শ্ৰীমতী এলজবিয়েটা ভালটারোভা’র সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কলকাতাতেই। এই তরুণটি বাংলা সাহিত্য ও ভারততত্ব নিয়ে পড়াশুনো করতে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। মাঝখানে একদিন কলকাতায় এসে অতি শিশুকন্যা ও স্বামীকে নিয়ে আমার বাড়িতে এক সন্ধ্যায় বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে গিয়েছিলেন। সে প্রায় বছর দশেক আগের কথা, তবু মনে আছে এই জন্য যে পোল্যান্ডের এই তরুণীটি বাংলা শব্দগুলি উচ্চারণ করছিলেন খুব সযত্নে এবং তাঁর পরনে ছিল একটা আগুন-লালবর্ণ শাড়ি। দেশে ফিরে এলজবিয়েটা আমাকে দু-তিনবার চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি আর যোগাযোগ রাখিনি, এখানে আসার আগে তাঁকে কোনও খবরও দিইনি, কারণ, এই ধরনের সুচারু কাজকর্ম করা আমার স্বভাবে নেই। ওয়ারশ পৌঁছবার দ্বিতীয় দিনে আকুমল যখন বলল আজ রাত্তিরে অধ্যাপিকা এলজবিয়েটা ভালটারোভার বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন, তখন আমি চমকে উঠলাম। আকুমল আরও বলল, উনি আপনাকে চেনেন, আপনি আসছেন এই খবর আমার মুখে শুনে তিনি আজ সন্ধেটি বুক করেছেন। যেতে হবেই। আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।
উপহার হিসেবে কিছু ফুল নিয়ে যাওয়ার জন্য আকুমল আমাদের নিয়ে গেল একটা দোকানে। রুমানিয়াতে যেমন সর্বত্র সব দোকানের সামনে লাইন দেখেছি, ওয়ারশতে সে রকম চোখে পড়ে না। এখানে খাদ্যদ্রব্যের অভাব প্রকট নয়। কিন্তু ফুলের দোকানে লাইন। নিছক ফুল নয়, ফুলকে সাজাবার কায়দা পোল্যান্ডে একটি উচ্চাঙ্গের আর্টের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এমনভাবে এই সব দোকানে বিভিন্ন রঙের ফুলের গুচ্ছ বেঁধে দেয়, মনে হয় যেন ছবি। ফুল উপহার দেওয়া এখানে জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। সোভিয়েত ইউনিয়নেও এমন দেখেছি। আমেরিকাতে ফুলের এত কদর নেই, প্রাচ্য দেশেও তেমন নেই। আমাদের দেশে মৃতদেহের ওপর ফুলের তূপের অপচয় দেখলে গা জ্বালা করে।
যেতে হবে বেশ দূরে। আকুমল আগে থেকে একটি ট্যাক্সি ঠিক করে রেখেছিল। আকুমল এ দেশে অনেকবার এসেছে, ট্যাক্সি ড্রাইভারটি তার পূর্ব পরিচিত, বন্ধু পর্যায়ের। তাঁর নাম ইভান, তিনি একজন ভূতপূর্ব মাইক্রোবায়োলজিস্ট, তাঁর স্ত্রী একজন সাইকোলজিস্ট। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের এমন বিদ্যাবত্তার পরিচয় জেনে কিন্তু আমার মনে শ্রদ্ধা জাগে না, বরং বিরক্ত বোধ করি, শিক্ষার এই অপচয় আমার সহ্য হয় না। হাঙ্গেরিতেও এমন দেখেছি। বেশি টাকা রোজগারের জন্যই এঁরা নিজেদের পেশা ছেড়ে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন তা বুঝি। কিন্তু একটা দেশের শাসনব্যবস্থা কেন এমন হবে, যাতে যারা উচ্চ শিক্ষা পেয়েছে, তারা তা প্রয়োগ করতে পারবে না?
