ক্লিয়োপেট্রার যদি নাকটা একটু ছোট হত, তা হলে সিজার কিংবা অ্যান্টনি এমনভাবে তার প্রেমে পড়তেন না। অত সহজে তা হলে কি আর ভেঙে যেত রোমান সাম্রাজ্য–খ্রিস্টধর্ম হত আরও বিলম্বিত, পৃথিবীর ইতিহাস হয়তো হত অন্যরকম। অথবা তারও আগে মদ খেয়ে বন্ধুর সঙ্গে মারামারি করে কিংবা পেটের অসুখে অত অল্প বয়সে যদি মারা না যেতেন মহাবীর আলেকজান্ডার, তাহলে ম্যাসিডোনিয়ার ওই তেজি ছোকরা পৃথিবীর চেহারা কীরকম করে দিতেন কে জানে। তাঁর মৃত্যুর পরই অমন করুণ দৃশ্য হত না, বিশাল গ্রিক সাম্রাজ্যের আর একবার কি ভারতবর্ষের শেষ দিকে এই বাংলাদেশ পর্যন্ত আসার চেষ্টা করতেন না? কিংবা ওয়ার্টলুর মাঠে যদি হঠাৎ বৃষ্টি না হত, যদি রোখা না যেত নেপোলিয়ানকে, তা হলে আমরা আজ নিশ্চিত ইংরেজির বদলে ফরাসি শিখতুম। টিপু সুলতানকে অত সহজে ঘায়েল করে ভারতের মাঠে-মাঠে আর ইংরেজের বিউগল বাজত না তবে। কিংবা নর্মান্ডি অবতরণের সময় হিটলার যদি শ্লিপিং পিল খেয়ে না ঘুমাতেন–যদি তিনি প্যানজার বোমারু বাহিনী ছেড়ে দেবার অনুমতি দিতেন তা হলে কোনদিকে ঘুরে যেত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কে জানে, কে জানে ওই রণদুর্মদ রক্তপাগল পৃথিবীতে আরও কত কেলেঙ্কারির স্রোত বইয়ে দিতেন।
ইতিহাসের অনেক বিশাল সন্ধিক্ষণে এমন অনেক মজার ছোটখাটো ঘটনা আছে। জয়পালের মেয়েকে চুরি করে নিয়ে যাওরার অমন বদ মতলব যদি পৃথ্বীরাজের না হত তা হলে ভারতে মহম্মদ ঘোরীর আগমন আরও কত বিলম্বিত হত। এমন জল্পনা করার লোকের অভাব নেই। একজন লেখক লিখতেন-ন্যান্ডিতে জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের আসল কারণ নাকি রোমেলের স্ত্রীর জন্য এক জোড়া সাদা জুতো। রোমেল কারুকে না জানিয়ে বিবাহ বার্ষিকীতে স্ত্রীকে উপহার দেবার জন্য ফ্রন্ট ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। নইলে রোমেল উপস্থিত থাকলে এত সহজে-হয়তো এসব জল্পনাই। ইতিহাস এত তুচ্ছ কারণে বদলায় না, সে তার নিজস্ব গতি নেবেই।
পৃথিবীর কয়েকটি ভৌগলিক বদল সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না। কয়েকটি ভৌগোলিক পরিবর্তন মানব সভ্যতার কী আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে, যেগুলি না ঘটলে এ পৃথিবীকে নিশ্চিত অন্য পৃথিবী মনে হত। যেমন হিমালয় পর্বত যদি না থাকত ভারতের উত্তরে, সাহারা মরুভূমি যদি মরুভূমি না হত সত্যিই। অর্থাৎ যেমন ছিল আগে।
ভূতত্ববিদরা বলেন, যেখানে এখন হিমালয়, আগে সেখানে ছিল এক অতি গভীর সমুদ্র, নাম তার টেথিস, হিমালয় তার কত নীচে ডুবে ছিল কে জানে। অসম্ভব ছিল না ডুবে থাকা। হিমালয়ের সবচেয়ে উঁচু শিখর এভারেস্টের উচ্চতা সাড়ে পাঁচ মাইলের কাছাকাছি, পৃথিবীর গভীর মহাসমুদ্রগুলির এখনও কোথাও-কোথাও গভীরতা ছ’মাইলের বেশি। যাই হোক, তারপর একদিন পৃথিবীর খামখেয়ালে হল বিষম ভূমিকম্প, টেথিস সাগর গড়িয়ে এল ভারতের নীচের দিকে, বিছিন্ন হয়ে গেল অনেকখানি ভূভাগ, দূরে সরে গিয়ে এখন তাঁর নাম অস্ট্রেলিয়া, জন্ম হল দুটি ছেলে-মেয়ে উপসাগর সমেত ভারত মহাসাগর।
