‘যে শিশু মানচিত্র ও প্রতিলিপি ভালোবাসে
তার কাছে এই বিশ্ব তার ক্ষুধার মতনই প্ৰকাণ্ড
ওহ, প্রদীপের আলোয়
কতই বা বিশাল এই পৃথিবী
স্মৃতির চোখে এই পৃথিবী কতই না ছোট!’
–শার্ল বোদলেয়ার
মোনিক তার অ্যাপার্টমেন্টে আমাদের থাকতে দিয়েছে, খাওয়ার খরচ আমাদের নিজস্ব। এই অ্যাপার্টমেন্টটাও মোনিককে সামনের পয়লা তারিখে ছেড়ে দিতে হবে, এত বড় জায়গার ভাড়া সে একা টানতে পারবে না, সে এর মধ্যেই একটা এক কামরার স্টুডিও ঠিক করে ফেলেছে। এক তারিখের পর আমাদের প্যারিসবাস খুব অনিশ্চিত। মার্গারিট আর আমার দুজনেরই টাকার টানাটানি। আমি আমেরিকা ছেড়েছি একশো ডলারেরও কম পকেটে নিয়ে। মার্গারিট তার মায়ের চিকিৎসার জন্য নিজস্ব টাকা শেষ করে ফেলেছে, এখন সে ধার করছে বন্ধুদের কাছ থেকে, মোনিকের কাছ থেকেই ধার নিয়েছে পাঁচ শো ফ্র্যাংক। এতেই চলে যাচ্ছিল বেশ, বাজার করে এনে বাড়িতে রান্না করে খেলে তেমন বেশি খরচ হয় না। কিন্তু এর মধ্যে বিপদ বাধিয়ে ফেলল মোনিকের এক বন্ধু।
মোনিকের এই বন্ধুটির নাম পিয়ের ক্লোদেল। বেশ শৌখিন ধরনের যুবা, মাথার চুলগুলো লাল, বাজপাখির ঠোঁটের মতন নাক, চওড়া কপাল, সে যতটা না লম্বা, সেই তুলনায় তার হাত দুটি বেশি লম্বা মনে হয়, আজানুলম্বিত যাকে বলে। সে ইংরিজি জানে, মানিকের মতন সে তার ইংরিজি জ্ঞান গোপন না করে আমার সঙ্গে খুব ইংরিজি চালায়।
প্রথম আলাপের সময় আমি তার নামটা শুনে কৌতূহলী হয়েছিলাম। আমাদের দেশের মানুষের নামের সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানদের নামের একটা বেশ তফাত আছে। আমাদের দেশের একই পদবির হাজার হাজার লোক আছে, এক চৌধুরি বা চ্যাটার্জির সঙ্গে অন্য এক চৌধুরি বা চ্যাটার্জির কোনও সম্পর্ক নেই। পদবির সংখ্যা সীমিত হলেও আমাদের দেশের নারী-পুরুষদের প্রথম নামটা বহু বিচিত্র ধরনের হয়। বাবা-মায়েরা অনেক সময় ছেলে মেয়েদের নতুন নাম বানিয়েও দেন। ক্রিশ্চিয়ানদের বেলায় এর ঠিক বিপরীত। ওদের প্রথম নামগুলো একেবারে ধরাবাঁধা। সব মিলিয়ে কুড়ি-পঁচিশটার বেশি হবে না, কিন্তু সারনেম বা পদবি অসংখ্য। সেইজন্য একই পদবির দু’জন অনাত্মীয় নারী-পুরুষ ওদেশে প্রায় দেখাই যায় না।
পিয়ের ক্লোদেল নামটি শুনেই আমার মনে পড়েছিল পল ক্লোদেলের কথা। পল ক্লোদেল খ্যাতনামা নাট্যকার, কবি ও কূটনীতিবিদ। খুবই গোঁড়া ক্যাথলিক, তাঁর শেষের দিকের রচনা ধর্ম-আরাধনায় ভরতি, সেই কারণেই মার্গারিট মাঝে মাঝে তাঁর লাইন মুখস্থ বলে।
আমি পিয়েরকে জিগ্যেস করলাম, পল ক্লোদেল তোমার কে হন?
পিয়ের অবহেলার সঙ্গে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ঠাকুরদার ভাই। আমাকে আর কিছু জিগ্যেস কোরো না, আমি ওঁর লেখা বিশেষ কিছুই পড়িনি। নট মাই কাপ অফ টি!
