আমাদের হোটেলের ব্যবস্থাপনাতেই তিন-চারটি বাস ছাড়ল পুশকিন শহরের উদ্দেশ্যে। আমি আর সারগেই আমাদের জন্য নির্দিষ্ট বাসে উঠে বসলুম। একটি ফুটফুটে তরুণী মেয়ে আমাদের গাইড। সে একটি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রাস্তার দু-ধারের বর্ণনা দিতে লাগল। আমি কিছুক্ষণ নিসর্গ দেখায় মন দিলুম। খুব একটা দেখবার কিছু নেই। মস্কোতে যেমন, লেনিনগ্রাডেও তাই, শহরের উপান্তে অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়ি। সোভিয়েত দেশের নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে বাসস্থান দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানে নাকি প্রতি পাঁচ মিনিটে একটা করে নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে যাচ্ছে।
শহর ছাড়াবার পর বৃক্ষবিরল সমতলভূমি। মাঝে-মাঝে ছোট-ঘোট বসতি ও কল কারখানা। এমন কোনও সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ল না, যার কথা বাড়িতে চিঠি লিখে জানানো যায়। বাইরের থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি বাসের যাত্রীদের লক্ষ করতে লাগলুম।
প্রায় সকলেই বিদেশি ভ্রমণকারী। বুলগেরিয়ান, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, আমেরিকান। এর মধ্যে একজন আমেরিকান ভদ্রলোক বিশেষ দ্রষ্টব্য। এই প্রৌঢ় লোকটি লম্বায় সাড়ে ছ’ফিটের বেশি তো হবেনই, বসা-অবস্থাতেই তাঁকে গাইড-মেয়েটির সমান মনে হচ্ছে। এক একজন দুর্ভাগা মানুষের ফিসফিস করে কথা বলার ক্ষমতা থাকে না, এই ব্যক্তিটি সেরকম। ইনি এঁর স্ত্রীর সঙ্গে যে নিভৃত আলাপ করছেন, তাও যেন মাইক্রোফোনে প্রচারিত হচ্ছে। এই কল্পকণ্ঠ ব্যক্তিটির নাম, আমি মনে মনে রাখলুম, মিঃ গোলায়াথ। ওল্ড টেস্টামেন্টের ডেভিড যার সঙ্গে লড়াই করেছিল। মিঃ গোলায়াথের নাক, ঠোঁট, চোখ। সবই বড়-বড়, ভুরু দুটি এত মোটা যে মুখখানাকে সবসময়েই বিস্মিত মনে হয়। এঁর স্ত্রী বেশ ছোট্টখাট্টো এবং মৃদুভাষী। আমার ঠিক সামনেই বসে আছে এক ফরাসি দম্পতি, তবে আজকালকার কেতা অনুযায়ী ওদের বোধহয় বিয়ে হয়নি, তাই প্রেম খুব গভীর, অন্য কারুর দিকে তাকাবার ফুরসত পর্যন্ত নেই। অন্যান্য যাত্রীরা সাধারণ টুরিস্টের মতন, আমি ছাড়া আর সবাই বেশ সুসজ্জিত।
মিঃ গোলায়াথ গাইড-মেয়েটিকে নানান প্রশ্ন করছেন। বাসে ওঠবার পরেই তিনি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, আটাশ বছর আগে তিনি একবার লেনিনগ্রাডে এসেছিলেন, সেই স্মৃতি তাঁর কিছু-কিছু মনে আছে। গাইড-মেয়েটির বয়েস আটাশের অনেক কম, অত আগের কথা তার জানবার কথা নয়। তা ছাড়া উত্তর দেওয়ার সময় ঠিক ইংরিজি শব্দটা খোঁজবার জন্য সে প্রায়ই মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে ফেলছে, অন্য কোনও যাত্রী তাকে সাহায্য করছে বাক্যটি শেষ করতে। মিঃ গোলায়াথের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গি দেখে অনেকেই মজা পাচ্ছে বেশ।
মিনিট চল্লিশেক-এর মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলুম পুশকিনে। বাস থেকে নেমেই বোঝা গেল এটি একটি প্রাসাদপুরী। এককালের রাজা-রাজড়াদের বিলাস ভবন। পিটার দা গ্রেট এবং বিখ্যাত রানি ক্যাথরিনের-স্মৃতি-বিজড়িত। আগে এই জায়গাটির অন্য নাম ছিল; পুশকিন এখানে লেখাপড়া করেছেন এবং তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবন এখানে কাটিয়েছেন বলে এখন তাঁর নামেই শহরটি নামাঙ্কিত। রাশিয়ায় কবি-সাহিত্যিকদের নামে অনেক শহরেরই নাম রাখা হয়েছে।