হিমালয় না থাকলে কী হত? কাব্য সাহিত্যের যে সমূহ ক্ষতি হত–তা ঠিকই। ম্রিয়মাণ কালিদাসের মুখ এখনই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনে কোনও পাহাড় নেই, তাদের কাব্যসাহিত্য কিন্তু সেজন্য কম সম্পদশালী নয়, তারা সমুদ্রের বন্দনা করেছে।
এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত হতেন জগমাতা দুর্গাসমেত মহাদেব, পদব্রজে স্বর্গে যাওয়ার কোনও উপায় থাকত না যুধিষ্ঠিরের। কোথায় থাকত পুণ্যসলিলা গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধুই বা হয়তো কোথায়। হিমালয়ের গায়ে অনেক জলজ জন্তু-মাছের অস্থিজীবি পাওয়া গেছে। কিন্তু তবুও মুনি-ঋষিরা অপবিত্র জ্ঞানে তাকে কখনও বর্জন করেননি, ওই নাগাধিরাজের গুহা করেই একদিন ভারতবর্ষের মহাওষ্কার ধ্বনি প্রথম জেগেছিল।
হিমালয় ব্যতীত ভারতবর্ষ হত শীতপ্রধান দেশ। সাইবেরিয়া থেকে ঠান্ডা হাওয়া বইত সারা বছর। আমরা সবাই হতুম ফরসা লোক। মৌসুমী হাওয়া হিমালয়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসে সারা উত্তর ভারতে, বাংলাদেশে যে বৃষ্টি ছড়াচ্ছে সেটা পাওয়া যেত না। বঞ্চিত হতুম বিশাল অরণ্যসম্ভার থেকে। ওই বিশাল প্রহরী না থাকলে রাশিয়া থেকে ভারত আক্রমণ হত বহুবার নিশ্চিত।
হিমালয় না থাকলে নেপাল-ভুটান-সিকিম-তিব্বতের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে হত না আমাদের। পাহাড় ঘেরা ছিলুম বলে বহুকাল আমরা শুধু ভারতবর্ষকেই পৃথিবী বলে জানতুম। হিমালয় বাইরের শত্রুর কাছে ভারতকে দুর্ভেদ্য করেছিল, আবার তার বিপরীত অর্থে, ভারতের বাইরে ভারতের ক্ষমতা বিস্তারের কথা কখনও মনে পড়েনি। ফলে আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে গেছে রক্ষণশীল।
সেই জন্যেই বাইরের শত্রু এসে বহুবার অপ্রস্তুত অবস্থায় আমাদের পর্যদস্ত করেছে। চোখের সামনে অমন গগনভেদী পাহাড়-তারই বন্দনা করছি আমরা। ওই বিশাল রহস্যের ভেদ করতে চাইনি বলে আমাদের জাতীয় চরিত্রও হয়ে গেছে মিস্টিক। আমরা সমুদ্রকে উপেক্ষা করেছি। অথচ সমুদ্রজয়ী জাতিগুলিই একদিন পৃথিবী জয় করেছে। হোমার লিখলেন, ইউলিসিসের অজানা সমুদ্র অভিযান, আর আমাদের দৌড় লঙ্কাদ্বীপ পর্যন্ত, তাও সেতুবন্ধন করে, জাহাজ-টাহাজ নয়! জলস্পর্শ বারণ! প্রাচীন হিন্দু রাজারা নোবিদ্যায় রয়ে গেলেন অজ্ঞ-তারপর মুসলমান শাসকরা এল আরবের মরুভুমি, পাহাড় থেকে, তারা ভালো করে সমুদ্র চোখেই দেখেনি! উত্তর হিমালয় ভারত পাহারা দিচ্ছে, এই জেনে নিশ্চিত হয়ে প্রায় তিন দিকের উপকূল রয়ে গেল চিরকাল অরক্ষিত।
হিমালয় না থাকলে ভারতের দক্ষিণে আরও জমি থাকত। জনসমস্যার সমাধান হয়ে যেতো কত সহজে। আলাদা হত না সিংহল। সুতরাং সিংহল প্রবাসী ভারতীয়দের ফিরিয়ে আনার কোনও কথাই উঠত না। যে স্থলভূমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ওখান থেকে–তা যদি হয় আজকের অস্ট্রেলিয়া–অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ, বাংলাদেশের নীচের ভাঙা জায়গাটায়–সারা বঙ্গোপসাগর জুড়ে কী চমৎকার ফিট করে যায়–তাহলে আরও অতখানি জমি থাকতো আমাদের অধিকারে, কি বিশাল হত বাংলাদেশ, বিভক্ত হলেও উদ্বাস্তু সমস্যা থাকতো না নিশ্চিত। তার বদলে, আজ সেই অস্ট্রেলিয়া জুড়ে রয়েছে সাত সমুদ্র পেরিয়ে আসা ইউরোপীয়রা। আজ এমন স্পর্ধা তাদের যে, কালো লোকেদের ইমিগ্রেশান বন্ধ করে দিয়েছে তারা।
