‘…আকাশ কুয়াশা ছাড়া কিছুই না,
শূন্যতা শুধু জল,
দেখো, এখন সব কিছুই মিশ্রিত, তবু চারপাশে আমি
খুঁজি রেখা ও আঙ্গিক
দিগন্তের জন্যও কিছু নেই,
শুধু গাঢ় অন্ধকার
রঙের অবশেষ
সব দ্রব্য মিলিত হয়েছে এক জলে,
যে জল
আমি অনুভব করি
আমার চিবুকে গড়াননা অশ্রুর
ধারায়…’
–পল ক্লোদেল
কান শহরটির পরিচিত আমাদের কাছে প্রধানত চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য। প্রত্যেক বছর কান ফিলম ফেস্টিভালের প্রতি থাকে সারা বিশ্বের ফিলম বাফুদের মনোযোগ। এই ফেস্টিভালেরই একটি শাখায় সত্যজিৎ রায় নামের এক অখ্যাত তরুণ পরিচালকের ‘পথের পাঁচালী’ নামে একটি ফিলম পুরস্কৃত হয়ে পৃথিবী বিখ্যাত হয়।
অনেকে এই শহরটিকে নাম উচ্চারণ করে ক্যান। কান না ক্যান, কোনটা সঠিক আমি জানি না। তবে নামটির উৎপত্তির খুব সম্ভবত বেতসকুঞ্জ থেকে, এককালে এখানকার বালিয়াড়িতে বেতের ঝাড় ছিল অনেক।
রিভিয়েরাতে উপকূলবর্তী পরপর চোঁধ ধাঁধানো সব কটি শহরই এক সময় ছিল জেলেদের গ্রাম। তবু এসব গ্রামেরও দু’ হাজার বছরের ইতিহাস আছে। ফোসিয়ান, কেল্ট ও রোমানরা এই সব গ্রামের অধিকার নিয়ে লড়ালড়ি করেছে। দশম শতাব্দীতে প্রাচ্যদেশ থেকে মুসলমানরা রণতরীতে এসে একাধিকবার আক্রমণ করেছে এই উপকূল।
নেপোলিয়ান যখন এলবা দ্বীপের নির্বাসন থেকে পালিয়ে আসেন, তখন প্রথম রাত্তিরটা তাঁবু গেড়ে ছিলেন এই কান গ্রামের বালিয়াড়িতে। ছোটখাটো একটি অনুচরবাহিনী সংগ্রহ করে এখান থেকে শুরু করে হয় তাঁর প্যারিস অভিযান।
আমরা গাড়ি চালিয়ে এক দুপুরবেলা উপস্থিত হলাম কান শহরে। ফিলম ফেস্টিভ্যালের সময় এখানে চিত্রতারকা, হবু চিত্রতারকা এবং সুযোগ সন্ধানীরা গিসগিস করে, এখন সেসব কিছু নেই, অন্য শহরগুলির মতনই টুরিস্টদের ভিড়। সকালবেলা এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছিল, এখন আবার নরম রোদ উঠেছে। বেলাভূমিতে শুয়ে আছে হাজার হাজার নারী পুরুষ। কারুরই উর্ধাঙ্গে কোনও বস্ত্র নেই, আর নিম্নাঙ্গের পোশাক সম্পর্কে ৈ সৈয়দ মুজতবা আলীর বর্ণনা ধার করে বলা যায়, আমার গলার টাই দিয়ে তিনটে মেয়ের জাঙ্গিয়া হয়ে যায়।
আমরা কেউ জিতেন্দ্রিয় পুরুষ নই, প্রায়-অনাবৃতা রমণীদের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হবেই। কিন্তু প্রথম দু-একদিন যেরকম চিত্তচাঞ্চল্য হচ্ছিল, আস্তে আস্তে তা বেশ কমে গেল, এখন পাশ দিয়ে কোনও আধা-উর্বশী হেঁটে গেলেও তেমন আকর্ষণ বোধ করি না, ফিরেও তাকাই না। আমি জন্ম-রোমান্টিক, নারীদের খানিকটা কল্পনার রহস্যে মুড়ে রাখতে চাই। এরকম প্রকাশ্য নগ্নতা আমার অরুচিকর লাগে।
জমকালো হোটেলগুলি দেখতে-দেখতে এক সময় মনে হয়, দুশো বছর আগেকার কোনও জেলে যদি হঠাৎ এখানে ফিরে আসত, তা হলে তাদের গ্রামটাকে কি চিনতে পারত? স্বয়ং নেপোলিয়ানই যদি আবার আসতেন, তিনিও নিশ্চয়ই ভাবতেন, এ কোন অচেনা স্বর্গপুরীতে এলাম রে যাবা!