পুশকিনের কথা ভাবলেই আমার বায়রনের কথা মনে পড়ে। রোমান্টিকতায় ও জীবনযাপনে দুজনের অনেকটা মিল আছে। দুজনেই লিখেছেন গাথাকাব্য। অবশ্য লেখক হিসেবে পুশকিনের প্রভাব অনেক ব্যাপক। অভিজাত ঘরের সন্তান হয়েও পুশকিন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতার সপক্ষে কলম ধরেছেন। এজন্য তাঁকে নির্বাসনের যাতনা সহ্য করতে হয়েছিল। তাঁর লেখা ‘ইউজেন ওনেজেন’-কে বলা হয় রুশ ভাষার প্রথম উপন্যাস। পুশকিনের ইস্কাবনের রানি’ নামের গল্পটি অনেক বাঙালি পাঠকের কাছেই পরিচিত। পুশকিনের অপূর্ব কাব্যময় ভাষায় আমি মুগ্ধ হয়েছি এক সময়।
প্রেমের ব্যাপারেও পুশকিন বায়রনকে টেক্কা দিয়েছিলেন। বত্রিশ বছর বয়েসে পুশকিন এক অসাধারণ রূপসি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, যে পুশকিনের নিজের ভাষাতেই তাঁর জীবনের ১১৩ নম্বর নারী। সেই নারীও তার চরিত্র নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসত, এবং, এবং সেই কারণেই কয়েক বছরের মধ্যেই এক ডুয়েল লড়তে গিয়ে পুশকিন প্রাণ হারান।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলুম রাজপ্রাসাদটির সামনে। কুড়ি-পঁচিশ জনের এক একটি ব্যাচকে ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে। বাইরে থেকেই প্রাসাদটিকে বেশ জমকালো দেখায়, মিশ্রিত রাশিয়ান বারোক স্থাপত্যের একটি বৃহৎ নিদর্শন। ক্যামেরা যার করে ছবি তুলে ফেললুম কয়েকটা।
ভেতরে ঢুকে আমাদের আর এক জোড়া করে জুতো পরতে হল। প্রতিটি কক্ষের মেঝেতেই অতি মূল্যবান সব কাঠের কাজ আছে, বাইরের জুতো পরে তার ওপর দিয়ে এত লোক হাঁটলে সেসব অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। আবার এদেশে খালি পায়ে হাঁটার কথা কল্পনাও করা যায় না, সেই জন্য এখানে আলাদা কাপড়ের জুতো রাখা আছে অনেক। সেইগুলো পায়ে গলিয়ে নিতে হবে। আমার কৌতূহল হল, আমাদের মিঃ গোলায়াথের পায়ের মাপের জুতো পাওয়া যাবে কি? তাও পাওয়া গেল এক জোড়া।
প্রাসাদটির প্রতিটি কক্ষের বর্ণনা আমি দেব না। সম্রাট-বাদশাদের বিলাস ভবন যে রকম হয় এটিও প্রায় সেইরকমই। এই প্রাসাদের মধ্যেই রয়েছে দুটি গির্জা, অসংখ্য ঘরের মধ্যে কোনওটি রাজা-রানির শয়নঘর, কোনওটি বিকেলে বসবার ঘর, কোনওটি সকালের, কোনওটি বিদেশি অতিথিদের জন্য, কোনওটি একলা একলা খাওয়ার জন্য, কোনওটি বেশি লোকের সঙ্গে ভোজসভার জন্য, কোনওটি আকাশ দেখবার জন্য, কোনওটি বই পড়বার জন্য ইত্যাদি। এ ছাড়া চোখ ধাঁধানো নাচঘর।
এখানকার দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা আমি বলব। প্রজাদের শোষণ করা টাকায় এক সময় রাজা-বাদশাদের হুকুমে অনেক প্রাসাদ এবং শিল্পকীর্তি রচিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য রাজা-বাদশাদের আলাদা কোনও কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব হচ্ছে সেইসব স্থপতি ও শিল্পীদের, যাঁরা ওইসবের পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেছেন। তাজমহলের জন্য শাজাহান শুধু হুকম দিয়েছেন আর রাজকোষ খুলে দিয়েছেন। তাঁর কি স্থাপত্য সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল? সেইরকম