অনেক সময়েই দেখেছি, বিখ্যাত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে সামান্য একটু আত্মীয়তা থাকলেই অনেকে তা বেশি বেশি জাহির করার চেষ্টা করে। পিয়ের তার ঠাকুরদার ভাইকে কোনও পাত্তাই দিল না।
যাই হোক, এই পিয়ের আমাদের এক সন্ধ্যায় এক রেস্তোরাঁয় নেমন্তন্ন করে বসল। প্লাস দ্য লা কঁকর্দ-এর কাছে একটা বেশ বনেদি গোছের রেস্তোরাঁ, কেউ না খাওয়ালে এখানে আমাদের ঢোকার কোনও সাধ্যই ছিল না। এইসব দোকানে ঢুকলে আমার পোশাক-পরিচ্ছদ ও জুতোর জন্য একটা হীনমন্যতা বোধ হয়। প্রতিদিন জু তো পালিশ বা বুরুশ করা আমার ধাতে নেই, এক শার্টে তিন-চারদিন চালিয়ে দিই, কাঁধের কাছে একটু ময়লা হয়ে থাকে, আর গলাতেও টাই বাঁধি না!
পিয়ের অবশ্য হাসি-ঠাট্টা-গল্পে জমিয়ে রাখল সারাক্ষণ।
খাওয়ার ব্যবস্থাও এলাহি। অর দ্যভর দিয়ে আরম্ভ। তারপর একটার পর একটা ডিশ। ফোয়া গ্রা, অর্থাৎ হাঁসের লিভার, কাভিয়ের অর্থাৎ স্টার্জন মাছের ডিম, আর একটা চিংড়ি মাছের রান্না, ছাগলের দুধের চিজ, সেই সঙ্গে এক বোতল শ্যাম্পেন ও দু’ বোতল বোর্দোর হোয়াইট ওয়াইন।
হোস্ট যখন বিল মেটান তখন সেইদিকে তাকানো অতিথিদের পক্ষে ভদ্রতাসম্মত নয়। তবু আমি চোরা চোখে না তাকিয়ে পারিনি। পিয়ের একটার পর একটা একশো ফ্রাংকোর নোট গুঁজে দিচ্ছে, অন্তত পাঁচ-ছ খানা তো হবেই। সে আমলে ছ’শো ফ্র্যাংক
অনেক টাকা। বাড়িতে খাওয়া আর রেস্তোরাঁর খাওয়া, বিশেষত এই ধরনের কায়দার রেস্তোরাঁর, আকাশ-পাতাল তফাত। কুড়ি-পঁচিশ ফ্র্যাংকের বাজার করে বাড়িতে রান্না করে খেলে মার্গারিট আর আমার দিব্যি চলে যায় দুবেলা। কিন্তু মাঝে মাঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়া এই সব দেশের জীবনযাত্রার অঙ্গ।
ওঠার একটু আগে মার্গারিট বলল, পিয়ের, এ-পাড়ায় একটা হাঙ্গেরিয়ান রেস্তোরাঁ আছে, সেখানে তুমি কখনও খেয়েছে?
পিয়ের বলল, না খাইনি। চলো, কাল সন্ধেবেলা সেখানে ডিনার খাওয়া যাক। হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ-এর খুব নাম শুনেছি।
সেটাই ঠিক হল, পরের দিন সন্ধেবেলা আবার বাইরে খাওয়া। আমার নিশ্বাসের একটু একটু কষ্ট হতে লাগল। রীতি অনুযায়ী পরের দিন পিয়ের আর মানিককে আমাদেরই খাওয়ানো উচিত, কিন্তু আমাদের সে পয়সা কোথায়? সাধের সঙ্গে যখন সাধ্য মেলানো যায় না, তখনকার গোপন কষ্টটা বোঝানোও যায় না কারুকে। ওদের কী করে বোঝাব যে আমরা কৃপণ নই, আমরা যে ভদ্রতা-সভ্যতা জানি না তাও নয়, কিন্তু আমরা অসহায়।
ফেরার পথে মার্গারিট বলল, কাল ওদের আমরা খাওয়াব।
আমি চমকে উঠে বললাম, টাকা পাবে কোথায়?
মার্গারিট বলল, তোমার আর আমার যা আছে, সব মিলিয়ে হয়ে যাবে। শ্যাম্পেন নেব।
আমি বললাম, সব টাকা খরচ হয়ে গেলে…তারপর?
