মস্কোয় পৌঁছোবার আগে আমাকে জার্মানির অনেকগুলো শহর ঘুরতে হয়েছে। ভারত উৎসব চলছে সে দেশে, সেই সূত্রে আমন্ত্রণ। এর আগে জার্মানির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে দেখার সুযোগ আমার হয়নি, এখন পূর্ব-পশ্চিম একাকার, দুই দিকের মিলনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। দেওয়াল ভাঙার উদ্মাদনা ও উল্লাস থিতিয়ে গেছে অনেকখানি, লাভ-লোকসান নিয়ে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। এত বড় একটা পরিবর্তনের পর কিছু বিশৃঙ্খলা ও সমস্যার সৃষ্টি হবেই। পূর্ব জার্মানির মানুষ স্বাধীন হয়েছে বটে কিন্তু পশ্চিম জার্মানির মতন যে তাৎক্ষণিক সমৃদ্ধি আশা করেছিল, তা জোটেনি। পশ্চিমেও কর-বৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য জমা হয়েছে কিছু কিছু ক্ষোভ। কিন্তু জার্মানির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনই সুদৃঢ় যে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও কোনও কিছুই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়নি, পাওয়া যায় সব কিছুই, কালোবাজারির প্রশ্নই ওঠে না, দরবৃদ্ধিও বেসামাল রকমের নয়।
পূর্ব দিকে অনাধুনিক কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার আশঙ্কায় তুর্কি ও ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশি ও শ্রীলঙ্কার ইমিগ্রান্টসদের ওপর হামলা চলছে কোনও কোনও জায়গায়, উগ্রপন্থী নব-নাতসি দলেরও সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের দেশে এসব কোনও কিছুই লুকিয়ে রাখা যায় না। দুই জার্মানির মিলনের এমন তাড়াহুড়োর কী দরকার ছিল, এ প্রশ্ন অনেক জায়গাতেই শোনা যায়। পূর্ব জার্মানির দিকে কেউ কেউ তিক্তভাবে বলে, দুই জার্মানির মিলনের ফলে আমরা কী পেলাম? এর চেয়ে আগের অবস্থাটাই বা মন্দ ছিল কী? ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর যখন নানারকম ডামাডোল শুরু হয়েছিল, চাল-চিনি কাপড়-কয়লার জন্য রেশনের লাইনে দাঁড়াতে হত, তখনও কিছু বয়স্ক লোক বলত, এর থেকে ইংরেজ রাজত্ব ভালো ছিল!
পশ্চিম দিকের লোকদের কাছে পূর্ব দিকের লোকরা এখনও অনেকটা গরিব আত্মীয়ের মতন। ট্রেনে যাওয়ার সময় এক পূর্ব দিকের সহযাত্রী এই সব প্রসঙ্গ তুলে আলোচনা করতে-করতে বলল, বহু বছর আমরা দেওয়ালের ওপাশে ছিলাম, দেওয়াল ভাঙার জন্য ব্যাকুলতা ছিল ঠিকই, কিন্তু এখন দেখছি, ওদের সঙ্গে আমাদের মানসিক ব্যবধান এতটাই তৈরি হয়ে গেছে যে, একমাত্র ভাষার মিল ছাড়া আমাদের দু’দিকের জার্মানদের আর কী মিল আছে?