রিভিয়েরার গ্রামগুলির এই হঠাৎ সমৃদ্ধির মূলে আছে ইংরেজরা। এক সময় তারা ফ্রান্সের অনেকটা অংশ দখল করেছিল। ইংরেজরা দ্বীপবাসী হলেও তাদের নিজস্ব কোনও উল্লেখযোগ্য বিচ নেই। ফরাসিদেশের এই গ্রামগুলিতে তারা স্বাস্থ্যনিবাস তৈরি করতে শুরু করে। যতই ধুরন্ধর ব্যবসায়ী হোক, ইংরেজদের যে সৌন্দর্যসন্ধানী চোখ আছে, তা স্বীকার করতেই হবে। আমাদের দার্জিলিং-কালিম্পং-এর মতন সুন্দর পাহাড়ি শহর যে বানানো যায়, তা ইংরেজরাই তো খুঁজে যার করেছিল। বাঙালিরা পুরীতে তীর্থ করতে গেছে কিন্তু বাংলায় কোনও উপকূল নগরী বানায়নি, আর নিজের দেশের মধ্যে এত চমৎকার পাহাড় থাকতেও পাহাড়চূড়ায় বসতি স্থাপনের কথা তাদের মাথাতেই আসেনি।
উপকূলের রাস্তা ধরে গাড়ি চালাতে-চালাতে আমরা এক সময় নিস শহর ছাড়িয়ে গেলাম। কান আর নিস-এর বহিরঙ্গ রূপের তেমন কিছু তফাত নেই। সেই বড় বড় হোটেল, পাম গাছের সারি ও বালির ওপর শুয়ে থাকা নারী-পুরুষ। নিস শহরে না থেমে আমরা চলে গেলাম মনাকো।
ফ্রান্স আর ইতালির মাঝখানে মনাকো একটা আলাদা রাজ্য। ভূমধ্যসাগরের কিনারে ছোট্ট একটা বিন্দু। মনাকোতে কোনও গ্রামবাসী থাকে না, কারণ গ্রামই নেই, একটা শহরই একটা রাজ্য। স্থায়ী জনসংখ্যা মাত্র চব্বিশ হাজার।
আমাদের ছাত্র বয়েসে এই মনাকোর রাজা আমাদের বুকে বড়ো দাগা দিয়েছিলেন। মনাকোর নাম তখনই প্রথম শুনি। চলচ্চিত্র জগতে আমাদের প্রিয় নায়িকা ছিল গ্রেস কেলি, তাকে এই মনাকোর রাজা বিয়ে করে একেবারে চলচ্চিত্র জগৎ থেকেই সরিয়ে নিয়ে গেল। কান্ট্রি গার্ল, রিয়ার উইন্ডোতে গ্রেস কেলি অপূর্ব অভিনয় করেছিল। গ্রেস কেলির সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তার সারল্য মাখা মুখখানা দেখলে মনে হত, খুব সাধারণ মেয়ে, যেন পাশের বাড়িতেই থাকে। সেই গ্রেস কেলি হয়ে গেল রানি। বড়লোকরা সিনেমার নায়িকাদের যখন তখন বিয়ে করে নিয়ে যেত তখন, বিশ্ববিখ্যাত ধনী আগা খাঁর ছেলে যেমন হলিউড থেকে হরণ করেছিল রিটা হেওয়ার্থকে।
এ রাজ্যে ঢুকতে আলাদা কোনও ভিসা লাগে না। গাড়ি পার্ক করে আমরা হাঁটছি, রাস্তার এক পাশে শুধু হিরে-জহরতের দোকান।
অসীম বলল, সুনীল, এর কোনও একটা দোকানে ঢোকার চেষ্টা করবে নাকি?
আমি বললাম, কেন, ঢুকতে দেবে না নাকি?