খাজুরাহো বা কোনারক দেখতে গিয়েও আমরা শুধু শুনি সেগুলি কোন রাজার আমলে তৈরি, শিল্পীদের নাম কেউ মনেও রাখেনি। এখানে কিন্তু রুশ গবেষকরা খুঁজে-খুঁজে যার করেছেন শিল্পীদের নাম, গাইডরা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে যখন আমাদের বিভিন্ন শিল্প সৌন্দর্য দেখাচ্ছিলেন, তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছিলেন আসল শিল্পীদের নাম। মূল প্রাসাদটির স্থপতি বারতোলোমিও রাস্টভেল্লি। নাম শুনে মনে হয় ইটালিয়ান।
আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল সোভিয়েত সরকারের ঐতিহ্যপ্রীতি। এ দেশের অভিজাততন্ত্র একেবারে মুছে ফেলা হলেও আগেকার দিনের প্রাসাদ, মূর্তি, স্তম্ভ কিছুও নষ্ট করা হয়নি, সব অবিকৃত রাখা হয়েছে। শুধু তাই-ই নয়, এই প্রাসাদটিও অর্ধেকটা নাতসিরা ধ্বংস করে দিয়েছিল, নাতসিরা এই শহরটি অধিকার করে এখানে থেকেও গেছে অনেকদিন, তখন যা খুশি ভাঙচুর করেছে। এখানকার মানুষ আবার পরম যত্নে সেইসব ভাঙা অংশের পুনরুদ্ধার করছে। যেমন তেমন মেরামত নয়, হুবহু আগের মতন। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আমরা দেখলুম, এখনও শিল্পীরা ছবি দেখে-দেখে এক একটা ঘর ঠিক আগের মতন অবস্থায় ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে আটত্রিশ বছর আগে।
ঘুরতে-ঘুরতে আরও একটি ব্যাপারে চমকিত হলুম। আমাদের সহযাত্রী মিঃ গোলায়াথের কথাবার্তা শুনে বাসের মধ্যে অনেকেই মুখ টিপে হাসছিলুম, কিন্তু এখন দেখা গেল, ওই দৈত্যকারের লোকটি কিন্তু একজন শিল্প-বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন ঘরে যেসব ছবি আছে, অনেক শিল্পীর নামই অপরিচিত, সেসব ছবি দেখে কিন্তু ওই ভদ্রলোক শিল্পীদের নাম, রঙের ব্যবহারের বিশেষত্ব, রীতি, শিল্প-ইতিহাস বলে যাচ্ছিলেন গড়গড় করে, গাইডরাও অতশত জানে না।
প্রাসাদ সফর শেষ হওয়ার পর অনেকেই গেল পার্শ্ববর্তী পুশকিন-সংগ্রহশালা দেখতে। আমার আর ইচ্ছে হল না। মিউজিয়ম বা এই ধরনের বড়-বড় বাড়ি হেঁটে-হেঁটে ঘুরতে বেশ ক্লান্তি লাগে। সামনের বাগানে একটা বেঞ্চে বসে পড়ে আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, আজ আর কোথাও যাওয়ার নেই তো?
সারগেই বলল, নাঃ, আজ আর কিছু নেই। ছুটির দিন বলে এখানকার এ পি এন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি, জানি না ওর কিছু ঠিক করে রেখেছিল কি না!
আমি বললুম, আর কিছু থাকলেও আজ আর আমি যেতুম না।
বলেই আমি দুবার হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে উঠলুম। সকালে বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগে গেছে।
বাস ছাড়ার সময়টা আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই সেখানে জড় হয়ে গেল। বাসটা চলতে শুরু করার খানিকক্ষণ পরে কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগতে লাগল, কীসের যেন অভাব বোধ করছি। আরও একটু পরে একজন যাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে গাইড মেয়েটিকে কী যেন বললে। মেয়েটিও খুব বিচলিতভাবে কথা বলতে লাগল ড্রাইভারের সঙ্গে। কিছু যেন একটা ঘটেছে।
আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, কী ব্যাপার?
সারগেই হাসতে-হাসতে বলল, সেই লম্বা আমেরিকান ভদ্রলোক মিসিং। তিনি আর তাঁর স্ত্রী বাসে ওঠেননি!