মার্গারিট বলল, সে পরে দেখা যাবে! কারুর কাছ থেকে ঠিক ধার পেয়ে যাব!
মার্গারিটের সারল্য ও টাকা-পয়সা সম্পর্কে উদাসীনতার কাছে আমি যারংবার হেরে যাই। টাকার চিন্তা আমি ভুলতে পারি না কেন? নিউ ইয়র্কে প্রায় শেষ মুহূর্তে গ্রেগরি করসো আমার টাকাটা ফেরত না দিলে তো প্রায় নিঃস্ব অবস্থাতেই আমাকে আসতে হত প্যারিসে, তাতে কী আর এমন হেরফের হত! আসলে আমার মধ্যে একটা পুরুষ-প্রাধান্য কাজ করে। মোনিক ও মার্গারিট সঙ্গে থাকলে আমার সব সময় ইচ্ছে করে, ওরা কিছু খরচ করবে না, আমিই সব দেব। অথচ আমার পকেট ফুটো!
আমার কাছে যা টাকাপয়সা ছিল, খুচরো-টুকরো সমেত সবই তুলে দিলাম মার্গারিটের হাতে। পরের দিন হাঙ্গেরিয়ান রেস্তোরাঁর পিয়েরের সঙ্গে আমাদের প্রায় মারামারি বেধে যাওয়ার উপক্রম।
দু-একটা কোর্স খাওয়ার পরেই পিয়ের বলল, ‘শোনো, আগেই একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে নিই। আমাদের ভারতীয় বন্ধুটি যেন বিল মেটাবার কোনও চেষ্টা না করে। আজকের বিলও আমিই দেব।
আমি বললাম, কেন, আমি কী দোষ করেছি? বিল মেটাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হব কেন?
পিয়ের তার লম্বা হাত বাড়িয়ে আমার কাঁধ ধরে বলল, তুমি আমাদের অতিথি। ইন্ডিয়াতে যখন যাব, তখন তুমি খাওয়াবে।
মোনিক বলল, সুনীলের পয়সা দেওয়ার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ও আমাদের দেশ দেখতে এসেছে, ওর অনেক খরচ আছে। কাল পিয়ের দিয়েছে, আজ দেব আমি।
মার্গারিট বলল, তুই কেন দিবি রে? এই হাঙ্গেরিয়ান রেস্তোরাঁয় আমি তোদের নেমন্তন্ন করেছি না?
পিয়ের বলল, মোটেই না। তুমি রেস্তোরাঁর নাম বলেছিলে শুধু, এখানে আসার প্রস্তাব দিয়েছি আমি। ঠিক কি না বলে!
এইরকম তর্কাতর্কির মধ্যেই খাওয়া চলতে লাগল। শেষের আইসক্রিম খেতে খেতে পিয়ের বলল, ওয়েটার, বিলটা আমাকে দেবে, আর কেউ চাইলেও দেবে না!
ওয়েটারটি হাসতে লাগল। এরই মধ্যে এক ফাঁকে বাথরুমে যাওয়ার নাম করে উঠে গিয়ে মার্গারিট কাউন্টারে গিয়ে পুরো বিলের টাকা এবং বকশিশ-টকশিশ সব দিয়ে এসেছে!’
এরপর মার্গারিট আর আমি একেবারে ঝাড়া হাত-পা, তবু নিঃস্ব পক্ষেরই জয় হল।
সে রাতেও বাড়ি ফিরে গল্প হল অনেকক্ষণ ধরে। পিয়েরও যদিও প্রায়ই বলে যে সাহিত্য-টাহিত্য তেমন বোঝে না, তবু সে লেখকদের সম্পর্কে অনেক ঘটনা জানে।
রাত যখন অনেক হয়েছে, গল্পের একেবারে শেষ দিকে প্রায়, এক অলৌকিক টেলিফোন এল আমার নামে। তাতে এল এমনই এক চমৎকার বার্তা, যাতে আমার মস্তিষ্কে বয়ে গেল কুলকুল এক আনন্দের নদী। যারা ভক্ত এবং ধর্মবিশ্বাসী, তাদের কাছে এটা একটা মিরাকল মনে হতে পারে। আমি ভাগ্য কিংবা দৈবে বিশ্বাসী নই, তবু আমার জীবনে মাঝে মাঝে এরকম আকস্মিক ঘটনা ঘটে। সেইজন্যই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মাঝে মাঝে বলেন, আমি নাস্তিক বলেই নাকি ভগবান আমাকে খুশি করার জন্য, নিজের দিকে টানার জন্য ওভার টাইম খাটেন।
আমি মার্গারিট-মানিকের কাছে শোনা গল্পগুলো বলে নিই।
সেদিন দুপুরে মার্গারিট আর আমি শেষ পর্যন্ত লুভর মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে কোন কোন ছবি ভালো লেগেছে, সেই আলোচনা করতে করতে এদুয়ার মানে-র আঁকা ‘ঘাসের ওপর মধ্যাহ্ন ভোজ’ (Le Dejeuner Sur L’Herbe) ছবিটার কথা ঘুরে ফিরে আসছিল। মোনিক একবার জিগ্যেস করল, এই ছবিটা যখন প্রথম দেখানো হয়, তখন কী কাণ্ড হয়েছিল জানো?
