এত বড় মিউজিয়ামের মধ্যে কাউকে হারিয়ে ফেললে খুঁজে যার করা শক্ত। সারগেইকে দেখতে না পেয়ে আমি ভাবলুম এই সুযোগে আরও বেশি করে হারিয়ে যাওয়া যাবে, তাহলে আরও বেশিক্ষণ ছবি দেখা যাবে। সন্ধেবেলা ট্রেন ধরতে হবে বলে সারগেই তাড়া দিচ্ছিল, ঠিক ক’টার সময় ট্রেন তা আমি জানি না।
আর দু-একটা ঘর ঘোরার পর আমার মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। সারগেই একটুতেই নার্ভাস হয়ে যায়। এতক্ষণ ও আমায় কোথায় খোঁজাখুঁজি করছে কে জানে! আমাদের বেরিয়ে পড়বার কথা ছিল, ও নিশ্চয়ই আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।
মিউজিয়াম থেকে বাইরে এসে দেখি সেখানেও সারগেই নেই। ফাঁকা রাস্তা, শন-শন করে হাওয়া দিচ্ছে। ওভারকোটের কলার তুলে পকেটে দু-হাত গুঁজে আমি পায়চারি করতে লাগলুম। অচিরেই আমি অন্তর্হিত হয়ে গেলুম লেনিনগ্রাড থেকে। এখন আমি কায়রোর রাস্তায়। কেন হঠাৎ কায়রোর কথা মনে পড়ল তা কে জানে, কায়রোতে আমি গেছি অনেককাল আগে, এবং লেনিনগ্রাডের সঙ্গে কায়রোর কোনওরকম মিল নেই।
কায়রোতে একদিন আমি হোটেলের রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলুম, ঠিকানাটাও মনে ছিল। একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করেছিলুম সে আমায় কোনও সাহায্য করতে পারবে কি না! পুলিশটি কোনও উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। আমি তো হতভম্ব। ডিউটির সময় তার সঙ্গে কথা বলে আমি অপরাধ করে ফেলেছি? সেইজন্য সে আমায় গ্রেপ্তার করল? পুলিশটি আমায় নিয়ে এল একটি দর্জির দোকানের সামনে এবং দর্জিকে ডেকে কী সব বলল। তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হল, ওই দর্জি ইংরিজি জানে, সে আমায় সাহায্য করবে। ততক্ষণে সে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গেছে।
আমি আবার লেনিনগ্রাডে ফিরে এলুম। এখানে রাস্তা হারাবার কোনও আশঙ্কা নেই। নদীর ধার দিয়ে হেঁটে গেলে আমার হোটেল খুঁজে পাবই। কিন্তু সারগেই গেল কোথায়?
মিনিট দশেক বাদে সারগেই বেরিয়ে এল। উদভ্রান্তের মতন চেহারা, রীতিমতন হাঁপাচ্ছে সে। আমার কাছে এসে ফুঃ করে মুখ দিয়ে বিরাট নিশ্বাস ছেড়ে সে বলল, সুনীলজি, কী হয়েছিল! আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
আমি মুচকি হেসে বললুম, আমি ইচ্ছে করেই তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে পড়েছিলুম। তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ পর দেখা হলে আমরা ট্রেন মিস করতুম, তা হলে ভালোই হত, আরও দু-একদিন থেকে যাওয়া যেত লেনিনগ্রাডে। আমার আজই লেনিনগ্রাড ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
সারগেই বলল, আমাদের যেসব প্রোগ্রাম করা আছে। ট্রেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, অ্যাপয়েন্টমেন্টস!