সেইজন্যই এতক্ষণ এত নিস্তব্ধ মনে হচ্ছিল বাসটাকে।
এখন কী করা যাবে, তাই নিয়ে একটা সংশয় দেখা দিল। বাসটা প্রায় দশ-বারো মাইল চলে এসেছে, এদিকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অনেকেই ক্লান্ত, এখন আবার বাসটা অতদূরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? একজন বলল, আরও তো কয়েকটি বাস রয়েছে, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই অন্য বাসে চলে আসবেন। গাইড মেয়েটি বলল, সবক’টি বাসই তো ভরতি, অন্য কোনও বাস ওঁদের নেবে কিনা সন্দেহ! একজন বললে, কেউ বিপদে পড়লেও নেবে না? আর একজন বলল, অন্য বাসও তো ছেড়ে দেবে, উনি যদি কোথাও ঘুমিয়ে পড়ে থাকেন? পরে আর ফেরবার উপায় নেই। আর একজন বলল, আমি ভদ্রলোককে একবার দেখেছিলুম, একটা সুভেনিরের দোকানে কেনাকাটা করতে।
শেষ পর্যন্ত গাইড-মেয়েটি বলল, আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। বাসটির মুখ ফেরানো হল।
আবার সেই প্রাসাদের কাছাকাছি এসে দেখা গেল সস্ত্রীক মিঃ গোলায়াথ রাস্তায় একটি স্টেশন ওয়াগনের ড্রাইভারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। সম্ভবত উনি গাড়িটি ভাড়া করতে চাইছেন, কিংবা গাড়িটা একেবারে কিনে ফেলার প্রস্তাব দেওয়াও বিচিত্র নয়।
আমাদের বাসের একজন যাত্রীও ভদ্রলোককে কোনও অভিযোগ জানাল না। গাইড মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আমরাই ভুল করে আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।
বাসে উঠে সেই দৈত্যাকার, বজ্রকণ্ঠ মানুষটি শিশুর মতন সরল মুখ করে অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, আপনাদের অসুবিধে ঘটাবার জন্য আমি দুঃখিত। দোষ আমারই।
এই ছোট্ট ঘটনাটি দেখে আমার মনে হল, সোভিয়েত দেশের সাধারণ মানুষ আমেরিকার সাধারণ মানুষের প্রতি কোনও বিদ্বেষ ভাব পোষণ করে না। সব দেশের সাধারণ মানুষই তো সমান।
সন্ধেবেলা হোটেলে ফিরে আমি আরও কয়েকবার হাঁচতে লাগলুম। সারগেই বলল, দাঁড়ান, আপনার জন্য ওষুধ আনছি।
সে এনে হাজির করল এক বোতল ভদকা।
এ দেশে এসে এখনও এ দেশের জাতীয় পানীয় আস্বাদ করা হয়নি বটে। আমি গেলাস ধুয়ে নিয়ে এলুম। ভদকার জন্য খুব ছোট-ছোট গেলাস লাগে, কিন্তু তা আর পাচ্ছি কোথায়? সারগেই আমাকে বোঝাতে লাগল ভদকা জিনিসটা কী ও কতরকম হয়। আমি শুনে গেলুম বাধা না দিয়ে। রাশিয়ান ও পোলিশ ভদকা ইউরোপের সব জায়গাতেই পাওয়া যায়, আমেরিকাতেও পাওয়া যায়, এমনকী কলকাতাতেও জোগাড় করা অসম্ভব কিছু না। ও আমার অনেকবার চেখে দেখা আছে।
ভদকা এক ঢোঁকে গলায় ঢেলে দেওয়ার নিয়ম। প্রথম গেলাসটি নেওয়ার পর সারগেই আমাকে বলল, সুনীলজি, সাবধানে খাবেন, এ জিনিস খুব কড়া। আমি তো ইন্ডিয়াতে গেছি, আমি দেখেছি ইন্ডিয়ানরা বেশি ড্রিংক করতে পারে না।
আমি সুন্দরবনের হাঁড়িয়া, সাঁওতাল পরগনার মহুয়া, খালাসি-টোলার এক নম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের চার চোঁয়ানি, মেক্সিকোর টাকিলা, গ্রিসের উজো খেয়ে দেখেছি, সেই সবের তুলনায় এই ভদকা আমার তেমন কড়া মনে হল না।
সারগেই অবশ্য বেশ সাবধানী সুরাপায়ী। একটা দুটো খেয়েই বলল, আমার যথেষ্ট হয়েছে। সারগেই-এর খানিকটা স্বাস্থ্যবাতিক আছে। ও আমাকে বলল, এক সময় আমি খুব সিগারেট খেতুম, খুব ড্রিংক করতুম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। সে কথা শুনে আমি হেসে খুন। বাইশ বছরের ছেলে, কবেই বা ধরল, কবেই বা ছাড়ল?