ছোটোর মধ্যেও এলজবিয়েটার ফ্ল্যাটটি বেশ ছিমছাম সুন্দর। এলজবিয়েটার স্বামী একজন শিল্পী, মাটি দিয়ে তিনি এক ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণ করছেন, যা একেবারে নতুন ধরনের। শান্তিনিকেতনে এসে এক বাঙালি শিল্পীর কাছে তিনি মাটির কাজ শিখেছিলেন, তার সঙ্গে নিজস্ব রীতিতে তিনি ভারি চমৎকার একটা ধারা তৈরি করেছেন। এই বিভিন্ন মৃত্তিকা-ভাস্কর্য দিয়ে ঘরগুলি সাজানো বলে অন্যরকম একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
এলজবিয়েটার বয়েস বেশি নয়, যখন তিনি বাংলা বলেন, তখন তাঁর কণ্ঠস্বরটি একেবারে বাচ্চা মেয়ের মতন শোনায়। তিনি সত্যজিৎ রায়ের বই পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করেছেন, এখন করছেন মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’। বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর কৌতূহলের অন্ত নেই। যেহেতু বইপত্র বেশি পান না, তাই তিনি আমাকে নানান প্রশ্ন করছিলেন। এখানে যে-কোনও আলোচনায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদলের প্রসঙ্গ আসবেই। অন্যরা সেই আলোচনায় মেতে ওঠে। এলজবিয়েটার রাজনীতিতে তেমন আগ্রহ নেই, শুধু দু-একবার বললেন, ওঃ, যা সব দিন গেছে না! সব চুকেবুকে গেছে, বেঁচেছি! এখন প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারছি, এইটাই বড় কথা। এখন ইচ্ছে মতন কাজ করতে পারব।
এদিককার বিভিন্ন দেশে এ রকম কথা অনেকবার শুনতে হয়েছে। যতবার শুনি, আমার একটু একটু মন খারাপ লাগে। সাম্যবাদ বা সমাজবাদ, যার প্রতিশ্রুতি ছিল সমস্ত মানুষের ঐক্য এবং সমান অধিকার, সেখানেও কেন সামান্য কিছু লোক গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষকে প্রায় একটা বন্দিদশায় রেখেছিল, কেন একটা দম বন্ধ আবহাওয়ার সৃষ্টি করছিল? এই আদর্শ-বিচ্যুতির মূল কোথায়? মানুষের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্যে?
পরদিন আমরা দেখতে গেলাম ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারততত্ব বিভাগ। এখানে হিন্দি ও বাংলার ক্লাস হয়। ভারততত্ব বিভাগের প্রধান হলেন অধ্যাপক বিরস্কি, যিনি অবিলম্বেই দিল্লিতে পোল্যান্ডের দূতাবাসের কালচারাল ফার্স্ট সেক্রেটারি হয়ে যাচ্ছেন। এলজবিয়েটা বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা, নানা কলেজের অনেকগুলি ছাত্র-ছাত্রী। আমরা ক্লাসরুমে গিয়ে ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ বসে আলাপ পরিচয়, সাহিত্য বিষয়ে প্রশ্নোত্তর, কবিতা পাঠে অংশগ্রহণ করলাম। এমন নির্মল আনন্দ বহুদিন পাইনি। এতদূর বিদেশে বাংলা ভাষা সম্পর্কে এত মানুষের আগ্রহ দেখলে আমাদের তো আনন্দ হবেই। আমার মাঝে-মাঝে বুখারেস্টের অমিতা বসুর কথা মনে পড়ছিল। সেখানে বাংলা-হিন্দির রেষারেষিতে দুটি বিভাগই উঠে গেল। এখানে সে রকম কোনও পরিবেশ নেই। পোল্যান্ডের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনেকেই ভারত সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী।
অনেককাল আগে আমি হিরন্ময় ঘোষাল নামে একজন লেখকের ‘কুলটুর কামপফ’ নামে একটি বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। হিটলারের রচনা ‘মাইন কামফপ’-এর ঠাট্টায় বইটির নাম, অর্থাৎ ‘সাস্কৃতিক লড়াই’, আসলে সেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতিকথা। ভাষা চমৎকার, দারুণ লেখা। সে বই এখন আর বোধহয় পাওয়া যায় না। বইটা পড়ে আমি শুধু জানতাম যে হিরন্ময় ঘোষাল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পোল্যান্ডে চাকরি করতেন, যুদ্ধের ডামাডোলে তাঁকে পালাতে হয়। এখানে এসে জানলাম, তিনিই ওয়ারশ বিদ্যালয়ে প্রথম বাংলা বিভাগ চালু করেন, তাঁর স্মৃতিতে অফিস-কক্ষটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ঘোষাল রুম।’
