সকালবেলা সারগেইকে আমি জিগ্যেস করলুম, আজ কী কী প্রোগ্রাম আছে বলো!
সারগেই পকেট থেকে কাগজ বার করে দেখে বলল, অপেরা পরিচালক ও অভিনেতা অভিনেত্রীদের সঙ্গে আলোচনা, রাইটার্স ইউনিয়ানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, এ পি এন অফিসে সাক্ষাৎকার, আর্ট এক্সিবিশান দেখা…
আমি অস্কুটকণ্ঠে বললুম, বাবাঃ, এ যে রীতিমতন ভি আই পি’র মতন ব্যাপার, সারাদিন একটুও বিশ্রাম নেই। এক একদিন ইচ্ছে করে কিছু না করে চুপ করে বসে থাকতে।
আজ বৃষ্টি নেই, শীতও কম, ঝকঝকে রোদ, একটা পার্কে বসে পায়রাদের ওড়াউড়ি দেখলে বেশ হত। এখানকার পায়রাগুলো বেশ স্বাস্থ্যবান ও স্বাস্থ্যবতী। মস্কোতে কাক দেখে চিনতে পারিনি এত মোটা, রংও কুচকুচে কালো নয়।
আমি সারগেইকে বললুম, সবক’টা জায়গাতেই যেতে হবে? দু-একটা বাদ দিলে হয় না?
সারগেই চোখ বড় বড় করে বলল, না! সব জায়গায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা আছে, লোকজন অপেক্ষা করবে।
সারগেই নিজেই রিগা শহরে এই প্রথম এসেছে। এখানকার সবকিছু জানা সম্পর্কে ওরও আগ্রহ আছে। হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা দিনের কর্ম শুরু করার জন্য বেরিয়ে পড়লুম।
একটা বেশ পুরোনো থিয়েটার হলের একটি ঘরে একজন নাট্য-পরিচালক ও কয়েকজন মঞ্চকর্মী ও অভিনেতা-অভিনেত্রী অপেক্ষা করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আলাপ করা গেল কিছুক্ষণ। নাটক ও অপেরা সম্পর্কে সোভিয়েত জনগণের অত্যুৎসাহের কথা আমরা জানি। এ দেশের ফিল্ম খুব একটা উচ্চাঙ্গের নয়। আইজেনস্টাইন-পুড়কিন চেরকাশভের কথা মনে রেখেও বলা যায়, সাম্প্রতিক দু-চারটি সোভিয়েত ফিল্ম বেশ উচ্চমানের হলেও অধিকাংশ ফিল্ম মোটা দাগের, শিল্পকলা বা উপভোগ্যতা দুটোই কম। এদেশের টিভি অনুষ্ঠানও তেমন আকর্ষণীয় নয়, এঁরাই কয়েকজন বললেন। নাটক আর অপেরা কিন্তু উচ্চমান বজায় রেখে গেছে। রিগার নাটক মাঝে-মাঝে বিদেশ সফরেও যায়। এক একটি নাটক অনেকদিন চলে। সফল নাট্যকারদের রোজগারও খুব ভালো।
আমি বললুম, নাটক সম্পর্কে আলোচনা না করে নাটক দেখা অনেক বেশি ফলপ্রসূ নয়?
