পনেরোই আগস্ট সকালে উত্তর কলকাতায় একটি অভিনব মিছিল বেরিয়েছিল। আগে আমরা স্বাধীনতা দিবসে প্রত্যেক পাড়াতেই দেখেছি প্রভাতফেরি কিংবা বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যদের শোভাযাত্রা। পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে কিশোর কিশোরীরা গান গাইতে-গাইতে যেত, অনেকে আবার কেবল ড্রাম, বিউগল নিয়ে ব্যাগ পাইপ বাজাত, সেইসব গানের সঙ্গে কচি-কচি উজ্জ্বল মুখ ও সেই দিশি গান ও বিলেতি বাজনার অদ্ভুত সংমিশ্রনই ছিল স্বাধীনতা দিবসের প্রধান অঙ্গ, এ ছাড়া বক্তৃতা উক্তৃতা তো আছেই।
এবারের যে মিছিলের কথা বলছি, তা একেবারে অন্যরকম। কয়েক হাজার নারী পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু ছিল এই মিছিলে, তাদের অধিকাংশরই খালি পা, অনেকেরই গায়ে জামা নেই, কারোরই মুখে হাসি নেই। এরা কলকাতার মানুষ-আবর্জনা। কলকাতা শহর পরিষ্কার করার প্রশ্ন উঠলেই এদের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়। সম্প্রতি বাগবাজার আর নারকেলডাঙ্গা গলির দুপাশ, ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাই পাসের দু-ধার, ভি, আই পি, রেল ব্রিজের নীচে এবং উল্টোডাঙ্গা রেল ব্রিজের কাছাকাছি জায়গাগুলো পরিষ্কার করার জন্য এইসব মানুষগুলোর অস্থায়ী ঝুপড়ি ভেঙে দিয়ে এদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুশকিল এই যে, শুধু আবর্জনা হলে তা পচিয়ে ফেলা যায় বা পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু এরা উঠে দাঁড়ায়, ফিরে আসে এবং আবার আশ্রয় চায়।
মিছিলটি আমি দেখতে যাইনি। আমার দু-একজন বন্ধু আমাকে যাবার জন্য বলেছিল, কিন্তু ছুটির দিন সকালে আমার দেরি করে ঘুম ভাঙে, এবং বাড়িতে বসে আলস্য করিতেই বেশি ভালো লাগে। খবরের কাগজ নিয়ে অনেকক্ষণ সময় কাটাবার পর হঠাৎ এক সময় খেয়াল হল। পনেরোই আগস্ট সকালটি যেন বড় বেশি শান্ত! আমাদের সরকার কি এই উৎসব বর্জনের ডাক দিয়েছে। কই, কাগজে তো সে রকম কোনও উল্লেখ নেই!
একটু বাদে আমার এক বন্ধু এসে প্রায় একই কথা জানাল। সে বলল, রাস্তা দিয়ে এলুম, কোথাও উৎসবের চিহ্ন নেই। পাড়ার ক্লাবগুলো কোনও শোভাযাত্রা বার করেনি, মাইক্রোফোনে গান নেই, কোনও বাড়িতেই জাতীয় পতাকা উড়ছে না। আজকের দিনটি যে এতবড় একটি জাতির স্বাধীনতা দিবস, সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই। শুধু টেলিভিসনে ইন্দিরা গান্ধির বক্তৃতা, ব্যাস আর কিছু না!
আমি বন্ধুটিকে উত্তর কলকাতার মিছিলটির কথা জানালুম। বন্ধুটি সঙ্গে-সঙ্গে চটে উঠল। সে একজন কলকাতা প্রেমিক, সে কলকাতার উন্নতির জন্য চিন্তা ভাবনা করে। বিদেশিরা যখন কলকাতার নিন্দে করে, তাতে তার গায়ে লাগে।
সে বলল, ওদের সম্পর্কে আমার কোনও সহানুভূতি নেই! ব্যাঙের ছাতার মতন ওরা যেখানে সেখানে ঝুপড়ি বানাবে, রাস্তাগুলিকে ওদের ল্যাট্রিন বানাবে, এক পয়সা ট্যাক্স দেবে না, শহরটাকে দিন-দিন আরও নোংরা করবে, আর তোমরা তাই সহ্য করবে? কোথাও একটা সীমারেখা তো টানতে হবে? বাইরে থেকে যে কেউ যদি এসে ভাবে যে কলকাতায় যে কোনও জায়গায় বিনা পয়সার ঝুপড়ি বানিয়ে থাকা যায়, তা হলে এই শহরটার আর কোনও ভবিষ্যৎ আছে?