তা হলে হিমালয়কে নিয়ে অত উচ্চতার গর্ব থাকত না আমাদের–কিন্তু পাক-ভারত বাংলার ব্যাপ্তি হত আরও বিশাল। চিনের সমকক্ষ। এখন এই শীতকালে সারা ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় জুইফুলের মতো বরফ পড়ত। এদিকের আবহাওয়া হত অনেকটা আমেরিকার মতো। কে জানে, রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয় আমেরিকা এই ভারতেই হত কি না।
ভূগোলের এ রকম আর একটা খামখেয়ালি ঘটেছিল সাহারা মরুভূমিতে। ভূতত্ববিদরা যাকে বলেন চতুর্থ বরফ যুগ, সেই সময় আফ্রিকা ছিল অনেক সুযোগভুক্ত। তখন কী দুর্দশা ইউরোপে, সমস্ত উত্তর ইউরোপ বরফে ঢাকা, আল্পস ও পিরেনিজ থেকে বিশাল বিশাল বরফের চাঁই নেমে আসত। প্রায় গোটা ইউরোপই ছিল মনুষ্যবাসের অনুপযোগী। ছিল প্রকাণ্ড সোমশ হাতি, পশমওলা গণ্ডার। আর সাহারায় তখন অগভীর জল, নলখাগড়ার বন, নানারকম ছোট সাইজের জানোয়ার। অনেক সুস্বাদু মাছ–আর এক জাতের মানুষ পাথরের অস্ত্র দিয়ে সেগুলো মেরে মেরে বেশ সুখে আছে। টাটকা মাছ মাংস আর বনের ফলমূল, তখনও আগুনের ব্যবহার আসেনি, সুতরাং রাগ হিংসা আসেনি, সেই সময় সভ্যতার ভোর শুরু হত।
কিন্তু তা হয়নি। আরম্ভ হল প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বরফ সরে যেতে লাগল আর্কটিক মহাসমুদ্রের দিকে–সারা ইউরোপে জন্মালো অসংখ্য চারাগাছ। কত রকমের ঘাস ফুল। ফুল থেকে এল ফল। তারপর বনস্পতি, সুবাতাস, যাযাবর মানুষ। ইউরোপ হয়ে উঠল মনুষ্যবাসের রম্যভূমি। আটলান্টিক থেকে বার্মার জোলো হাওয়া মুখ ফিরিয়ে বইতে লাগল উত্তর ইউরোপে, দিতে লাগল সুফলা বৃষ্টি। সে হাওয়া তার মুখ ফিরিয়ে এল না আফ্রিকা –এশিয়ার বিশাল ভূমিখন্ডে, সাহারা শুকিয়ে গেল। হা-হা করতে লাগল তৃষ্ণায়, পরিণত হল পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমিতে। সেই মরুভূমির ছোঁয়াচ লাগল আশেপাশেও। আফ্রিকার আর জাগরণ হল না।
যদি অচলাবস্থা বজায় থাকত–তবে কে জানে, আফ্রিকানদের দুর্পিত পদভারেই সারা পৃথিবী টলমল করত–ইউরোপের বরফ গলতেই একদিন কিন্তু ততদিনের বৃষ্টিহীন আফ্রিকা যদি কালো না হয়ে যেত-তবে, প্রস্তুত হয়ে থাকত একদল সংঘবদ্ধ মানুষ। তারাই বেরিয়ে পড়ত ইউরোপ দখলে। প্রকৃতির পরিহাসে তা তারা পারেনি। সাহারা থেকে ভ্রষ্ট প্রধান আদিম মানুষের দল যাযাবর হয়ে যায়। নিজেরা সভ্যতা গড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে–তাই সভ্যতার ওপর জাতক্ৰোধ জন্মে যায় হয় তো তাদের। পৃথিবীর নানান সভ্যতা এদের প্রতি আক্রমণে বারবার কেঁপে উঠেছে। দুর্ধর্ষ তাতার, হুনেরা ওই যাযাবরদেরই বংশধর।
সাহারা যদি শস্যশ্যামলাই থাকত, আর ইউরোপ বরফ ঢাকা–তাহলে কি হত পৃথিবীর ইতিহাস কে কল্পনা করতে পারবে। এত দীর্ঘকাল অন্ধকারে থাকার বদলে আজ আফ্রিকার সভ্যতা ও সংস্কৃতিরই হয়তো হত জয়জয়কার। হয়তো নিগ্রোদের মতো কালো হওয়াই হত খুব সুন্দর হওয়ার চিহ্ন। আমাদের দেশের মায়েরা মেয়ের বিয়ের জন্য কাঠকয়লার মতন কালো চেহারার পাত্র খুঁজতেন। সবাই বলত, কালো জগতের আলো।