আমি বললাম, জানি না। বলো, বলো। আমার এইসব কাহিনি শুনতে খুব ভালো লাগে।
মোনিক মার্গারিটকে জিগ্যেস করল, তুই সুনীলকে সালোঁ দে রেফুউজের ঘটনাটা বলিসনি?
মার্গারিট বলল, আমি ভালো জানি না। তুই বল।
আমরা যখন বসে গল্প করছি, তার ঠিক একশো এক বছর আগেকার ঘটনা। ফরাসি দেশের সম্রাট তখন তৃতীয় নেপোলিয়ান।
গত শতাব্দীর মধ্যভাগে প্যারিসে হাজার হাজার শিল্পী গিসগিস করত। যাদেরই একটু আঁকার হাত বা শখ থাকত, তারা দূর দূর থেকে প্যারিসে এসে জমায়েত হত ভাগ্যান্বেষণে। প্যারিসের কোনও প্রদর্শনীতে একবার স্বীকৃতি পেলে সারা পৃথিবীতে নাম ছড়াবে। শুধু ফরাসিদের জন্যই নয়, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, আমেরিকার তরুণ শিল্পীদের কাছেও প্যারিস ছিল শিল্পের স্বর্গ।
শিল্প ও সংস্কৃতির মান বজায় রাখার জন্য কয়েকটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানও চালু করা হয়েছিল সরকার থেকে। যেমন আকাদেমি ফ্রাঁসেজ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হত লেখকদের, ভাষার শুদ্ধতা রক্ষার দায়িত্বও এই আকাদেমির। সেইরকম, তরুণ শিল্পীদের যোগ্যতার বিচার হয়তো আকাদেমি দে বোজার। দু’বছর অন্তর অন্তর এই আকাদেমির উদ্যোগে হত এক বিশাল শিল্প প্রদর্শনী। তার আগে শিল্পীদের বলা হত মনোনয়নের জন্য ছবি জমা দিতে। হাজার হাজার তরুণ-প্রবীণ শিল্পী তাদের একাধিক ক্যানভাস জমা দিত, একটি কমিটি সেই সব ছবি দেখে দেখে বিচার করতেন। বাতিল হত অনেক, আর যেগুলি যোগ্য বলে প্রদর্শনীতে স্থান পেত, সেগুলি রসিক ও ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত তো বটেই, ওই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়াই ছিল শিল্পীদের স্বীকৃতি।
তবে এই যে আকাদেমির সর্বশক্তিমান বিচারক কমিটি, তার সদস্য হত সাধারণত মাঝারি প্রতিভার বয়স্ক শিল্পীরা, তারা সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট এবং অভিজাতদের আশীর্বাদধন্য। সুতরাং দৃষ্টিভঙ্গিতে তারা রক্ষণশীল। সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কোনও এক্সপেরিমেন্ট দেখলে তারা শিউরে উঠত, নবীন প্রতিভাবানদের সমাদর করার বদলে তারা ট্র্যাডিশনাল শিল্পীদেরই মর্যাদা দিত বেশি।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে একদল যুগান্তকারী শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এদুয়ার মানে, ক্লদ মনে, এডগার দেগা, জাঁ রেনোয়া, পল সেজান, কামিল পিসারো, সিসলে, হুইসলার এবং আরও অনেকে। পরে এঁদের সঙ্গে যুক্ত হয় ভ্যান গগ, পল গগ্যাঁ, মারি কাসাট, বার্থ মরিসো প্রমুখ। সেই ষাটের দশকে এদের কোনও গোষ্ঠী তৈরি হয়নি বটে, তখনও এঁরা ইমপ্রেশানিস্ট নামে পরিচিত নয়, কিন্তু এক কাফেতে আড্ডা মারতেন, কোনও কোনও স্টুডিয়োতে একসঙ্গে ছবি আঁকতেন।