আমি বললুম, চলো।
সারগেই একবার মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখতে না পেয়ে আবার ভেতরে ঢুকেছিল, তারপর প্রায় দৌড়ে গোটা মিউজিয়ামটাতেই আমাকে খুঁজে দেখে এসেছে।
হোটেলে ফিরে আমরা তৈরি হয়ে নিলুম তাড়াতাড়ি।
শীতের দেশে এলে মোটাসোটা জামাকাপড় আনতে হয়, তাই আমার সুটকেসটি বেশ ভারী। যাতে বইতে না হয় সেজন্য তলায় চাকা লাগানো। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আমি সুটকেসটার টিকি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছি আর ঘর্ঘর-ঘর্ঘর শব্দ হচ্ছে, লোকজনরা ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। যদি অন্যদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তা হলে আর চাকা লাগাবার মানে কী? সুটকেসটা আমি তুলে নিলাম।
আমাদের দেশের রেল স্টেশনগুলিতে মৌমাছির ভনভনের মতন সবসময় একটানা একটা আওয়াজ শোনা যায়। শ্বেতাঙ্গ জাতিরা প্রকাশ্য স্থানে নীরবতা পছন্দ করে। এত বড় স্টেশন, এত মানুষ, অথচ প্রায় কোনও শব্দই নেই। হকারদের চ্যাঁচামেচির তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
কিছু-কিছু মানুষ স্বভাবেই ব্যস্তবাগীশ। ট্রেন বা প্লেন ধরতে হলে সারাদিন ধরে তাদের উৎকণ্ঠা থাকে। যদি ঠিক সময় পৌঁছনো না যায়, রাস্তা জ্যাম হয়, এইজন্য তায়া রওনা হয় অনেক আগে। সারগেইও অনেকটা সেইরকমের। আমাদের ট্রেন ছাড়তে এখনও পুরো এক ঘণ্টা বাকি।
রাত্রির ট্রেনে সকলেরই শুয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। আমাদের কুপেতে চারটে বার্থ। অন্য দুজন এখনও এসে পৌঁছয়নি। প্রতিটি বার্থেই রয়েছে বেশ পুরু তোষকের বিছানা ও কম্বল। এই কুপের মধ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ, তার জন্য বাইরে আলাদা জায়গা আছে।
ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিট আগে অন্য দুজন যাত্রী এসে পৌঁছল। যাত্রী নয়, যাত্রিনী, দুজনেরই বয়েস তিরিশের মধ্যে, বেশ সুসজ্জিত। এরা কি দুই বোন, না দুই বান্ধবী? বোঝবার কোনও উপায় নেই। সারগেই-এর সঙ্গে তায়া রুশ ভাষায় মামুলি দু-একটা কথা বলল মাত্র, গল্প করার কোনও উৎসাহ দেখাল না, দুজনে দুটি বই খুলে বসল।
চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলুম বাইরে। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে, কিন্তু বাইরে কোনও অন্ধকার নেই। লেনিনগ্রাড শহর হোয়াইট নাইটসের জন্য বিখ্যাত, যে সময় সারা রাতে অন্ধকার নামে না। এখন অবশ্য সে সময় আসেনি।
একটু বাদে একজন যুবতী সারগেইকে কিছু বলতেই সারগেই আমাকে জানাল, চলুন সুনীলজি, আমরা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।
আমরা বাইরে যেতেই মেয়ে দুটি দরজা বন্ধ করে দিল। বুঝলুম ওরা রাত্রির জন্য পোশাক বদলে নিচ্ছে। আমাদের অবশ্য পোশাক বদলাবার প্রশ্ন নেই, যা পরে আছি, সেই সুন্ধুই শুয়ে পড়ব। সারগেইকে প্রথম দিন যে চামড়ার কোটটা পরতে দেখেছি সেটা আর সে ছাড়েনি।
বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাতেই অন্য একজন লোক এসে আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট চাইল। আগেও কয়েকবার আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এটা বেশ মজার লাগে। আমার সিগারেট ফুরিয়ে গেল আমিও নিশ্চয় যেকোনও একজনের কাছ থেকে সিগারেট চাইতে পারি বিনা দ্বিধায়।
লোকটি কিছু জিগ্যেস করল আমাকে। সারগেই অনুবাদ করে বোঝাল যে, লোকটি জানতে চাইছে, আমি কি এদেশে নতুন এসেছি, আমার এ দেশ কেমন লাগছে?
