কিয়েভে এসে প্রথম ওভারকোট খুলে ফেলতে পারলুম। ফুরফুরে বাতাসে বেশ উপভোগ্য ঠান্ডা, একটা পাতলা গরম জামা গায়ে দিলেই চলে যায়। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এখানে প্রকৃতই বসন্ত। মে মাসের ৯ তারিখ এখানে জাতীয় বিজয় দিবসের ছটি, সমস্ত অফিস কাছারি বন্ধ, পথে পথে উৎসব-মনা নারী-পুরুষের ভিড়। রাস্তায় পা দিলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। এমন ‘‘ফুল্ল-কুসুমিত মদল শোভিনী’ শহর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যে দিকে তাকাই সেদিকেই পার্ক চোখ পড়ে। রাস্তাগুলি চড়াই-উতরাই। দু’পাশের বাড়িগুলিও সুদৃশ্য এবং মিউজিয়ামের সংখ্যাও প্রায় অগুন্তি। কোনটা ছেড়ে যে কোনটাকে দেখি তা-ই ঠিক করতে পারি না।
আজ ছুটির দিন বলে আমাদের কোথাও কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর বেড়াতে বেড়াতে গিয়ে আমরা কিছুক্ষণ বসে রইলুম একটা পার্কে। মস্ত বড় বড় গাছ, নানারকমের ফুল, মাঝে মাঝে চমৎকার ভাস্কর্য। ছুটির দিন বলে অনেক লোক এসেছে, কিন্তু কোনও গোলমাল নেই, বেশ শান্ত নির্জন পরিবেশ।
আমি খুব একটা প্রকৃতিপ্রেমিক নই। উদ্যানের চেয়ে অরণ্য আমাকে বেশি টানে। শোভার চেয়ে রহস্যময়তা। তবে ‘দা সিক্রেট লাইফ অফ প্ল্যান্টস’ নামে একটি বই পড়ার পর সব গাছপালাকেই শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি। যে-কোনও বড় বৃক্ষের সামনে দাঁড়ালেই মনে হয় সেই মহাম আমার আপাদমস্তক লক্ষ করছেন।
পার্কটি একটি উঁচু টিলার ওপর। যেখানটা সবচেয়ে উঁচু, সেখান থেকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ উপত্যকা, তার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নিপার নদী। বিশ্ববিখ্যাত নদীগুলির মধ্যে এই নদী একটি।
অন্যান্য শহরের নদী দেখিয়ে সারগেই আমাকে জিগ্যেস করেছে, এই নদী কি আপনাদের গঙ্গার চেয়ে বড়?
প্রত্যেকবারই আমি বলেছি, না হে, সারগেই ভায়া, নদী দেখিয়ে আমাকে চমকানো খুব শক্ত। আমি নদী নালার দেশেরই মানুষ। তুমি তো পদ্মা কিংবা ব্রহ্মপুত্র দ্যাখোনি!
নিপার নদী দেখে আমার মুগ্ধতা স্বীকার করতেই হল। শুধু বিশাল নয়, এই নদীর একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।
সারগেই বলল, চলুন, আমরা নিপার নদীতে বেড়াতে যাই।
অতি উত্তম প্রস্তাব। একটা বাস ধরে আমরা চলে এলুম স্টিমার ঘাটায়। এখানে অনেকগুলি সুদৃশ্য স্টিমার বা বড় মোটরবোট রয়েছে, প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর ছাড়ে। বহু লোক এসেছে আজ এখানে ছুটি কাটাতে। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে আমরা একটি বোটে চড়ে বসলুম।
বোটটি বেশ চওড়া, ভেতরে বসবার বন্দোবস্তও বেশ ভালো। কিন্তু ভেতরের পরিবেশটি তেমন জমজমাট নয়, চালকের কেমন যেন একটা দায়সারা ভাব। আমস্টারডাম, প্যারিসে আমি এরকম জলযানে নদী ভ্রমণ করেছি, সেখানে গাইডরা নানারকম ঠাট্টা-রসিকতা করতে করতে দু-পারের দৃশ্য দেখায়, সেইসঙ্গে ইতিহাস শুনিয়ে দেয়। যাত্রীরাও অনেক কৌতুক করে, সময়টা যে কোথা থেকে কেটে যায় তা বোঝাই যায় না। এখানেও সেই রকম কিছু আশা করেছিলুম। নদী পরিভ্রমণের ব্যবস্থা যখন আছেই, তখন আয়োজনটি সর্বাঙ্গসুন্দর করাই উচিত।
বোটটি ছাড়ামাত্র তীব্র বেগে চলতে লাগল। এত দ্রুত গতি ঠিক যেন ছুটির দিনের মেজাজের সঙ্গে খাপ খায় না, বাইরের দৃশ্যও ভালো করে দেখা যায় না।
কিয়েভ শহরটি সারগেই-এর আগে থেকেই চেনা, সে আমাকে ধারাভাষ্য দিয়ে যেতে লাগল। নদীর ডানপাশটি বেশি সবুজ ও বেশ উঁচু, সেখানে দেখতে পেলুম একটি টিলার ওপর সুবিশাল একটি মূর্তি। কিন্তু বোটের প্রচণ্ড গতির জন্য সেটিকে প্রাণভরে দেখা গেল না, ছবি তোলারও সুবিধে হল না।
নদীর অন্যদিকে চোখে পড়ে একটি সদ্য গড়ে ওঠা উপনগরী। অসংখ্য ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে।
নিপার নদীর সঙ্গে পদ্মার খানিকটা মিল আছে। কোথাও কোথাও এই নদী খুব চওড়া হয়ে গেছে এবং মাঝখানে চড়া পড়েছে। ঝোঁপঝাড় ও গাছপালাও গজিয়ে গেছে সেইসব চড়ায়। ছোট ছোট নৌকো নিয়ে অনেকে সেই চড়ায় এসেছে পিকনিক করতে। সেই দৃশ্য দেখে লোভ হয়, ওরকম কোনও জায়গায় নেমে পড়ি, কোনও একটা পিকনিক পার্টির সঙ্গে যোগ দিই।
আমি সারগেইকে জিগ্যেস করলুম, এখানকার লোক কি নিজস্ব নৌকো রাখতে পারে? এরকম ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার নিয়ম আছে?