এই দলটিকে আকাদেমি বোজার একেবারে পাত্তাই দিত না। বছরের পর বছর এঁদের ছবি বাতিল হয়ে ফিরে আসত। সে-যুগের যারা শ্রেষ্ঠ শিল্পী, তাদেরই ভাগ্যে জুটত সরকারি উপেক্ষা। প্রদর্শনীতে স্থান না পেয়ে বাতিল ছবি তাঁরা ঘাড়ে করে ফিরিয়ে আনতেন, পরের বার আবার নতুন ছবি জমা দিতেন, এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও তো
এক বছর একটা বিস্ফোরণ ঘটল। সেটা ১৮৬৩ সাল, সেবার এই দলের শিল্পীদের অনেকখানি আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছে, তাঁরা বুঝতে পেরেছেন যে এক নতুন শিল্পীরীতি তাঁরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। এঁরা তাঁদের শ্রেষ্ঠ ফসলগুলি জমা দিলেন। অন্যান্য বছর এই দলের দু-একজনের একটা-আধটা ছবি নির্বাচিত হয়েছে, এর এঁদের ধারণা, সকলেই একসঙ্গে স্থান পাবেন, দর্শকরা বুঝবেন, শিল্পজগতে একটা পালাবদল এসেছে!
সে বছর সবাই বাতিল!
অন্যান্যবারের মতন তরুণ শিল্পীরা এবার আর মুখ বুজে এই অবিচার মেনে নিতে চাইল না। তারা তাদের নির্দিষ্ট কাফেতে গিয়ে হইচই, চিৎকার শুরু করল, গালমন্দের ঝড় বইয়ে দিল। কেউ কেউ টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়ে বলতে লাগল, এর দেখে নেব!
শিল্পীরা অধিকাংশই খুব গরিব, সরকারের ওপরের মহলে কোনও চেনাশুনো নেই। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন এদুয়ার মানে। তিনি ধনীর সন্তান। তাঁর যাবা তাঁর ছবি আঁকার বাতিক ছাড়াবার অনেক চেষ্টা করেছেন, ছেলেকে শিল্পীর অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে দিতে চাননি। একবার মানে-কে একটা জাহাজের চাকরি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, যাতে মানে-র এই রোগ কেটে যায়, কিন্তু মানে ছবি আঁকার জন্য জীবন পণ করেছিলেন।
মানে সেই কাফেতে বসে বললেন, আমার বাবা একজন ম্যাজিস্ট্রেট, আমি বাবাকে দিয়ে সম্রাটের কাছে প্রতিবাদপত্র পাঠাব!
আর একজন বলল, আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর চেনা আছে, আমি তাঁকেও জানাব যে এসব কী চলছে!
শিল্পীদের এই বিক্ষোভের কথা কিছু কিছু ছাপা হল খবরের কাগজে, বেশ কয়েকটা চিঠি গেল সরকারের কাছে। প্রবীণ শিল্পী দেলাক্রোয়া নবীনদের প্রতি সমর্থন জানালেন। ক্রমে এই কথাটা সম্রাটের কানে গেল।
সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ান সব সময় বিপ্লব-বিদ্রোহের জু জ্বর ভয় পেতেন। শিল্পীদের নেতৃত্বে একটা বিদ্রোহ শুরুর সম্ভাবনা তিনি একেবারেই পছন্দ করলেন না। তিনি খবর পাঠালেন, স্বয়ং তিনি সালেতে গিয়ে নির্বাচন পদ্ধতি দেখবেন।
স্বর্ণমণ্ডিত রথে চেপে বাদশা এলেন একদিন। তাঁর সিংহাসনটিও নিয়ে আসা হল। তাতে বসে তৃতীয় নেপোলিয়ান দেখলেন সব বাতিল ছবি। একটার পর একটা ছবি এনে দেখানো হল তাঁকে। তারপর তিনি আদেশ দিলেন, এর আনো তো কোন ছবিগুলো মনোনীত হয়েছে!