গেলাসের পর গেলাস উড়িয়ে আমি বোতলটা শেষ করে ফেললুম এক সময়। খুব একটা বেশি কিছু নয়। এইসব ভদকার বোতলের ছিপি খুব পাতলা। একবার খুললে আর লাগাবার ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ এই বোতল খুলে একবারেই শেষ করে দেওয়া নিয়ম!
সারগেই বিদায় নেওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ বইটই পড়লুম। আজও সহজে ঘুম এল না। ঘুমের আবার এ কী ব্যাপার হল? অবশ্য রাত্তিরে ঘুম না হলে আমি ব্যতিব্যস্ত হই না, বরং নিজেকে নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটানো যায়।
মে-দিবস উপলক্ষে এখানে পর পর দুদিন ছুটি। সারগেই এ পি এন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না, তবে আগে থেকেই আজকের অন্য একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে আছে।
হোটেল থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে রেলওয়ে স্টেশনে মাত্র পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গিয়ে বুঝলুম, ট্যাক্সি না নিলেও চলত। এটির নাম ফিনল্যান্ড স্টেশন, এখান থেকে সরাসরি ট্রেন ফিনল্যান্ড যায়। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে আত্মগোপন করতে হলে লেনিন ফিনল্যান্ডে চলে যেতেন। আমরা অবশ্য ততদূর যাব না, আমাদের গন্তব্য পঁচিশ মাইল দূরে কোমারোয়া নামে একটা ছোট্ট জায়গা।
এখন বেলা এগারোটা, লোকাল ট্রেনে বেশি ভিড় নেই। ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও বোধ হয় ট্রেন আজকাল জনপ্রিয় নয়। আমরা একটা ফাঁকা কামরায় উঠে বসলুম। সারগেই শোনাল তার ভারতীয় রেলযাত্রার অভিজ্ঞতার কাহিনি। একবার তাকে বোম্বে থেকে নাগপুর যেতে হয়েছিল, হঠাৎ সেই সময় তার খুব জ্বর হয়েছে। ট্রেনে রিজার্ভেশন নেই। অসহ্য ভিড়ের মধ্যে সারারাত কাটাবার সময় তার মনে হয়েছিল, সে বুঝি হঠাৎ মরেই যাবে।
অবশ্য সারগেই-এর বর্ণনার মধ্যে কোনও তিক্ততা ছিল না। সে জানে, ভারতবর্ষ অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে ভুগছে। সেই তুলনায় সোভিয়েত রাশিয়ায় জনসংখ্যা কমতির দিকে।
চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ এক সময় মাইক্রোফোনে অনেকক্ষণ ধরে কী সব ঘোষণা হতে লাগল। আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, কী বলছে? সারগেই বলল, ও চাকরির খবর। রেলে কতগুলো চাকরি খালি আছে, কত মাইনে, কী কী সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে তাই জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যদি যাত্রীদের মধ্যে কেউ ওইসব চাকরি নিতে উৎসাহিত হয়।
আমি হতবাক! রেলে চাকরি খালি? লোক পাওয়া যাচ্ছে না, যাত্রীদের অনুরোধ করা হচ্ছে? আমাদের দেশে রেলের চাকরিতে দশটা পোস্ট-এর জন্য বিজ্ঞাপন দিলে অন্তত দশ হাজার দরখাস্ত পড়ে না? আমরা সবাই একই পৃথিবীর মানুষ?