অনুবাদে আড্ডা জমে না, কুপের দরজা খুলতেই আমরা চলে এলুম ভেতরে। যুবতী দুটি পোশাক বদল করে আবার বই খুলে বসেছে। আমার হ্যান্ডব্যাগে কোনও বই নেই। এখন সুটকেস খোলা এক বিড়ম্বনা।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। তারপর এক সময় একটি মেয়ে সারগেইকে কিছু বলতেই সে আমায় জানাল, সুনীলজি, এখন আলো নিবিয়ে দিলে আপনার কোনও আপত্তি আছে?
আমি বললুম, না, না, আপত্তি কেন থাকবে?
যদিও এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার কোনও বাসনা আমার ছিল না। ইচ্ছে করছিল কিছুটা গল্পগুজব করতে। মেয়ে দুটির সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। ভাষা জানি না। সারগেই নব বিবাহিত যুবক, অন্য মেয়েদের প্রতি তার বোধহয় কোনও ঔৎসুক্য নেই এখান।
ট্রেনে আমার ভালো ঘুম আসে না। সারারাত ধরে আমি প্রায় তিনশো স্বপ্ন দেখলুম। একটি প্রকাণ্ড স্বপ্নমালা বলা যায়।
সকাল বেলা কোনও স্টেশন থেকে চা বা কফি কেনার দরকার হয় না। যে মহিলা কন্ডাকটর গার্ড কাল রাত্রে আমাদের টিকিট পরীক্ষা করতে এসেছিলেন, তিনিই সকালবেলা নিজে হাতে করে আমাদের জন্য কফি নিয়ে এলেন। এই কফির দাম বোধহয় টিকিটের মধ্যেই ধরা থাকে।
সকাবেলা যুবতী দুটি মুখ খুলল, টুকিটাকি প্রশ্ন করতে লাগল আমাদের। দেখা গেল, এদের মধ্যে একজন ইংরিজি জানে। যাঃ, তা হলে তো এর সঙ্গে অনায়াসেই ভাব জমানো যেত। কিন্তু এখন আর সময় নেই, রিগা স্টেশন প্রায় এসে গেছে।
এক একজন লোককে দেখলেই মনে হয় বেশ সুরসিক। এ পি এন-এর যে প্রতিনিধি আমাদের রিসিভ করতে এসেছেন স্টেশনে, তাঁর মুখখানাও সেরকম। ছাতা হাতে ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আপনি যে ক’দিন এখানে থাকবেন, আপনার খুব টাইট প্রোগ্রাম, সব জায়গাতেই যেতে হবে, বিশ্রামের সুযোগ পাবেন না। এখন হোটেলে গিয়ে একটু বিশ্রাম করে নিন, দশটার সময় আমরা আবার আসব।
আমি কিন্তু ক্লান্ত বোধ করছি না একটুও। শরীরটা বেশ হালকা হালকা লাগছে। গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা মিহি বাতাসের স্পর্শ, তার আমেজই আলাদা।
হোটেল ল্যাটভিয়া বেশ আধুনিক কায়দার হোটেল, কিন্তু এর সামনে নদী নেই। সাততলার ওপরের ঘর থেকে দেখতে পাওয়া যায় সামনের ব্যস্ত রাস্তা ও একটি বিশাল গির্জার অঙ্গন।
ল্যাটভিয়া রাশিয়ার মধ্যে নয়, একটি স্বতন্ত্র রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি রাষ্ট্র। অবশ্য রাশিয়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই নিবিড়, এখানকার প্রধান কবি জ্যানিস রেইনিস-এর ভাষায় মুক্ত রাশিয়ার মধ্যে মুক্ত ল্যাটভিয়া।’