সেগুলিও দেখার পর তিনি বললেন, মনোনীতগুলোর চেয়ে বাতিলগুলো তো কোনও অংশে খারাপ দেখছি না!
আকাদেমির পরিচালক বললেন, কিন্তু হে সম্রাট, জুরিদের বিচারেই তো ভালো ছবিগুলি নির্বাচিত হয়েছে!
সম্রাট বললেন, জুরিরা চুলোয় যাক! কুকুরের গায়ে যেমন এঁটুলি লেগে থাকে, ওরাও তেমনি সর্বাঙ্গে সংস্কারগ্রস্ত! এই সব বাতিল ছবিও এবার টাঙাতে হবে!
কিন্তু জায়গা পাওয়া যাবে কোথায়?
জায়গা খোঁজো! নতুন বাড়িতে টাঙাও!
সম্রাটের আদেশে সেবার দুটি প্রদর্শনী চালু হল। একটি পূর্ব-নির্বাচিত শিল্পীদের, অন্যটি বাতিলদের। দ্বিতীয়টির নামই হল সালে দে রেফুউজে। কিন্তু এই বাতিলদের প্রদর্শনী কে দেখতে আসবে? সম্রাট সেদিকেও চিন্তা করেছিলেন। উদ্বোধনের দিন তিনি নিজে আসবেন সদলবলে, তা হলেই আসবে অভিজাতরা, এবং এই সমাগম দেখেই উপস্থিত হবে কৌতূহলীরা। সম্রাট সেইরকমভাবেই কিছুক্ষণের জন্য এলেন। তরুণ শিল্পীদের খুশি করার জন্য তৃতীয় নেপোলিয়ান চেষ্টার ত্রুটি করেননি। তাতেও কোনও লাভ হল না!
কৌতূহলী দর্শকে হল ভরতি হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে সবাই চুপ। সম্রাট চলে যাওয়ার পর শুরু হল গুঞ্জন, তারপর ঠাট্টা-ইয়ার্কি, অট্টহাসি। মেয়েরা মুখে রুমাল চাপা দিল, পুরুষরা পেট চেপে ধরেও হাসি সামলাতে পারে না। শিল্পরসিক প্যারিসের দর্শকদের চোখে এই সব কোনও ছবির মধ্যেই শিল্প নেই।
সবচেয়ে বেশি ভিড় হলো এদুয়ার মানে-র ‘ঘাসের ওপর মধ্যাহ্ন ভোজ’ এবং হুইসলারের ‘শ্বেত বালিকা’ ছবির সামনে। সবচেয়ে বেশি বিদ্রূপও বর্ষিত হল এই দুটি ছবির ওপরে। মানে সম্পর্কে চেঁচিয়ে বলা হতে লাগল, পাগল! লোকটা বদমাস! অশ্লীল ছবি এঁকেছে। এই ছবিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা উচিত।
সারা পৃথিবীতে যারা ছবি ভালোবাসে, তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে মানে-র এই ছবিটি দেখিনি। ছবিটির কম্পোজিশান যে খুবই বিচিত্র, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জঙ্গলের মধ্যে ঘাসের ওপর বসে আছে দুজন সম্পূর্ণ সুসজ্জিত পুরুষ। তাদের পাশে একটি রমণী সম্পূর্ণ নগ্ন, একটু দরে আর একটি পাতলা জামা পরা রমণী জলে পা ধুচ্ছে। দুজন সম্পূর্ণ পরিচ্ছদ পরিহিত পুরুষের পাশে নগ্ন রমণীটিই যাবতীয় কৌতূহলের কারণ, যদিও ছবিটির মধ্যে অশ্লীলতার আভাসমাত্র নেই। অশ্লীলতা পোশাক দিয়ে বিচার করা যায় না, অশ্লীলতা ফুটে ওঠে ভঙ্গিতে।
বর্তমানে ছবিটি বিশ্ববন্দিত, লুভর মিউজিয়ামে টাঙানো রয়েছে, অথচ একশো বছর আগে ছবিটা ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিল দর্শকরা, শিল্পীর ভাগ্যে জুটেছিল লাঞ্ছনা!
