পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলির তুলনায় মস্কো শহর সন্ধের পর বেশ নিষ্প্রভ। শহরের রাস্তাকে উজ্জ্বল করে দোকানপাটের চাকচিক্য এবং বিজ্ঞাপনের আলো। এতকাল এখানে দোকানগুলিকে মনোহারী করে সাজাবার প্রয়োজনীয়তা ছিল না, কারণ কোনওরকম প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল না। আর প্রতিযোগিতা না থাকলে বিজ্ঞাপনেরও প্রশ্ন নেই।
আমরা যে, সব সময় বিজ্ঞাপন পছন্দ করি, তা নয়। অনেক বিজ্ঞাপনের ছবি ও গালভরা মিথ্যে রীতিমতন কুৎসিত লাগে, অনেক পশ্চিমি দেশে বিজ্ঞাপনে আলোর জাঁকজমক দেখে মনে হয় বিদ্যুতের অপচয়। তবু আমরা বিজ্ঞাপনে অনেকটা অভ্যস্তও হয়ে গেছি। নাগরিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে নানা ধরনের দোকানপাট জড়িয়ে থাকবেই। পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না থাকলে বর্ণহীন মনে হয়। বিজ্ঞাপনের মধ্যে মুনাফার গন্ধ এবং ভাবী ক্রেতাদের ছেলেমানুষ ঠাওরাবার ব্যাপার থাকলেও আর একটা অন্য দিকও আছে। মানুষ সবসময় বৈচিত্র্য সন্ধানী এবং বিজ্ঞাপনদাতারা সেই সুযোগ নেয়। শুধু প্রয়োজনীয় দ্রব্যে মনের ক্ষুধা মেটে না। কিংবা এমনও বলা যায়, অনেক অপ্রয়োজনীয় বৈচিত্র্য সুন্দর জিনিস আসলে মানুষের খুবই প্রয়োজনীয়। সামান্য এক টুকরো ন্যাকড়া পকেটে রাখলেই
মোছা যায়, তবু মানুষ নানারকম নকশা কাটা রুমাল ব্যবহার করে। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় উৎপন্ন দ্রব্যের সেই বৈচিত্র্য নেই, তাই বিজ্ঞাপনও নেই। মানুষের পছন্দের কোনও অধিকার থাকবে না, সরকার যা বানাবে, সকলে তাই নিতে বাধ্য। সরকার লাভ করতে চায় না। দেশের সকলকে সমান মূল্যে উৎকৃষ্ট দ্রব্য সরবরাহ করবে, এই নীতি শুনতে খুবই ভালো। কিন্তু প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, তা অবাস্তব। মূল্য কম হলেও সরকারি দ্রব্য সবসময় উকৃষ্ট হয় না। বৈচিত্র্যহীন বস্তু কম দামে পেলেও মানুষ পছন্দ করে না, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সরকার অতি প্রয়োজনীয় বস্তুও সরবরাহ করতে না পারলে পাশের দোকান থেকে কিনে নেওয়ার উপায় নেই। টুথপেস্ট কিংবা টয়লেট পেপার পাওয়া যায় না, এমনও হয়।
এখন অবশ্য মস্কোতে কিছু কিছু বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের দোকানও খুলছে ক্রমে ক্রমে। তবে দু’রকম মুদ্রার ব্যবহার ন্যক্কারজনক লাগে। বাইরের লোকের কাছে ডলার থাকলে যা খুশি কিনতে পারবে, আর মস্কোর নাগরিকরা রুবল দিয়ে অনেক কিছুই কিনতে পারবে না, এই অপমানজনক ব্যবস্থাটা এখন সর্বত্র প্রকট। এমনকি, মস্কোতে ‘দিল্লি’ নামে যে ভারতীয় রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছে, সেখানেও দু’টি ভাগ। একদিকে ডলারের খরিদ্দার, অন্যদিকে রুবলের। বলাই বাহুল্য, রুবলের দিকটা অনেক মলিন এবং সেখানে সব কিছু পাওয়া যায় না।