আমি তর্কবাগীশ নই। কেউ বাছা-বাছা যুক্তি প্রয়োগ করলে আমি তক্ষুনি পালটা যুক্তি প্রয়োগ করতে পারি না। আমার মনে হল বন্ধুটি ঠিকই বলছে। একটা শহরের যেখানে সেখানে এরকম ঝুপড়ি গজিয়ে উঠবে এটা কেউই মেনে নিতে পারে না। অবশ্য আমি নিজে যদি ওরকম কোনও বাসিন্দা হতুম তাহলে নিশ্চয়ই একটা কিছু জোরালো যুক্তি দিতে পারতুম।
বন্ধুটিকে জিগ্যেস করলুম, আচ্ছা, এরা কারা বলো তো? ঝুপড়ির সংখ্যা দিন দিন তো বেড়েই চলেছে, এরা কোথা থেকে আসে? এরা কি পূর্ব বাংলার রিফিউজি?
বন্ধুটি বলল না, না! পূর্ববাংলার রিফিউজিদের সমস্যা তো অন্যরকম। তাদের কলোনিগুলো শহরের প্রান্ত এলাকায়। এরা অনেকেই এসেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা থেকে, অন্য জেলা থেকেও আসে। বিহার থেকে আসে। এদের ঝুপড়িগুলো হল সমাজ বিরোধীদের আড্ডা, মদ-চোলাই, জুয়া, মেয়ে-মানুষের ব্যাবসা কী না হয় ওখানে। সন্ধ্যের
পর ওই সব জায়গা দিয়ে মানুষ হাঁটতে ভয় পায়।
-তুমি কোনও দিন হেঁটেছ?
-না, আমি কোনও দিন ওসব দিকে যাই না। কিন্তু কাগজে তো এরকম ঘটনা প্রায়ই থাকে।
-আচ্ছা ভাই, এরা কি একজন দুজন করে এসে ঝুপড়ি বানায়, না দল বেঁধে আসে? প্রথমে একজন দুজন করেই আসে। তারপর সুবিধে বুঝে ভাই বেরাদরদের ডেকে আনে। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস যখন তৈরি হতে শুরু হয় তখন ওখানে কোনও বসতি ছিল না। তারপর দেখলুম একটা দুটো ঝুপড়ি তৈরি হচ্ছে। কয়েক মাসের পরই রাস্তার দুদিক ভরে গেল!
-প্রথম যখন একজন দুজন এসে-এসে ঝুপড়ি বানায়, তখনই কেউ বাধা দেয় না কেন? আমি কি ইচ্ছে করলেই কলকাতার গঙ্গার ধারে একটা বাড়ি বানাতে পারি? পুলিশ এসে বাধা দেবে নিশ্চয়। সেই রকম ওদের মধ্যে প্রথম লোকটি ঝুপড়ি বানায়, তাকে কেন পুলিশ বুঝিয়ে দেয় না যে এইরকমভাবে কলকাতায় থাকার চেষ্টা করা বেআইনি? আর একটা সরল প্রশ্নও আমার মনে আসছে। এই সব ঝুপড়িগুলোতে যদি মদ তৈরি, জুয়া আর মেয়ে মানুষের কারবার চলে, তা বলে পুলিশ তাদের ধরে জেলে পুরছে না কেন? শুধু ঝুপড়ি ভেঙে বা পুড়িয়ে দিয়ে এই সব অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটাও তো সাংঘাতিক ব্যাপার!
