এক হাঙ্গেরিয়ান লেখক-দম্পতির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল অনেকদিন ধরে। জর্জ সোমলিও এবং তার স্ত্রী আনা। জর্জ নামটি হাঙ্গেরিয়ান উচ্চারণে অনেকটা গিওর্গি হয়ে যায়। টেলিফোন গাইডে জর্জের ঠিকানা পাওয়া গেল, কিন্তু সেখানে এখন সে থাকে না, নতুন ঠিকানা সেই বাড়ির কেউ বলতে চায় না। জর্জ একজন বিখ্যাত কবি এবং সম্পাদক, তার নাম ওদেশে সবাই জানে। আমাদের বাড়িউলি বৃদ্ধাও জানেন। আমাদের সঙ্গে দরকারি কথাবার্তা চালাবার জন্য মাদাম এখন একটি নতুন কায়দা বার করেছেন। একটা খবরের কাগজের অফিসে ফোন করে ফরাসি কিংবা ইংরেজি-জানা কারুকে ধরেন, তারপর আমাদের একজন তার সঙ্গে কথা বলে, সে আবার মাদামকে হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় বুঝিয়ে দেয়। সেইরকমভাবেই মাদাম একজন মহিলা সাংবাদিককে ধরে দিলেন, সেই মেয়েটি জানাল যে, জর্জ কোথায় থাকে তা জানা একটু শক্ত, কারণ ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সদ্য বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তবে সে আমাদের সাহায্য করবার চেষ্টা করবে।
বছর কয়েক আগে অসলো শহরে নরোয়েজিয়ান লেখিকা বিয়র্গ ভিক আমাকে বলেছিল, জর্জ আর আনার খবর জানো? ওদের বিয়েটা বোধহয় টিকবে না। খবরটা শুনে আমি খুব অবাক হইনি। আয়ওয়াতে আন্তর্জাতিক লেখক সমাবেশে আমরা অনেকে মাস চারেক ধরে ছিলাম। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, গ্রিস, জাপান, মেক্সিকো, ব্রাজিল, পোলান্ড, সোভিয়েত ইউনিয়ন, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি বহু দেশের লেখক-লেখিকা ছিলেন, সবচেয়ে বয়ঃজ্যেষ্ঠা ছিলেন চিনের প্রখ্যাত লেখিকা মাদাম ডিং লিং, যিনি ছিলেন মাও সে তুং-এর এক কালের বান্ধবী, তাঁর কাছে চিনের বিপ্লবের অনেক গল্প শুনেছি। আবার অন্যান্য দেশের অনেক তরুণ-তরুণী কবি-ঔপন্যাসিকও ছিলেন। তবে, নানা আলাপ-আলোচনায় ওই হাঙ্গেরিয়ান দম্পতির কথা এসে যেত প্রায়ই। তার কারণ, ওই দুজনই ছিল বিশেষ দ্রষ্টব্য। জর্জ মধ্যবয়স্ক, মোটাসোটা থলথলে চেহারা, মাথার চুল পাতলা, কথাবার্তাতেও চাকচিক্য নেই, আর আনা-র বয়েস তার অর্ধেক, সে অতিশয় রূপসী। আনা জর্জের তৃতীয় তরুণী ভার্যা। আনাকে দেখে আমাদের সকলের ধারণা হয়েছিল, হাঙ্গেরিয়ান মেয়েরা খুব সুন্দর হয়। অনেকে জল্পনা করত, এত বয়েসের তফাত সত্বেও আনা জর্জকে বিয়ে করেছে কেন, শুধু জর্জের খ্যাতির মোহে? আনা নিজেও লেখিকা, সে ছোট গল্প লিখত। আনা একদিন আমাকে বলেছিল, পুরুষ লেখকদের চেহারায় কিছু আসে যায় না কিন্তু কোনও লেখিকা যদি রূপসী হয়, তা হলে সে কিছু কিছু সুবিধে পায় বটে, তার চেয়ে অসুবিধে অনেক বেশি। আনা আমার সঙ্গে প্রায়ই গল্প করত, কারণ ওর ধারণা ছিল, ও সিকি পরিমাণ ভারতীয়। ওর চোখের তারা কালো, পিঠ পর্যন্ত ছাওয়া দীঘল কালো চুল, ও বলত, ওর শরীরে নিশ্চয়ই জিপসিদের রক্ত আছে। হাঙ্গেরিতে জিপসির সংখ্যা প্রচুর এবং অনেকের মতে সেই সব জিপসিরা গেছে ভারতবর্ষ থেকে।