কথায় কথায় মোনিক বলল, এদুয়ার মানে-র এই ছবিটা কিন্তু সম্পূর্ণ মৌলিক নয়। লেখকরা যেমন অন্য লেখকদের কাছ থেকে ভাব ধার নেয়, এদুয়ার মানে-ও সেরকম এ ছবিটার কমপোজিশান ধার করেছেন, মানসানতানিও রাইমণ্ডির এনগ্রেভিং আফটার রাফায়েল’স জাজমেন্ট অফ প্যারিস’ থেকে।
মার্গারিট এটা মানতে কিছুতেই রাজি নয়। দুজনে তর্ক লেগে গেল। তর্ক থামাবার জন্য আমি জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা, সেই সময় লেখক-কবিরা এই শিল্পীদের সাহায্য করেনি? আমি তো জানতাম, বোদলেয়ার এদের পক্ষ নিয়ে লিখেছিলেন।
পিয়ের বলল, বোদলেয়ারের আর কী ক্ষমতা ছিল? তিনি তখন নিজের জ্বালায় মরছেন। কেউ তাঁর লেখা ছাপে না, চতুর্দিকে ধার, বিধবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন নানা ছুতোয়, ওদিকে আবার জান দুভাল নামে এক রক্ষিতাকে টাকা দিতে হয়। বোদলেয়ারের মৃত্যুও তখন কাছাকাছি এসে গেছে। ওদের আর এক লেখক বন্ধু ছিলেন এমিল জোলা। এমিল জোলা ছিল পেল সেজান-এর স্কুলের বন্ধু। দুজনেই এসেছেন এক্স আঁ প্ৰভাঁস থেকে। তবে এমিল জোলাও তখন ঠিক মতন প্রতিষ্ঠিত নন, বিশেষ কেউ চেনে না, তিনি খবরের কাগজে কিছু কিছু লিখতেন বন্ধুদের সম্পর্কে।
আমি জিগ্যেস করলাম, আর ভিক্তর হুগো? তিনি তো তখন রীতি মতন প্রতিষ্ঠিত।
ভিক্তর হুগোর নাম শুনে পিয়ের হো হো করে হেসে উঠল উচ্চকণ্ঠে।
ওর হাসির কারণটা জানা হল না, এই সময় বেজে উঠল টেলিফোন। মোনিক উঠে গিয়ে ফোনটা ধরে এক মিনিট কথা বলে, হাত উঁচু করে বলল, সুনীল, তোমার।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। প্যারিসে আমি এদের বাইরে আর কারুকেই চিনি না, আমায় কে ফোন করবে? তাও রাত সাড়ে বারোটায়? উঠে গিয়ে কণ্ঠস্বর শুনেও আমার বিস্ময় একটু কমল না।
আটলান্টিক মহাসমুদ্রের ওপার থেকে পল এঙ্গেল বলল, হাই সুনীল, কী খবর তোমার? এখান থেকে চলে যাওয়ার পর একটা চিঠি লিখলে না। ফোন করলে না।
আমি লজ্জায় জিভ কাটলাম। সত্যি এটা আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমি বড়ই তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি। সেই সময় ইন্ডিয়ানার ব্লমিংটনে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসু, ওঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, প্রতিভা বসু কত ভালোবাসা ও যত্নের সঙ্গে আমাকে একবার কাছে রেখে খাইয়েছিলেন, ওদের ছেলে পাপ্পার সঙ্গে ছিল আমার খুব ভাব। ওঁদেরও কিছু জানিয়ে আসা হয়নি, একসঙ্গে এসব মনে পড়ে গেল।
আমি জিগ্যেস করলাম, পল, তুমি এখানে আমাকে কী করে ফোন করলে? আমি যে এ বাড়িতে থাকব, তা তো প্যারিসে আসবার আগে আমিও জানতাম না।
পল এঙ্গেল বললেন, এটা এমন কিছু শক্ত নয়। তুমি কোনও ফরোয়ার্ডিং অ্যাড্রেস রেখে যাওনি। আমি ভেবেছিলাম, নিউ ইয়র্ক থেকে তুমি কলকাতায় ফিরে যাবে। নিউ ইয়র্কে অ্যালেন গিনসবার্গকে ফোন করে জানলাম, তুমি প্যারিসে। অ্যালেনই এই নাম্বারাটা দিল।
নিউ ইয়র্ক থেকে আমি একবার মার্গারিটকে ফোন করেছিলাম বটে, নাম্বারটা লিখে রেখেছিলেন ওদের অ্যাপার্টমেন্টের দেওয়ালে, সেখানে আরও বহু নাম্বার লেখা, অ্যালেন তার মধ্য থেকে এটা ঠিক খুঁজে বার করেছে!
