হিটলারের আত্মহত্যা কিংবা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঠিক সতেরো দিন পর জার্মানি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করে মিত্রশক্তি বাহিনীর কাছে। জার্মান জাতি সারা পৃথিবীতে প্রভুত্ব করবে, এই স্বপ্নে তাদের মাতিয়ে তুলেছিল হিটলার। কিন্তু পরাজয়ের পর জার্মান রাষ্ট্রের অস্তিত্বই মুছে গেল। আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটাকে ভাগাভাগি করে নিজেদের দখলে রাখল। যুদ্ধ শেষ হওরার সঙ্গে সঙ্গেই মিত্র শক্তির কেউ আর কারু মিত্র নয়, তাদের মধ্যে মতভেদ প্রকট।
চার বছর বাদে, আমেরিকা-ব্রিটেন-ফ্রান্সের অধিকৃত অংশে প্রতিষ্ঠিত হল একটি নতুন রাষ্ট্র, ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি, রাজধানী হল বন। তার এক মাসের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলীকৃত অংশে জন্ম নিল জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক, রাজধানী হল দ্বিখণ্ডিত বার্লিন শহরের একটি অংশে। বার্লিনের অপর অংশে পশ্চিমি ত্রিশক্তির সৈন্যবাহিনী বসে রইল তাঁবু গেড়ে। একই সংস্কৃতি ও ভাষার উত্তরাধিকারী জার্মানরা দু’ভাগ হয়ে গেল পরের ইচ্ছায়।
১৯৫২ সালে স্টালিন একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন বটে যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার শর্ত আরোপ করে দুই জার্মানিকে এক করা যেতে পারে, কিন্তু আমেরিকা তাতে রাজি হল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জন্য পশ্চিম জার্মানিতে তাদের একটি ঘাঁটির খুবই প্রয়োজন, কেন-না, এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন একবার আচমকা বার্লিন ব্লকেড করে পশ্চিম বার্লিনের সৈন্য ও সাধারণ মানুষদের না খাইয়ে রাখার উপক্রম করেছিল, তখন বিমানে খাদ্য সরবরাহ করতে হয়েছিল দিনের পর দিন।
এক জাতি দু-ভাগ হয়ে গেল, দুটি আলাদা রাষ্ট্র। ভারতবর্ষও দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল প্রভুদের ইচ্ছেয়, কিন্তু তার মূলে ছিল অন্তঃকলহ। আমাদের দেশের নেতা বা জনপ্রতিনিধিরা এক যোগে গলা মিলিয়ে বলতে পারেননি যে, না, আমরা দেশ-বিভাগ মানব না। হিটলারের পাপে জার্মানি তখন অপরাধবোধে নতশির। তাদের কিছুই বলার মতন মুখ ছিল না।
পশ্চিম জার্মানি হল। পশ্চিমি শক্তির তল্পিবাহক, পূর্ব জার্মানি গ্রহণ করল সমাজতন্ত্র। পশ্চিম জার্মানিকে প্রথম কয়েক বছর নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হল উদ্বাস্তু সমস্যা। পোল্যান্ড এবং কাছাকাছি অন্যান্য দেশে যত জার্মান ছিল, তারা বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসতে লাগল। ভাগাভাগির পর পূর্ব জার্মানি থেকেও দলে দলে লোক চলে আসতে শুরু করল পশ্চিমে। অবশ্য এই সব উদ্বাস্তুরা দেশ গড়ার কাজে সাহায্যও করেছে। এরা প্রায় সকলেই দক্ষ শ্রমিক বা প্রযুক্তিবিদ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে যখন সক্ষম পুরুষ মানুষেরই প্রচণ্ড অভাব, তখন এইসব সুশিক্ষিত কর্মীরা দেশের বোঝার বদলে সম্পদ হিসেবেই গণ্য হল। প্রায় একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে কীভাবে আবার জার্মানরা দেশটাকে গড়ে তুলল, তা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও শক্ত। আমরা অবহেলা ও ঔদাসীন্যে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে গত পঁয়তাল্লিশ বছরে কলকাতা শহরটার অবস্থা কত যে খারাপ হয়ে গেছে, তা আমরা গ্রাহ্যও করি না। ফ্রাংকফুর্ট শহরটা যুদ্ধের সময় নব্বইভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেই ছবি আমি দেখেছি, আজ সেই আধুনিক শহরটি দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শুধু জার্মানি নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি ইত্যাদি দেশের অনেক শহরেরই পুনর্জন্ম হয়েছে।
পাশাপাশি বর্ধিত হতে লাগল একই জার্মান জাতির দুটি দেশ। এটা এমন কিছু অভিনব ঘটনা নয়। ইতিহাসের বিচারে মাত্র সেদিন, অর্থাৎ একশো কুড়ি বছর আগেও জার্মানি ছিল টুকরো-টুকরো কতকগুলি রাজ্য, ফ্রান্স ইংল্যান্ডের তুলনায় কোনও শক্তি হিসেবে গণ্যই হত না। মধ্য ইউরোপের তাঁবেদার ছিল তখন অস্ট্রিয়া। ভিয়েনার নির্দেশে জার্মান সামন্তরা ওঠা-বসা করত। প্রাসিয়ার প্রধানমন্ত্রী অটো ফন বিসমার্ক-এর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বেই জার্মান জাতীয়তাবোধ দানা বাঁধে। বিসমার্ক ছিলেন প্যারিসে প্রাসিয়ার রাষ্ট্রদূত, তাঁকে ডেকে এনে যখন প্রধানমন্ত্রী করা হয়, তখন অনেকে চমকে উঠেছিল। কিন্তু অস্ট্রিয়াকে পর্যুদস্ত করার পর বিসমার্ক জার্মান জাতিকে সংঘবদ্ধ করে যে সামরিক শক্তি গড়ে তোলেন, তারই প্রতিক্রিয়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, পরবর্তীকালে হিটলারের অভ্যুত্থান ও আর একটি বিশ্বযুদ্ধ। চূড়ান্ত পরাজয়ের পর বিজয়ী সম্মিলিত বাহিনী জার্মানিকে সম্পূর্ণ শক্তিহীন করে দিতে চেয়েছিল, তার ফলে জার্মানি যে আবার টুকরো-টুকরো হয়ে যায়নি, তাই-ই যথেষ্ট, মাত্র দুটি ভাগে বিভক্ত হল।
একদিকে ধনতন্ত্র, অন্যদিকে সমাজতন্ত্র। একদিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়াবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিযোগিতা, বাজারি অর্থনীতি, লোভ, হিংসা, ভোগ্যপণ্যের নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন, উৎপাদনভিক্তিক শ্রম, পুনরুত্থিত জাতীয়তাবাদ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, আত্মহত্যা ও যৌন অধিকারের চূড়ান্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা। অন্যদিকে মুনাফা ও পুঁজিবাদের বিলোপ, সমস্ত কল কারখানার রাস্ত্রীয়করণ, কৃষি ব্যবস্থায় সমবায়। প্রতিটি মানুষের শ্রম শুধু নিজের স্বার্থে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য, তার বিনিময়ে রাষ্ট্র প্রতিটি মানুষকে দেবে জীবিকা ও বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সমান সুযোগ। পশ্চিমের মানুষ ছন্নছাড়া, সবসময় দৌড়চ্ছে, তবু নিঃসঙ্গ। পূর্বের মানুষ সংঘবদ্ধ ও সমাজের অংশ, ব্যক্তি স্বাধীনতার চেয়েও সমাজ বাস্তবতা তার কাছে বড়।
পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের ব্যবস্থা নিশ্চিত অনেক বেশি সমর্থনযোগ্য, ইতিহাসের এক ধাপ অগ্রবর্তী, আমাদের মতন গরিব দেশের চক্ষে স্বপ্নের মতন। পশ্চিম জার্মানি ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পশ্চিমি শক্তির পক্ষচ্ছায়া পেয়েছে। পূর্ব জার্মানিও অসহায় নয়, শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন তার অভিভাবক। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি তার আত্মীয়। তা ছাড়াও পৃথিবীর অনেক ধনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দেশের বহু সংখ্যক মানুষ এই সমাজতন্ত্রের পক্ষপাতী। এখন এই দুই জার্মানি কে কতখানি এগোতে পারে, তা রুদ্ধশ্বাসে পর্যবেক্ষণ করা ছিল গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে একটি প্রধান বিষয়।
পশ্চিম জার্মানি গোড়ার দিকে কিছু সুযোগ পেয়েছে। আমেরিকার কাছ থেকে মার্শাল প্ল্যানে সাহায্য পেয়েছে চার বিলিয়ন ডলার, ওদিকে পূর্ব জার্মানি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিয়েছে দশ বিলিয়ন ডলার। পশ্চিম পেয়েছে অনেক দক্ষ কর্মী, পূর্বকে অনেক কলকারখানা নতুন করে গড়তে হয়েছে। পশ্চিম বিদেশিদেরও সাহায্য নিয়েছে যথেচ্ছভাবে। এমনকি আরব দেশ, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের অনেকেও সেখানে কাজ পায়, সেই তুলনায় পূর্বে বিদেশিদের সংখ্যা নগণ্য। পূর্ব জার্মানিকে কয়েক বছরের মধ্যেই শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পড়তে হয়েছিল, তা দমন করার জন্য সোভিয়েত সৈন্য ডাকতে হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য তারপর যুদ্ধঋণ মুকুব করে দেয় এবং পূর্ব জার্মানির অর্থনীতি আস্তে আস্তে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্র পূর্ব জার্মানির ওপরে একেবারে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বিষয়ও নয়। একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায় যে স্যাক্সনি এবং থুরিঙ্গিয়া অনেককাল আগে থেকেই সমাজতন্ত্রীবাদীদের শক্ত ঘাঁটি
ছিল। পূর্বের অন্তর্ভুক্ত প্রাক্তন প্রাসিয়া এক সময় রাশিয়ার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবে বার্লিনের বুদ্ধিজীবীরা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। স্পার্টাকাশ লিগ কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বসূরি। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ব জার্মানিতে বিকশিত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
একটা মজার ব্যাপার এই যে, জার্মানি ভেঙে দুটি আলাদা রাষ্ট্র হলেও পশ্চিম জার্মানি এই বাস্তবতাকে কোনওদিনই স্বীকার করতে চায়নি। পশ্চিমের সংবিধানে পূর্বের পৃথক অস্তিত্বটাকে মানাই হয়নি, সেখানে অখণ্ড জার্মান রাষ্ট্রের ধারণাটাকেই আঁকড়ে রাখা হয়েছিল। সারা পৃথিবী জানে যে জার্মানি নামে দুটি দেশ, শুধু পশ্চিম জার্মানিই যেন তা জানে না। পূর্ব জার্মানি যাতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি না পায় তার জন্য পশ্চিম জার্মানি অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে, একে-একে ধনতান্ত্রিক দেশগুলিও জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিককে স্বীকৃতি দিতে শুরু করে এবং ৭৩ সালে জি ডি আর রাষ্ট্রসংঘেও স্থান পায়।