ওরা বললেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
পরে আমাকে একটি নাটক দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন ওঁরা।
রাইটার্স ইউনিয়ানে গিয়ে কয়েকটি চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারলুম। এঁদের বাড়িটি অবশ্য মস্কোর রাইটার্স ইউনিয়ানের মতন অমন বনেদি বাড়ি নয়। এখানকার সেক্রেটারি বললেন, ল্যাটভিয়াতে ২০০ জন লেখক আছেন, লেখাটাই যাঁদের জীবিকা! ল্যাটভিয়ার জনসংখ্যা মাত্র পঁচিশ লক্ষ, সেখানে দুশো লেখক? আরও জানলুম যে এখানে সঙ্গীত রচয়িতা ও সঙ্গীত সমালোচক আছে ৭০ জন, এবং শিল্পীর সংখ্যা ৭০০। এঁরা সবাই ইউনিয়নের সদস্য। এর বাইরেও শখের লেখক-শিল্পী আছেন, যাঁদের মূল্য জীবিকা অন্য কিছু।
এই তথ্যের বিস্ময় আমাকে অনেকক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখল। একটা জাতি কতখানি শিল্প-সাহিত্য প্রেমিক হলে সেখানে এতগুলি লেখক-শিল্পী-সঙ্গীতজ্ঞ থাকতে পারে! পঁচিশ লক্ষ জনসংখ্যার প্রত্যেকেই শিক্ষিত বলে ধরে নিচ্ছি, তা হলেও তাদের মধ্যে এত লেখক শিল্পীর সমাবেশ প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। অথচ সত্যি। ল্যাটভিয়ান ভাষায় সাহিত্যচর্চার বয়েসও বেশি নয়। একশো বছর আগেও এদেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর ছিল।
সেক্রেটারি মশাই বললেন, কিছু বছর আগে একটা সংস্কৃত অভিধান হাতে পেয়ে আমরা চমকে উঠেছিলুম। কিছু কিছু সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে আমাদের মিল আছে।
ল্যাটভিয়ানরা লাটিন জাতি, তাঁদের ভাবা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
আমি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললুম, আপনাদের এক সহোদরা ভাষার প্রতিনিধি হিসেবে আমি এসেছি, আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
বসন্তকালে রিগা শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভাল হয়। দোম ক্যাথিড্রালের সামনের প্রকাণ্ড চত্বরে তরুণ শিল্পীরা তাদের যার যার ছবি, ওয়াটার কালার, ট্যাপেস্ট্রি, পোস্টার, সেরামিক দ্রব্য ইত্যাদি যার যেরকম খুশি সাজিয়ে নিয়ে বসে। অনেকটা প্যারিসের Salon des indepedants-এর মতন। হাঁটতে-হাঁটতে সেখান দিয়ে যেতে-যেতে দেখলুম সেই শিল্পমেলার প্রস্তুতি চলছে। কয়েকজন তরুণ-তরুণী বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি টাঙাচ্ছে। মেলাটা শুরু হতে কয়েকদিন দেরি আছে, ততদিন আমার এখানে থাকা হবে না।
শুনলুম যে, এখানে ছবি প্রদর্শন করবার জন্য কোনও সিলেকশন কমিটি নেই। কোনওরকম বিধিনিষেধ নেই। প্যারিসের মেলার মতনই এখানেও ছবি রাখবার শর্ত একটাই, কোনও শর্তই থাকবে না! ছবির গুণাগুণ নির্ধারণের জন্যও থাকে না কোনও বিচারক; বিচারক হল দর্শকরা। তারা ইচ্ছে হলে কিনবে, অথবা কিনবে না!
শিল্পমেলাটি দেখা হবে না বলেই দেখতে গেলুম একটি শিল্প প্রদর্শনী। আমাদের হোটেলের কাছেই একটি বড় হলে রিগার তরুণ শিল্পীদের বার্ষিক প্রদর্শনী চলছে, টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।
প্রায় শ’দেড়েক ছবি ও কিছু ভাস্কর্য। সবচেয়ে যেটা অবাক লাগল, তা হল এতগুলি ছবির মধ্যে একটি ছবিও তথাকথিত রিয়েলিস্টিক নয়। ক্রুশ্চভের আমলে কলকাতায় সোভিয়েত শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী দেখেছিলুম, তার অধিকাংশ ছবিই আমাদের পছন্দ হয়নি। সেসব বেশিরভাগ ছবিই ছিল ফটোগ্রাফিক, চড়া রং ও হাইলাইটের ব্যবহার, শিল্পের বিস্ময় ছিল খুবই কম। এখানে, এখানকার তরুণ ছেলেমেয়েদের ছবিতে দেখতে পাচ্ছি রহস্যময়তার দিকে ঝোঁক। মানুষের মূর্তি যেতে চাইছে বিমূর্ততার দিকে। কিছু কিছু ছবি অবশ্য ইম্প্রেশানিস্টদের কপির মতন।
ঘণ্টাদুয়েক সেই শিল্প প্রদর্শনীতে বেশ কাটল।
এরপর গেলুম এ পি এন অফিসে। আজ ৫ মে, কোনও কারণে এখানে ছুটি। তবু ছুটির দিনেই আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য দফতরে এসেছেন কয়েকজন। যে সুরসিক ব্যক্তিটি রেল স্টেশনে আমাদের অভ্যর্থনা করতে গিয়েছিলেন, তিনিই এখানকার অফিস প্রধান।
তিনি জিগ্যেস করলেন, খুব ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে তো?
