১৫. তরকারির নাম কচ্চালু

ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে একরকম তরকারি হত, তার নাম কচ্চালু। হয়তো এ নামের তরকারি অন্য কোথাও পরিচিত নয়। আমাদের পারিবারিক নাম। অর্থাৎ যুদ্ধের পরপর যখন আলুর খুব টানাটানি, তখন আমরা খুব আলুর দম খেতাম, অবশ্য দু-একটা আলুর সঙ্গে প্রচুর কচুর ভেজাল দিয়ে। ভেজাল আবিষ্কারের পর কচ্চালু নাম রেখেছিলাম।

ছেলেবেলায় আর একটা কথা ছিল, দৈবাৎ যদি কখনও পেট ব্যথা করত, মা অমনি ধমকে বলতেন, কেন হোটেল মোটেলে খাস। ওদের কি রান্নার কোনও মাথামুন্ডু আছে? হোটেলের সঙ্গে নিতান্ত ধন্যাত্মক মোটেল শব্দটা মা নিতান্ত না জেনেই ব্যবহার করতেন। পরে জানতে পারি, মোটেলও একটা বস্তু। নিতান্ত ধ্বন্যাত্মক না। অনেকটা কচ্চালুর মতো। মোটর গাড়ি ও হোটেলের সন্ধি!

মোটর গাড়ির সঙ্গে মোটেলের যোগ শুধু এইটুকু যে, মোটর গাড়ি যাত্রীরা এসব হোটেলে রাত্রির বেলা মোটর গাড়ি রেখে দিতে পারেন। বিরাট-বিরাট হাইওয়েতে পদযাত্রী একজনও থাকে না। আমেরিকায় সকলেরই গাড়ি এবং গাড়ি পার্ক করা বিষম সমস্যা। সুতরাং রাত্রে বিশ্রাম নেবার জন্য গাড়ির মালিকের মতো গাড়িরই একটা শোবার জায়গা দরকার! হোটেলের বদলে মোটেল কথাটা লেখা থাকলেই বুঝতে পারা যাবে–খটর গাড়ি রাখবার জায়গা আছে। ক্লান্ত আরোহী হয়তো গাড়ি চালিয়ে চলেছেন পরপর পান্থনিবাস দেখে-দেখে, অনেক মোটেলের গায়ে জায়গা নেই লেখা জ্বলজ্বল করছে। মোটেলগুলো থাকে সাধারণত বাইরে। শহরের মধ্যে গাড়ি থামাবার জায়গা নেই। থাকলেও ঘণ্টা অনুযায়ী পয়সা দিতে হয়।

শিকাগো এয়ারপোর্টে আমি একদিন রাত্তির বেলা বসে আছি, আমার পরের প্লেন পরের দিন সকালে। রাতটা এয়ারপোর্টে গদিমোড়া চেয়ারে শুয়ে কাটিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু বহুক্ষণ প্লেনে কাটিয়ে আমার ইচ্ছে হচ্ছিল আরাম করে শুয়ে ঘুমোতে। কাছাকাছি হোটেলগুলোর নাম খুঁজলাম। একটাও নেই, সব মোটেল। অথচ আমার তো গাড়ি নেই। তা ছাড়া ওগুলো কত দূরে কী জানি। তবু শয়নের ইচ্ছে প্রবল হওয়ায় আমি তালিকার নীচের দিকের নামের মোটেলে ফোন করলাম। আমি একটা রাত থাকতে চাই, তোমাদের ওটা কত দূরে? উত্তর এল, মাইল চারেক হবে। কেন তোমার গাড়ি কি খারাপ হয়ে গেছে?

–আমার গাড়ি নেই।

ও, আচ্ছা! ঠিক আছে, তুমি বাইরে এসে দাঁড়াও। আমাদের গাড়ি পাঠাচ্ছি।

দাঁড়ালুম। হুম করে কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা বিশাল গাড়ি এসে দাঁড়াল। লম্বা নিগ্রো ড্রাইভার বলল, তুমি ফোন করেছিলে? এসো।

উঠে খানিকটা গেছি, হঠাৎ কী খেয়াল হল ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলাম, তোমাদের মোটেলের চার্জ কত? দশ ডলার। শুনেই হঠাৎ আমার শীত করতে লাগল। পকেটে মাত্র আটটি ডলার। আর কিছুই নেই প্লেনের টিকিট কাটা আছে। কাল সকালেই পৌঁছে যাব টাকা বেশি দরকারও ছিল না। কিন্তু এখন কী করি? এতখানি আসার পর এখন ফিরে যাই বা কী করে? ড্রাইভারটিকে বললাম, তুমি ভারতবর্ষের সিগারেট খাবে?

