প্রথম মানব আদমের জ্যেষ্ঠ সন্তানের নাম সেম। সেই সেমের বংশধররাই সেমেটিক বা সেমাইট জাতি। অর্থাৎ জু, ইহুদি। ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্য জাতি। শেক্সপিয়ার মার্চেন্ট অব ভেনিসের শাইলকের বর্ণনা করতে গিয়ে শুধু সংক্ষেপে বলেছেন–’হি ইজ আ জু!’ অর্থাৎ আর কিছু নিন্দাবাদের দরকার নেই। শুধু ‘ইহুদি’–এই শব্দের উচ্চারণেই ঝরে পড়ে তীব্র ঘৃণা। হাজার হাজার বছর ধরে ইহুদিরা সারা পৃথিবীর কাছ থেকে ঘৃণা, লাঞ্ছনা ও অত্যাচার সহ্য করেও স্বতন্ত্র জাতির অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে। মূল্যহীন, দেহহীন ইহুদিরা ইতিহাসের বুকের উপরে চির ভ্রাম্যমাণ।
ইহুদিদের ওপর প্রথম অত্যাচার শুরু হয়েছিল মিশরে। আজও পৃথিবীর একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রের প্রবলতম শত্রু মিশর। তিন হাজার বছরেরও আগে আর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন সন্ত মোজেজের নেতৃত্বে ইহুদিরা মিশর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। সেই ঘরছাড়া মানুষদের জন্য মোজেজের লোকান্তরের পর ইহুদিদের নেতা জেসুয়া বাহুবলে জয় করলেন প্যালেস্টাইন, স্থাপিত হল প্রথম ইহুদি রাজ্য।
প্যালেস্টাইনে কয়েকশো বছর সুখ ও সমৃদ্ধির সুখ দেখেছিল ইহুদিরা। তারপরেই রোমান আক্রমণ। যিশুখ্রিস্টের মৃত্যু। রোমানরা শুধু প্যালেস্টাইনকে পদানত করেই খুশি হল না, প্যালেস্টাইন থেকে উচ্ছেদ করে দিতে শুরু করল ইহুদিদের। ইহুদিরা আবার বিবাগি, ঘরছাড়া। প্যালেস্টাইনের সমস্ত ইহুদি মন্দির ও ধর্মস্থান ধ্বংস করে দিয়েছিল রোমানরা, অবশিষ্ট ছিল মাত্র একটি দেয়াল–যে দেয়ালটির জন্য দেশ বিদেশের ইহুদিরা বিলাপ করতো।
প্যালেস্টাইনের এক অংশের এখন নতুন নাম ইজরাইল। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসংঘের সনজ অনুযায়ী প্যালেস্টাইনকে বিভক্ত করে এক অংশের নাম হল জর্ডন একটি আরও চলমান রাষ্ট্র। অপর অংশটি ইজরাইল নাম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল স্বাধীন ইহুদি রাজ্য। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল আরবদের বিদ্বেষ। প্রায় দু-হাজার বছর পর মাতৃভূমি ফিরে পাওয়া এবং দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে একটি নতুন রাজ্য গড়ে তোলার এ রকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে অভূতপূর্ব। এবং রোমাঞ্চকর সেই ইতিহাস।
চতুর্দশ শতকে যখন সারা ইউরোপ জুড়ে প্লেগের উপদ্রব দেখা দিল, ইতিহাসে যার নাম দিয়েছে ব্ল্যাক ডেথ। হাজার হাজার মানুষ মরতে লাগল বিনা চিকিৎসায়, তখনও দোষ পড়লো ইহুদিদের ওপর। ওরা জাদুকর, ওরা মন্ত্র জানে, ওরা শয়তান, ওরা খরো। এই রব উঠল। প্রথম এড ওয়ার্ড ইংল্যান্ড থেকে সমস্ত ইহুদিদের বিদায় করে দিলেন। রাশিয়াতেও চরম অত্যাচার হয়েছে–জারেরা প্রচার করলেন, খ্রিস্টানদের রক্ত না হলে ইহুদিদের কোনওরকম পূজা-আচ্চা হয় না। সুতরাং ইহুদিদের পুড়িয়ে মারার ঢালাও হুকুম। পোলান্ডে কন্সাক আক্রমণের সময় পাঁচ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৮৮১ সালে রাশিয়ার খবর দ্বিতীয় আলেকজান্ডার নিহত হন সন্ত্রাসবাদীদের বোমার আঘাতে। সন্ত্রাসবাদীদের দলে ছিল একটি ইহুদি মেয়ে, সেই মেয়ের অপরাধে রাশিয়ায় গ্রহণ করা হয়েছিল ধারাবাহিক ইহুদি নিধন পরিকল্পনা, ‘প্রোগ্রোম’। লক্ষাধিক ইহুদি মরেছিল সেই সময়।