পোল্যান্ডের আর একজন লেখকও আমার বন্ধু। তাঁর নাম ক্রিস্তফ জারজেস্কি। ইনি ঠিক লেখক নন, অনুবাদক। এক সময় আমেরিকার আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ক্রিস্তফ আর আমি শুধু সতীর্থ নয়, ছিলাম একই বাড়িতে প্রতিবেশী। আমার বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে ক্রিস্তফেরও বন্ধুত্ব ছিল, ক্রিস্তফের ঘরে আমরা অনেক আড্ডা দিয়েছি। এখানে খোঁজ করে জানলাম, ক্রিস্তফ শহরে নেই, সে আমেরিকা চলে গেছে। সেখানেই সে থাকবে। আমেরিকার মোহিনী মায়া কতজনকে যে টানে! পোল্যান্ডে এসে অবশ্য ডলার-লোভীদের ফিসফিসানি তেমন শুনতে পাইনি পথেঘাটে। অথচ আগেকার ভ্রমণকারীরা সকলেই ‘ডলার, ডলার, চেইঞ্জ মানি!’ এই ফিসফিসানি ও দালালদের উৎপাতের কথা লিখে গেছেন। এখন তা বন্ধ দেখে প্রথম একটু অবাক হয়েছিলাম, পরে জানলাম, নতুন সরকার ব্ল্যাক মার্কেট রেটটাকেই মেনে নিয়ে বাস্তব অবস্থার স্বীকৃতি দিয়েছেন। অর্থাৎ এখন ব্যাঙ্ক থেকেই ডলার ভাঙিয়ে অনেক বেশি জলোটি পাওয়া যায়। কিছু কিছু দালাল এখনও রাস্তায় ঘোরাফেরা করে, বোধহয় পুরোনো অভ্যেসবশত, কিন্তু তাদের কেউ আর পাত্তা দেয় না।
সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ মোটামুটি একই রকম। কৃষির বদলে যন্ত্রপাতি উৎপাদনের দিকে অত্যধিক ঝোঁক, বিশ্বের বাজারে সেগুলি রফতানি করতে গিয়ে অন্যান্য দেশগুলির সঙ্গে সব সময় পাল্লা দিতে পারেনি। পশ্চিমের বাজারে চাহিদা কমে গেলে উৎপন্ন দ্রব্যগুলি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কল-কারখানাগুলির সম্প্রসারণের জন্য ঋণ নিতে হয়েছে বৈদেশিক ব্যাংক থেকে, পোলন্ডে এক সময় এই ঋণের বোঝা দাঁড়িয়েছিল সাতাশ বিলিয়ন ডলার। তখন সেই ঋণ শোধ দেওয়ার জন্য দেশের খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্য বিক্রি করতে হয়েছে বাইরে, তার ফলে দেশের মানুষের পেটে টান পড়েছে। টাকার অভাবে কল-কারখানাগুলির আধুনিকীকরণও হয়নি, তাতে সেগুলি রুগ্ন হয়ে পড়েছে একে একে। জীবনযাত্রার মান নেমে যাওয়ায় ক্ষোভ জমেছে মানুষের মনে। এরই মধ্যে শ্রমিকদের মধ্য থেকে সলিডারিটির উত্থান হওয়ায় তা সর্বশ্রেণির মানুষের সমর্থন পায়।
শাসকদল বদলের পর পোল্যান্ডের মানুষ যেন অনেককাল পরে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এর মূলে যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি পুরোপুরি অবিশ্বাস রয়েছে তা হয়তো নয়। মূল কারণ বোধহয় তীব্র স্বাজাত্যাভিমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের তাঁবেদারি থেকে মুক্তিই যেন বড় কথা। পৃথিবীর সর্বত্রই এরকম একটা মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী আর মিলিত হয়ে থাকতে চাইছে না, বড় দেশগুলি টুকরো টুকরো হতে চলেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে এই বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রবণতা, যেমন আমাদের ভারতেও। যুক্তি থাক বা না থাক, পৃথিবীর সমস্ত ভাষার মানুষই যেন নিজস্ব খালিস্থান চায়। বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব নিছক আজগুবি ধারণা?