সারগেই বলল, কেন নৌকো রাখতে পারবে না? ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানে কী? আমার জামাটা একটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আমার উপার্জন দিয়ে আমি একটা গাড়ি বা নৌকো কিনতে পারি, সেটা আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আমার বাড়ির সামনে যদি খানিকটা জমি থাকে, সেখানে আমি আলু পেঁয়াজের চাষ করে তা বাজারে বিক্রি করতে পারি। আমি যদি নিজে কোনও মেশিন বানাই, তাহলে বাড়িতে সেই মেশিন বসিয়ে কিছু উৎপন্ন করার অধিকারও আমার আছে। কিন্তু আমি আর তিন-চারজন লোককে খাটাতে পারি না। কারণ, অপরের শ্রম থেকে লাভ করার অধিকার কারুর নেই। যে-পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভালো চাকরি করে, তারা টাকা জমিয়ে অনায়াসেই একটা গাড়ি বা নৌকো কিনতে পারে।
নদীর চড়ায় এরকম শত শত পিকনিকের দল দেখতে পেলুম। কেউ কারুর কাছাকাছি নয়, সবাই আলাদা আলাদা জায়গা খুঁজে নিয়েছে।
ভালো করে দেখবার জন্য আমি দু-একবার ওপরের ডেকে এসে দাঁড়াবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু এমন হুহু হাওয়া যে সেখানে এক মিনিট তিষ্ঠোবার উপায় নেই, মনে হয় যেন হাতের আঙুলগুলো জমে যাচ্ছে, ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে নাকের ডগাটা।
এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের মোটরবোট অনেকখানি এলাকা চক্কর দিয়ে ফিরে এল ঘাটে। এইরকম ভ্রমণও অনেকের কাছে ভালো লাগতে পারে, কিন্তু এমনভাবে নদী দেখা আমার মনঃপূত নয়। ইচ্ছে রইল, আবার কোনও একদিন নিপার নদীর কাছে ফিরে এসে একটা পালতোলা নৌকোয় বেড়াব।
আজ এখানে জাতীয় ছুটির দিন বলে অনেক দোকানপাটই বন্ধ। আমাদের হোটেলের বেশ কিছু কর্মচারীও ছুটি নিয়েছে। ঠিক সময়ে না গেলে খাবারদাবার পাওয়া যাবে না। দুপুরবেলা একটু দেরি করে এসে আমরা আহার্য পছন্দ করার কোনও সুযোগ পাইনি। তাই সন্ধে হতে না হতেই আমরা গিয়ে বসলুম ডাইনিং হলে।
হোটেলে এখন প্রচুর বিদেশি ভ্রমণকারীর ভিড়। সোভিয়েত সরকারের ‘ইন টুরিস্ট’ নামে দপ্তর এখন বাইরে থেকে বহু টুরিস্টদের আসবাব জন্য নানারকম সুযোগসুবিধে দিচ্ছে এবং টুরিস্টদের সবদিক ঘুরিয়ে দেখাবারও ব্যবস্থা করেছে। টুরিস্টদের মধ্যে আমেরিকানই বেশি।
আমাদের পাশের টেবিলে একজন প্রৌঢ় বিদেশি একা একা বসে খাচ্ছিলেন, এক সময় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ইংরেজি বলতে পারো?
আমি হেসে ঘাড় নেড়ে বললুম, একটু একটু।
প্রৌঢ় বিদেশিটি বললেন, তোমাদের টেবিলে যোগ দিতে পারি?