পল এঙ্গেল জিগ্যেস করলেন, প্যারিসে তুমি কোথায় আছ? প্যারিস তো খরচের জায়গা। আমি তোমাকে আমার এক বন্ধুর কাছে রাখার ব্যবস্থা করতে পারি।
আমি বললাম, তার দরকার নেই। আমি একটা থাকার জায়গা পেয়ে গেছি।
পল এঙ্গেল বললেন, তুমি মেরির সঙ্গে দেখা করে যাওনি। মেরি খুব রাগ করেছে। আজ সারাদিন সে তোমার কথা বলছিল।
এবার আমার লজ্জায় কথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পলের স্ত্রী মেরি আমায় সত্যিই খুব ভালোবাসেন। অনেকবার তিনি আমায় আদর করে বলেছেন, এই ছেলেটাকে আমি পোষ্যপুত্র হিসেবে রেখে দেব! মেরির কাছ থেকে বিদায় নেওয়া খুব কঠিন হত বলেই আমি তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা করিনি। এটা খুবই অন্যায় হয়েছে।
আমি কোনওক্রমে বললাম, আমি ক্ষমা চাইছি, পল। একবার কি মেরির কাছে ক্ষমা চাইতে পারি?
পল এঙ্গেল বললেন, না, পারো না। মেরির আজ আবার খুব ডিপ্রেশান হয়েছে, সারাদিন রাগারাগি করছিল, এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ঘুমোচ্ছে, তুমি তো জানো…
মেরির এই অসুস্থতার কথা আমি জানি ঠিকই। মেরির খুব রাগ তাঁর স্বামীর ওপর। মাঝে মাঝে তাঁর ডিপ্রেশান হয়। মেরির অভিযোগ একটাই, তাঁর ব্যস্ত স্বামী তাঁর জন্য সময় দিতে পারেন না। সারাদিন ও সন্ধে, কখনও দিনের পর দিন ও রাত মেরিকে একা একা কাটাতে হয়। সেইসব দিয়ে মেরি জিন পান করতে শুরু করেন, ক্রমশ নেশা বেড়ে যায়, কিছু জিনিসপত্র ভাঙেন ও একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। ওদেশে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাদের নিজের নেশা করা একটা অতি পরিচিত রোগ। প্যারিসে এখন মধ্যরাত হলেও আমেরিকায় এখন বিকেল, এরই মধ্যে মেরি অজ্ঞান।
আমি অনুতপ্তভাবে বললাম, মেরিকে আমি চিঠি লিখব ক্ষমা চেয়ে।
পল এঙ্গেল বললেন, ‘শোনো, মেরি তোমাকে একটা উপহার দিতে চায়। আজ সারাদিন সেই কথাই বলছিল। তুমি কাল প্যারিসের যে-কোনও আমেরিকায় এক্সপ্রেস ব্যাংকে গিয়ে তোমার পাসপোর্ট দেখালে ওরা তোমাকে দুশো ডলার দেবে।
আমি বললাম, না, না, আমার এখানে টাকা লাগবে না। আমার এখানে বেশ চলে যাচ্ছে, কয়েকজন বন্ধু পেয়েছি।
পল এঙ্গেল ধমক দিয়ে বললেন, এটা মেরির উপহার। তোমার প্রয়োজন আছে কি, তা জেনে কেউ উপহার দেয় না! তুমি না নিলে মেরি দুঃখ পাবে!
টেলিফোনটা রাখার পর আমি একটুক্ষণ হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। এ যে স্বপ্নের মতন। মেরি আমাকে এত ভালোবাসে! মায়েদের যেমন একটা ইনসটিংকট থাকে, সেইরকমই কি মেরি ঠিক আজই আমার অবস্থাটা অনুভব করে এই উপহার পাঠাল?
দুশো ডলার বিরাট কিছু সম্পদ নয়, তখনকার হিসেবে এক হাজার টাকা। কিন্তু আমার সেই অকিঞ্চন অবস্থায় সেই টাকাটাই লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পাওয়ার মতন।
হঠাৎ আমার চোখ জ্বালা করে উঠল। পল ও মেরির এই যে আমার প্রতি অকারণ ভালোবাসা, আমি ও দেশ ছেড়ে চলে এসেছি তবু আমার জন্য উদ্বেগ, আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা, আমি কি এত কিছুর যোগ্য?