এই স্বাধীনতাবোধের মধ্যে এমনই জাদু আছে, যা কিছুদিনের জন্য অনেক অভাব অভিযোগও ভুলিয়ে দেয়। পোল্যান্ডের অনেক কিছুর অভাব আছে, ভবিষ্যতে অর্থনীতি কীভাবে চাঙ্গা হবে তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে, কিন্তু বর্তমানের অনটন সবাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে, কারুর মুখে বিরক্ত ভাব নেই, যেমন দেখেছি, রুমানিয়ায়। ওয়ারশ’র জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক ও সুশৃঙ্খল। ক্ষমতা বদলের সময় এখানে রক্তপাত হয়নি, তাই আর যখন-তখন হিংসা কিংবা অস্ত্র ঝিলিক দেয় না।
আকুমলের সঙ্গে আমাদের রোজ কোপারনিকাসের মূর্তির পাদদেশে দেখা হয়। তারপর আমরা টো টো করে ঘুরি, দেখা করি বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে। একদিন গেলাম চিটেলনিক নামে এক প্রকাশন সংস্থায়। চিটেলনিকের বেশ সুনাম আছে প্রকাশক হিসেবে। আকুমলের লেখা একটি ছোটদের বই এঁরা প্রকাশ করছেন। এই সংস্থার প্রধান জেকফি সিটো’র সঙ্গে আলোচনা হল অনেকক্ষণ। ভারতের অন্যতম মুখ্য প্রকাশক হিসেবে বাদল বসু অনেক তথ্য বিনিময় করলেন তাঁর সঙ্গে। জেকফি সিটো নিজে একজন নাট্যকার, শেকসপিয়রের অনেক নাটক অনুবাদ করেছেন। তিনি সম্প্রতি এই সংস্থার ভার নিয়েছেন, অনেক ধরনের বই প্রকাশের পরিকল্পনা আছে তাঁর। কিন্তু কাগজের অভাবে ছাপা শুরু করা যাচ্ছে না। কাগজের অভাবের জন্যও তিনি খুব ক্ষুব্ধ নন, বললেন, নতুন সরকারি নীতি এখনও ঠিক মতন গড়ে ওঠেনি, তাই এই সময়টা কিছুদিন তো অসুবিধে থাকবেই।
অনেকের মুখেই এরকম কথা শুনি, তবু মনে প্রশ্ন জাগে, এইসব দেশগুলির ভবিষ্যৎ রূপ কী হবে? আপাতত সকলে গণতান্ত্রিক অধিকার, অবাধ ভোট, বিরোধী দল গড়ার স্বাধীনতা পেয়েই খুশি। এরই নাম স্বাধীনতা। কিন্তু গণতন্ত্রে ফিরে এসে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সব কিছুই কি বর্জন করা হবে? মানুষের ইতিহাসে গণতন্ত্রের পরবর্তী ধাপই কি সমাজতন্ত্র নয়? সকলের স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করার অধিকারের পরেই তো আসে সকলের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবিকার সমান সুযোগ। ইতিহাস কি এক পদক্ষেপ সামনে ফেলে আবার পিছিয়ে আসে?
জানুসির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, একদলীয় শাসনে কিছু কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে সমাজতন্ত্রের বিকৃতি ঘটেছে, সাধারণ মানুষের ওপর জোর জবরদস্তি খাঁটিয়ে, ব্যক্তি-মানুষকে অগ্রাহ্য করে, শিল্প-সাহিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ রোধ করার জন্য অনেক নিয়ম-কানুন চাপিয়ে সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্যটাই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তা হলেও সমাজতন্ত্রের আদর্শটিকে কি ব্যর্থ বলা যায়? ভুল প্রয়োগে কি মূল বিষয়টিকে নস্যাৎ করা চলে? সমাজতন্ত্র নিশ্চয়ই অন্য কোনও রূপ নিয়ে ফিরে আসবে।
জানুসি জিগ্যেস করেছিলেন, কী রূপ?