ল্যাটভিয়ার জনসংখ্যা মাত্র পঁচিশ লক্ষ, আমাদের পশ্চিমবাংলার অনেক জেলার জনসংখ্যাই এর চেয়ে বেশি। তবু এই ছোট রাজ্যটি নিয়েই ইতিহাসে অনেক রকম রাজনৈতিক খেলা চলেছে। মধ্য শতাব্দীতে এই ল্যাটভিয়া ছিল জার্মান ফিউড়ালদের শাসনে। তখন দমন ও অত্যাচার ছিল চরম। ল্যাটভিয়ানরা মূলত ছিল লুথেরান, তাদের ওপর জোর করে ক্যাথলিক মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হত। দোম ক্যাথিড্রালের সামনের ময়দানে ক্যাথলিক সাধুরা শত-শত লোককে ধর্মদ্বেষের নামে পুড়িয়ে মেরেছে। সেই সময় জার্মানদের চোখে লাটভিয়ানরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাশিয়ান সম্রাট পিটার দা গ্রেট-এর বিজয়ীবাহিনী ল্যাটভিয়াকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করে নেয়। সেই সময় রিগা হয়ে ওঠে রাশিয়ার একটি প্রধান বন্দর। জারদের আমলে ল্যাটভিয়ার ব্যবসায়ী শ্রেণির সমৃদ্ধি হয়েছিল বটে, কিন্তু শ্রমিক-কৃষকদের অবস্থা বিশেষ কিছু বদলায়নি।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মান সম্রাট কাইজার ল্যাটভিয়াকে আবার দখল করে নেবার লোভ করেছিল। ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র এবং কাঁচা মাল সরবরাহের জন্য ল্যাটভিয়ার গুরুত্ব ছিল। এখানকার বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলের টান ছিল রুশ বিপ্লবীদের দিকে। অক্টোবর রিভোলিউশানে অনেক ল্যাটভিয়ান যুবকও অংশগ্রহণ করেছিল। সামরিক জার্মান অবরোধের বিরুদ্ধে ল্যাটভিয়ান রাইফেলম্যানরা বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে ল্যাটভিয়া নিজেকে স্বাধীন সোভিয়েত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।
কিন্তু পাঁচ মাস পরেই ল্যাটভিয়াতে আবার পালা বদল শুরু হয়। জার্মানির সহযোগিতায় ল্যাটভিয়ার সোভিয়েত-বিরোধী হোয়াইট গার্ডরা আবার ক্ষমতা দখল করে নেয়। তারপর সুদীর্ঘকাল ধরে ল্যাটভিয়াতে বিপর্যয় চলতে থাকে, এই রাজ্যটি আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ফিরে আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়, সে ইতিহাস অনেকেরই জানা।
একটা জিনিস এখানে এসে বারবার মনে হচ্ছে, পুরোনো ঐতিহ্য রক্ষায় সোভিয়েত নাগরিকরা খুবই তৎপর। লেনিনগ্রাডের মতন রিগা শহরেও প্রচণ্ড তাণ্ডব চলেছিল, এখন তার কোনও চিহ্নই নেই। শুধু তাই নয়, বোমার আঘাতে যেসব ঐতিহাসিক অট্টালিকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেখানে কিন্তু নতুন বাড়ি ওঠেনি, অবিকল আগের বাড়িটাই পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।
রিগা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্য শহর। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা প্রথমে শহরটা ঘুরে দেখতে বেরুলুম, শহরটা দেখতে তো সুন্দর বটেই, তা ছাড়া আমার আর একটা অনুভূতিও হল, আমি এখানে খুব সহজ ও সাবলীল বোধ করছি। কোনও নতুন জায়গায় গেলে কাঁধ দুটো একটু উঁচু হয়ে থাকে। কে কী ভাবছে, কেউ আমাকে লক্ষ করছে কি না, কোনও আদবকায়দায় ভুল করে ফেললুম কি না, এইসব ভেবে সবসময় একটা সতর্ক ভাব বজায় রাখতে হয়। এখানে সেই ব্যাপারটা নেই। যে-কোনও অচেনা লোকের সামনে দাঁড়ালেই একটা পারস্পরিক তরঙ্গ বিনিময় হয়। অর্থাৎ সে আমাকে প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করছে কি না তা আমরা বুঝে যাই। এখানে শুধু রিগায় নয়, লেনিনগ্রাড ও মস্কোতেও সেই তরঙ্গ বিনিময় বেশ সন্তোষজনক। যে-কোনও লোকের সঙ্গেই কথা বললে বোঝা যায়, ভারতীয়দের সম্পর্কে এখানে কোনও বিরূপ মনোভাব বা অবজ্ঞার ভাব নেই।