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এসব দেশে যত বড়লোকি দোকান কিংবা হোটেলই হোক, সেখান থেকে কিছু কিনি বা না কিনি, থাকি বা না থাকি, তবু ঢুকতে কেউ বাধা দেয় না। ব্যক্তি-স্বাধীনতা এখানে এমনই প্রবল যে কারুর পোশাক দেখে তার ক্রয়ক্ষমতা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তোলে না। সেই জন্যই অসীমের প্রশ্ন শুনে আমার একটু খটকা লাগল।
অসীম বলল, না না, ঢুকতে দেবে নিশ্চয়ই। ঢুকে একটা মুক্তোর মালার দাম জিগ্যেস করে দ্যাখো না কী হয়।
বুঝতে পারলাম, আমার সঙ্গে কিছু একটা প্র্যাকটিক্যাল জোক করতে চাইছে। ওই ফাঁদে আমি পা দিই, মাথা খারাপ!
চেপে ধরতে অসীম বলল, ওইসব দোকানের নাকি বিশেষ একটা কায়দা আছে। ওই সব দোকানের আসল খদ্দেররা কেউ কক্ষনো কোনও জিনিসের দাম জিগ্যেস করে না। কেউ দাম জিগ্যেস করলেই দোকাদাররা বুঝে নেবে, সে তোক ওই দ্রব্য কেনার উপযুক্ত নয়। খুব বিনীতভাবে তাকে জানাবে, ওটা বিক্রির জন্য নয়। আসল খদ্দের কোনও একটা জিনিস পছন্দ করে বলবে, এটা আমার হোটেলে পাঠিয়ে দিন। সেই সব খদ্দেররা নিজেদের কাছে পয়সাও রাখে না, তারা পেছন ফিরে সেক্রেটারিদের বলে, পেমেন্ট করে দিও।
দোকানগুলোর শো-কেসে লক্ষ-কোটি টাকা দামের হিরে মুক্তোর হার সাজানো রয়েছে। এসব জিনিস বাপের জন্মে দেখিনি, দেখতে ক্ষতি কী? সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কেউ বাধা দেয় না।
আর একটু এগোলেই দুনিয়াখ্যাত জুয়োর আড্ডা, মন্টিকার্লো। বহু কোটিপতি এখানে নিঃস্ব হতে আসে। জোচ্চোর ছাড়া, জুয়োখেলায় শেষ পর্যন্ত কেউ জেতে, এমন কদাচিৎ শোনা যায়। কাছাকাছি বড় হোটেলগুলি থেকে এই মন্টিকার্লোতে যাওয়ার জন্য মাটির নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ আছে। পকেট ভরতি টাকা নিয়ে ওপরের রাস্তা দিয়ে কেউ যেতে সাহস করে না, মাঝপথে ছিনতাই হয়ে যেতে পারে।
আমরা মন্টিকালোর সামনে দাঁড়ালাম। বাড়িখানাও দেখবার মতন, সোনালি রঙের বিশাল গেট। ইচ্ছে করলেই ভেতরে ঢোকা যায়, পকেটে পয়সা না থাকলেও ঢুকে এক চক্কর মেরে বেরিয়ে এলে কেউ কিছু বলবে ন, কিন্তু জুয়াখানা দেখার কোনও আগ্রহ বোধ করলাম না।
মনাকো এমনই একটি রাজ্য, যেখানে একজনও গরিব নাগরিক নেই। প্রত্যেকের গাড়ি আছে, টেলিফোন আছে, টিভি আছে। স্বর্গ-টর্গ কি এই রকমই? আমরা গরিবদেশের মানুষ, পৃথিবীরই একটা অংশের এরকম সচ্ছলতা দেখলে আমাদের ঈর্ষা হয়, রাগও হয়। এখানকার ট্রাফিক পুলিশদের পর্যন্ত সাজপোশাক দারুণ, প্রত্যেকের হাতে সাদা গ্লাভস!
ভাস্কর অনেকটা অকারণ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, হুঁ, ব্যাটারা সাদা হাত দেখাচ্ছে! ফুটানি কত!