একজন বঙ্গবাসী ও ভুক্তভোগী হিসেবে আমি মনে-মনে বললাম, ভাগ্যিস তোমাদের ধর্মের অমিল নেই। তা হলে নিশ্চিত এতদিনে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে যেত।
দুই অসম দিকের মিলনের ফলে বেশ কিছু বিক্ষোভ, হতাশা, তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু গোটা জার্মানির জীবনযাত্রায় তার প্রভাব বিশেষ পড়েনি। বেকাররা যা ভাতা পায়, তাতে তাদের খাদ্য-বস্ত্র পানীয় ঠিক জুটে যায়। মিটিং-মিছিল হয়, কিন্তু তার জন্য যানবাহন বা উৎপাদন বন্ধ থাকে না। এশিয়ান ইমিগ্রান্টসদের ওপর হামলা হচ্ছে বটে, আবার বহু জার্মান তার প্রতিবাদও জানাচ্ছে। জার্মান মুদ্রা বিশ্বের বাজারে এখনও অত্যন্ত সুদৃঢ়। ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার দাম বাড়ছে।
জার্মানি থেকে মস্কোয় এসে প্রথমেই যেটা চোখে বিসদৃশ লাগে, তা হল রাস্তাঘাটের অবস্থা এবং সোভিয়েত মুদ্রা রুবলের হেনস্থা।
জার্মানির পশ্চিম অঞ্চলের রাস্তা একেবারে একঘেয়ে রকমের নিখুঁত। রেসশাইড থেকে বার্লিনে ফিরেছিলাম গাড়িতে বেশ কয়েকশো কিলোমিটার, কোথাও একটা গর্ত নেই, উঁচু-নীচু নেই। সেই তুলনায় মস্কোর রাস্তায় অনেক ফাটল ও খন্দ। সাড়ে সাত বছর আগেও এরকম দেখিনি। সরাসরি কলকাতা থেকে গেলে হয়তো এসব চোখে পড়ত না। কলকাতার সঙ্গে কোনও জায়গারই তুলনা হয় না, কলকাতা সত্যিই অতুলনীয়, এত খারাপ রাস্তা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। মস্কোর রাস্তা কলকাতার তুলনায় অবশ্যই ভালো, কলকাতার মতন এত নোংরা আবর্জনা সেখানে নেই।
আগে এক রুবলের সরকারি মূল্য ছিল দেড় ডলারের কাছাকাছি। আগেও ডলারের ব্ল্যাক মার্কেট ছিল অবশ্যই। কিন্তু আমি সরকারি অতিথি হিসেবে এসে সে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। গত দু-তিন বছরে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে স্থানীয় মুদ্রার সঙ্গে ডলারের সরকারি ও বেসরকারি মূল্যমানের ব্যবধান প্রকটভাবে চোখে পড়েছে। কিন্তু রাশিয়ান বর্তমানের অবস্থাটা অবিশ্বাস্য রকমের। হাঙ্গেরি, রুমানিয়ায় দেখেছি এক ডলারে সাত গুণ, দশ গুণ বেশি স্থানীয় টাকা পাওয়া যায়। আর মস্কোতে? এক ডলারের চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ গুণ! প্রতিদিনই সেটা বাড়ছে। দশটা ডলার ভাঙালে রাশি রাশি রুবল পাওয়া যায়। বার কাছে ডলার আছে, তার কাছে মস্কো এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শহর!
তার কারণ, অনেক কিছুরই দাম বাঁধা আছে আগেকার মতন। যেমন ট্রেন ভাড়া। মস্কো থেকে লেনিনগ্রাডের (সেন্ট পিটার্সবার্গের) প্রথম শ্রেণির ট্রেন ভাড়া। সারারাত গরম বিছানায় শুয়ে আরামের যাত্রা। এই দীর্ঘপথের ভাড়া ২৪ রুবল। ডলারের হিসেবে মাত্র আধ ডলার, আমাদের টাকার হিসেবেও বারো-চোদ্দ টাকা। এটা হাস্যকর না। রুবলের এই করুণ পরিণামের ফলেই ব্লাক মার্কেট ও ঘুষের রাজত্ব চলছে চারদিকে। ওখানকার। ঘুষের সঙ্গে আমাদের ঘুষের কোনও তুলনাই চলে না।
মস্কোর ট্যাক্সি কলকাতাকে বহু গুণ হার মানিয়ে দিয়েছে। ট্যাক্সিচালকরা সরকারি কর্মচারী, ভাড়ার রেটও বাঁধা। সেই জন্য কোনও ট্যাক্সিচালকই বাঁধা রেটে যেতে রাজি নয়। চলন্ত ট্যাক্সি হাত দেখালে গ্রাহ্যই করে না। স্ট্যান্ডের টাক্সি আগে দরাদরি করে, বিদেশি দেখলে সরাসরি ডলারে ভাড়া দাবি করে। কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালা কুড়ি টাকা মিটার উঠলে যদি চল্লিশ টাকা চায় আমরা আঁতকে উঠি, মস্কোর ট্যাক্সি কুড়ি রুবলের জায়গায় চাইবে পাঁচশো রুবল। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় একটা সগর্ব ঘোষণা ছিল যে সেখানে জিনিসপত্রের কোনও দাম বাড়ে না!