আমি বলেছিলাম, তা ঠিক জানি না। নিশ্চিত কোনও পরিচ্ছন্ন রূপ। সর্বজনগ্রাহ্য কোনও মানবিক রূপ, সোসালিজম উইথ এ হিউম্যান ফেস।
জানুসি ঈষৎ বিদ্রুপের সুরে বলেছিলেন, হিউম্যান ফেস-এর তো নানারকম মুখোশও হয়। চমৎকার সব মুখোশ। আবার সুযোগ দিলেই ওরা মানব দরদীর মুখোশ পরে এসে ক্ষমতা দখল করে যথেচ্ছাচার চালাবে। স্টালিনের আমলে তাকেও তো মহান আদর্শবাদী বলা হত, কিন্তু সেই স্টালিন পাঁচ কোটি মানুষকে হত্যা করিয়েছে।
এইসব দেশে এখন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতি তুলনা ও তর্ক-বিতর্ক সব জায়গায় চলছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিদারুণ ক্ষতচিহ্নগুলি এখনও চতুর্দিকে ছড়ানো বলে সবাই গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার পক্ষে। পরপর এতগুলি দেশ সমাজতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করল, তার কারণ সর্বত্রই এই একই নজির। এক পার্টির শাসনে পার্টি সদস্যরা হয়ে যায় সর্বেসর্বা, তারা অনেকরকম সুযোগ-সুবিধার অধিকারী, অন্যরা বঞ্চিত হয় হোক। পার্টির উঁচু মহলের কর্তারা আজীবন ক্ষমতা দখল করে থাকে, তাদের নড়ানো যায় না, শ্রমিকরা পায় না কল-কারখানার নীতি নির্ধারণে কোনও ভূমিকা, যুবসমাজ পায় না সমাজ পরিচালনার কোনও অধিকার। উঁচু মহলের কর্তারা এমনকি ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাজা-মহারাজার মতন বাড়িয়ে গেলেও বাধা দেওয়ার কোনও উপায় নেই। হো-চি-মিন-এর মতন আদর্শ নেতা যেন নিছক ব্যতিক্রম, বাকি সকলেই গোপনে গোপনে বিলাসী ও ভোগী। শুধু চাউসেস্কুকে একা দোষ দেওয়া হবে কেন, আরও অনেকের এই স্বরূপ এখন উদঘাটিত।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন রাষ্ট্রীয়করণের ফলে কেউই আন্তরিক শ্রম দিতে চায়। প্রতিযোগিতা নেই বলে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার অধিকার চলে যাওয়ায়, সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের সম্পত্তিকে আপন মনে করে না। প্রতিযোগিতা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি, নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্কের মতনই, ভূমির ওপর আকর্ষণও অতি ব্যক্তিগত। সূচ্যগ্র মেদিনী আজও স্বেচ্ছায় ছাড়তে চায় না কেউ।
অর্ধ শতাব্দী ধরে সমাজতন্ত্রের পরীক্ষাতে দেশ ও জাতির সীমা মুছে দেওয়া গেল না। এমনকী সমাজতন্ত্রের বর্ণবৈষ্যমও কি ঘোচানো গেছে? দিকে দিকে ফুঁসে উঠেছে বিচ্ছিন্নতাবাদ। সম্পূর্ণ শোষণমুক্ত, শ্রেণিহীন সমাজ কি শুধুই একটা সুন্দর স্বপ্ন? ইউটোপিয়া? একে বাস্তবে সার্থক করার ক্ষমতা মানুষের নেই? মানুষের চরিত্রের অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য, সমভ্রাতৃত্ব ও স্বার্থপরতার লড়াই চলতেই থাকবে?