বলাই বাহুল্য, রাস্তাঘাটগুলো ঝকঝকে তকতকে। যেখানে সেখানে পার্ক। আমরা একটা পার্কে বসে আমাদের রুটি মাখন চিজ সালামি যার করে স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেতে শুরু করলাম। পার্কটা ধাপে ধাপে নীচের দিকে নেমে গেছে। একেবারে তলায় ঘন নীল সমুদ্র। যেন ওলটানো আকাশ। অতি নয়নাভিরাম দৃশ্য। আমরা গরিবদেশের লোক হলেও এই দৃশ্যটি বিনা পয়সায় উপভোগ করা যায়। এখানে জনসংখ্যা এতই কম যে পার্কে লোকজন প্রায় দেখাই যায় না, তবু এত পার্ক বানিয়ে রেখেছে। আর কলকাতার মতন জনাকীর্ণ শহরে পার্কই নেই বলতে গেলে। আমার মতন নাস্তিকের মুখ দিয়েও আর একটু হলে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ভগবানের কী অবিচার।
যারা আস্তিক, তাদের প্রতি আমার এই প্রশ্নটা করতে ইচ্ছে করে, তোমাদের ভগবান কি সত্যিই সব মানুষকে ভালোবাসে? এই যে একটা শহর, এখানে কিছু মানুষ নিছক জুয়াখেলাকে কেন্দ্র করে দিব্যি সুখে আছে, ভালো খাচ্ছে-দাচ্ছে, সব রকম আরাম ভোগ করছে। আর আমাদের দেশের একটা চাষা উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও দু’বেলা খেতে পায় না। তবু তোমরা বলবে, সব মানুষের মধ্যে ভগবান আছে? নাকি এর পর পূর্বজন্মের কর্মফলের মতন গাঁজাখুরি ব্যাপারও মানতে হবে!
অসীম একটা খবরের কাগজ কিনেছিল, তাতে একটা মজার খবর বেরিয়েছে। একজন জেলে একটা বিরাট মাছ ধরেছে সেটা সে বিক্রি করেছে একজন দোকানদারকে। দোকানদার সেই মাছটা কেটে দেখে, না, শকুন্তলার হারানো আংটি নয়, প্রায় আড়াই কেজি ডিম। মাছের পেটে ডিম থাকবে, এটা অভিনব কিছু নয়, কিন্তু মাছটা হচ্ছে স্টার্জন মাছ, সুতরাং তার পেটের ডিমটা হয়ে গেল ক্যাভিয়ের। ক্যাভিয়ের অতি দুর্মূল্য খাদ্য। মাছটার দাম বড়ো জোর হাজার খানেক টাকা হবে, কিন্তু ক্যাভিয়েরের দাম অন্তত এক লাখ টাকা। জেলেটি মাছটা চিনতে পারেনি, এখন দোকানদারের সৌভাগ্যোদোয় দেখে সেও ডিমের বখরা দাবি করছে। কিন্তু দোকানদারই বা তা দেবে কেন, সে তো কিনেছে পুরো মাছটা।
মনাকোর মতন রাজ্যে এই সবই হচ্ছে বড় খবর।
পার্কে কিছুক্ষণ বসার পর আমরা গাড়িতে পুরো রাজ্যটাই এক চক্কর ঘুরে এলাম। আধ ঘণ্টাও লাগল না, তাতেই একটা দেশ দেখা হয়ে গেল। এর মনাকো ছেড়ে এসে অসীম গাড়ি চালাল সামনের দিকে।
কিছুক্ষণ পর খেয়াল হল, আমরা ইতালিতে ঢুকে পড়েছি। আমি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, এ কী, কী করছ, গাড়ি ঘোড়াও, গাড়ি ঘোরাও।
আমার ইতালিয়ান ভিসা নেই। অন্য তিনজন ইউরোপের যে-কোনও দেশে যখন খুশি যেতে পারে, কিন্তু আমাকে সীমান্তরক্ষীরা ক্যাঁক করে চেপে ধরবে। এর মধ্যে যে একটা চেকপোস্ট পেরিয়ে এসেছি, সেটা লক্ষই করিনি কেউ, ওরাও আটকায়নি। ফেরার পথে আমার বুক দুরদুর করতে লাগল। আমাকে ওরা ধরেটরে রাখবে কি না কে জানে।
কিন্তু খোলা গেট দিয়ে অসীম সোজা গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে এল। সীমান্তরাক্ষীরা রোদ্দুরে চেয়ার পেতে বসে রেড ওয়াইন পান করছে। তারা খোসমেজাজে আছে, কোনও গাড়িই চেক করছে না। অর্থাৎ আমি বিনা ভিসায় অনায়াসে ইতালির মধ্যে চলে যেতে পারতাম।