সন্ধের পর মস্কোতে যাওরার জায়গা বিশেষ নেই। একদিন রাত এগারোটার পর আমরা এমনিই শহর ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। সি পি এস ইউ-র বিরাট ভবনের সামনের রাস্তাটা খাঁ খাঁ করছে। সদর দরজায় তালা বন্ধ, পুরো বাড়ি অন্ধকার শুধু আলো জ্বলছে একতলার একটি ঘরে, বোধহয় সেখানে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রহরীরা। শোনা যায় যে, এই কমিউনিস্ট পার্টির উঁচু দিকের নেতারা একশো বিলিয়ন ডলার গোপন রেখেছে বিভিন্ন জায়গায়। এখন ইয়েলেৎসিনের সরকার সেই বিপুল অর্থ উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে।
ঝরঝিনস্কি স্কোয়ারে আমরা নামলাম গাড়ি থেকে। এককালে এই জায়গাটার নাম শুনলেই অনেকের ভয়ের শিহরণ হত, অসময়ে কেউ এদিক দিয়ে হাঁটত না। এখানেই কে জি বি-র হেড কোয়ার্টার। ওই প্রকাণ্ড বাড়িটিতে বহু মানুষের আয়ু হারিয়ে গেছে। পুরো এলাকাটা জুড়েই মাটির তলায় রয়েছে জেরা কক্ষ। সেখানে আমরা হাঁটছি রাত সাড়ে এগারোটায়। আমার সঙ্গী সুবোধ ও সমর রায় বলল, কিছুদিন আগেও এটা ছিল অবিশ্বাস্য। আমাদের অবশ্যই গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হত। এখন শুনলাম, শুধু কিছু কিছু গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।
চৌরাস্তার মাঝখানে উঁচু বেদির ওপর ছিল ঝরঝিনস্কির দীর্ঘ প্রস্তরমূর্তি। লেনিনের সহচর এই ঝরঝিনস্কি বলশেভিক বিপ্লবের ঠিক পরেই গুপ্ত পুলিশবাহিনী সৃষ্টি করেছিল। এতদিন যারা কে জি বি-র ভয়ে মুখ খোলেনি, তারা এখন বলছে যে বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে জারের আমলের পুলিশি ব্যবস্থাই আবার চালু করা হয়েছিল। জারের আমলেও গুপ্ত পুলিশ যে-কোনও মানুষকে সামান্য সন্দেহে ধরে নিয়ে যেত, তারপর তাদের অনেকেরই আর হদিশ পাওয়া যেত না। ডস্টয়েভস্কিকে কত তুচ্ছ কারণে গুলি করে মারার জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তা আমরা জানি। বিপ্লবের পরেও সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা পায়নি। স্তালিনের আমলে নাকি মাসে অন্তত দশটা অভিযোগ দায়ের করতে না পারলে শাস্তি পেতে হবে এই ভয়ে গুপ্তচররা নিরীহ পাড়াপ্রতিবেশীদের নামে চুকলি কেটে আসত কে জি বি-র কাছে। এরকম ভীতির আবহাওয়া তৈরি করা কি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? সমাজতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে যে ব্যক্তিটি সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, সেই জোসেফ স্তালিনই আসলে সমাজতন্ত্রের এমন ব্যর্থতার জন্য দায়ী। এদেশে এখনও মুষ্টিমেয় সংখ্যক যারা কমিউনিজমে বিশ্বাসী, যারা মনে করে যে সমাজতন্ত্রের পথে কিছু ভুলভ্রান্তি ঘটলেও আদর্শটা মিথ্যে হতে পারে না, তারাও কিন্তু, ঘৃণার সঙ্গে ছাড়া, কখনও উচ্চারণ করে না স্তালিনের নাম।
ঝারঝিনস্কির মূর্তিটা উপড়ে ফেলা সেই ঘৃণারই প্রকাশ। স্তালিন আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ওই মূর্তিটা ছিল সমস্ত অত্যাচারের প্রতীক। ওই মূর্তির মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন নামহীন মানুষ, এই ছবি ছাপা হয়েছে বিশ্বের সমস্ত সংবাদপত্রে। দেশ বিদেশের বহু সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিল। আমরা তিনজনে এখন সেই শূন্য বেদিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কী মজবুত করে বানানো হয়েছিল এই পাথরের মঞ্চ, আরও দু-এক শতাব্দীতে ওই মূর্তির ক্ষতির কোনও সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু মানুষের ঘৃণার কাছে পাথর-বন্দুক-ট্যাংক-মেশিনগান সবই শেষ পর্যন্ত হার মেনে যায়।
