সোভিয়েত ভূমিতে পা দিয়েছি কিন্তু এর মধ্যে এত বেশি স্থান বদল ও বিভিন্নরকম মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়েছে যে মনে হয় যেন কতদিন কেটে গেছে। সেই তুলনায় কিয়েভ শহরে অবশ্য তত বেশি ঠাসা প্রোগ্রাম ছিল না, ছুটির মেজাজে ইচ্ছেমতন ঘুরে বেড়াবার অনেক সুযোগ পাওয়া গেছে, এই রমণীয় শহরটি ভালোভাবে উপভোগ করা গেছে। আগামীকাল ফিরে যেতে হবে মস্কোতে।