আয়ওয়া ছাড়ার পরেও বছর চারেক বাদে জর্জ ও আনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল বেলজিয়ামে। সেবারেও অনেক গল্প হয়েছিল, তবে আমি লক্ষ করেছিলাম, স্বামীর প্রতি আনার সেই গদগদ ভাবটা নেই, তার মিষ্ট কণ্ঠস্বরে মাঝে মাঝে ঝাল বাক্য বেরিয়ে আসছে।
ওরা দু’জনেই আমাকে অনেকবার হাঙ্গেরিতে আসার জন্য নেমন্তন্ন করেছে, এখন সত্যিই আমি বুড়াপেস্টে উপস্থিত হয়েছি, তবু ওদের সঙ্গে দেখা হবে না? কিছুতেই ঠিকানা বা কোনও নাম্বার যোগাড় করা যাচ্ছে না। এটুকু খবর পাওয়া গেল যে জর্জ ও আনার বিচ্ছেদ এখানকার সাহিত্যিক সাংবাদিক মহলের সাম্প্রতিক বেশ একটা মুখরোচক ঘটনা, বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে আনা একজন নামকরা চিত্র পরিচালককে বিয়ে করেছে এবং জর্জ খুব মুষড়ে পড়েছে।
মহিলা-সাংবাদিকটি সত্যিই আমাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছিল। একদিন রাত দশটায় টেলিফোন বেজে উঠল, আমাদের মাদাম চেঁচিয়ে উঠলেন, ইংলিশ, ইংলিশ! অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায় কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি গিয়ে ফোন তুলতেই শুনতে পেলাম আনার কণ্ঠস্বর।
খানিকটা অপরাধী গলায় প্রচুর ক্ষমা চেয়ে আনা জানাল যে একটু আগে সে আমার খবর পেয়েছে এক সাংবাদিকের কাছ থেকে, কিন্তু কাল ভোরেই তাকে চলে যেতে হচ্ছে প্যারিস, আজ অনেক রাত হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে তার দেখা হবে না এ জন্য সে মর্মাহত, কিন্তু কোনও উপায়ও তো নেই। টেলিফোনেই অনেক গল্প হল, দু-তিনবার সে জিগ্যেস করল, তোমাদের খাওয়াদাওরার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
পরদিন সন্ধেবেলা ফোন করল জর্জ সোমলিও। সে-ও মহিলা সাংবাদিকটির কাছ থেকে খবর পেয়েছে। সেই সাংবাদিকটির সঙ্গে আমাদের চাক্ষুষ দেখা হয়নি, তার এই নিঃস্বার্থ তৎপরতার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করেছি।
খানিক বাদেই চলে এল জর্জ, তাকে নিয়ে আমরা কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে গেলাম। হাঙ্গেরিয়ানরা সাহিত্যপ্রেমিক, রেস্তোরাঁর মালিক ও পরিচারকরাও চিনতে পারল এই বিখ্যাত কবিকে।
বিরহ কিংবা মর্মবেদনায় জর্জ বেশ রোগা হয়ে গেছে, চুলে কালো রং মাখার জন্য তার বয়েস এখন কিছুটা কম দেখায়। আমি অন্য বন্ধুদের আগেই বলে দিয়েছিলাম যে জর্জের কাছে আনার প্রসঙ্গ একেবারেই উল্লেখ করা হবে না। জর্জও প্রায় দু-ঘণ্টা আড্ডার শেষে আমার দিকে চেয়ে বলল–তুমি হয়তো জানো না, আমার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তোমার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল, তুমি তার সঙ্গে আলাদা দেখা করতে পারতে, কিন্তু আমি তার কোনও খোঁজ রাখি না।
রেস্তোরাঁয় বসে জর্জ প্রথমেই একটা অদ্ভুত কথা বলেছিল, সে এর মধ্যে ইংরিজি প্রায় ভুলে গেছে, ইংরিজিতে কথা বলতে তার অস্বস্তি হয়। হাঙ্গেরিয়ান ছাড়া ফরাসি ভাষায় কথা বলতে সে সাবলীল বোধ করে। তাতে অসুবিধে নেই, আমাদের ফরাসি ভাষী অসীম আছে, কিন্তু আমরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারব না। একটা ত্রিপাক্ষিক অনুবাদ সংলাপ চালাতে হবে?