কাল রাত্তিরেই আমি একবার ১৯৮৩ সালের ইয়ার-বুকে সোভিয়েত নাগরিকদের চাকরির অবস্থার কথা পড়ছিলুম। এ দেশের প্রত্যেক মানুষের কাজ পাওয়ার অধিকার আছে। নতুন সংবিধান অনুযায়ী ইচ্ছে মতন চাকরি বেছে নেওয়ার অধিকারও হয়েছে। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর প্রত্যেকের চাকরি বাঁধা। ১৯৩০ সালের পর থেকে এদেশে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ উঠে গেছে। ইদানীং পনেরো থেকে পঁচিশ লাখ চাকরি খালি যায়, লোক পাওয়া যায় না।
এটা একটা দারুণ উন্নতির প্রমাণ। যে-সমাজে প্রতিটি মানুষই কাজের অধিকার পায়, সে সমাজে সবাই সসম্মানে বাঁচতে পারে। ইংল্যান্ড-আমেরিকাতে এখন বেকারিত্ব প্রকট। আমেরিকায় বর্তমানে বেকারের সংখ্যা শতকরা ১৬ জনের বেশি। অবশ্য, এই সঙ্গে এ কথাও বলা দরকার, ইংল্যান্ড-আমেরিকা-কানাডার মতন সোভিয়েত রাশিয়াকে বহিরাগতদের চাপ সহ্য করতে হয় না। বহিরাগতদের জন্যই ইংল্যান্ডে বর্ণ-সমস্যা এবং বেকার সমস্যা পাশাপাশি চলছে। আমেরিকা বা কানাডার যে-কোনও ছোট শহরেও কালো মানুষ, চিনে, আরব, ভারতীয় চেহারার নতুন নাগরিক দেখা যায়। রাশিয়ায় সে সমস্যা নেই।
ছোট-ছোট স্টেশন আসছে যাচ্ছে, লোকজনের ওঠা-নামা খুবই কম। খানিকবাদেই আমাদের জায়গাটায় পৌঁছে গেলুম। বেশ একটা পরিচ্ছন্ন গ্রামের মতন। আমরা যাব এখানকার একটি রাইটার্স হোমে। স্টেশনের একজনকে জিগ্যেস করে সারগেই পথ নির্দেশ জেনে নিল।
গাছের ছায়া-ফেলা পথ ধরে আমরা হাঁটতে লাগলুম। দুপাশে শান্ত-নির্জন বাড়ি। অধিকাংশ বাড়িই তালা দেওয়া, কোনও-কোনও বাড়িতে কুকুর রয়েছে দেখলুম, অর্থাৎ মানুষও রয়েছে। নিজস্ব ব্যবহারের জন্য এদেশে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখা নিষিদ্ধ নয়। গ্রামের দিকে অনেকেরই ডাচাউ বা কানট্রি হাউস থাকে। ছুটিছাটায় বেড়াতে আসে।
আমরা যে-লেখকের সঙ্গে দেখা করতে চলেছি, তাঁর পরিচয় বেশ অভিনব। সোভিয়েত দেশের উত্তরাঞ্চলে, আর্কটিক ওশানের কাছে, বরফের রাজ্যে, চুকচা নামে একটি উপজাতির বাস। জনসংখ্যা মাত্র পনেরো হাজার। কিছুদিন আগে পর্যন্তও এই চুকচাঁদের কোনও লিখিত ভাষা ছিল না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন যেহেতু মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে বিশ্বাসী, তাই চুকচাঁদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য তাদের ভাষার একটা লিখিত রূপ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এবং এক জেনারেশনেই তাদের মধ্যে একজন লেখক সারাদেশে যশস্বী হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনেও আমি এঁর লেখা দেখেছি।
মধ্যবয়স্ক এই লেখকটির নাম রিথিউ ইউরি সারগেইভিচ। ইনি পৃথিবীর অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন, কলকাতাতেও এসেছেন।
রাইটার্স হোম একটি বেশ বড় বাড়ি। তাতে আলাদা আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট, সেখানে এসে লেখকরা থাকতে পারেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, টাইপ-রাইটার ও টেলিফোন আছে, খরচ নামমাত্র। রিথিউ সারগেইভিচ আমাদের নিয়ে তাঁর লেখার ঘরে বসিয়ে বললেন, হ্যাঁ, কলকাতার কথা আমার মনে আছে, কলকাতায় বেশ প্রাণ আছে!