আমি হাসলুম।
তিনি বললেন, আমাদের কাজ হচ্ছে আপনাকে যত বেশি জায়গা সম্ভব ঘুরিয়ে দেখানো। মনে হচ্ছে আপনার কিছু কিছু সময় ফাঁকা যাচ্ছে, সেখানে আরও দু-একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঢুকিয়ে দিতে হবে।
আমি বললুম, দা মোর দা মেরিয়ার!
ছুটির দিয়ে অফিস-অফিস ভাব নেই, পরিবেশটা অনেকটা আড্ডার মতন। ওঁদের কাছে শুনতে লাগলুম ল্যাটভিয়ার অতীত ইতিহাস।
আমি জিগ্যেস করলুম, আচ্ছা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত তো ল্যাটভিয়ান অনেকরকম বিপর্যয় গেছে, এখনাকার মানুষজনকে বহুরকম কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু এখন রাস্তাঘাটে যাদের দেখি, সকলেই বেশ স্বাস্থ্যবান, খুশি-খুশি চেহারা, শিল্প-সাহিত্যে এখানকার মানুষদের এত আগ্রহ, এত তাড়াতাড়ি এরকম উন্নতি কী করে সম্ভব হল?
ওঁদের একজন বললেন, মানুষের প্রাণশক্তি! মানুষ সব পারে!
আমি আবার বললুম, আমার আর একটি কৌতূহলের নিবৃত্তি করুন তো! সোভিয়েত দেশে এসে দেখছি, থিয়েটারে-অপেরায়, ট্রেনে, রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, মেয়েরা আলাদা বসে, একসঙ্গে এক জোড়া নারী পুরুষের বদলে আলাদা নারী, আলাদা পুরুষ দেখতে পাই, এর কারণ কী? নারী-পুরুষের মেলামেশার নিশ্চয়ই কোনও বিধিনিষেধ নেই, তবু পুরুষ সঙ্গীহীন যুবতীদের এত বেশি সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায় কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আরও অনেক প্রশ্ন এসে যায়।
সোভিয়েত ইউনিয়ানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, শিক্ষার ক্ষেত্রে, জীবিকার ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষেত্রে। পশ্চিমি দেশগুলিতে মেয়েরা এতখানি স্বাধীনতা ও সমান অধিকার এখনও পায়নি। কিন্তু এই সমান মর্যাদাও অনেক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
বাড়ির বাইরে মেয়েরা পুরুষদের সমান অধিকার অর্জন করলেও, নিজের সংসারে কি সেই অধিকার পাওয়া সম্ভব? স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই সমান মাইনের এবং সমান পরিশ্রমের চাকরি করে। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পরও কি দুজনে সব কাজ সমানভাবে ভাগ করে নিতে পারে? মেয়েদের রান্নাঘরে ঢুকতেই হয়। বাচ্চাদেরও দেখাশুনো করতেই হয়, সে সময়টায় তার স্বামী টিভি দেখে কিংবা গল্পের বই খুলে বসে বা পাড়ার ক্লাবে খেলতে যায়। আজকাল অনেক স্বামী রান্না বা বাসন মাজার কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করে। কিন্তু তা সাহায্য মাত্র, সব কাজ সমানভাবে ভাগ করে নেওয়া অসম্ভব। বাড়িতে কোনও অতিথি এলে স্বামীর মুখ দিয়ে অমনি বেরিয়ে পড়বে, ওগো, দু-কাপ চা করে দাও তো! যেন এটা শুধু মেয়েদেরই কাজ। তা ছাড়া, যাকে বলে সংসার চালানো, ভাঁড়ার ঘর ভরতি রাখা ও জামাকাপড়ের হিসেব রাখা ও দায়িত্ব মেয়েদেরই নিতে হয়।
ধরা যাক, এসব দায়িত্বও পুরুষরা সমানভাবে ভাগ করে নিল। কিন্তু শিশুপালন পুরুষের পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব নয়। কোনও মা-ই এ দায়িত্ব পুরুষদের ওপর ছেড়ে দিতে চাইবেও না। সুতরাং বাইরের জগতে সমান অধিকারপ্রাপ্তা মেয়েদের বেশি পরিশ্রম করতে হয় নিজের সংসারে। এই কারণে খিটিমিটি বাধে, তারপর মন কষাকষি, তার পরেই ডিভোর্স।