আর কোনও পথচারী নেই, তবু ভারী জুতোর শব্দ শুনে আমরা মুখ ফিরিয়ে তাকাই। অদূরে রাস্তার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজন পুলিশ। তারা আমাদের কিছু বলবে কি না এই কৌতূহল নিয়ে আমরা অপেক্ষা করি। কিন্তু তারা কিছুই বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে। একটু পরে আমরাই এগিয়ে যাই ওদের দিকে।
আমরা তিনজনই চেহারায় বিদেশি হলেও সুবোধ ও সমর ওই পুলিশদের মাতৃভাষা জানে জলের মতন। সুবোধ যেই জিগ্যেস করল, কেমন ঠান্ডা পড়েছে, স্বদেশিভাষা শুনে তারা উৎসাহিত হয়ে উঠল। ওরা তিনজনই বেশ তরুণ, সারল্য মাখা মুখ, ওরা মিলিশিয়ার অন্তর্গত, ওদের কাজ সারারাত রাস্তায় পাহারা দেওয়া। আমাদের দেখে ওরা অবাক হয়েছে, বেদিটার ওপর উঠে আমরা এত রাতে কেন গল্প করছি, তার কারণ বুঝতে পারছে না। সত্যিই তো কোনও কারণও নেই, আমরা এমনিই এসেছি ঘুরতে ঘুরতে। ওরা বলল, ঝরঝিনস্কির মূর্তিটা আছে একটা মিউজিয়ামের পাশের বাগানে, আমরা ইচ্ছে করলে যেতে পারি সেখানে।
আমাদের পেয়ে ওরা খুশিই হয়েছে মনে হল, গল্প করতে লাগল নানারকম। আমি ওদের ভাষা জানি না, আমাকে বোঝানো হচ্ছে অনুবাদে। আমি প্রকৃতই বিদেশি এবং এই দ্বিতীয়বার মস্কো এসেছি শুনে ওরা সুযোধকে বলল, আমাদের এই অতিথিটিকে জিগ্যেস করুন তো, এই যে আমাদের দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেল, এতে আমাদের ভালো হবে, না আরও খারাপ হবে?
আমি উলটে জিগ্যেস করলাম, তোমরাই বলো না, তোমাদের কী মনে হয়।
তিনজন তরুণ পুলিশই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল, আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।
এটা রাশিয়ার অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরই প্রতীক প্রশ্ন বলা যায়। সব দেশেই সাধারণ মানুষ সমাজ, সরকার বা বিশ্ব নিয়ে মাথা ঘামায় না, নিজস্ব রুজি-রোজগার, খাদ্য-বস্ত্র-গৃহের সংস্থান আর নিজের পরিবারের নিরাপত্তার চিন্তায় দিন কাটিয়ে দেয়। এতদিন এরা একটা ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, ভালো-মন্দ যাই-ই হোক সেটা জানা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আকস্মিকভাবে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যৎ অজানা। সেই অজানা সম্পর্কে সংশয় থাকাও স্বাভাবিক। তা ছাড়া, এতদিন ওপর থেকে যা চাপিয়ে দেওয়া হত, তাই মান্য করতে সবাই বাধ্য ছিল। এখন ওপর থেকে সেই চাপ সরে গেছে, তার ফলে এসেছে এক শূন্যতা। মানুষ একমাত্র শূন্যতার কাছেই হতবুদ্ধি হয়ে যায়।
