শিশু খুন এবং যে খুনী, সেও শিশু। গল্পটা এই রকম : যদিও গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। এই ঘটনাটি ঘটেছিল আমার প্রথম নিউইয়র্ক ভ্রমণের সময় নিউইয়র্কের শহরতলি ব্রংকসে একটি ছোট দোকানদারের চার বছরের ছেলেটির নাম এলবান। সে তাদের দোকানের সামনের ফুটপাথে খেলা করছিল, এমন সময়, আর একটি আট বছর বয়সের ছেলে এসে তাকে বলল, এই আমার পুতুল দেখবি? আয়, তা হলে আমাদের ছাদে আয়।
চার বছরের ছেলে এলবান সেই আট বছরের ছেলেটির সঙ্গে উঠে গেল পাশের বাড়ির ছাদে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই দুজনের বেশ ভাব হয়ে গেল। কিন্তু ছাদে ওঠার পরই, আট বছরের ছেলেটি দাঁত কিড়মিড় করে টেলিভিশনের, সিনেমার, কমিক স্ট্রিপের ডাকাতদের মতন, বলল, তোর পকেটে কী টাকাকড়ি আছে বার করা এলবান খিলখিল করে হেসে বলল, কিছু নেই, একটা পয়সাও নেই।
–পকেট দেখি!
এলবান পকেট উলটে দেখালো। তখন বড় ছেলেটি চোখ পাকিয়ে বলল, পয়সা যখন নেই, তখন তোকে ছাদ থেকে রাস্তায় ঠেলে ফেলে দেব। এলবান তাতেও ভয় পেল না। তার হাতে এক প্যাকেট আলুভাজা ছিল, সে বলল, পয়সা নেই, আলুভাজা নেবে? সব না কিন্তু, অর্ধেক। বড় ছেলেটি সাগ্রহে আলুভাজার দিকে হাত বাড়াল। ক্রমশ আলুভাজা সব শেষ হয়ে গেলে, সে বলল, এবার? এলবান হাত উল্টে বলল, আর কিছু নেই, নেই। কী মজা!
বড় ছেলেটি তখন এলবানকে ঠেলতে ঠেলতে কার্নিসের ধারে নিয়ে এল, তারপর হঠাৎ তাকে দু-হাতে উঁচু করে তুলে নীচে ফেলে দিল।
এলবান পড়ে গেল ছ’তলা বাড়ির ছাদ থেকে। তারপর একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটল। সেই বাড়ির ঠিক নীচে ছিল এক গাদা ডাঁই করা কার্ড বোর্ডের বাক্স। বৃষ্টিতে ভিজে সেগুলো নরম তুলতুলে হয়েছিল, এলবান মরল না। তার বাবা-মা ছেলেকে অত উঁচু থেকে পড়তে দেখে মূক হয়ে যায়। হাসপাতালে এলবানের পেটের মধ্যে অবিরাম রক্তক্ষরণ হতে থাকে, কিন্তু অপারেশনের ফলে সে বেঁচে যায় ও সুস্থ হয়ে উঠে। এলবানের অবিশ্বাস্য গল্প শুনে, তার বর্ণনা মতন যে পাড়ার ৬ থেকে ১৭ বছর বয়স্ক বহু ছেলেকে তার সামনে হাজির করানো হয়, কিন্তু এলবান তাদের কারুকেই সেই আততায়ী বলে চিনতে পারে না।
এর সপ্তাহ দু-এক বাদে, সেই পাড়াতেই জাভিয়ের নামে আর একটি ৪ বছরের ছেলেকে দেখতে পাওয়া যায়–একটা পাঁচতলা বাড়ির ছাদ থেকে ছিটকে পড়েছে। এবার নীচে কোনও কার্ড বোর্ডের বাক্স ছিল না, ছেলেটা থেঁতলে মরে যায়, তার হাতে তখনও এক প্যাকেট আলুভাজা। এই ছেলেটা ছিল এলবানের খুব বন্ধু। এবারও আততায়ী ধরা পড়ল না।
এর কিছুদিন পর এলবানদেরই দোকানে একটি আট বছরের ছেলে এসে বলতে লাগল, তার এক ভাগ্নে নাকি সুযোগ পেলেই বাচ্চা ছেলেদের ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। কিন্তু সেই ছেলেটিকে দেখেই এলবান প্রাণপণ চিৎকার করে ওঠে ভয়ে। এলবনেদের দাদারা তখন ছেলেটিকে ধরে রেখে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ আসবার আগে অপেক্ষা করার সময় ছেলেটি বলে, আমার খিদে পেয়েছে। তাকে কেক এবং লেমনেড খেতে দেওয়া হলে সে বেশ শান্তভাবেই খায় এবং এলবানের দাদাদের জিগ্যেস করে, আপনাদের হোট ভাইকে ভালোবাসতেন? সে বেঁচে যাওয়ায় খুশি হয়েছেন?
পুলিশের কাছে জেরাতেও ছেলেটি প্রথমে স্বীকার করতে চায়নি কিছু, কিন্তু দূর থেকে তার মা-কে আসতে দেখেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং বারবার বলতে থাকে, মা-কে বলবেন না, মা-কে বলবেন না। মা মারবে। মা খুব মারবে।
এলবানের মা নিজের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখে কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, আমি যে আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি তাই যথেষ্ট। আমি ওই ছেলেটার শাস্তি চাই না। ওকে ফাঁসি দিও না।
ফাঁসি অবশ্য সেই আট বছরের ছেলেটির হবে না–একটি খুনি এবং একটি খুনের চেষ্টা সত্বেও! কারণ তার বয়স কম। ছেলেটির পারিবারিক ইতিহাস এই রকম, তার বাবা নেই, মা সব সময় ব্যস্ত এবং রাগি, থাকে একটা নোংরা ঘরে। তার চেহারা রোগা বলে পাড়ার অন্য ছেলেরা তাকে মারে। একদিন সে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছিল -তখন তার মা তাকে আরও মার দিয়েছিল। বলেছিল, চুপ করে বাড়িতে বসে থাকবি। তখন সে জানলা দিয়ে রাস্তার লোকের গায়ে থুতু ছেটাত। তাতে তার মা তাকে ধরে আরও বেদম মার দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রেখে যায়। এরপর থেকে, সে তার চেয়ে অনেক কম বয়সি ছেলেদের সঙ্গে খেলা শুরু করে। টেলিভিশন দেখা, সিনেমা দেখা, বড়দের খেলা।