তবে ইহুদি হত্যার চরম কৃতিত্ব পাবার অধিকার হিটলার। পরশুরামের পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়হীন করার পরিকল্পনার আধিপত্য ছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের। এই দুই শক্তি সে সময় একটি বিখ্যাত চাল চালে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধে পর্যুদস্ত হবার পর্যায়ে এসে। তুরস্ক যোগ দিয়েছিল জার্মানির সঙ্গে–তাই তুর্কিদের বিরুদ্ধে আরবদের খেপিয়ে দেবার জন্য ঘোষণা করা হল যে, যুদ্ধ শেষ হলে এবং ইংল্যান্ড ফ্রান্স জয়লাভ করলে–আরবদের স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
নেল লরেন্স–’মরুভূমির লরেন্স’ নামে যিনি খ্যাত-তাকে লাগানো হল আরবদের সঙ্ঘ-বদ্ধ করার কাজে। আর অন্যদিকে, ইহুদিদেরও জানানো হল যে যুদ্ধ শেষে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের স্বাধীন রাজ্য দেওয়া হবে–এই ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, জার্মানির ইহুদিরা যাতে জার্মানির পক্ষে লড়াই না করে। ইহুদিদের প্রতি সেই ঘোষণা, ‘বালফোর ডিক্লারেসান’ নামে খ্যাত। বলা বাহুল্য, যুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজ ফরাসীরা কোনও প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেননি। তখন শুরু হল আরব ইহুদিদের পৃথকভাবে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতা। এতকাল পর তারপর নিজেদের বুকের ওপর আর একটি বিদেশি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। কারণ এতদিনে ইহুদিদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চালচলন ইউরোপীয়দের মতো হয়ে গেছে–সুতরাং স্বদেশে ফিরলেও তারা এখন পুরোপুরি সাহেবি। এই দ্বিমুখী শত্রুতা সত্বেও অসীম ধৈর্য এবং আত্মবিশ্বাসে গোপনে লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ইহুদিরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারল।
ইহুদিদের প্রতি খ্রিস্টান ও মুসলমান–দুই ধর্মাবলম্বীরাই বিদ্বেষী। কারণ প্যালেস্টাইনে জেরুসালেম শুধু ইহুদিদের নয়, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামেরও পবিত্র তীর্থ। জেরুজালেম যিশুখ্রিস্টের স্মৃতি বিজড়িত। আবার রোমানরা এই নগর ধ্বংস করে যাওয়ার পর ইহুদি মন্দিরের শেষ দেয়ালটির পাশে খলিফা ওমর মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই দেয়াল ইহুদিদের কাছে মহা পবিত্র : ‘উইপিং ওয়াল, অশ্রু প্রাচীর নামে পরিচিত। সেই দেয়ালের সেখানে কপাল ঠুকে ইহুদিরা যখন কাঁদে-তখন মুসলমানরা মনে করে যে ওমরের মসজিদের অবমাননা করা হচ্ছে।
ইহুদিদের সঙ্গে আরবদের জীবনযাত্রার অনেক তফাৎ। ইহুদিরা আরবদের তুলনায় অনেক শিক্ষিত, ধনবান এবং বিজ্ঞানের সাহায্যপুষ্ট। সুতরাং আরবদের বিদ্বেষ থাকা সংগত। সঙ্গে আছে ধর্মবিদ্বেষ। অতএব ইজরাইল রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য আরব রাষ্ট্রগুলি মিলিতভাবে উদ্যোগী। মিশরের নাসের সেই দলের নেতা। সমস্ত প্রতিবেশী শত্রু দেশগুলির মধ্যে ঘেরা অবস্থায় ইজরাইল নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে প্রাণপণে।
সম্প্রতি ইজরাইল ও আরব রাষ্ট্রগুলির বিবাদ নতুন রূপ নিয়েছে। আমেরিকা ইজরাইলকে সাহায্য করে। পশ্চিম জার্মানি পূর্ব পাপের ক্ষালন হিসাবে ইজরাইলকে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য করছে। অপর পক্ষে মিশরও আমেরিকায় জার্মানির সাহায্য করছে। কিন্তু ইজরাইলের যে বন্ধু, সে কখনও মিশর বা কোনও আরব রাষ্ট্রের বন্ধু হতে পারে না। সুতরাং নাসের চাইছেন পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে সমগ্র আরব দুনিয়ার সম্পর্ক ছেদ করতে এবং আমেরিকার প্রতি অভিমানে ঝুঁকে পড়ছেন রাশিয়ার দিকে।
আরব, ইজরাইল ও পশ্চিমি শক্তির বর্তমান মনকষাকষি ত্রিভূজ প্রেমের দ্বন্দ্বের মতোই জটিল।