পরদিন আমরা মস্কোর নতুন মিউজিয়ামটি দেখতে গিয়েছিলাম। ভেতরটা এখনও সম্পূর্ণ সাজানো হয়নি, ভেতরে দ্রষ্টব্য খুবই কম। তবু টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। বাইরে বাগানের এক পাশে খানিকটা জায়গাকে বলা যায় মূর্তির কবরখানা। সদ্য উৎপাটিত ঝরঝিনস্কির লম্বা মূর্তিটা পড়ে আছে মাটিতে। চিৎ ও উপুড় অবস্থায় একাধিক স্তালিন। আরও কয়েকটি মূর্তি ঠিক কাদের তা চেনা গেল না। আমাদের সঙ্গে একজন জর্জিয়ার যুবক ছিল। সে একটা দাড়িওয়ালা মূর্তি দেখিয়ে বলল, ওই তো লেনিন! আমি খুব কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলাম, না, লেনিন নন, অন্য কেউ। অত্যুৎসাহী জর্জিয়ানটির বোধ হয় লেনিনকেও ধরাশায়ী করার ইচ্ছে। এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের সময়, জর্জিয়ানরা লেনিনকে নস্যাৎ করে স্তালিনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায় কি না, তাই-ই বা কে জানে। ওদের কথাবার্তায় সেরকম আভাস যেন মাঝে মাঝে পাওয়া যায়।
জাতীয়তাবাদের এই উগ্রতাও অদ্ভুত। সারা বিশ্বের মার্কসবাদীরা ইংরেজ ঐতিহাসিক টয়েনবিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু টয়েনবি অনেক দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন যে কমিউনিজমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হবে ন্যাশনালিজম। এখন তো দেখা যাচ্ছে, সেই দ্বন্দ্ব যুদ্ধে জাতীয়তাবাদই জয়ী হল। মার্কসবাদে যেমন শ্রেণিবৈষম্য কিংবা ধর্মের স্থান নেই, সেইরকম জাতীয়তাবাদেরও স্থান নেই। সারা বিশ্বের সর্বহারা শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির ঐক্যের ডাক দিয়েছে মার্কসবাদ, কিন্তু এই ‘সারা বিশ্ব নিছক কথার কথা, কোনও এক দেশের বঞ্চিত শ্রমিকদের নিয়ে অন্য দেশের শ্রমিকরা মাথা ঘামায় না। প্রবল স্বাজাত্যাভিমান সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতেও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশ যেমন ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষিত হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার কোনও শিক্ষা দেওয়া হয়নি সাধারণ মানুষকে, ধর্মের অরাজকতা চলছে যথেষ্টভাবে। সমাজতন্ত্রী দেশগুলিতেও শুধু কিছু বুলি শোনানো হয়েছে, স্লোগান দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে মানুষের মনের ভাষা, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে ওঠার কোনও শিক্ষাই দেওয়া হয়নি। যুগোশ্লাভিয়ার রাশ একটু আলগা হতেই সার্বিয়ান আর ক্রোয়েশিয়ানরা খুনোখুনি শুরু করেছে। এতকাল সাম্যবাদের নামে তারা পাশাপাশি ছিল অথচ, তাদের ভেতরে-ভেতরে পরস্পরের প্রতি এমন তীব্র বিদ্বেষ জমে ছিল? চিন ও সোভিয়েত দেশের সীমান্ত সংঘর্ষের সময় প্রকট হয়ে উঠেছিল
ভিন্ন জাতিতত্ব। সমাজতন্ত্র গ্রহণ করলেও শ্বেতাঙ্গ ও পীতাঙ্গ মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে শান্তির পথে এগোতে পারে না। শুধু গায়ের রং নয়, ভাষাও মিলনের অন্তরায়। রুমানিয়ানরা দু’চক্ষে দেখতে পারে না হাঙ্গেরিয়ানদের। চেকোশ্লোভাকিয়ায় চেক ও শ্লোভাক এই দুই আলাদা ভাষাভাষীদের মধ্যে বিরূপতা রয়ে গেছে। আলবেনিয়ানরা অন্য সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে মিশতে চায় না। পোল্যান্ডের মানুষ রাশিয়ানদের সম্পর্কে তিক্ত সুরে কথা বলে। পূর্ব জার্মানিতে কালো ভিয়েতনামিদের অবজ্ঞা দেখানো হত!
সোভিয়েত রিপাবলিক যে ভেঙে গেল। এর অন্তর্গত প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই যে স্বাধীন হতে চাইছে, এই ঘটনা থেকে আর একটি সত্য বেরিয়ে আসছে। এতকাল তা হলে এদের জোর করে ধরে রাখা হয়েছিল? সমাজতন্ত্র কিংবা সাম্যবাদের দীক্ষা হয়নি, নিছক জোর জবরদস্তি! আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, এই শুনতে-শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আমেরিকা যে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা অস্বীকারও করা যায় না। কিন্তু রাশিয়াও যে সোভিয়েত ইউনিয়নের নামে এতকাল এক সাম্রাজ্যবাদ চালিয়ে গেছে, তা গোপন করে যাওয়া হয়েছিল কেন? নিজেরা সাম্রাজ্যবাদী হয়ে অন্যকে সেই একই অভিযোগে গালমন্দ করা যায়?
আমাদের সঙ্গে সদ্য পরিচিত জর্জিয়ান যুবকটি সেখানকার এক মন্ত্রীর প্রাইভেট সেক্রেটারি। বুদ্ধিমান, ঝকমকে চেহারা, দায়িত্বপূর্ণ পদে আছে। তার মুখে সাংঘাতিক এক চমকপ্রদ কথা শুনলাম। কথায়-কথায় সে বলল, তোমরা ভারতীয়রা দুশো বছর ইংরেজদের অধীনে ছিলে, তবু আমি বলব, তোমরা ভাগ্যবান। এ কথার তাৎপর্য বুঝতে না পেরে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকাতেই সে আবার বলল, তোমরা পরাধীন ছিলে বটে, তা হলেও তোমরা ছিলে ব্রিটিশদের মতন এক সভ্য জাতের অধীনে। আমাদের মতন বর্বর রাশিয়ানদের অধীনে তোমাদের থাকতে হয়নি।
আমি একেবারে স্তম্ভিত। আমি এ পর্যন্ত যত রাশিয়ান দেখেছি, তারা সকলেই ভদ্র, সভ্য, উদার, অনেকেরই বেশ রসিকতা জ্ঞান আছে। কিন্তু জাতিগতভাবে তারা জর্জিয়ানদের চোখে বর্বর? একেই বলে জাতি-বৈর। আমি জর্জিয়ান কখনও যাইনি বটে, কিন্তু আগে ল্যাটভিয়া এবং ইউক্রাইনে গেছি। সেখানে যাদের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়েছিল, সকলের মুখেই মহান সোভিয়েত ইউনিয়ানের জয়গান শুনেছি। এখন ল্যাটভিয়ার এবং ইউক্রাইনের যেরকম ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে রাশিয়া থেকে বিযুক্ত হওরার, তাতে বোঝা যাচ্ছে, সেইসব জয়গান ছিল নিতান্ত মুখস্থ বুলি!
আমাদের দেশেও যাঁরা সোভিয়েত ইউনিয়ানের প্রদর্শিত পথকে আদর্শ পথ ভেবে এসেছেন, তাঁরাও কি বুঝতে পারেননি যে জোর-জুলুম করে, কামান-ট্যাংকের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন জাতিকে এক পতাকার নীচে মেলাবার চেষ্টা চলেছে? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সযোগ নিয়ে স্তালিন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে গ্রাস করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন, আগেকার রাশিয়ান সাম্রাজ্যেরই একটা অন্য রূপ। সমাজতন্ত্র একটা ছুতো। হাঙ্গেরি-পোল্যান্ড চেকোশ্লোভাকিয়ার মতন দেশগুলির শাসকদের মস্কোর অঙ্গুলি হেলনে পুতুলের মতন উঠতে-বসতে হত। সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত রাষ্ট্রগুলির তো আলাদাভাবে কোনও কণ্ঠস্বরই ছিল না। সর্বত্র চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাশিয়ান ভাষা। যুগোশ্লোভিয়ায় গিয়ে দেখেছি, সেখানে অনেকগুলি ভাষা এবং তা নিয়ে রেষারেষি আছে বটে, কিন্তু প্রত্যেকেই রুশ ভাষা শিখতে বাধ্য।