অজানা কোনও শহরে গিয়ে হোটেলে বসে-বসে একা একা খাবার খাওয়া যে কী বিড়ম্বনার ব্যাপার সে অভিজ্ঞতা আমার আছে। আমি সাগ্রহে তাঁকে আমাদের টেবিলে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালুম।
ইনি কানাডিয়ান, এসেছেন তীর্থ দর্শনে। শ’খানেক বছর আগে এঁর পূর্বপুরুষ এই ইউক্রাইন থেকেই পাড়ি দিয়েছিলেন কানাডায়। ইনি এসেছেন তাঁর প্রাক্তন মাতৃভূমি (অথবা পিতৃভূমি) পুনর্দর্শনে।
আমি কানাডায় গিয়ে শুনেছিলুম যে এডমান্টন ও ক্যালঘেরি শহরের মাঝামাঝি কোথাও ইউক্রাইনিয়াদের বিরাট বসতি আছে। সেইজন্য আন্দাজে ঢিল মেরে জিগ্যেস করলুম, আপনি কি এডমন্টনের কাছাকাছি কোথাও থাকেন?
ভদ্রলোক প্রায় লাফিয়ে উঠে বললেন, তুমি এডমান্টন চেনো? গিয়েছ সেখানে? কবে গিয়েছিলে?
বেশ গল্প জমে গেল। এই ভদ্রলোক কানাডার কিছু ভারতীয়কে চেনেন, তাঁদের নাম বললেন, আমি অবশ্য তাঁদের একজনকেও চিনি না।
সারগেই যে-কোনও কারণেই হোক, এই লোকটিকে বেশি পাত্তা দিল না। আমি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পরেও সে চুপ করে রইল। এই লোকটি দু-তিনটি ইউক্রাইনিয়ান গান শোনাবার চেষ্টা করে সারগেইকে জিগ্যেস করলেন, তুমি এই গানগুলি জানো?
প্রায় একশো বছরের পুরোনো অপ্রচলিত গান, সারগেই জানবে কী করে? ইনি ইউক্রাইনিয়ান ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলে সারগেই উত্তর দিল ইংরিজিতে, সম্ভবত ওই ভাষাও তার বোধগম্য নয়।
রাত্তিরের দিকে আবার শহরটা খানিকটা ঘুরে এসে সারগেই আর আমি গেলুম যে-যার ঘরের দিকে। রাত্তির মোটে দশটা, এরই মধ্যে হোটেলটি প্রায় নিঃশব্দ! অনেক আলো নিবে গেছে।
হোটেলের প্রত্যেক ফ্লোরে একজন মহিলা থাকেন, যাঁর কাছে চাবি জমা থাকে। বেশির ভাগ হোটেলেই দেখেছি বৃদ্ধারাই এই কাজ করেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সকলেই সরকারের কাছ থেকে বার্ধক্যভাতা পায়। অতিরিক্ত রোজগারের জন্য বুড়োবুড়িরা আবার পার্টটাইম চাকরিও নিতে পারেন। ঘর ঝাঁট দেওয়া, রাস্তা পরিষ্কার করা, হোটেলে রাত্তিরের ডিউটি, এইসব কাজেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখতে পাওয়া যায় বেশি। এক-এক সময় একটু নিষ্ঠুর লাগে, শরীরিক পরিশ্রমের কাজেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের লাগানো হয় দেখে। শুধু সোভিয়েত দেশেই নয়, অন্যান্য অনেক পাশ্চাত্য দেশেই এই অবস্থা। উপায়ই বা কী? সকলেই যদি শিক্ষার সুযোগ পায়, মোটামুটি শিক্ষা লাভের পর সকলেই যদি চাকরি পেতে পারে, তাহলে বাথরুম পরিষ্কার, হোটেলে বাসন মাজার কাজের লোক পাওয়া যাবে কী করে? একজন অফিস কর্মচারী আর একজন নর্দমা পরিষ্কারকের মাইনে সমান হলেও সবাই চাইবে অফিসের কাজটাই নিতে। জোর করে কারুর ওপর কোনও কাজ চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সোভিয়েত দেশের নতুন সংবিধানেও প্রত্যেক নাগরিকেরই চাকরি নির্বাচনের অধিকার আছে। একমাত্র বুড়োবুড়িদের জন্যই ভালো চাকরির সুযোগ বেশি নেই।
আজ হোটেলের অনেকেই ছুটি নিয়েছে, কিন্তু আমার ফ্লোরের এই বৃদ্ধা রাত জেগে বসে একটা বই পড়ছেন।
ইংরেজি বলে কোনও লাভ নেই, তাই আমি হাত বাড়িয়ে চাবিটা নিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললুম, কেমন আছ, দিদিমা? তোমার কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো? বাড়িতে তোমার জন্য কেউ প্রতীক্ষা করে নেই তো?
দিদিমাও হেসে ফেলে তাঁর ভাষায় কী যেন সব বলে গেলেন, তার মধ্যে একটা শব্দ যেন ‘শুভমস্তু’র মতন শোনাল। যেন উনি আমাকে আশীর্বাদ করছেন।