দুই জার্মানি ও বার্লিনের মাঝখান দিয়ে কাঁটা তার ও শক্ত দেওয়াল গাঁথা হয়, মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে একই ঐতিহ্যের দুই শরিক এগোতে থাকে। কে কতটা এগোল, তা সঠিকভাবে বোঝ শক্ত ছিল। ষাটের দশকে ধ্বংস স্তূপ থেকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে পশ্চিম জার্মানি অর্থনৈতিক উন্নতির যেন ম্যাজিক দেখাল। ধনতান্ত্রিক দেশের খবরাখবর জানতে অসুবিধে নেই, আমরা সেইসব খবর বেশি পাই। ওদিকে জাপান, এদিকে পশ্চিম জার্মানি আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দিতে লাগল। বিশ্বের বাজার, আশির দশকে পশ্চিম জার্মানির কারেন্সি অতিশয় শক্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য হল। পূর্ব জার্মানির ব্যাবসা প্রধানত পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে, তার অর্থনৈতিক বুনিয়াদ কতটা দৃঢ় হল তা স্পষ্টভাবে জানা যায় না। এক দল বলে ওরা কিছুই উন্নতি করতে পারছে না, অন্য দল বলে ওসব ধনতান্ত্রিক নোংরা দেশগুলির অপপ্রচার, সি আই এ-র চক্রান্ত ইত্যাদি। প্রচার, অপপ্রচার, দাবি ও পালটা দাবির ধূম্রজাল সরিয়ে দেখা যায় যে পূর্ব জার্মানিরও উন্নতি হয়েছে যথেষ্ট। মাঝারি শিল্পের উৎপাদন হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। অবশ্য কৃষি উৎপাদন শতকরা ১১ ভাগ মাত্র। তবু পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির তুলনায় পূর্ব জার্মানির অবস্থা ভালোই বলতে হবে। পোল্যান্ড-হাঙ্গেরি-বুলগেরিয়ার চেয়ে পূর্ব জার্মানির পার ক্যাপিটা ন্যাশনাল ইনকাম দ্বিগুণ। রুমানিয়া-যুগোশ্লাভিয়ার তিনগুণ। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির অর্ধেক। পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে পূর্ব খণ্ড পিছিয়ে পড়েছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ যেন দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই হঠাৎ ধনী হয়ে গেল, অন্য ভাই গরিব রয়ে গেল।
গরিবেরও তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ থাকে। ধনতন্ত্রের বিলাস, ভোগবাদ, অপরের শ্রমে, মুনাফা ও ঐশ্বর্যের অস্থিরতার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পূর্ব জার্মানির ধীর, শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়াই তো স্বাভাবিক ছিল। কারণ, তাদের সামনে রয়েছে সমাজতন্ত্রের অনেক উন্নত আদর্শ, তাদের জীবিকা ও শিক্ষা-চিকিৎসার সমান সুযোগ দিতে রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। জীবনের এই সব ব্যাপারের নিরাপত্তা পেলেও মানুষ বিষম প্রতিযোগিতাময় অবস্থার মধ্যে ফিরে যেতে চাইবে কেন? এই শতাব্দীর শেষ দশকের প্রাক্কালে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। মানুষ কী চায়?
রাজতন্ত্রের অবসানের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল, মানুষ গণতন্ত্রকে আবার চিনে নেওয়ার পর তার চেতনায় গণতন্ত্র একটা স্থায়ী আসন পেয়ে গেল। অনেক দেশে এখনও স্বৈরতন্ত্র রয়েছে। অনেক দেশে গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যভিচার ঘটানো হচ্ছে। তবু সাধারণ মানুষের মন থেকে গণতান্ত্রিক আদর্শ আর কোনওদিন মুছে যাবে না। এমনকী স্বৈরাচারীরাও মিথ্যে হোক, ধাপ্পা হোক, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা উচ্চারণ করে। কিছু কিছু দিতে বাধ্যও হয়। সেইরকমই সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, চিন