বয়স্ক-নেতৃত্ব সুবিধাবাদকে আঁকড়ে ধরে, তারা কথার ফুলঝুরি দিয়ে সাধারণ মানুষের মন ভোলায়, মঞ্চের ওপর উদ্দীপ্ত ভাষণের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কোনও মিল থাকে না, তাদের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাদের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার লালসা আর সব কিছুকে তুচ্ছ করে দেয়। কিন্তু কৈশোর-তারুণ্যের সময় অনেকটাই খাঁটি আদর্শবাদী থাকে। আদর্শের জন্য তারা যে-কোনও মুহূর্তে জীবন দিতেও ইতস্তত করে না। যে-বয়সে জীবন সবচেয়ে মূল্যবান, সেই বয়েসেই মানুষ মাথা উঁচু করে মৃত্যুর দিকে যেতে পারে। সারা দেশে অনাচার, বৈষম্য ও দুর্নীতি দেখে ফুসে ওঠে তরুণ সমাজ, একটা বিপ্লবের ডাক শুনলে তারা সব তুচ্ছ করে বেরিয়ে আসে, নিজেদের প্রাণের বিনিময়েও বিপ্লব সফল করতে চায়। কিন্তু বিপ্লব সফল হলে তারা নতুন শাসনভার তুলে দেবে তাদেরই হাতে, যারা আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সাধারণ মানুষদের স্তোকবাক্যে ভোলাবে? বিপ্লব যারা সফল করে আর বিপ্লবের পরবর্তীকালে যারা দেশ গড়ার ভার নেয়, এদের চরিত্রগত একটা তফাত এসে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এই যদি হয় বিপ্লবের পরিণাম, তা হলে পরবর্তীকালের তরুণরা কোন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখবে?
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে এখন আর বিপ্লব বলা হচ্ছে না, যে-অভ্যুত্থানের ফলে সেই ব্যবস্থার পতন হল, তাকেই এখন বলা হচ্ছে বিপ্লব। এটা একটা নিয়তির পরিহাস নয়? যতবার এই বিপ্লব শব্দটি শুনেছি, আমার কানে খট করে লেগেছে। ইরানে যখন রাজতন্ত্র সরিয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মৌলবাদের, তাকেও বলা হয়েছিল বিপ্লব!
গণতন্ত্রই বা মানুষকে কতখানি মুক্তি দিতে পারে? সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র। নির্বাচন ও ভোটে জিতে যারা ক্ষমতা হাতে পায়, তারা যদি সত্যিই দেশের সমস্ত মানুষের ইচ্ছ-অনিচ্ছার মূল্য দেয়! ভোটে জেতার জন্য সর্বত্রই চলে টাকার খেলা এবং গায়ের জোর, সুতরাং যারা জয়ী হয়, তারাই যে যোগ্যতম, তা কিছুতেই বলা যায় না। ব্রিটেন এবং আমেরিকা গণতন্ত্রের গর্ব করে, কিন্তু ওইসব দেশের শাসকরা যখন একটা আগ্রাসী যুদ্ধ বাধিয়ে দেয় তখন কি তারা দেশের মানুষের মতামতের তোয়াক্কা করে? তারা চিন্তার স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতার ধ্বজা তুলে ধরলেও যুদ্ধের প্রকৃত খবর জানতে দেয় না দেশবাসীকে, মিথ্যে খবর জানাতে দ্বিধা করে না। যুদ্ধের সময় পরিকল্পিতভাবে দেশের মধ্যে কুৎসিত রকমের উগ্র দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা হয়, ছড়ানো হয় অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন প্রকাশ্যে নলেন যে, তিনি ইরাকের প্রেসিডেন্টের মৃত্যু চান, তখন মনে হয় পৃথিবী কি সত্যিই সভ্য হয়েছে? এই কি সভ্যতার নমুনা? তা হলে বর্বরতা কাকে বলে?