ইনি ইংরিজি জানেন না। সারগেই আমাদের দো-ভাষী। নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও ইনি অবশ্য রুশ ভাষা ভালোই জানেন, ইচ্ছে করলেই রুশ ভাষায় লিখতেও পারেন, কিন্তু নিজেদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য সেই ভাষাতেই লিখে যেতে চান। তাতে অবশ্য প্রচারের অসবিধে কিছু নেই। কারণ লেখামাত্র অনবাদ হয়ে যায়। যে-ভাষার সমগ্র জনসংখ্যাই মাত্র পনেরো হাজার, সেই ভাষার একজন লেখক হয়েও ইনি লেখাটাকেই জীবিকা করতে পেরেছেন, লেনিনগ্রাড শহরে এঁর নিজস্ব একটি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সংসার-খরচের জন্য চিন্তা করতে হয় না। ইচ্ছেমতন ভ্রমণ করতে পারেন।
বিদেশি কোনও লেখকের সঙ্গে কথা বলতে আমার অনেক ক্ষেত্রেই বেশ অসুবিধে হয়। ওঁরা আমাদের লেখাটেখা সম্পর্কে কিছুই জানেন না, বাংলা ভাষার অস্তিত্ব সম্পর্কেই অনেকের স্পষ্ট ধারণা নেই। অথচ আমরা ওদের সম্পর্কে মোটামুটি জানি। রিথিউ সারগেইভিচেরও একটি ছোট গল্প অন্তত আমার আগেই পড়া আছে। একটি ছেলেকে নিয়ে গল্প, তারা বাবা নৌকো নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেত, ছেলেটি অপেক্ষা করত কবে বাবা আসবে, কবে বাবা আসবে। একবার বাবা ফিরে এল না। সবাই ধরে নিল সে সমুদ্রে নৌকোডুবি হয়ে মারা গেছে। কয়েক বছর পরে ছেলেটি তার বাবাকে অন্য একটি শহরে দেখতে পায়, কিন্তু সে কথা সে তার মাকে জানাল না। সেটাই তার জীবনের প্রথম গোপন কথা।
একটি গল্প পড়েই সেই লেখকের রচনাভঙ্গি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা যায়। কিন্তু আমার সম্পর্কে উনি কী ধারণা করবেন?
যাই হোক, খানিকক্ষণ গল্প-টল্প হল। আমি ওঁকে ওঁর লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে টুকিটাকি কয়েকটা প্রশ্ন করলুম। উনি ওঁর স্বজাতির নানান লোক-কাহিনি, গ্রাম্য জীবন বিষয়েই বেশি লিখতে চান। অবশ্য আধুনিক শহুরে জীবন নিয়েও কিছু কিছু লিখেছেন। রুশ ক্লাসিকাল সাহিত্য ওঁর বেশ ভালোই পড়া আছে।
এক সময় উনি নিজেই চা তৈরি করে খাওয়ালেন।
আমি জিগ্যেস করলুম, এইরকম নির্জনবাসে কি আপনার লেখার বেশি সুবিধে হয়?
উনি বললেন, শহরে অনেক লোকজন, নানারকম আকর্ষণ। বাড়ির লোকজনের জন্যও সময় দিতে হয়। এরকম কোনও ফাঁকা জায়গায় বেশ কয়েকদিন থাকলে কল্পনাশক্তি বাড়ে। এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। খুব কাছেই সমুদ্র। লেখায় মন না বসলে আমি সমুদ্রের ধারে হাঁটতে যাই।
আমি চমকে উঠে বললুম, কাছেই সমুদ্র? আমরা ঘুরে আসতে পারি?
উনি কোট ও টুপি পরে বাইরে এসে আমাদের সমুদ্রের দিকের পথটা দেখিয়ে দিলেন। দু-একটা ছবি তোলার পর আমরা উষ্ণ করমর্দন করে বিদায় নিলুম।
দুপাশে প্রায় বনের মতন। রাস্তাটা এক জায়গায় অনেকখানি ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে। সারগেই জিগ্যেস করলো, সুনীলজি, আর যাবেন? ফেরার সময় কিন্তু এতখানি খাড়া উঠতে হবে।
আমি বললুম, এত কাছে সমুদ্র, তবু দেখব না? চলো, চলো!
সেই ঢালু পথ ধরে প্রায় ছুটতে-ছুটতে নেমে এসেই দেখতে পেলাম বেলাভূমি। অনেকদিন বাদে সমুদ্র দর্শন হল। আমার অভিজ্ঞতায় আর একটি নতুন সমুদ্র, এর নাম বালটিক উপসাগর।
দুপুরবেলা সমুদ্র তীর একেবারে নির্জন। আমি এগিয়ে গিয়ে জলে হাত রাখলুম। অচেনা জল সব সময়েই ছুঁতে ভালো লাগে।