সোভিয়েত ইউনিয়ানে ডিভোর্সের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। রিগা শহরে শতকরা ৫০টি পরিবারেই ডিভোর্স হয়।
আলোকপ্রাপ্তা মেয়েরা বিয়ের পরেও চাকরি ছাড়তে চায় না। শুধু টাকা পয়সার জন্য নয়, মেয়েরা চায় না শুধু পারিবারিক জীবনে আবদ্ধ থাকতে। তারা চায় সমাজের কাজেও নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে, গোষ্ঠীজীবনে তারা নিজেরাও প্রত্যেকে কিছু দিতে চায়, তারা চায় নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিবেশ।
সম্পূর্ণ সমান অধিকার পাওয়ার পর তারা আর যে-কোনও ভাবে পুরুষের চেয়ে বেশি পরিশ্রম বা বেশি দায়িত্ব নেওয়াটা বরদাস্ত করতে পারে না। এর ফলে জন্মহার সাংঘাতিকভাবে কমে যাচ্ছে। বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়া মানেই মেয়েদের বেশিদিনের জন্য বাড়িতে আটকে থাকা, বেশি দায়িত্ব, বেশি কাজ। সেইজন্য অধিকাংশ পরিবারেই আজকাল একটি মাত্র সন্তান। এদেশে দুটি সন্তান আছে এমন পরিবারের সংখ্যা যত, একটিও সন্তান নেই এমন পরিবারের সংখ্যাও তত। তিনটি সন্তান আছে, এমন পরিবার শতকরা মাত্র একটি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সোভিয়েত ইউনিয়ানের এখন জনসংখ্যা কমতির দিকে। বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য দম্পতিদের প্রতি সরকারি তরফ থেকে নানারকম উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। একগাদা কাচ্চাবাচ্চার মা হলে এদেশে সে সোনার মেডেল পাবে!
ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই এদেশে ডিভোর্স চায় বেশি। তার কারণ মেয়েদের নিরাপত্তার কোনও অভাব নেই। প্রত্যেক মেয়েই চাকরি পাবে এবং আলাদা থাকলে নিজস্ব ফ্ল্যাটও পাবে।
মেয়েদের সমান অধিকার আর পরিবার প্রথা, এই দুটিকে যেন আর খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। এর একটা সুষ্ঠু সমাধানের জন্য সমাজতাত্বিকদের নতুন করে ভাবতে হবে। পশ্চিমি দেশগুলিতে তো ছেলেমেয়েরা আজকাল বিয়েই করতে চাইছে না। সেইজন্য পারিবারিক বন্ধনও থাকছে না। ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতেও বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে, এবং সন্তান সংখ্যা কমছে। শুধু বড় শহরে নয়, গ্রামেও। উন্নত দেশগুলিতে এখন সত্যিকারের গ্রাম বলতে কিছু নেই, গ্রামের জীবনযাত্রাও শহুরে ধাঁচের।
সেইজন্যই পথে বা ট্রেনে বা থিয়েটারে আলাদা-আলাদা নারীদের দেখা যায়, যারা হয় কুমারী অথবা বিবাহ-ভগ্না। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ফল যদি হয় নারী ও পুরুষের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, তবে সেটাও তো খুব ভয়াবহ হবে।
আড্ডার মাঝখানে একটু চায়ের আয়োজন করা হল। স্পিরিট ল্যাম্পে গরম জল ফুটিয়ে তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হল চায়ের পাতা। এদেশে এসে একদিনও ভালো চা খাইনি, এই চা-ও যথারীতি বিস্বাদ। ভারত নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনেক চা বিক্রি করে, আমরা ওদের এত খারাপ চা দিই কেন?