আমাদের ভারতবর্ষে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে গণতন্ত্রের পরীক্ষায় আমরা কী পেয়েছি? দিন দিন বেড়ে চলেছে গণতন্ত্রের ব্যভিচার। এক রকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন হয়, শাসনভার হাতে পেলেই তা তুচ্ছ হয়ে যায়। একই দল বিরোধী পক্ষে থাকলে বলে, হরতাল ডাকো, শাসনক্ষমতা পেলে বলে, হরতাল ভাঙো! নির্বাচিত হওয়ার পর আজ যে বিরোধী পক্ষে কাল সে সরকার পক্ষে। নীতির কোনও বালাই নেই। যে দল গতকাল বৃহৎ ব্যবসায়ীগোষ্ঠীকে শোষক ও শ্রেণিশত্রু বলেছে, আজ সে তাদেরই সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। আমাদের গণতন্ত্র বাক-স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অথচ দেশের শতকরা ষাটজন মানুষকেই অশিক্ষিত রেখেছে। ধর্ম-নিরপেক্ষতার নীতি কাগজে-কলমে গ্রহণ করা হলেও এত বছরের মধ্যে সাধারণ মানুষকে বোঝানোই হল না ধর্ম-নিরপেক্ষতা কাকে বলে।
আমাদের দেশের গ্রামে-গঞ্জে, আধা মফঃস্বলে আমি ঘুরেছি অনেক। আমি দেখেছি বাঁধের ওপর বসে থাকা বিষণ্ণ মানুষ, যার কোনও কাজ নেই, পেটে ভাত নেই। দেখেছি খরায় বিবর্ণ ফসলের খেতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিমর্ষ চাষিকে। বস্তির ধারে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করে ধুলোর মধ্যে। শহরের চৌরাস্তায় গাড়িগুলো থামলে শিশু কোলে নিয়ে ভিক্ষে চাইতে আসে জননী। পূরীষের পাত্র মাথায় করে নিয়ে যায় হরিজন। এরা যেন অনন্তকালের স্রোতে এক একটি বিন্দু। কোনও পরিবর্তন নেই। আমাদের শৈশবে যেমন শিশু-কোলে জননীকে ভিক্ষে করতে দেখেছি, আজও তাই দেখছি। গণতন্ত্র এই শিশু ও তার জননীকে মাথার ওপর একটা আচ্ছাদন দিতে পারেনি, দিতে পারেনি একটা সম্মানজনক জীবিকা। কোনও শিল্পী হয়তো সেই ভিখারিণীর মর্মন্তুদ ছবি আঁকেন, তার জন্য বাহবা পান, লেখা হয় কবিতা, মঞ্চস্থ হয় নাটক, তবু চৌরাস্তার মোড়ে শিশুকোলে জননীকে দেখতে পাওয়া যাবেই। ছেলেবেলায় রাস্তার মুচিকে ঠিক যে-অবস্থায় যে পোশাকে বসে থাকতে দেখতাম, এখনও তারা ঠিক সেরকমই রয়েছে। বাড়িতে ধাঙড়েরা আসে খালি পায়ে, নেংটি পরে, আমাদের ঠাকুরদারা যেমন দেখেছিলেন, আমরাও সে রকমই দেখছি। প্রতিদিন যে-মানুষটি আসে তার নামও আমরা জানি না, ওরা সবাই ধাঙড় বা মেথর। আফ্রিকার কেনিয়া শহরে আমি জুতে-পায়ে মেথর দেখেছি, পরনে প্যান্ট-শার্ট, আমাদের এখানকার যে-কোনও ধনী কিংবা সাম্যবাদীর বাড়ির মেথরের একইরকম চেহারা। কাশী শহরে ভিখারির লাইনের মধ্যে এক বৃদ্ধকে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম, তার মুখে অজস্র আঁকিবুকি, সামনে হাত পেতে বসে সে ঘুমে ঢুলছে। আমার মনে হয়েছিল, ওই ভিখারির বয়েস আড়াই হাজার বছর, গৌতম বুদ্ধ ওকে যেমন দেখেছিলেন, আমরাও সেই অবস্থাতেই দেখছি। কিছুই বদলাতে পারিনি।
এই গণতন্ত্র আমাদের কোন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে? কোন পথে আসবে সমস্ত মানুষের মুক্তি? নাকি সেই মুক্তি কোনওদিনই আসবে না? তার আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী কিংবা মানব সভ্যতা? যদি মানব সভ্যতার বিনাশ হয়ই, তবে তা পরমাণু অস্ত্র বা বিষবাষ্পে হবে না। হবে বঞ্চিত মানুষদের দীর্ঘশ্বাসে।