মস্কোর রাস্তায় যখন তখন দেখা যায় বহু নারী-পুরুষ চলন্ত গাড়িগুলির দিকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। ট্যাক্সি থামে না, কিন্তু অনেক প্রাইভেট গাড়ি বুড়ো আঙুল দেখলে থামে। যাত্রীদের তুলে নেয়। বিনা পয়সায় লিফট দেয় না অবশ্য, প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। গরবাচেভ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর গাড়ির মালিকদের এই ব্যবসায়ের আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছেন।
সরকারি বাঁধা দামের দোকানগুলিতে এখনও কোনও জিনিসের দাম বাড়েনি। এটা এখন বেশ কৌতুকের ব্যাপার। দাম বাড়বে কীসের, কোনও জিনিসই তো নেই! সমস্ত সরকারি দোকান খালি। রেড স্কোয়ারের পাশে একটা সুপার মার্কেট আছে, এত বড় মার্কেট খুব কমই দেখা যায়। বহু দোকান, তার অধিকাংশই বন্ধ, যে দু-একটা খোলা আছে, তাদের অবস্থা করুণ। একটা দোকানে ঢুকে বেশ মজার ব্যাপার হল। সে দোকানটি সরকারি ঘড়ির দোকান, কিন্তু তাতেও একটাও ঘড়ি নেই। রয়েছে কিছু সাবান। তাও ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। আমরা জিগ্যেস করলাম, ঘড়ির দোকানে ঘড়ি নেই কেন? তখন কর্মচারীটি একটি শো-কেস দেখিয়ে দিল। তাতে রয়েছে কিছু হাতঘড়ির ব্যান্ড। অর্থাৎ এখন শুধু ব্যান্ড কিনে নিয়ে যান, পরে কখনও ঘড়ি কিনবেন। এই নিয়ে মস্কোতে, অনেক রসিকতা চালু আছে। একজন কেউ এক শিশি রান্নার তেল কিনতে গিয়েছিল, কিনে আনল এক জোড়া জুতো। কারণ, তেল নেই, জুতো আছে। এরপরে যখন তার জুতো কেনার দরকার হবে, তখন জুতো পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে টুথ ব্রাশ!
এই নিয়ে একটি বেশ মজার গল্প শুনেছি। মস্কো অলিম্পিকের সময় একটি হোটেল ঘোষণা করেছিল যে সেখানে বিশ্বের সবরকম খাবার পাওয়া যায়। যে কেউ যে-কোনও খাবারের অর্ডার দিলে তা পাওয়া যাবে আধঘণ্টার মধ্যে। যদি আধঘণ্টার মধ্যে দেওয়া না যায়, তা হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ সেই খরিদ্দারকে দশ হাজার রুবল দেবে। একজন খরিদ্দার সেই হোটেলে এসে জিগ্যেস করল, আমাকে কচি উটের মাংস আর আলুর ঝোল খাওয়াতে পারবে? ম্যানেজার সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ। খদ্দেরটি বসল টেবিলে, অপেক্ষা করতে লাগল। একটু বাদে সে জানলা দিয়ে দেখতে পেল, একটা বাচ্চা উটকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পেছন দিকে। তা হলে তার মনোমতন খাবার আসবেই। কিন্তু আধঘণ্টা কেটে গেল, ম্যানেজার কাঁচুমাচু মুখে এসে বলল যে, স্যার আপনার খাবারটা দেওয়া যাচ্ছে না, আপনি দশ হাজার রুবল নিন। খরিদ্দারটি অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কেন পাওয়া যাবে না? ওই যে একটা উটকে নিয়ে যেতে দেখলাম? ম্যানেজার বলল, হ্যাঁ, উট জোগাড় হয়েছে বটে, কিন্তু আলু নেই!