আজকাল ভিসার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। কিন্তু বজ্র আঁটুনির মধ্যে ফস্কা গেরোও আছে। একবার সুইডেন থেকে নরওয়ে যাওয়ার জন্য ভিসা জোগাড় করতে আমার কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। এখন দেশ ছাড়ার আগে কোন-কোন দেশে যেতে চাই, তা ঠিক করে ভিসা নিয়ে নিতে হয়। বিদেশে বসে হঠাৎ কোনও দেশের ভিসা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভবই বলতে গেলে। সেবারে আমার নরওয়ের ভিসা ছিল না, কিন্তু স্টকহলমে থাকতে থাকতেই অসলো’র একটি বাঙালি ক্লাব আমাকে নেমন্তন্ন করল। কিন্তু যাই কী করে। শেষ পর্যন্ত অসলোর উদ্যোক্তারা সেখানকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ধরে সুইডেনের রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানিয়ে ভিসার ব্যবস্থা করেছিলেন, ভিসার ফি-ও দিতে হল চার পাঁচশো টাকা। সেই ভিসায় সশস্ত্র হয়ে আমি স্টকহলম থেকে ট্রেনে চাপলাম দুপুরবেলা। তারপর সারা দুপুর বিকেল সন্ধে দু-ধারের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে রাত প্রায় দশটার সময় পৌঁছলাম অসলোতে, এর মধ্যে কেউ একবারও আমার পাসপোর্ট দেখতে চায়নি, স্টেশানেও কেউ আটকালো না। সুইডেন-নরওয়ের লোকেরা বিনা ভিসায় প্রতিদিন ট্রেন যাতায়াত করে, তার মধ্যে আমার মতন বিদেশি দৈবাৎ দু’একজন থাকবে কি না, তা নিয়ে বোধহয় কেউ মাথা ঘামায় না। অথচ ভিসা জোগাড় করার কত ঝকমারি।
সুইডেনের ট্রেনের একটি অভিজ্ঞতা আজও মনে পড়ে।
প্রথম দিকে কামরায় অনেকরকম যাত্রী ছিল। একজন অত্যন্ত রূপবান যুবক ও এক প্রৌঢ়া আমার সামনেই বসেছিল, ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তারা ওয়াইন পান শুরু করে দিল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তারা ইঙ্গিতে আমাকে ওয়াইনের একটা গেলাস দিতে চাইল, কিন্তু অচেনা লোকদের কাছ থেকে আমি ওয়াইনে ভাগ বসাতে যাব কেন? আমার প্রত্যাখ্যানে মহিলাটি বেশ চটে গেলেন মনে হল। যুবকটির সঙ্গে মহিলাটির বয়েস তফাত অন্তত পনেরো বছর তো হবেই। যুবকটিকে রাজকুমারের মতন দেখতে বললে অত্যুক্তি হয় না, কিন্তু মহিলাটির মুখে বেশ ভাঁজ পড়ে গেছে, চুল এলোমেলো, একটুক্ষণের মধ্যেই তিনি বেশ মাতাল হয়ে গেলাম। শ্বেতাঙ্গ জাতিদের মধ্যে দেখেছি, একমাত্র সুইডিশরাই প্রকাশ্যে মাতলামি করতে লজ্জা পায় না। মহিলাটির ব্যবহার রীতিমতন বিরক্তিকর, কিন্তু যুবকটি দারুণ ধৈর্যে ও মমতায় মহিলাটিকে সামলাচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে তার ওষ্ঠে চুম্বন করছিল।
এদের দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক তাই-ই আমি বুঝতে পারছিলাম না। এই দুটি চরিত্রকে নিয়ে যেন একটা গল্প লেখা যায়, শুধু ভেতরের কথা একটু জানা দরকার। কিন্তু নেশাগ্রস্ত মহিলাটি এক সময় চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন, একটা স্টেশনে ট্রেন থামতেই যুবকটি তাঁকে নিয়ে নেমে গেল, আমার অজানা রয়ে গেল ওদের গল্পটি।
খানিক বাদে পুরো কামরাটিই খালি হয়ে গেল, উঠল একটা নতুন ছেলে। তাকে আমি গ্রিক বলে ভুল করেছিলাম, পরে বোঝা গেল গেল সে আরবদেশীয়। বাইশ-তেইশ বছর বয়েস, প্যান্টের সঙ্গে কোটটা ঠিক মানানসই নয়। তখন সন্ধে হয়ে গেছে, বাইরে কিছুই দেখার নেই, আমার কাছে কোনও বই-ই নেই। ছেলেটি মুখ তুলতেই তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়।
একবার সে সুইডিশ ভাষায় আমায় কী যেন জিগ্যেস করল।
আমি ইংরিজিতে জানালাম যে আমি সুইডিশ বুঝি না।
তখন সে ভাঙা-ভাঙা ইংরিজিতে জিগ্যেস করল, তুমি কোন দেশের লোক?
আমি ভারতীয় শুনে সে বেশ অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর জিগ্যেস করল, ভারত তো অনেক দূরের দেশ। তুমি সেখান থেকে এসেছ কি চাকরি করবার জন্য?