রিগা শহরের কেন্দ্রে রয়েছে তিন ল্যাটভিয়ান রাইফেলম্যান-এর ভাস্কর্য। বিপ্লবের সময়ে এয়াই প্রথমে এগিয়ে যায়, সেই সম্মানে এদের মূর্তি বসানো রয়েছে। শহরের যে কোনও জায়গা থেকে দেখা যায় প্রাচীন দোম ক্যাথিড্রালের চুড়া। এখন এই ক্যাথিড্রালটিকে অর্গান রিসাইটালের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
শহরের মাঝখানে একটি খুব পুরোনো পাড়াকে অবিকৃত রাখা হয়েছে। সরু সরু গলি, ছোট ছোট দোতলা বাড়ি, খোয়া পাথরের চত্বর। আমার সঙ্গীদের কাছে শুনলুম, পুরোনো ইউরোপের পটভূমিকায় যেসব সিনেমা ভোলা হয় তার অনেকগুলিরই শুটিং-এর জন্য পরিচালকরা রিগা শহরে আসেন।
এই পাড়ারই একটি ছোট রেস্তোরাঁয় আমরা গেলুম কফি খেতে। এই রেস্তোরাঁর নাম ‘ড্রপ’, গেটের কাছে কোট জমা রাখতে হয়, ভেতরটা অন্ধকার-অন্ধকার। টেবিলে টেবিলে মোমবাতি জ্বলছে। এই দোকানটির কফি নাকি খুব বিখ্যাত, ছেলে-ছোঁকরারা খুব আসে এখানে।
কালো গাউন পরা দীর্ঘকায়া এক যুবতী এল আমাদের কাছে অর্ডার নিতে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা। আমি যদি এই শহরের নাগরিক হতুম, তা হলে ওই রেস্তোরাঁয় নিশ্চয়ই রোজ কফি খেতে আসতুম।
সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলুম নদীর ধারে। যে-কোনও শহরে এলেই আমার একবার নদী দেখে নিতে ইচ্ছে করে। এখানকার নদীর নাম ডাংগোভা। নদীটি তেমন প্রশস্ত নয়, তবু এর ওপরে একাধিক সেতু, দূরের একটি সেতু বেশ আধুনিক কায়দার।
এই নদীর ধার থেকে শহরটাকে অনেকখানি দেখা যায়। শুধু প্রাচীন বাড়ি নয়, নতুন বাড়িও উঠেছে অনেক। মস্কোতে হোটেল ইউক্রাইনের বাড়িটি যেরকম, সেরকম একটি বাড়ি এই শহরেও দূর থেকে চোখে পড়ে। স্তালিন আমলে এই ধরনের কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছিল।
কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমরা এলুম একটি হোটেলে, দুপুরের আহার সেরে নেবার জন্য। হোটেলটির নাম ‘ব্লু উইন্ড’। এখানে আমরা এ পি এন-এর নিমন্ত্রিত অতিথি। এ পি এন-এর স্থানীয় শাখার কর্তা এবং আরও কয়েকজন এসেছেন।
এই হোটেলটিও পুরোনো কায়দায় সজ্জিত। চাপা আলো। বড়-বড় পিঠ-উঁচু চেয়ার। চেয়ারগুলি ঠিকমতন সাজাতে গিয়ে একটি চেয়ার উলটে পড়ে গেল সশব্দে। এই ব্যাপারটা বেশ পছন্দ হল আমার। সবকিছু ঠিকঠাক চলার মধ্যে একটা কিছু হঠাৎ গণ্ডগোল হয়ে গেলে বেশ হয়। সবাই আমরা ভদ্র-মার্জিত ব্যবহার করছিলুম, এর মধ্যে একটা চেয়ার পড়ে যাওয়ায় সবাই একসঙ্গে চুপ।
সব সাজিয়ে ঠিকঠাক করে বসা হল। তবু তক্ষুনি খাবারের অর্ডার দেওয়া যাচ্ছে না। নিমন্ত্রণ কর্তাদের একজন বললেন, আমরা আর একজনের জন্য অপেক্ষা করছি, তিনি এক্ষুনি এসে যাবেন।
তখনও আমি জানি না, একটা বেশ চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য।