আস্তে আস্তে অবশ্য ব্যাপারটা সহজ হয়ে এল। জর্জ কখনও ভাঙা ভাঙা ইংরিজি বলে, কখনও ইংরিজি সঠিক শব্দ খুঁজে না পেলে অসীমকে ফরাসিতে জিগ্যেস করে, তখন তার মুখ কুঞ্চিত হয়ে যায়। ইংরিজি সম্পর্কে জর্জের দ্বিধার কারণ আমি বুঝতে পারি। লেখক মাত্রই শব্দের কারবারি, নিজস্ব ধরনের শব্দ ব্যবহারেই তার বৈশিষ্ট্য, শব্দকে নিয়ে সে খেলা করতেও পারে, সেটা মাতৃভাষাতেই সবচেয়ে বেশি সম্ভব। লেখা কিংবা কথা বলার সময় সঠিক শব্দটা খুঁজে না পেলে একজন লেখকের শারীরিক কষ্ট হয়, অপমান বোধ হই। ভুল ভাষা আর যাকেই হোক, কোনও লেখককে মানায় না। তবু আমরা অনেক সময় বাধ্য হই। ইংরেজ-আমেরিকানদের সঙ্গে সব সময় আমাদের এক অসম প্রতিযোগিতায় থাকতে হয়। তারা কথা বলে মাতৃভাষায়, আমরা বলি আয়ত্ত করা ইংরিজিতে। অনেক সময়েই তারা ভাষার মোচড়ে চকিত রসিকতা করে, আমরা তার উত্তর না দিতে পেরে মুখে হাসি মাখিয়ে রাখি।
আড্ডায় ঘুরেফিরে সাম্প্রতিক পালাবদলের প্রসঙ্গ আসবেই। আমার বন্ধুরা জিগ্যেস করল, হাঙ্গেরির সাধারণ মানুষ সবাই কি শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন খুশি মনে নিয়েছে?
জর্জ বলল, বেশিরভাগ লোক চেয়েছে বলেই তো পরিবর্তন এসেছে। এখানে তো জোর করে সরকারের পতন ঘটানো হয়নি। একটুও যুদ্ধ বা রক্তপাত হয়নি।
ভাস্কর জিগ্যেস করল, কমুনিস্ট পার্টি কেন ক্ষমতা ছেড়ে দিল সেটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
জর্জ বলল, আমার ধারণা, সেটা এখন পৃথিবীর সবাই জেনে গেছে। তবু আমি সংক্ষেপে বলছি।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, জর্জ, দেশের সাধারণ মানুষ সরকার পরিবর্তনের জন্য চাপ দিয়েছিল, সেটা বুঝলাম, কিন্তু তোমার মতন বুদ্ধিজীবী-শিল্পীরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইল কেন? আমি যতদূর জানি অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তোমাদের এখানে অনেকটা স্বাধীনতা ছিল, সেন্সরশিপের কড়াকড়ি ছিল না, তোমরা ইচ্ছেমতন বিদেশে যেতে পারতে, তুমি নিজে অনেকবার গেছ, তা হলে তোমার ব্যক্তিগতভাবে কি সরকারের প্রতি কোনও ক্ষোভ ছিল?
জর্জ বলল, আমি বিদেশে গেছি, হয় অন্য দেশের কোনও প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে, কিংবা হাঙ্গেরির সরকারের প্রতিনিধি হয়ে। একমাত্র সেইভাবেই যাওয়া যেত। সাধারণ মানুষের ইচ্ছেমতন বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ছিল না। এখানে অনেক টুরিস্ট আসে, বাইরের বহু দেশের মানুষ বুড়াপেস্ট বেড়াতে আসে, কিন্তু এখনকার মানুষ যেভাবে যখন খুশি বেড়াতে যেতে পারত না। ঠিক যে বাধা দেওয়া হত তা নয়, কিন্তু একটা পরোক্ষ চাপ ছিল, কেউ যেতে চাইলে তাকে অন্য কোনও ছুতোয় হয়রান করা হত। অন্য দেশের লেখক এ দেশে আসে, অথচ হাঙ্গেরিয়ানরা কেন বাইরে যেতে পারবে না, তারা তো কূপমন্ডুক নয়। তাদের মনে ক্ষোভ তো জমবেই।
আমি বললাম, তোমার মতন বুদ্ধিজীবীদের তো সে অসুবিধে ভোগ করতে হয়নি।
তোমরা অনেকটাই স্বাধীনতা পেয়েছ। তুমি কি মনে করো না যে ধনতন্ত্র বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের চেয়ে সমাজতন্ত্র অনেক উন্নততর ব্যবস্থা?