সরকারি দোকানগুলোর পাশাপাশি এখন অনেক লোক পশরা সাজিয়ে বসে। কিছু কিছু ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারি দোকানে হয় কিছুই নেই অথবা পড়ে আছে দু-চারটে পচা-ধচা জিনিস, আর পাশের দোকানগুলিতে বিক্রি হচ্ছে টাটকা সবজি ও মাংস। সরকারি বাঁধা রেটের চেয়ে অনেক গুণ বেশি মূল্যে। মাংসের সরকারি রেট আট রুবল, অন্য ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে ষাট রুবল দরে। ভর্তকি দিয়ে সস্তায় খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থার এই অবস্থা! সোভিয়েত ইউনিয়নে মাঝারি ধরনের চাকুরিজীবীদের মাইনে গড়ে তিনশো রুবল। তারা ষাট রুবল কিলো দরে কাদিন মাংস খাবে? বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পেনশান মাসে চল্লিশ-পঞ্চাশ রুবল, এক কিলো মাংসের দামের চেয়েও কম।
রেড স্কোয়ারের পাশের সুপার মার্কেটটির অনেক ঘর এখন ভাড়া দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানিতে। সরকারের ওই বাজার চালাবার সাধ্য নেই। ইতালিয়ান, বেলজিয়ান অনেক কোম্পানি বেশ কিছু দোকানঘর কিনে নিয়ে নিজেদের মতন করে সাজাচ্ছে। কোন মুদ্রায় জিনিসপত্র বিক্রি হবে সেখানে? বিদেশি ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই রুবলকে বেয়াত করবে না।
সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কলঙ্ক হল বিরোউস্কা অর্থাৎ বিদেশি মুদ্রার দোকান। চিনেও এরকম দোকান আছে। এইসব দোকানে ভালো ভালো বাছাই করা সব বিদেশি দ্রব্য থাকে কিন্তু দেশীয় মুদ্রায় কিছুই কেনা যাবে না, ডলার, পাউন্ড লাগে। এই সব কোনও দেশেরই সাধারণ মানুষের কাছে ডলার-পাউন্ড থাকা আইনসঙ্গত নয়। সুতরাং সাধারণ মানুষার পথে যেতে-যেতে জানলার কাঁচ দিয়ে এইসব লোভনীয় দ্রব্যগুলি দেখবে কিন্তু কিনতে পারবে না। একটা দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি এটা চরম অপমান। বিদেশি মুদ্রার কালোবাজারের উৎসও এইসব দোকান।
এখন বিদেশি মুদ্রার দোকান অনেক গজিয়ে উঠেছে মস্কো শহরে। এক আইরিশ কোম্পানি রীতিমতন একটা সুপার মার্কেট বসিয়েছে, তার মধ্যে ঢুকলে কে বলবে যে
মস্কোতে খাবারদাবারের অভাব, পৃথিবীর সব কিছুই পাওয়া যায়, যেমন ইউরোপ আমেরিকার সুপার মার্কেট হয়, ট্রলি ভরতি করে যা খুশি নেওয়া যায়, দাম দিতে হবে শক্ত কারেন্সিতে। এখানকার খরিদ্দার কারা? শুধু বিদেশিদের দিয়ে তো আর সুপার মার্কেট চলে না! অর্থাৎ ডলারের চোরাকারবারের প্রতি এখন চোখ বুজে থাকা হচ্ছে। সাধারণ রাশিয়ানরা যদি কোনও উপায়ে ডলার জোগাড় করতে পারে ত কিনুক।
যারা হতভাগ্য, যাদের ডলার নেই, তারা খাদ্য-নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সন্ধানে সারা দিন ব্যস্ত। রাস্তার যে-কোনও মানুষকে যদি জিগ্যেস করা যায়, এই দেশটা ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, তা নিয়ে তুমি কী ভাবছ? সে বিরক্ত হয়ে উত্তর দেবে, ওসব ভাবার সময় নেই, আজকের জন্য রুটি-আলু-মাখন পাওয়া যাবে কি না সেটাই আমার প্রধান চিন্তা।
ভবিষ্যৎ বলতে আগামী শীত। ভয়াবহ শীত। অনেকেই বলাবলি করছে যে এবারের শীতে খাদ্যসংকট আরও বাড়বে এবং জ্বালানির অভাবে ঘর গরম করা যাবে না।
মস্কো শহরে ঘুরে বেড়ালে এখন চোখে পড়ে শুধু চিন্তিত ও নিরানন্দ মানুষের মুখ। আমার পূর্ব-পরিচিতরা অনেকেই শহরে নেই। যে যুবকটি আমার আগেরবারের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল, তার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না, সে ইউক্রাইনের লোক। ইউক্রাইন এখন সোভিয়েত সংঘে থাকতে চায় না। আগেরবার রাইটার্স ইউনিয়ানে আড্ডা দিতে গেছি কয়েকবার। এবার শোনা গেল, কট্টরপন্থীদের তিনদিনের অভ্যুত্থানের সময় কোনও কোনও লেখক তাড়াহুড়ো করে সেই অভ্যুত্থান সমর্থন করে ফেলেছিল। এখন তারা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে। অভ্যুত্থানের সমর্থকদের প্রতি এই মুহূর্তে জনরোষ প্রচণ্ড। লেখকদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেছে, তাই রাইটার্স ইউনিয়ন