–পুলিশ তাদের কর্তব্য কতখানি পালন করছে না করছে, সেটা আলাদা প্রশ্ন। আমি বলছি, এইসব ঝুপড়ি ভেঙে দিয়ে শহর পরিষ্কার করা, নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য কি না। আমি সমর্থন করি।
বন্ধুটি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল বলে আমি তাকে একটা সিগারেট দিলুম। তারপর বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বললুম, আবার বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। এবারে ঠিক বর্ষাকাল শুরু হওয়ার সময়েই এই সব হতভাগ্য লোকদের বাড়ি ঘর ভেঙে দেওয়া হল, পুড়িয়ে দেওয়া হল। বর্ষার সময় এই লোকগুলো থাকবে কোথায় সে কথা কি কেউ ভাববে না? তুমি নীতিগত প্রশ্ন তুললে বলেই আমিই তোমায় দু-একটা প্রশ্ন করি। বাগবাজারের খালের ধারে আমি এই সব ঝুপড়ি খুব কাছ থেকে দেখেছি। মানুষের এর থেকে খারাপ বাসস্থান আর সম্ভব নয়। এর থেকে সামান্য একটু ভালো জায়গায় যদি এদের পক্ষে থাকা সম্ভব হত, তা হলে নিশ্চয়ই এরা সেখানেই চলে যেত! তা ঠিক নয়? আর কোনও যাওয়ার জায়গা নেই বলেই এরা এখানে থাকে। বছরের পর বছর বেঁচেও আছে। এখানে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ সবই চলছে। তুমি কি জানো, এইসব ঝুপড়ির মানুষদের জন্য কমিউনিটি সার্ভিসেস সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় তিরিশটি ইস্কুল চালায়।
কার অনেকেই সেখানে পড়তে আসে তুমি এদের সবাইকেই সমাজ-বিরোধী, অপরাধী বলে দিলে? চায়ের দোকানে যে ছোট ছেলেমেয়েরা কাজ করে, যারা ঠ্যালা চালায়, রিক্সা চালায়, দিন মজুরি করে, বাড়িতে ঠিকে ঝি-র কাজ করে, তারা কি সবাই সমাজ-বিরোধী? তাদের জন্য এই শহর কোনও থাকার জায়গা দিয়েছে? অথচ এদের আমরা প্রত্যেকদিনই কাজে লাগাই! এরা তো পোকা মাকড় কিংবা কুকুর বেড়াল নয় যে শহর পরিষ্কার করবার নামে এদের যখন তখন তাড়িয়ে দেওয়া যায়। এরা মানুষ আমরা কি এখনও আগেকার দিনের সেই জমিদার কায়দা চালিয়ে যাচ্ছি, যে যখন ইচ্ছে হল তখনই গরিব লোকদের বাড়ি ঘর ভেঙে আগুন জালিয়ে দেব?
বন্ধুটি বলল, তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। এই সব কথা অনেকবার শুনেছি। বোঝাই যাচ্ছে, এই শহরটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হোক, তুমি তা চাও না।
এবার আমার উত্তেজিত হবার পালা। আমি জোর দিয়ে বললুম, না চাই না! কলকাতা শহর আরও নোংরা হোক, তাতেও কিছু আসে যায় না। এদের জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে এদের নির্দিষ্ট জীবিকার ব্যবস্থা না করে যদি পুলিশ দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে তাকে আমি বলব বর্বরতা।
বন্ধুটি হাসতে-হাসতে বলল, বসসা বিয়ার খাওয়া যাক। বিকেলবেলা রাজভবনে রাজ্যপালের সঙ্গে আমার চা খাওয়ার নেমন্তন্ন ছিল, সেখানে আমি গেলুম না। সেখানে অনেক মান্যগণ্য ভি . আই . পি . আসবেন, সেখানে যদি হঠাৎ আমি বলে ফেলি, আসাম থেকে বহিরাগতদের তাড়াবার প্রশ্ন উঠলে আপনারা প্রতিবাদ করেন, এখন কলকাতা থেকে আপনারাই বহিরাগতদের তাড়াচ্ছেন কেন? তাহলে একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার হবে, সুতরাং আমার না যাওরাই ভালো।
সারাদিন বাড়ি বসে থাকার পর সন্ধ্যেবেলা গেলুম একটা সিনেমা দেখতে। ন’টার সময় ট্যাক্সি নিয়ে ফিরতে ফিরতে অবাক হয়ে গেলুম। ক্যামাক স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিটের কিছু অংশ, সার্কুলার রোড একেবারে অন্ধকার। আজও লোডশেডিং? পনেরোই আগস্ট, আজ সমস্ত কলকারখানা, অফিস কাছারি বন্ধ, তবু লোডশেডিং? ছেলেবেলায় এই দিনটিতে কতরকম আলোকসজ্জা দেখেছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা স্বাধীনতা দিবসের কোন স্মৃতি মনে রাখবে?
গাড়ির হেড লাইটের আলোয় একটি মূর্তি দেখে চমকে উঠলুম পার্কস্ট্রিট ক্যামাক স্ট্রিটের মোড়ে রাস্তার ঠিক মাঝখানে। দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি উলঙ্গ নারীমূর্তি। একটু বেঁকে দাঁড়িয়ে গভীর বিস্ময়ে কী যেন দেখছে। এক নিমেষের জন্য মনে হল, কাকে দেখছি? পরের মুহূর্তেই বুঝতে পারলুম, না, একজন সাধারণ পাগলি, এরকম তো প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়।