জর্জ বলল, আমি সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলাম। একটা আদর্শ হিসেবে। কিন্তু কাগজে কলমে সেটা যত বড় আদর্শ, কাজে তার অনেক তফাত ঘটে যায়। সমাজতন্ত্রে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর। এতে কিছু লোকের হাতে ক্ষমতা জমে যেতে বাধ্য। একদলীয় শাসনে পার্টি হয়ে যায় সর্বেসর্বা। পার্টির অনুগত না হলে তুমি কোনও ভালো কাজ পাবে না। এর থেকেই আসে করাপশান। এখানে পার্টির নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী ছিল, তার নাম ওয়াকার্স মিলিশিয়া, সাধারণ মানুষ, এমনকি আমরা এদের ভয় পেতাম। প্রত্যেকটা কারখানায়, অফিসে, পার্টির নিজস্ব সেল ছিল, তারা সব লোকের ওপর নজর রাখত, খবরদারি করত, চুকলি কাটত,… এদের জন্য সব সময় আমাদের একটা অস্বস্তির মধ্যে থাকতে হত, এদের প্রতি বেশিরভাগ মানুষের একটা ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল। গতবছর আমাদের পার্লামেন্ট তাড়াতড়িতে কয়েকটা আইন পাশ করে পার্টির এই একচ্ছত্র ক্ষমতা যদি নষ্ট করে না দিত, তা হলে নির্ঘাত বড় রকমের আন্দোলন ও রক্তারক্তি শুরু হয়ে যেত। ওয়ার্কাস মিলিশিয়া ভেঙে দেওয়া হল, অফিস-কারখানায় পার্টি সেলগুলো তুলে দেওয়া হল। কমিউনিস্ট পার্টি এগুলো মেনে নিয়ে খুব বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে। ঠিক সময়ে তারা পার্টির নাম সোসালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির বদলে শুধু সোসালিস্ট পার্টি করেছে। ওয়ার্কাস পার্টি এটা ছিলও না, কোনও সোসালিস্ট দেশেই ওয়ার্কার্স পার্টি হয়নি, ওটা কথার কথা। আমাদের এখানকার কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের মনোপলি ছেড়ে দিয়ে মাল্টি পার্টি ডেমোক্রেসি মেনে নিয়ে দেশটাকে বাঁচিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থাও এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে খোলাবাজার নীতি না নিলে রুমানিয়ার মতন আমাদেরও না খেয়ে থাকতে হত।
ভাস্কর জিগ্যেস করলে, কমিউনিস্ট পার্টি বিনা যুদ্ধে নিজেদের অধিকার ছেড়ে দিল কেন?
জর্জ বলল, পোল্যান্ডের দৃষ্টান্ত দেখে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থা দেখে। অনেকটা অধিকার ছেড়ে দিয়ে তারা পার্টিটাকে বাঁচাল। সাধারণ মানুষ যে ফুসছে তা তারা টের পেয়েছিল। না হলে, পার্টির নাম বদলেও তারা সাধারণ মানুষের ক্রোধ থেকে রক্ষা পেত না। সোভিয়েত ট্যাংক এবার তাদের বাঁচাতে আসত না। এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ইমরে পৎসগেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, ছাপ্পান্ন সালের ঘটনা মোটেই প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান ছিল না, সেটা ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ! এটাই তো একটা মস্ত বড় ট্রাজেডি।
অসীম জিগ্যেস করল, ইমরে নেগিকে এখন আর বিশ্বাসঘাতক বলা হচ্ছে না?