ও লাতিন আমেরিকান সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইতিহাস তাকে স্বীকার করে নিয়েছে। সমাজতন্ত্র যে একটি আদর্শ ধারণা তা বিশ্বের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষই বিশ্বাস করে। এমনকি যেসব ধনতান্ত্রিক দেশ সমাজতন্ত্রের শত্রু হিসেবে পরিগণিত, সেইসব দেশেও ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সমাজতন্ত্রের কিছু কিছু ধারণা ঢুকে পড়েছে, কিছু কিছু ব্যবস্থাও সেইসব রাষ্ট্র গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। সেইসব দেশে শোষণ আছে, প্রতিযোগিতা আছে, ধনী ও মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শ্রেণিবিভাগ আছে, আবার বেকার ভাতাও প্রবর্তিত হয়েছে, বুড়ো-বুড়িদের ভার নেয় রাষ্ট্র, দরিদ্রের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়। অর্থাৎ কোনও ধনতান্ত্রিক দেশই এখন আর সে দেশের কোনও মানুষকে চরম বঞ্চনা ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় না, মোটামুটি বেঁচে থাকার সুযোগ দিয়ে বলে, বাকি উন্নতির জন্য তুমি লড়ে যাও। সেই মোটামুটি সুযোগটাও আমাদের মতন গরিব দেশের মানুষের কাছে অনেকখানি আর সমাজতান্ত্রিক দেশের অনেক মানুষের সমান-সমান।
কার্ল মার্কস ধনতন্ত্রের সমালোচনা করেছিলেন এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামো এঁকে গিয়েছিলেন। সেই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটা আদর্শ হিসেবে ধরলেও সেই রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, তা কখনও স্পষ্ট হয়নি। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি, সর্বহারাদের হাতে ক্ষমতা যায়নি, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে পার্টির বুদ্ধিজীবী ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর হাতে। সেই গোষ্ঠী-মানুষ কী চায়, এই প্রশ্নে বারবার ভুল করছে।
মানুষ কী চায়? মানুষকে যদি বলা যায়, তোমাকে জীবিকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে না। পরিবারের খাওয়া-পরার চিন্তা করতে হবে না, মাথা গোঁজবার ঠাঁই তুমি পাবে, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও রাষ্ট্র করে দেবে, তা হলে মানুষ এর বেশি আর কী চাইবে? সমস্ত জাগতিক দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে সে সমাজ গড়ার জন্য সম্পূর্ণ শ্রম ও উদ্যম দেবে, এটাই তো স্বাভাবিক, তবু তা হয় না কেন? সেই মানুষকে যদি বলা যায়, তোমাকে খেতে-পরতে দেওয়া হবে বটে, কিন্তু তুমি কী বই পড়বে, কী সিনেমা বা টি ভি প্রোগ্রাম দেখবে, তা আমি ঠিক করে দেব, বেশিদূর ভ্রমণের স্বাধীনতা তুমি পাবে না বাপু, বিদেশিদের সঙ্গে গালগল্প কোরো না, এসব অমান্য করলে কিন্তু তোমায় পুলিশে ধরবে। তাহলে কি সে তা মাথা পেতে মেনে নেবে? কতদিন মানবে? চেকোশ্লোকিয়ার বাতিশ্লাভা শহরে গিয়ে আমি এক বৃদ্ধের করুণ বিলাপ শুনেছিলাম। ও দেশের চেক দিকের বড় শহর প্রাগ, আর শ্লোভাক দিকের বড় শহর বাতিশ্লাভা। এক সময় ওই শহরের খুব রমরমা ছিল, এখন নিষ্প্রভ। প্রাগ-এর তুলনায় বাতিশ্লাভা বেশ মলিন। তা নিয়ে চেকদের বিরুদ্ধে শ্লোভাকদের বেশ ক্ষোভ আছে। যাই হোক, এক বৃদ্ধ দিগন্তের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, ওই যে ছোট ছোট পাহাড় দেখছ; ওর ওপাশেই ভিয়েনা শহর। এককালে আমরা সকালবেলা ট্রামে চেপে ভিয়েনা চলে যেতাম। সেখানে বিয়ার খেতাম, কনসার্ট শুনতাম, বাড়ি ফিরে আসতাম মাঝরাতে। সরকারের কতকগুলো গর্ধভ সীমানায় পাহারা বসিয়ে এখন আর আমাদের ভিয়েনা যেতে দেয় না। সেই বৃদ্ধের বিলাপ শুনে মনে হয়েছিল, তাঁকে খেতে পরতে দিয়ে একটা বড়সড়ো খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে।
প্রাগ শহরে গিয়েছিলাম, একটি বইয়ের দোকানে গিয়ে খোঁজ করেছিলাম ফ্রানৎস কাফকার কয়েকটি বইয়ের। আমাদের সঙ্গিনী গাইডটি বেশ সাহসের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলেছিল, জানো না, এই শুয়োরের বাচ্চারা আমাদের কাফকা পড়তে দেয় না! আমি হতবাক। ফ্রানস কাফকা চেকোশ্লোভাকিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক, প্রাগ শহরে তাঁর মর্তি আছে। অথচ তাঁর রচনা সে দেশের লোককে পড়তে দেওয়া হয় না। এই কারা নেয়? সেদিনই লেখক সমিতির এক সভায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে আমি ফস করে জিগ্যেস করলাম, তোমাদের দেশে কাফকার বই পাওয়া যায় না কেন? ওঁদের এক মুখপাত্র, বেশ হোমরা চোমরা চেহারা, পার্টির উচ্চ পদাধিকারী মনে হয়, বললেন কে বলেছে পাওয়া যায় না, যায় তো! আমি নাছোড়বান্দার মতো বললাম, দোকানে খোঁজ করেছি, তারা বলল, নেই, কুড়ি বছর ধরে নেই! ভদ্রলোক জোর দিয়ে বললেন, নেই মানে আউট অফ প্রিন্ট! নিষেধ কিছু নেই। এটা একটা ডাহা মিথ্যে কথা! কুড়ি বছর ধরে কোনও প্রধান লেখকের সমস্ত রচনা আউট অফ প্রিন্ট থাকতে পারে? নিষিদ্ধ করার চেয়েও এই মিথ্যেটা আরও বেশি অন্যায়। সাধে কি আর সেখানে ক্ষমতাসীন পার্টির ওপর সাধারণ মানুষের এত ক্রোধ জমে ছিল!
দুই দেশের চলাচলের মধ্যে বিধিনিষেধ জারি করেছিল পূর্ব জার্মানি একতরফাভাবে। ধনতন্ত্রের নষ্টামি ও ভোগ্যপণ্যের প্রলোভন যাতে এদিকে না আসতে পারে তাই পূর্ব দিকের এই কড়াকড়ি। পশ্চিম কিন্তু সব সময় পূর্বের মানুষদের স্বাগত জানিয়েছে। সমাজতন্ত্রের চেতনা এসে এদিককার ধনতন্ত্রকে বিষিয়ে দিতে পারে, এ ভয় তারা পায়নি। এটা একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা। বার্লিনের দেওয়াল যারা আগে দেখেছে, তারা সবাই জানে পশ্চিম দিকে কোনও বিধিনিষেধ নেই। পুলিশ-মিলিটারি নেই, যার খুশি দেওয়ালের কাছে আসতে পারে, কত লোক সেই দেওয়ালে ছবি এঁকেছে, কাব্য রচনা করেছে, অনেক দুঃখের বাণী লিপিবদ্ধ করেছে! আর দেওয়ালের পূর্ব দিকে ধারে কাছে কেউ আসতে পারবে না, কিছু দূর অন্তর অন্তর গম্বুজের ওপর মেশিনগান হাতে প্রহরী, হিংস্র কুকুর ছাড়া রয়েছে নীচে, পূর্ব থেকে কেউ পালাতে চাইলেই মরবে। তবু বহু লোক প্রাণ তুচ্ছ করে পালিয়ে এসেছে। তারপর একদিন তারা দল বেঁধে দেওয়াল ভাঙতে এল।
বিনা যুদ্ধে দুই প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মিলন বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে একটা বিরাট ঘটনা। আমি ভুক্তভোগী, দেশবিভাগের ক্ষত আমার বুকে এখনও দগদগ করে। তাই একই জাতির দুটি অংশ আবার স্বেচ্ছায় পুনর্মিলিত হতে যাচ্ছে, এই ঐতিহাসিক দৃশ্যটির সাক্ষী থাকবার জন্যই আমি অক্টোবরের তিন তারিখে বার্লিন গিয়েছিলাম।