ওঁদের একজন বললেন যে, তিনি সদ্য কানাডা ঘুরে এসেছেন, সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন এই চা।
অর্থাৎ আমি বিশিষ্ট অতিথি বলেই তিনি কানাডা থেকে সযত্নে নিয়ে আসা স্পেশাল চা পান করাচ্ছেন আমাকে। এর আগে এক জায়গায় শুনেছিলুম, জর্জিয়াতেও নাকি চা হয়। আমার সব ভূগোলের জ্ঞান গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমরা তো জানতুম, ভারত বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা বার্মা চিন ছাড়া আর কোথাও চা হয় না। এখন শুনছি জর্জিয়ান চা, ক্যানাডিয়ান চা, এসব কী? যাই হোক, আমি বঙ্গবাসী, আমার বাড়ি থেকে দার্জিলিং বেশি দূরে নয়, আমার কাছে এঁদের এই কালচে তরলপদার্থ মোটেই চা পদবাচ্য নয়।
রাত্তিরবেলা থিয়েটায়টি বেশ উপভোগ্য হল। আমাদের বসতে দেওয়া হয়েছিল একটি সংরক্ষিত বক্সে। দারুণ খাতিরের ব্যাপার। ওখানে বসতে পান শুধু নগরপাল এবং সোভিয়েত ডেপুটিরা। বক্সটির সংলগ্ন একটি ছোটঘর, সেখানে আছে ওভারকোট ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখার জায়গা আর ধূমপানের ব্যবস্থা। আমি আর সারগেই দোতলার বক্সে বসেছি, নীচ থেকে দর্শকরা কৌতূহলের সঙ্গে তাকিয়ে-তাকিয়ে আমায় দেখছে। আমাকে আফ্রিকার কোনও দেশের রাষ্ট্রপতি ভাবছে কি না কে জানে!
প্রেক্ষাগৃহটি দর্শকে পরিপূর্ণ। নাটকের কাহিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকার, প্রচণ্ড শীতে এক বরফ-ঝরা মধ্য রাত্রে একজন আগন্তুক এসে আশ্রয় চেয়েছে একটি গ্রামের বাড়িতে। জমিদারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, পালিয়ে এসেছে লোকটি, গ্রামের লোকদের জমিদারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ করতে চায়, কিন্তু দেখা গেল যে-বাড়িতে সে আশ্রয় নিয়েছে, সে বাড়ির কর্তী তার পূর্ব প্রণয়িনী। এই ব্যাপারটা টের পেয়ে গিয়ে বাড়ির কর্তা বারবার মদের দোকানে চলে গিয়ে ধূম মাতাল হয়ে পড়ে ইত্যাদি। কাহিনিটি অনেকটা আন্দাজে বুঝলুম, কারণ নাটকটি ল্যাটভিয়ান ভাষায় বলে সারগেইও বুঝতে পারছিল না। তবে অভিনয়ে ও মঞ্চসজ্জায় বেশ জমজমাট।
নাটক দেখে ফেরার পথে আমরা আর গাড়ি নিলুম না, হাঁটতে লাগলুম। পথে অনেক মানুষজন। আমাদের কোনও তাড়া নেই। আমরা গল্প করতে-করতে আস্তে-আস্তে হাঁটছি।
হঠাৎ একজন লোক আমার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটির চোখমুখ দেখে মনে হয় কিঞ্চিৎ-অধিক ভদকা সেবন হয়েছে।
লোকটি জিগ্যেস করল, হিন্দি?
বুঝলুম সে জানতে চাইছে আমি ভারতীয় কি না। আমি মাথা নাড়লুম।
লোকটি হাসিমুখে আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, হিন্দি-রুশী বায় বায় (ভাই ভাই)।