জর্জ বলল, সে কথা আমাকে জিগ্যেস করছ কেন, রাস্তার যে-কোনও মানুষের কাছ থেকে জেনে নাও। ছাপ্পান্ন সালের তেইশে অক্টোবর সেই অভ্যুত্থান হয়েছিল, এ বছর সেই দিনটাতে জাতীয় উৎসব হয়েছে। আর ১৬ জুন, একত্রিশ বছর আগে যে দিনটায় ইমরে নেগিকে হত্যা করা হয়েছিল, সেই দিনটির স্মরণে প্রায় তিন লাখ লোক মিছিল করে গিয়ে ইমরে নেগির স্মরণ বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছে। (আমাদের দেশে অনেক মিছিলে বা জনসভায় লাখ লাখ লোক হয়। কিন্তু হাঙ্গেরির মতন ছোট দেশে তিন লাখ লোকের মিছিল একটা অভূতপূর্ব ঘটনা)!
এটাও ইতিহাসের একটা ট্রাজেডি। আজ যাকে বিশ্বাতঘাতক কিংবা শত্রু বলে শাস্তি দেওয়া হয়, এক যুগ বা কয়েক যুগ পরে তাকেই বলা হয় হিরো। বার গলায় পরানো হয়েছিল ফাঁসির দড়ি, তার মূর্তির গলায় পরানো হয় ফুলের মালা। কিংবা, আজ মহান আদর্শবাদী হিসেবে বার নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হচ্ছে, পরের যুগের ইতিহাস তাকে অভিহিত করেছে স্বার্থান্ধ খুনি হিসেবে। মানুষই মানুষ সম্পর্কে এরকম ভুল করে। মানুষই ইতিহাস বদলায়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলে দুর্দান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে রুখেছিলেন জোসেফ স্টালিন। সর্বকালের ইতিহাসে হিটলার এক নর-দানব বলে গণ্য। খর্বকায়, নিরামিষাশী সেই মানুষটি প্রায় অর্ধেক পৃথিবীতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, অকারণে লক্ষ লক্ষ নারী, পুরুষ, শিশুকে প্রাণ দিতে হয়েছে তার পাগলামিতে। নেপোলিয়ান রাশিয়া আক্রমণ করেও জিততে পারেনি, হিটলারের বাহিনি ছিল অনেক শক্তিশালী, সেই তুলনায় সীমিত অস্ত্রবল নিয়েও অসীম মনের জোরে স্টালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত দেশের মানুষ হিটলারকে হঠিয়ে দিয়েছে। শুধু বামপন্থীরাই নয়, সমস্ত মুক্ত বিশ্বের মানুষই সেজন্যে ধন্য ধন্য করেছে স্টালিনের নামে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রধান বীরপুরুষ স্টালিন। তাঁকে নিয়ে বীরপূজা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কত কবিতা, কত গান লেখা হয়েছে তাঁর নামে। বাংলাতেও একজন কবি স্টালিনের নাম উচ্চারণ করলেই কত শুভ কাজ হয় তার তালিকা দিতে দিতে লিখেছিলেন, ‘স্টালিন, তোমার নামে গভিনীর সুখ-প্রসব হয়।’
সেই স্টালিনের মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকেই তাঁর অন্য একটা পরিচয় প্রকাশিত হতে থাকে। এখন সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐতিহাসিকরাই নথিপত্র ঘেঁটে এই তথ্য উদ্ধার করেছেন যে, স্টালিনের নির্দেশে তাঁর নিজের দেশে প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন বা পাঁচ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মিথ্যা সন্দেহে কিংবা আক্রোশের বশে। জার্মানির মতন সোভিয়েত ইউনিয়নেও অনেক কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ছিল, সেখানে যাদের ভরা হত, তাদের আর সন্ধান পাওয়া যেত না, কয়েকজন বাঙালি বিপ্লবীও রাশিয়ার সেইসব কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে হারিয়ে গেছেন। হিটলারের আক্রমণে সোভিয়েত দেশে দু’কোটি মানুষ নিহত হয়েছে, আর স্টালিন মেরেছেন পাঁচ কোটি স্বদেশবাসীকে। অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে স্টালিনের নিজের দেশেই। সোভিয়েত দেশে আজ আর কেউ ভুলেও স্টালিনের নাম উচ্চারণ করে না।