দেখি, দাও তো একটা। বাঃ চমৎকার তো।

-তুমি একটা প্যাকেট নেবে? তোমাকে উপহার দিলাম।

-ধন্যবাদ।

–শোনো ভাই, আমার কাছে টাকা কম আছে। আট ডলার। তোমাদের মোটেলে যাওরার সামর্থ্য নেই। মাত্র আট ডলার আছে। এখন কী করি বলল তো?

-ও, এই ব্যাপার? হু! আচ্ছা এখানে যেটা সবচেয়ে সস্তা সেটাই আট ডলার। তোমাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।

-কিন্তু সেটা তো তোমাদের কোম্পানি নয়!

–তা হোক, চলো, তোমাকে একটা লিফট দিই।

পরের হোটেলে ঢুকেই আমি ম্যানেজারকে বললাম, আমাকে আট ডলারের একটা ঘর দাও। আমি কিছু চাই না, খাবার না, সারভিস না। কিন্তু কাল ভোরবেলা দয়া করে তোমাদের গাড়িতে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিও। আমার কাছে আর একটাও পয়সা নেই। মোটেলগুলোর নামে নানান বদনাম শুনেছিলাম। তা ছাড়া বিত্তবান যাত্রীরাই এখানে আসে–সকাল বেলা আরও কী চার্জ দিতে হয়, কে জানে। আগে থেকে বলে রাখা ভালো।

-তুমি খাবে না রাত্তিরে? ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করল।

-না। দয়া করে সকালবেলা আমাকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতেই হবে। আমার কাছে আর পয়সা নেই।

-হ্যাঁ দেবো। আচ্ছা, তুমি তিন ডলার ফেরত নাও। আমার খানিকটা কনশেসন করার ক্ষমতা আছে।

-না, ধন্যবাদ। তুমি যে কাল আমায় পৌঁছে দেবে, এজন্যই আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর বেশি কিছু চাই না। তাহলে আমার খারাপ লাগবে, মনে হবে তুমি আমায় দয়া করছে।

-ও, আচ্ছা। তুমি একটা ডলার অন্তত ফেরত নাও। কাল সকালে যে পোর্টার তোমার মাল তুলে দেবে, তাকে কিংবা ড্রাইভারকে বকশিশ দিও।

নির্দিষ্ট ঘরে এসে সুস্থ হলাম। রাত্রে ঘুমের সম্ভাবনায় খুব খুশি-খুশি লাগছিল, যদিও খিদেতে পেট চিন চিন করছে। তা থাকগে। আশে পাশের কয়েকটা ঘরে হই-হুল্লা হচ্ছে। লাল নীল আলোর মধ্যে কালো আর সাদা আর হলদে পোশাক পরা নারীপুরুষ। সামনের উঠোনে রকমারি মোটর গাড়িতে ঠাসা। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় দিগন্ত ধুয়ে যাচ্ছে।

দরজায় ঠুকঠুক। আঃ কী মুশকিল, বলে এলাম তো আর কিছুই চাই না। বেয়ারা ঢুকলেই তো বকশিশ দেবার কথা ওঠে। ম্যানেজার ঢুকলেন, হাতে প্যাকেট। অত্যন্ত বিনীত লাজুক ভঙ্গি। বললেন, যদি কিছু মনে না করেন আসুন আপনার ঘরে আমার খাবারটা আপনি আর আমি দুজনে ভাগ করে খাই। আমার একা-একা খেতে ভালো লাগে না। দয়া করে আমার সঙ্গে আমার এই খাবার একটু খাবেন? কিন্তু প্লিজ এতে আর কিছু মনে করবেন না।