বন্ধ। প্রোগ্রেসিভ পাবলিশিং হাউজ, যেখান থেকে বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হত, আমাদেরও কিছু কিছু অনুবাদ বেরিয়েছে, সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। যারা অনুবাদকের চাকরি করত, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আবহাওয়া বেশ মনোরম, মস্কো শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগে। এখানকার প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান অবশ্যই রেড স্কোয়ার। সেখানে ভিড় তেমন নেই। লেলিনের মরদেহ দেখতে দর্শনার্থীদের লম্বা লাইন দেখেছি আগেরবার, এখন সে দিকটা ফাঁকা। এই দেহ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। লেনিনগ্রাড অর্থাৎ সেন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র আনাতোলি সোবচাক বলেছেন, লেনিনকে তো সরানো হচ্ছে না। লেনিনের ইচ্ছে ছিল, তাঁর জন্মস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হোক। এতকাল আমরা সেই ইচ্ছের মূল্য দিইনি। এবার তাঁকে রেড স্কোয়ার থেকে সরিয়ে এনে যথারীতি তাঁর জন্মস্থানে কবর দেওয়া
মস্কো শহরে স্টালিন বহুকাল নিশ্চিহ্ন, কিন্তু লেনিনের মূর্তি কেউ ভাঙেনি। বলটিক রাষ্ট্রগুলিতে লেনিনকেও সরিয়ে ফেলা হয়েছে শুনেছি, কিন্তু এখানে আমি দেখলাম, কার্ল মার্কসের একটা মূর্তির গায়ে অনেক হাবিজাবি লিখে রেখেছে কেউ, কিন্তু লেনিনের মূর্তিগুলি অবিকৃত। তবে সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে লেনিন সম্পর্কেও। বাক-স্বাধীনতা পাওয়ার পর এখন কেউই সমালোচনার উর্ধে নন। আমাদের দেশে অনেকে মহাত্মা গান্ধিকে কুৎসিত ভাষায় গালমন্দ করেছেন, তাঁর তুলনায় লেনিন নিশ্চয়ই দেবতা নন।
অনেকে বলছে যে, এই যে সাধারণ মানুষকে যখন তখন ধরপাকড় ও পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা, লেনিনই তো তার প্রবক্তা। কেউ কেউ আবার লেনিনকে বাঁচিয়ে এমন কথাও বলছেন যে একেবারে শেষের দিকে লেনিন তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন, এই ব্যবস্থা বদলাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন আর তাঁর ক্ষমতা ছিল না, স্টালিন কার্যত সমস্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে লেনিনকে প্রায় গৃহবন্দি করে রেখেছিল। এসব কথা আমি আগে কখনও শুনিনি। লেনিনের ব্যক্তিগত জীবন থেকেও অনেক কিছু খুঁড়ে বার করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা ধর্তব্যের বিষয় নয়।
রেড স্কোয়ারে এখন প্রধান দ্রষ্টব্য একটি লাল পতাকা। মস্কো থেকে লাল রং একেবারে মুছে গেছে বলা যায়। আমি আগেরবার এসেছিলাম মে-দিবসের ঠিক আগে, তখন সর্বত্র ছিল লালে লাল, সমস্ত ল্যাম্পপোস্টে লাল পতাকা, মোড়ে মোড়ে সংগ্রামী শ্রমিকদের বড় বড় লাল রঙের কাটআউট ছবি। বস্তুত অত লাল দেখে গা শিরশির করত। লাল রং রক্তের রং তা চক্ষের পক্ষে প্রীতিপ্রদ নয়। বড় বড় শিল্পীরা পারতপক্ষে লাল রং ব্যবহার করেন না। মিছিল-টিছিলে খুব বেশি লাল রং মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়।
এখন সব লাল যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। রাশিয়াতে ফিরে এসেছে তেরঙা ঝাণ্ডা, তারও ব্যবহার সর্বত্র নেই। পতাকার বাহুল্যই নেই। গোটা মস্কো শহরে এখন একটি মাত্র কাস্তে-হাতুড়ি মার্কা লাল পতাকা আমার চোখে পড়েছে ক্রেমলিনের একটি অংশে। সেখানে গরবাচেভ বসেন, সোভিয়েত ইউনিয়ানের রাষ্ট্রপতির দপ্তর। তার কাছেই আর এক জায়গায় উড়ছে তেরঙা পতাকা। সেটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়েলেৎসিনের এলাকা। ক্রেমলিনে এখন এই দুটি পতাকা উড়ছে। তবে গরবাচেভ-এর কক্ষের ওই সবেধন নীলমণি লাল পতাকাটিরও দিন ঘনিয়ে এসেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ান বলে আর কিছু থাকছে না, কয়েকটি রাজ্য মিলে যদি একটি আলাদা ধরনের জোট বেঁধে থাকতে রাজিও হয়, তার পতাকা কী হবে কে জানে! ওই লাল পতাকা টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা খুবই কম।