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, তা এখানকার কাগজপত্র পড়ে ও বিভিন্ন লোকের কথা শুনে নতুনভাবে জানা গেল। আমরা এতকাল জেনে এসেছিলাম যে প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্তে বিপ্লবের ফসল নষ্ট করার জন্যেই হাঙ্গেরিতে একটি প্রতি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। এতে মদত দিয়েছিল কিছু কিছু ধনতান্ত্রিক দেশের গুপ্তচররা। এখন হাঙ্গেরিয়ানরা বলছে যে, এই প্রচারটাই সম্পূর্ণ অপপ্রচার। হাঙ্গেরিয়ানদের দেশপ্রেমের প্রতি অপমান। এই অভ্যুত্থান মোটেই কমিউনিজম-বিরোধী ছিল না। এই আন্দোলনের নেতাও ছিলেন মস্কোপন্থী। প্রতিবাদ বা আন্দোলন শুরু হয় পার্টির জুলুমবাজি ও দাদাগিরির বিরুদ্ধে এবং হাঙ্গেরিয়ানদের আত্মমর্যাদা ও পুনরুদ্ধারের জন্য।
এগারো বছর ধরে সোভিয়েত সৈন্যবাহিনী হাঙ্গেরির ভূমিতে বসেছিল। সমাজতন্ত্র দেশাত্মবোধ মুছে দিতে পারেনি কোনওখানেই। হাঙ্গেরিয়ানরা সোভিয়েত বাহিনীকে বিদেশি সৈন্য বলেই মনে করত, এবং কেউই নিজের দেশে বিদেশি সৈন্যের অবস্থিতি সম্মানজনক মনে করে না। ঘাড়ের ওপর ওইরকম একটা শক্তি থাকার ফলে হাঙ্গেরির সরকারও ছিল তার ক্রীড়নক। মস্কোর নির্দেশেই হাঙ্গেরির নেতাদের উত্থান-পতন ঘটত।
ছাপ্পান্ন সালে কয়েকটি পরিবর্তন ঘটে। তিন বছর আগে স্টালিনের মৃত্যু হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশতম কংগ্রেস-এ নিকিতা ক্রুশ্চেভ স্টালিনের পার্সোনালিটি কাল্ট-এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেন। পোল্যান্ডে সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ শোনা গেল। এ বছরই সোভিয়েত সেনাবাহিনী তাঁবু গোটাতে শুরু করল হাঙ্গেরি থেকে। অনেকেরই ধারণা হল, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে এবার খোলামেলা হাওয়া আসছে। বুড়াপেস্ট-এর একদল ছাত্র তাদের দাবিদাওয়া জানাবার জন্য সমবেত হল একটা মিছিলে। পথ চলতি মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিল সেই মিছিলে, সংখ্যা বাড়তে লাগল ক্রমশ সেই বিশাল জনতা কিন্তু সরকারের পতন চায়নি, চেয়েছিল শাসনব্যবস্থার কিছু কিছু সংস্কার। কিন্তু তখন হাঙ্গেরির যিনি কর্তা, সেই জেরো ছিলেন মস্কোর পুতুল, তিনি সেই জনতার দাবিদাওয়া শোনার বদলে ধমক দিলেন, তারপর হুকুম দিলেন গুলি চালাতে।
রক্তপাত শুরু হতেই সেই শান্তিপূর্ণ মিছিল হিংস্র হয়ে উঠল, সেনাবাহিনী এনেও তাদের দমন করা গেল না, বরং হাঙ্গেরিয়ান সৈন্যরা যোগ দিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে, সেনা ব্যারাক থেকে অস্ত্র বিলি হতে লাগল জনসাধারণের মধ্যে। জেরো পালালেন, চতুর্দিকে গজিয়ে উঠল লোকাল কাউন্সিল, জেলখানার দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন রাজবন্দিরা। কৃষকরা তাঁদের বাজেয়াপ্ত জমি আবার দখল করে নিতে শুরু করলেন। বিভিন্ন দলের এক সম্মিলিত সরকারে ফিরিয়ে আনা হল ইমরে নেগি-কে। এই ইমরে নেগি কিছুদিন আগেই ছিলেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী। ইনি বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী। বামপন্থা জাতীয়তাবাদীকে স্বীকার করে না এবং জাতীয়তাবাদকে মুছে ফেলার মতন অবস্থা যে পৃথিবীতে আসেনি, তা-ও তারা মানতে চায় না। আজ দেখা যাচ্ছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেও প্রায় সর্বত্র জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, প্রত্যেকটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যেও চড়া জাতীয়তাবাদের সুর, এমনকি চিনও প্রবল জাতীয়তাবাদী। জাতীয়তাবাদের বোধ যে কত তীব্র তা বোঝা গিয়েছিল চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনায়। সীমান্ত যেখানে মুছে যাওরার কথা, সেখানে তার বদলে সীমান্ত সংঘর্ষ!