আমি বেড়াতে এসেছি জেনে সে আরও বিস্মিত হয়ে বলল, সুইডেনে বেড়াতে এসেছ? এখানে দেখবার কী আছে? এ দেশটা অতি বিশ্রী। এখানকার মেয়েরাও বিশ্রী।
এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। সুইডেনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশ্ববিদিত। গ্রেটা গার্বো, ইনগ্রিড বার্গমানের দেশের মেয়েদের কেউ বিশ্রী বলতে পারে, এ যে কল্পনার অতীত। সুইডেনে অসুন্দর কোনও মেয়ে খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।
ছেলেটি আবার মুখ বিকৃতি করে বলল, এ দেশের সব কিছু বিশ্রী। কিচ্ছু ভালো না।
আমি বললাম, তুমিও তো বিদেশি। তা হলে তুমি এ-দেশে আছ কেন?
ছেলেটি বলল, আমার দেশ ইরাক। আমি সেখান থেকে পালিয়ে এসেছি।
আমার মনে হল, এই ছেলেটিও একটি গল্পের চরিত্র। আগেকার যুবক ও প্রৌঢ়ার কাহিনিটি জানা হয়নি, এই যুবকটি সম্পর্কে আমি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম।
কিন্তু শেষপর্যন্ত না জানা গেল, তা গল্প নয়, একটি বিভ্রান্তিকর করুণ কাহিনি।
ছেলেটি আমাকে জিগ্যেস করল, তুমি জানো, আমাদের দেশের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ চলছে? যুদ্ধটা কেন হচ্ছে তুমি জানো?
সেই সময় ইরান ও ইরাকের মধ্যে ঘোরতর লড়াই চলছিল। দুটোই ইসলামিক আরব দেশ, সিয়া-সুন্নির বিভেদের জন্য তারা পরস্পরের ওপর কেন বোমাবর্ষণ করছে, তা আমার বুদ্ধির অগম্য।
ছেলেটি জানাল, তার বাড়ি ছিল বাগদাদ থেকে সত্তর মাইল দূরে। তাদের গ্রামের ওপর গোলাবর্ষণ হয়। তার এক ভাই যুদ্ধে যোগ দিয়ে মারা গেছে। দেশে থাকলে তাকেও যুদ্ধে যোগ দিতে হত, তাই সে পালিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে সুইডেনে। এখানে অবশ্য তাকে এখন একটা কারখানায় কাজ করতে হয়। তার একটা সুইডিস বান্ধবীও জুটেছে। কিন্তু সুইডিস মেয়েদের তার পছন্দ নয়, কারণ, সবাই তাকে পড়াশুনো করতে বলে সব সময়। তাকে শিক্ষিত করতে চায়।
ছেলেটি খুব সরল ধরনের। সে বলল, তুমি ইরাকে বেড়াতে যাও, আমার গ্রামের
ঠিকানা দেব, দেখে এসো, কী সুন্দর সেই গ্রাম। সুইডেনের চেয়ে অনেক ভালো। আমার খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেখানে। কিন্তু ফিরলেই আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। যে যুদ্ধ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, কেন যুদ্ধ চলছে তাও জানি না, সেই যুদ্ধে যোগ দিতে আমি মরতে যাব কেন?
ছেলেটির চোখ ছলছল করে উঠল। ইরাকের গ্রাম তাকে টানছে। কিন্তু সেখানে তার ফেরার উপায় নেই। এক অদ্ভুত যুদ্ধ তাকে দেশত্যাগী হতে বাধ্য করেছে।
আমাদের পাশের বাংলাদেশের ওপর অনেক যুদ্ধবিগ্রহ গেছে, কিন্তু পশ্চিমবাংলায় আমরা কখনও যুদ্ধের আঁচ তেমনভাবে অনুভব করিনি। ছেলেটিকে দেখে আমার অসম্ভব মায়া হচ্ছিল। আমার মতন অচেনা এক বিদেশিকেও সে ব্যাকুলভাবে যার বার জিগ্যেস করছিল, এই সব যুদ্ধ কেন হয় বলো তো? কেন শুধু শুধু আমি যুদ্ধে গিয়ে মরব? কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর আমি আর কী দেব! বড় বড় রাষ্ট্রনায়ক, যারা যুদ্ধ বাধায়, তাদের মনে কি একবারও এই সব প্রশ্ন আসে না!