বছরের পর বছর, দশকের পর দশক এতগুলি রাষ্ট্রের ওপর ডান্ডা ঘুরিয়েও রাশিয়া তাদের অধীনস্থ রাখতে পারল না। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি আর চাইল না চাটুকার হয়ে থাকতে। চোখ রাঙিয়ে, হাতে অস্ত্র নিয়ে ভয় দেখিয়ে কোনও আদর্শ প্রচার করা যায়? মার্কসবাদ যদি সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ হয়, তা হলে এতগুলি বছর ধরে সেই পথে থেকেও আর কোনও রাষ্ট্র তা মানতে চাইছে না কেন? ভুল হয়েছিল কোথায়? মার্কসবাদের বিরুদ্ধাচারীরা নয়, প্রকৃত মার্কসবাদীদের মনেই তো এই প্রশ্ন জাগা উচিত। শুধু গরবাচেভ বা ইয়েলেৎসিন বা দু-তিনজনের ভুলের জন্য এতবড় একটা আদর্শ, এতবড় একটা সাম্রাজ্য তাসের ঘয়ের মতন ভেঙে পড়ল, এটা শিশুর যুক্তি। অতিসরলীকরণ।
কেউ কেউ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে জোর জবরদস্তি কিংবা মগজ ধোলাই করে রাশিয়ান সমাজতন্ত্র বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। তাঁদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। খুবই বিস্ময়কর লাগে, বহুকাল আগে, উনিশশো বাইশ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ইতিহাসের গতি সম্পর্কে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। গয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন :
The recent revolution in Russia is very interesting study . The Shape which it has now assumed is due to the attempt to force Marxian doctrines and dogmas on the unwilling genius of Russia . Violence will again fail . If I have read the situation accurately, I except a counter revolution . The soul of Russia must struggle to free herself from the socialism of Karl Marx.
রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া পরিদর্শনে গিয়ে অনেক প্রশংসার কথা লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রশংসার ব্যাপারে ছিলেন অকৃপণ। জীবনে কি তিনি কখনও কারুর নিন্দে করেছেন? যাদের পছন্দ করতেন না (যেন, আধুনিক কবিদের), তাদেরও তিনি প্রশংসার সার্টিফিকেট দিতে দ্বিধা করতেন না। ইতালিতে গিয়ে আতিথ্যের বহর দেখে তিনি মুসোলিনিরও প্রশংসা করে ফেলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া সফর ছিল ১৪ দিনের। সমস্ত বিদেশি অতিথিদেরই দু’সপ্তাহের ভিসা দেওয়া হত। এবং আগে থেকে নির্দিষ্ট, সাজানো গোছানো জায়গাগুলিই দেখানো হত তাঁদের। রাশিয়ান প্রশংসনীয় অনেক কিছুই ছিল অবশ্যই এবং রবীন্দ্রনাথ যথার্থ আন্তরিকতার সঙ্গেই তার প্রশংসা করেছেন। সংস্কার থেকে মুক্তি, দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার দমন, মানুষে মানুষে সম-ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা, এসব কোন কবি না চায়? কিন্তু এই মহৎ আদর্শের নামে জোর জবরদস্তি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার বিলোপ, এসবও সেই দূরদর্শী কবির নজরে এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে উদ্ধৃতি যারা প্রচারের কাজে লাগায়, তারা রবীন্দ্রনাথের ওইসব মন্তব্যের উল্লেখও করে না। ‘রাশিয়ার চিঠি’র রুশ অনুবাদে ওইসব অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সামান্য বিকৃতি হলেই আমরা হইচই তুলি। ইন্দিরা গান্ধির এমার্জেন্সির আমলে কোনও কোনও নির্বোধ প্রশাসক রবীন্দ্রনাথের দু-একটি কবিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চেয়েছিল। সে জন্য ইন্দিরা গান্ধির কংগ্রেস দল অবশ্যই ধিক্কারযোগ্য। কিন্তু সোভিয়েত দেশে রবীন্দ্রনাথের লেখার ওপর কাঁচি চালিয়ে যখন প্রকাশ করা হল, তখন আমরা উচ্চবাচ্য করিনি।