যাই হোক, ইমরে নেগি যখন আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি মস্কোর অধীনতা অস্বীকার করেননি, কিন্তু হাঙ্গেরির শাসনব্যবস্থায় কিছু কিছু সংস্কারের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এ দেশের ওপর জোর করে হেভি ইন্ড্রাস্ট্রি চাপিয়ে দেওয়া তিনি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। চাষিদের জমি কেড়ে নিয়ে জবরদস্তি সমবায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা তাঁর মনে হয়েছিল অবাস্তব ব্যবস্থা। জনসাধারণকে কিছু কিছু ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করাও সরকারের দায়িত্ব। আধুনিক জীবনের সরঞ্জাম তো তারা চাইবেই। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিয়ে অন্তরীণ শিবিরগুলি একেবারে তুলে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এই সবগুলোই ছিল সাধারণ মানুষের দাবি। কিন্তু এই ধরনের কিছু কিছু উদার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যেতেই ইমরে নেগি-কে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর পার্টি মেম্বারশিপও কেড়ে নেওয়া হয়।
একবছর পর বিপ্লবী জনসাধারণ তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনল। নেগি তাঁর সংস্কার ব্যবস্থাগুলি পুনঃপ্রবর্তন করতে চাইলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানালেন পুরো সৈন্যবাহিনী হাঙ্গেরি থেকে সরিয়ে নিতে। একটা কোয়ালিশন গভর্নমেন্টের প্রধান হিসেবে নেগিকে জনসাধারণের দাবিগুলি মেনে নিতে হচ্ছিল।
মস্কো থেকে কয়েকজন কর্তাব্যক্তি এলেন নেগিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করতে। এর মধ্যে নেগি দুটি সাংঘাতিক ঘোষণা করে বসলেন। ওয়ারস চুক্তি থেকে হাঙ্গেরি নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিল। এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে হাঙ্গেরিকে একটি নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে গণ্য করার দাবি জানানো হল। মস্কো হাঙ্গেরির এতটা বাড়াবাড়ি বরদাস্ত করতে রাজি নয়। সোভিয়েত বাহিনী হাঙ্গেরির সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, আবার ট্যাংকগুলির মুখ ঘুরল, সোভিয়েত দেশ থেকে আরও কিছু ট্যাংক এল, আবার ট্যাংকের ঘর্ঘর শব্দে কেঁপে উঠল বুড়াপেস্ট। প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গার দিকে ওঁচানো রইল কামানের মুখ।
ছাত্র ও শ্রমিকরা ইতস্তত সংঘর্ষের মধ্যে গেলেও সোভিয়েত ফৌজের তুলনায় তারা কিছুই না। এই সময় গুজব উঠেছিল যে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি হাঙ্গেরির সাহায্যে এগিয়ে আসবে, সোভিয়েত বাহিনীর মোকাবিলা করবে। সে রকম কিছুই ঘটল না। বিদ্রোহ ক্রমশ প্রশমিত হয়ে গেল, বহু শিক্ষিত ব্যক্তি পালাল দেশ ছেড়ে।
ইমরে নেগি প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলেন বুড়াপেস্ট-এর যুগোশ্লাভ দূতাবাসে। সেখান থেকে চলে গেলেন রুমানিয়া। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে গ্রেফতার করে একটা গুপ্ত বিচার অনুষ্ঠিত হল এবং অবিলম্বে গুলি করে মেরে ফেলা হল, একটা প্রতি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর নাম মুছে ফেলা হল হাঙ্গেরির ইতিহাস থেকে।
মাত্র তিনটি দশক অতিক্রান্ত হয়েছে, এখন আবার ইমরে নেগির নামে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তাঁকে এক মহান নেতা হিসেবে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নেও প্রেসিডেন্ট গরবাচেভ বলেছেন যে, নেগির বিচার ভুল হয়েছিল। তিনি যে সব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এখন সেগুলিই গ্রহণ করা হচ্ছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের ভুল সিদ্ধান্তে ইমরে নেগিকে প্রাণ দিতে হয়েছিল এবং হাজার হাজার মানুষ বাধ্য হয়েছিল দেশত্যাগ করতে। কী নির্মম, হৃদয়হীন এই সব ভুল।